আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এক ভাগ্যবঞ্চিতা মিতুর কথা বলছি।

গেদু চাচার খোলা চিঠি। মাগুরার এক নিভৃত পল্লীর নাম কুল্লিয়া। এখানে সব বাড়িতে সুখ আর হাসি খেলা করে না। জৈবিক তাড়নার ফলাফলে যদি কোন শিশু অভাবের সংসারে জন্মায় তবে সেখানে হাসির থেকে চিন্তার বলিরেখায় আরেকটা ভাঁজ বেড়ে যায়। এমনই এক নিতান্ত দরিদ্র ভবতোশের সংসারে চলে আসে ফুটফুটে মিতু।

মিতুকে কিভাবে বর্ণনা দেয়া যায় তা আমার জানা নেই...কারণ দরিদ্র বাবার এই মেয়েটার মাথায় শ্যাম্পু আর সাবান নামক জিনিষের ছোঁয়া পেত খুব কম। মিতু বছরে একবারই হয়তবা লিলেনের কাপরের পোষাক পেত...সাথে হয়তবা খুব অল্প দামি প্রসাধণ। মিতুর দিদিমা বলতো, ‘ও ভবতোশ...দেক মা স্বরসতী আইছে’। ভবতোশ মনে মনে কষ্ট চেপে বাইরে মায়ের উপর কপট রাগ দেখায় বলত, ‘তুমার বউমাক দেকাউগা’। বৃদ্ধা রাগ না চেপে রেখে বলতেন, ‘এত অভাবের সংসারে জুয়ো খেলা কুলোয় তুমার...মিয়াক দেকলি রাগ লাগে?’ মিতু ছিলো এমনই কারো আদরের নীল কান্ত মণি...কারো চেপে রাখা কষ্টের মাঝেও একটু ভালো লাগা সন্তান।

সংসারের বড় সন্তান প্রতাপ অনেক কষ্টে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ালেখা টেনে এনেছে...নিতান্ত গরীবের ঘরে একজনের ইচ্ছাই এখানে যথেষ্ট কিছু। প্রতাপ এবার বায়না ধরে আদরের ছোট বোনকেও পড়ালেখা করাতে হবে...সুতরাং মিতুকেও স্কুলে যেতে হয়। বাবার ইচ্ছা কোন রকম নাম সই করতে পারলেই বিয়ে দিয়ে দেবেন। মিতু একে একে এক ক্লাস দুই ক্লাস করে ক্লাস সিক্সে উঠে পরে...মিতু শরীরে লেগে যায় বয়ঃসন্ধীর হাওয়া। মিতু চোখে পরে যায় কুল্লিয়া গ্রামেরই আরেক টাকাওয়ালার ছেলে মৃত্যুঞ্জয়ের চোখে।

মৃত্যুঞ্জয় বাবার একমাত্র ছেলে...তার জিদ অন্যরকম। সে মিতুকে নানাভাবে পেতে চায়। চাওয়াপাওয়ার এই ব্যাপারটা মিতুকে প্রথম স্বর্শ করে। সে কি বলবে ভেবে পায়না...কি করবে তাও জানেনা। এভাবে এক সময় মৃত্যুঞ্জয় মিতুর বাড়ির আঙ্গিনায় প্রবেশাধীকার পায়।

মৃত্যুঞ্জয়ের বাবার বড় শখ ছেলেকে তিনি বিবিএ পড়াবেন। তাই অনেকের কাছেই খোঁজ খবর নেন...কোথায় পড়ালে ভাল হয়...কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালে কি খরচ। ছেলেকে এরকম স্বপ্ন দেখার মাঝে তিনি হোচট খেলেন যখন ছেলে তাকে তার বিয়ের কথা বলল। মেয়ে যদি কোন বংশীয় ঘরের হোত তবে তিনি একটা ব্যবস্থ্যা করে রাখতেন...কিন্তু মিতুর বাবা একজন ছা-পোষা জেলে। তিনি মুখের উপরে বলে দিলেন...এ বিয়ে তিনি এবং মৃত্যুঞ্জয়ের মা কেউই মানবেন না।

ছেলের জেদের প্রতিউত্তর...সে মিতুকে বিয়ে করে ঘরে তুলে আনবেই। আজকে মৃত্যুঞ্জয়ের বাড়িতে ভয়ংকর অবস্থ্যা। ছেলে আজ মিতুকে বিয়ে করে ঘরে তুলে এনেছে... গৃহকর্তা বাড়ির বাইরে...ফিরে এসে দেখলে কি কান্ড ঘটবে এই ভাবতেই শিউড়ে উঠছেন মৃত্যুঞ্জয়ের মা। গৃহকর্তা বাড়ি ফিরে সব শুনে ডাক দেন ছেলেকে...উঠোনের মাঝে ছেলে আর বাবার তীব্র বাক বিতন্ডা লেগে যায়...এক পর্যায় বাবা ছেলের গায়ে হাত তুলেন। ছোট্ট মিতু...ভয়ে ভয়ে সব দেখে জানালা দিয়ে...সে বুঝতে পারে না কেন এমনটা করছে সবাই...সে জানেনা কি তার দোষ।

বিয়ের প্রথম রাত এভাবেই কেটে যায়। মৃত্যুঞ্জয়ের মা ব্লাউজ পরবেন না (এটাকে সনাতন হিন্দু রীতিতে কি বলে আমি জানিনা...তবে অনেকেই এটা করে থাকেন)। ছেলের সাথেও কথা হয়না...মিতুর সাথে তো নাইই। মিতু বুঝে উঠতে পারে না কি করবে...সব সময় সবার মুখ ভার... মৃত্যঞ্জয়ের মা কিছুক্ষণ পর পরই ডুকরে ডুকরে কাঁদেন যে তার ছেলের এই সর্বনাশ কে করলো। মিতুর ভাল লাগে না।

এই অল্প কদিনেই মিতুর বয়স অনেক বেড়ে যায়। কোন এক রাতে মৃত্যুঞ্জয়ে সবার উপরে রাগে আগুন হয়ে মিতুকে বেদম প্রহার করে...মিতু হতে পারে তিন বেলাতে এক বেলা ভালো করে খাবার খাওয়া বাড়ির মেয়ে তবুও মিতুর গায়ে হাত ওঠেনি...সোজা কথায় বলতে গেলে কেউ সাহস করেনি। মিতুর মনে রাগ...দুঃখ...অভিমান সব দলা পাকিয়ে যায়...কাঁন্না যেখানে কোন সমাধান নয়। এভাবেই কেটে যায় বেশ কিছু দিন। কোন এক রাতে মৃত্যুঞ্জয় যাত্রা দেখতে বের হয়ে যায়...সাঁঝ পার হয়ে তখন প্রায় মাঝরাত ছুই ছুই... মৃত্যুঞ্জয়ের মা চিৎকার দিয়ে উঠে... ‘ওরে সর্বনাশ করিছে...মিতু গলায় দড়ি নেছে’।

ছোট্ট মিতু কি আসলেই আত্মহত্যা করেছিলো নাকি এটা একটা নিছক খুনকে অন্য কিছুর সাথ চালিয়ে দেয়া হয়েছিলো তা আজো জানা যায়নি। মিতুর গরীব বাবা চেয়েছিলেন মেয়ের এই অকালপ্রয়ানের বিচার তিনি দেখবেন...চেষ্টাও করেছিলেন... কিন্তু এদেশে ক্ষমতার দৌড় বাবা-মায়ের কাঁন্না কি জিনিষ জানেনা...তাই গরীবের প্রতিবাদ ফাটা বাঁশিতে সুর তোলার মতই অল্প সুরে থেমে গেছে। শুধু মিতু চলে গেছে না ফেরার দেশে...মিতুর মায়ের কাঁন্না হয়ত এখনো গোপনে রান্না ঘরের পরিবেশ ভারী করে তোলে...দিদিমার ছানি পরা চোখে অঝোরে পানি এনে দেয়...উপরে উপরে পাষাণ সাজা ভবতোশের বুকে কিসের যেন একটা শুন্যতা এনে দেয়। মিতুর এই অকাল প্রয়ানের বিচার এদেশে হয়না...মিতুরা সেই কপাল নিয়ে আসেনি। পুনশ্চঃ মৃত্যুঞ্জয়ের মা ইদানিং যাকে দেখছেন তাকেই বলছেন ছেলের এবার ধুমধাম কর বিয়ে দেবেন...আর হ্যাঁ তিনি আবার ব্লাউজ পরা শুরু করেছেন।

এত ব্যাক্তির কথার মাঝে একজনের কথা কিন্তু বলা হয়নি...মিতুর হতভাগ্য দাদা প্রতাপ উচ্চ মাধ্যমিকে পাশ করতে পারেনি আদরের ছোট বোনের অকাল মৃত্যকে দেখে..সে এক সময় বোন হারানোর শোক কে ভুলতে না পেরে ভারতে চলে গেছে। এটা একটা সত্য ঘটনা...যেখানে কোন কিছুকেই রুপকের আড়ালে জড়ানোর সাহস করা হয়নি। আমরা মিতুর আত্মার স্বর্গবাসের জন্যে প্রার্থনা করি। এক ভাগ্যবঞ্চিতা মিতুর কথা বলছি। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।