আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলার গৌরব ও ঐতিহ্য (৪র্থকিস্তিঃদিনাজপুর রাজবাড়ী,কান্তজীউ মন্দির,রামসাগর,সীতাকোট বিহার)

তোমার আমার ঠিকানা,পদ্মা-মেঘনা-যমুনা দিনাজপুর রাজবাড়ি দিনাজপুর শহরের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত ধ্বংসপ্রাপ্ত নিদর্শন মাত্র। প্রধান ফটক দ্বিতীয় ফটক ভেতরের ফটক দূর্গা মন্দির রাণী মহল রাণীর গোসলের জন্য নির্ধারিত পুকুর রাণীর কাপড় পরিধানের রুম প্রাসাদের ভিতরে মন্দিরের গেইট আদিতে প্রতিরক্ষা পরিখা ও উচুঁ প্রাচীর বেষ্টিত দিনাজপুর রাজবাড়ির বর্তমান পরিত্যক্ত ধ্বংসস্তুপে প্রবেশের জন্য পশ্চিম দিকে একটি উচুঁ খিলানপথ রয়েছে। প্রবেশ পথের বাম দিকে মূল প্রাসাদ এলাকার মধ্যে খোলা জায়গায় রয়েছে একটি কৃষ্ণ মন্দির। ডানদিকে রয়েছে প্রাসাদের বহির্বাটির কিছু ধ্বংসাবশেষ ও অপর একটি প্রবেশ পথ। বর্গাকার চত্বরটির পূর্বপার্শ্বে রয়েছে চত্বরমূখী সমতল ছাদ বিশিষ্ট একটি মন্দির।

চারটি সেমি-কোরিনাথিয়ান স্তম্ভের উপর মন্দিরের সামনের বারান্দা এবং অপর এক সেট কলামের উপর মূল হল ঘরটির ছাদ ন্যস্ত। এ সকল দালান-কোঠা এবং পূর্ব ও দক্ষিণের দুটি বৃহৎ দিঘি, পরিখা, বাগান, একটি বিলুপ্ত চিড়িয়াখানা, একটি টেনিস কোর্ট, কাচারি ও কুমার হাউসসহ রাজবাড়িটি প্রায় ১৬.৪১ একর এলাকা নিয়ে বিস্তৃত। মূল মহল ও এর সংলগ্ন পরিখা সম্ভবতঃ অষ্টাদশ শতাব্দীতে মহারাজা প্রাণনাথ ও তাঁর পোষ্যপুত্র রামনাথ নির্মাণ করেছিলেন। প্রাসাদটি নির্মিত হয়েছিল ইউরোপীয়, মুসলিম ও হিন্দু রীতির এক অদ্ভুত সংমিশ্রণে, যা খুব একটি দৃষ্টিনন্দন হয়নি। রামডাঙ্গা নামক দুটি সমান্তরাল পরিখা প্রাসাদটি ঘিরে ছিল।

পরিখাটি সম্ভবত আলীবর্দী খানের শাসনামলে রংপুরের ফৌজদার সৈয়দ আহমেদ খানের আক্রমণের পরই রামনাথ খনন করেছিলেন। আয়না মহল নামে পরিচিত পূর্বমুখী দ্বিতল মূল প্রাসাদটির অধিকাংশই এখন ধসে পড়েছে। এ ধ্বংসাবশেষে অথবা টিকে থাকা সামান্য কিছু নিদর্শনের মাঝে বা চুর্ণ-বিচুর্ণ পাথরের কোথাও এর পূর্বের কাচের মোজাইক চোখে পড়ে না। পূর্বদিকের ৪৫.৭২ মিটার প্রাসাদে ৩.০৫ মিটার প্রশস্ত একটি বারান্দ রয়েছে। ব্যালকনির উভয় পার্শ্বে দুটি প্রশস্ত প্যাঁচানো সিড়ি দোতালায় উঠে গেছে।

সম্মখভাগের বারান্দাটির নিচে রয়েছে গ্রিক আয়োনিক রীতির স্তম্ভের সারি। জোডায় জোড়ায় স্থাপিত স্তম্ভগুলিতে আবার রয়েছে গোলাকৃতির ব্যান্ড। একটি মাত্র আয়তাকার প্যানেল ব্যতীত উপরের প্যারাপেটটি সমতল। প্যারাপেট থেকে সামান্য উচু আয়তাকার প্যানেলটিতে রয়েছে রাজকীয় চিহ্নের মাঝে রিলিফ করা মুখোমুখি দুটি হাতি ও মুকুটের নকসা। মহলটির মেঝে সাদা-কালো মার্বেল পাথর দ্বারা এবং ছাদ, বিশেষ করে দরবার হল, জলসা হল, তোষাখানা ও পাঠাগার, স্টাকো পদ্ধতিতে চকচকে করা হয়েছে।

চেহেলগাজী মাজার ও মসজিদ দিনাজপুর শহর থেকে সাত কিলোমিটার উত্তরে দিনাজপুর-রংপুর সড়কের পশ্চিম পাশে অবস্থিত এ অঞ্চলের এক সময়ের সাধু পুরুষ চেহেলগাজীর মাজার ও মসজিদ । দিনাজপুর জাদুঘরে সংরক্ষিত এ মসজিদের একটি শিলালিপি থেকে জানা যায় সুলতান রুকনুদ্দীন বারবক শাহ এর রাজত্বকালে তার উজির ইকরাব খানের নির্দেশে দিনাজপুর পরগনার শাসনকর্তা উলুঘ নুসরত খান এ মসজিদটি ৮৬৫ হিজরি তথা ১৪৬০ খ্রিস্টাব্দে এটি নির্মাণ করেন। চার পাশের দেয়াল ছাড়া বর্তমানে মসজিদটির সবকিছুই ধ্বংস হয়ে গেছে। আর মসজিদের আরেকটি শিলালিপি থেকে জানা যায় ১৪৬০ খ্রিস্টাব্দে চেহেলগাজী মসজিদ নির্মাণের সময় মাজারটি সংস্কার করা হয়। জনশ্রুতি আছে ৪০জন গাজীকে (ধর্মযোদ্ধা) এখানে একত্রে সমাহিত করা হয়েছিল।

এ জন্য এ স্থানের নাম চেহেল (চল্লিশ) গাজী। দিনাজপুর শহর থেকে বাসে কিংবা রিকশায় আসতে পারেন এখানে। কান্তজিউ মন্দির দিনাজপুর শহর থেকে ২১ কিলোমিটার দূরে কাহারোল থানার কান্তনগর গ্রামে অবস্থিত কান্তজিউ মন্দির। অনেকের মতে কান্তনগরে স্থাপিত বলে-এর নাম কান্তজিউ মন্দির। জনশ্রুতি আছে, শ্রী-কৃষ্ণের বিগ্রহ অধিষ্ঠানের জন্য এ মন্দির নির্মিত হয়েছিল।

দিনাজপুরের তৎকালীন জমিদার প্রাণনাথ রায় ১৭২২ খ্রিস্টাব্দে পোড়ামাটির অলঙ্করণ সমৃদ্ধ এ মন্দিরটির নির্মাণ কাজ শুরু করেন। তবে তার জীবদ্দশায় এ মন্দিরের নির্মাণ কাজ শেষ করে যেতে পারেন নি। পরে ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দে তারই পালক পুত্র রাম নাথ রায় মন্দিরের নির্মাণ কাজ শেষ করেন। এর পরে তিনি এ মন্দিরটি শ্রী কৃষ্ণের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন। স্থাপত্যিক রীতি, গঠন বিন্যাস, শিল্পচাতুর্য মন্দিরটির সামগ্রিক দৃশ্যকে এতই মাধুর্যমণ্ডিত করে তুলেছে যে এর চেয়ে সুন্দর, নয়নাভিরাম মন্দির বাংলাদেশে দ্বিতীয়টি নেই।

শৈল্পিক বিশ্লেষণে প্রায় ৩ ফুট উঁচু এবং ৬০ ফুট বাহু বিশিষ্ট প্রচ্চর নির্মিত বর্গাকৃতি সমান্তরাল জায়গার উপর এই মন্দির দণ্ডায়মান। সৌধ পরিকল্পনায় মন্দিরটি তিন ধাপে নির্মিত। সামগ্রিক দৃষ্টিতে মন্দিরটি দেখতে সুবৃহৎ রথের মতো। তিনতলা বিশিষ্ট এবং বর্গাকারে নির্মিত মন্দিরের প্রত্যেক বাহুর দৈর্ঘ্য ৫২ ফুট এবং উচ্চতা ৭০ ফুট। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে কিছু অংশ ভেঙে যাওয়ায় উপরের গম্বুজ ঘরের আকৃতি ধারণ করেছে।

ভূমিকম্পে ভেঙে যাওয়ার আগে গম্বুজের উপরে ৯টি সুদৃশ্য চুড়া ছিল। বারান্দার সামনে রয়েছে ইটের তৈরি দুটি করে চ্চম্ভ। এই চ্চম্ভের সাহায্যে দেয়ালের সঙ্গে প্রত্যেক পাশে সংযুক্ত রয়েছে তিনটি করে খোলা দরজা। দ্বিতীয় তলার দক্ষিণ পাশের দরজা দু’টি বেশি লক্ষ্য করা যায়। এই দরজার পরে, ভেতরে মূল কামরা, সেখানে আছে মোট ১৮টি কক্ষ।

বড় কামরাগুলোর চারিদিকে আছে ছোট কামরা। মন্দিরের বেদির নিচে এবং দেয়ালের গায়ে পোড়ামাটি খচিত প্রায় লক্ষাধিক ছবি রয়েছে। পৌরণিক চিত্র সংবলিত টেরাকোটা ছাড়াও মন্দিরের দেয়ালের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন মূর্তির টেরাকোটাও রয়েছে। এসব টেরাকোটার মধ্যে নারী-পুরুষ, দেবতা ও কিন্নর, গায়ক ও বাদক, যোদ্ধা ও শিকারী, গৃহিনী, নৌকার মাঝি, নৃত্যরতা রমণী, পালকি বাহক, গাছ-পালা, ফল ও ফুল, লতা-পাতা ইত্যাদির ছবি মূর্তমান। কান্তজিউ মন্দিরের পাশেই রয়েছে প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত এক চূড়া বিশিষ্ট একটি মন্দির এটিও নির্মাণ করেন মহারাজা প্রাণনাথ।

রাজা প্রাননাথ এই মন্দির নির্মাণ করে এখানে কৃষ্ণের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। এই মূর্তি তিনি এনেছিলেন বৃন্দাবন থেকে। এ মন্দিরটি ছিল ১৬ পার্শ্ব সংবলিত সৌধ এবং ৪০ ফুট উচ্চতায়। কান্তজিউ মন্দিরের ঐতিহ্য অনুযায়ী প্রতি বছর রাস পূর্ণিমায় এখানে বসে পক্ষকালব্যাপী মেলা। দিনাজপুর কেন্দ্রীয় বাস স্টেশন থেকে পীরগঞ্জের বাসে কান্তনগর নামতে হবে।

ভাড়া জনপ্রতি ২০-২৫ টাকা। সেখানে নেমে ঢেপা নদী পার হয়ে একটু সামনেই মন্দিরটি। শীতের সময় নদী পায়ে হেঁটে পার হতে পারলেও এই বর্ষায় কিন্তু নৌকায় পার হতে হবে। নয়াবাদ মসজিদ কান্তজিউ মন্দির থেকে মাইলখানেক দূরে রয়েছে ঐতিহাসিক নয়াবাদ মসজিদ। তিন গম্বুজ বিশিষ্ট এ মসজিদটিও কান্তজি’র সমসাময়িক মসজিদ।

এ মসজিদটিতে তিনটি প্রবেশপথ এবং একটি মিহরাব রয়েছে। মসজিদের বাইরে চারপাশ সামান্য উঁচু দেয়ালে ঘেরা এবং দেয়ালের ভেতরের খোলা জায়গা পাকা করা, কান্তজিউ থেকে নয়াবাদ মসজিদ যেতে পারেন রিকশা কিংবা ভ্যানে চড়ে। রামসাগর দিনাজপুর শহর থেকে আট কিলোমিটার দক্ষিণে আউলিয়াপুর ইউনিয়নে অবস্থিত রামসাগর দীঘি। প্রজাদের সেচ সুবিধা ও জলকস্ট দূরীকরণের লক্ষ্যে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচীর মাধ্যমে রাজা রামনাথ এ দীঘি খনন করেন। চারপাশের চত্ত্বরসহ এ দীঘির মোট আয়তন প্রায় ৪৩৭৪৯২ বর্গমিটার।

মূল দীঘি অর্থাত জলভাগের দৈর্ঘ্য ১০৩১ মিটার আর প্রস্থ ৩৬৪ মিটার। দীঘির চারপাশে মনোরম বাগান বেস্টিত। শহর থেকে বিকশায় যেতে সময় লাগে প্রায় এক ঘন্টা। ঘোড়াঘাট দূর্গ ভগ্নাবশেষ ঘোড়াঘাট দূর্গের মসজিদ ঘোড়াঘাট দূর্গের মসজিদ দিনাজপুর জেলার দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে করতোয়া নদীর ডান তীরে অবস্থিত। দুর্গ এলাকার অভ্যন্তরে অনেকগুলি ধর্মীয় ও ঐতিহ্যিক ইমারত নির্মিত হয়েছিল।

সেগুলির মধ্যে কেবল ধ্বংসোন্মুখ অবস্থায় মসজিদটি এবং ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কয়েকটি ঢিবি টিকে আছে। শিলালিপি অনুসারে সরকার ঘোড়াঘাটের জনৈক মুগল ফৌজদার জয়নাল আবেদীন ১৭৪০-৪১ সালে মসজিদটি নির্মাণ করেন। মসজিদটির বর্তমান অবস্থা এমন যে, এর তিনটি গম্বুজই ভেঙ্গে পড়েছে, পার্শ্ব বুরুজগুলি খুবই ক্ষতিগ্রস্ত, পশ্চিম দেওয়ালও ভেঙ্গে পড়েছে, আর বাকি অংশে ছোট ছোট গাছপালা জন্মেছে। মসজিদের অভ্যন্তরভাগ বর্তমানে ধ্বংসস্তুপে পরিপূর্ণ। এর সামনে ছিল একটি বাঁধানো অঙ্গন, বর্তমানে সেটি জঙ্গলে ছেয়ে গেছে।

অঙ্গনের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব কোণে বিশালাকৃতির দুটি ফাঁপা অষ্টকোণাকার বুরুজ ছিল, যার ভিত্তি এখনো টিকে আছে। এ বাঁধানো অঙ্গনের দক্ষিণে একটু দূরে রয়েছে বড় একটি পাথরের কূপ, যা সম্ভবত নির্মিত হয়েছিল ওযুর উদ্দেশ্যে। ইমারতের অভ্যন্তরে প্রবেশের জন্য ছিল পূর্ব দেওয়ালে তিনটি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দেওয়ালে একটি করে চতুর্কেন্দ্রিক খিলানযুক্ত প্রবেশপথ। বাইরের দিক বহুখাঁজ বিশিষ্ট খিলান শোভিত পূর্ব দেওয়ালের মধ্যবর্তী প্রবেশপথটি দেওয়াল থেকে সামনের দিকে একটি আয়তাকার প্রক্ষিপ্ত অংশে অবস্থিত। উত্তর ও দক্ষিণের প্রবেশ পথদ্বয়েও অনুরূপ প্রক্ষাপণ রয়েছে।

পূর্ব দেওয়ালের এ তিনটি প্রবেশপথের সমান্তরালে পশ্চিম দেওয়ালে নিশ্চয়ই তিনটি মিহরাব ছিল, বর্তমানে যা চাপা পড়ে আছে ধ্বংসস্ত্তপের নিচে। চারকোণের অষ্টাভুজাকৃতির পার্শ্ব বুরুজগুলি বর্তমানে অনুভুমিক কার্নিস পর্যন্ত উচুঁ। তবে প্রকৃতপক্ষে এগুলি সম্ভবত ছাদের উপরে প্রলম্বিত ছিল এবং এর শীর্ষে ছিল নিরেট ছত্রী ও ক্ষুদ্রাকৃতির গম্বুজ(cupola)। ইমারতটির পাশেই এদের ভগ্নাংশ পড়ে রয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন স্থানে ভেঙ্গে যাওয়া এ বুরুজগুলির ভিত্তিতে ছিল দৃষ্টিনন্দন ’কলস’ মোটিফ।

মসজিদের তিনটি বে’র উপর ছিল তিনটি গম্বুজ, প্রশস্ত এবং নিরেট খিলান গম্বুজগুলির ভার বহন করত। পূর্ব দেওয়ালে এবং দুপাশের দেওয়ালে খিলানের চিহ্ন এখনও স্পষ্টভাবেই দেখা যায়। পূর্ব দেওয়ালের বাইরের অংশে অনেকগুলি অগভীর খোপ নকশা (panel) রয়েছে, বর্তমানে গাছপালা জন্মে সেগুলি ভরাট হয়ে গেছে। এগুলিই বর্তমানে এ পুরো ইমারতের গায়ে টিকে থাকা একমাত্র অলংকরণের নিদর্শন। সূরা মসজিদ ১৯৮০’র দশকের শেষ দিকে দুর্গের অভ্যন্তরে একটি ঢিবি খনন করতে গিয়ে আরেকটি মসজিদ আবিস্কৃত হয়েছে।

উপরিউক্ত মসজিদটি থেকে প্রায় ২০০ গজ পশ্চিমে দুর্গের পশ্চিমদিকের বেষ্টনী প্রাচীর ঘেঁসে এর অবস্থান। উৎখননে মসজিদটি অংশিক উন্মোচিত হয়েছে। সীতাকোট বিহার রামায়নের কাহিনী কম বেশি সকলেরই জানা, লঙ্কাদ্বীপ থেকে সীতাকে উদ্ধার করে আনার পর তাকে নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠে। বাধ্য হয়ে রাম সীতাকে আবারও বনবাসে পাঠালেন। সীতার দ্বিতীয় বার বনবাসের সময়ে তিনি নাকি বাল্মিকী মুনির আশ্রয়ে এক সুন্দর ইমারতে বাস করতেন।

সে জন্য এ স্থানের নাম রাখা হয় সীতাকোট। অর্থাৎ সীতার দুর্গ। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যে ক’টি বৌদ্ধ বিহার মাটি খুঁড়ে বের করা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে সীতাকোট বিহারকে সবচেয়ে প্রাচীন বলা যেতে পারে। যে কোন অবসরে অথবা ছুটির দিনে সপরিবারে অথবা বন্ধু–বান্ধব নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন। দিনাজপুর জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলায় এটি অবস্থিত।

নবাবগঞ্জ সদর থেকে ২ দশমিক ৫ কিলোমিটার পশ্চিমে ফতেপুর মাড়াষ মৌজায় প্রায় এক একর আয়তনবিশিষ্ট ভূমির উপর সীতাকোট বিহার অবস্থিত। এটি প্রায় বর্গাকৃতির। বিহার অঙ্গনটি চুন-সুড়কি দিয়ে পাকা করা ছিল। পূর্ব বাহুর উত্তরাংশে পেছনের দেয়াল ভেদ করে একটি সম্পূরক প্রবেশ পথ ছিল। মূল বিহারের প্রবেশ পথটি ছিল উন্মুক্ত যায়গা দিয়ে মূল প্রবেশ কক্ষের দিকে।

প্রবেশ কক্ষটি ছিল বিহার কক্ষের সারিতে একই রেখায়। দক্ষিণ বাহুর বহির্মূখী অভিক্ষেপটি ছিল একটি হল ঘরেরর মতো এবং সেই হল ঘরে ঢুকতে হতো ভেতর দিক দিয়ে। কক্ষে প্রবেশের পথ ৩ থেকে ৫ ফুট প্রশস্ত। মূল প্রবেশ পথ উত্তর দিকে। প্রত্যেক কক্ষে প্রবেশের জন্য একটি মাত্র প্রবেশ পথ রয়েছে।

বিহারে প্রবেশ করে যা যা দেখবেনঃ পরীখাঃ এই বিহারের চারদিকে পরীখা ছিল। এ পরীখাগুলো তৈরি করা হয়েছিল নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার জন্য। এগুলো ছিল বাইরের দেয়াল থেকে ১৫০ গজ দূরে। তবে এখন আর পরীখাগুলোর কোন চিহ্ন আপনি খুঁজে পাবেন না। প্রাচীরঃ সীতাকোট বিহারের চারদিকে বেষ্টনী প্রাচীর ছিল।

এটি ৮ দশমিক ৫ ফুট উঁচু ছিল, এতকাল পরও কোন কোন যায়গায় ৪-৮ ফুট উচ্চতা টিকে আছে। বিহারটিকে শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য প্রহরীরা সব সময় ব্যস্ত থাকত। তাদের সংখ্যা কত ছিল তা জানতে না পারলেও ৬টি প্রহরী কক্ষ দেখে অপনি অনুমান করতে পারবেন এর নিরাপত্তার ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ কতটা সচেতন ছিল? তোরণঃ প্রশস্ত মুখপাত বিশিষ্ট তোরণ কমপ্লেক্সটি উত্তর বাহুর মধ্যাংশে অবস্থিত। প্রধান দরজাঃ এবিহারটি ছিল দুর্গের আকারে তৈরি। এর উত্তর ব্লকের ঠিক মাঝখানে ছিল বিহারে ঢোকার প্রধান দরজা।

এটি ছিল প্রায় ৬ ফুট চওড়া। কেন্দ্রীয় কক্ষঃ বিহারটিতে ৩টি কেন্দ্রীয় কক্ষ ছিল। এর পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ বাহুর কেন্দ্রীয় কক্ষত্রয় অন্যান্য কক্ষগুলোর তুলনায় আয়তনে অনেক বড় ছিল। প্রতিটি কেন্দ্রীয় কক্ষে একটি করে ইটের বেদী ছিল সেগুলোতে পুজার মূর্তি রাখা হতো। কক্ষঃ এ বিহারটিতে মোট কক্ষ ছিল ৪১ টি।

এর উত্তর বাহুতে ৮টি এবং অন্য তিন বাহুতে ১১টি করে ৩৩টি কক্ষ ছিল। কক্ষগুলো ছিল প্রায় সম-আয়তনের। এগুলোর আয়তন ৩.৬৬ মিটার*ত.৩৫ মিটার। কক্ষগুলো দেয়াল দ্বারা বিভক্ত ছিল। বিভাজক দেয়ালের পুরত্ব ছিল ০.৯১ মিটার থেকে ১.২২ মিটার এবং পেছনের দেয়ালের পুরুত্ব ছিল ২.৫৯ মিটার, কিন্তু সম্মুখ দেয়ালের পুরত্ব ছিল ১.০৭ মিটার।

পেছনের দেয়ালগুলোকে অবলম্বন করে বিহারের কামরাগুলো তৈরি করা হয়েছিল। কামরাগুলোর মাঝের দেয়ালগুলো এক মাপের নয়। কোনটি প্রায় ১০ ফুট পুরু আবার কোন কোনটি ৪ থেকে ৫ ফুট পুরু। বিহারের কক্ষগুলোর অধিবাসীদের স্বাস্থের দিকে নজর রেখে কক্ষের ভেতর বাতাস চলাচলের জন্য ভেন্টিলেটার রাখার ব্যবস্থা করা হয়। এখানে অধ্যয়নরত ছাত্রদের শোয়ার জন্য খাট ও বই পুস্তক রাখার জন্য বইয়ের তাক ছিল।

তবে এগুলোর কোনটিই এখন আর আপনি খুঁজে পাবেন না, কল্পনায় দেখে নিতে হবে। বারান্দাঃ বিহারের ভেতর দিকে ২.৫৯ মিটার প্রশস্ত একটি টানা বারান্দা ছিল। ১.০৭ মিটার প্রশস্ত ও ১.৬৮ মিটার লম্বা দরজার মাধ্যমে কক্ষগুলো ভেতরের টানা বারান্দার সাথে যুক্ত ছিল। সমগ্র বারান্দাকে আঙ্গিনা থেকে আড়াল করে রাখতো ১.২২ মিটার পুরু ও ০.৭৬ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট একটি দেয়াল। কামরাগুলোর সামনে ছিল ৮ ফুট চওড়া টানা বারান্দা।

বারান্দার উপর কোন ছাদ ছিল না। বারান্দার শেষ সীমায় ছিল ৪ ফুট পুরু ও ৩ ফুট উঁচু দেয়াল। কুলঙ্গিঃ কক্ষগুলোর পেছনের দেয়ালে কুলঙ্গি ছিল। কক্ষগুলোর মাঝে দেয়াল দিয়ে পার্টিশন তৈরি করা হয়েছিল। বিভাজক দেয়ালের পুরত্ব ছিল ২.৫৯ মিটার কিন্তু সম্মুখ দেয়ালের পুরত্ব ছিল ১.০৭ মিটার।

খাবার পানির চাহিদা পূরণের জন্য বিহারের ভেতরে দক্ষিণ পুর্বদিকে একটি কুপ ছিল। এটি শ্বেত কুয়া নামে পরিচিত। বর্তমানে এটি ভরাট হয়ে গেছে। বিহার খননের সময় এখানে প্রচুর পরিমান হাঁড়ি পাতিলের টুকরা পাওয়া যায়। দীঘিঃ বিহারে বসবাসরত লোকদের গোসল ও পানির সুবিধার জন্য একটি দীঘি খনন করা হয়েছিল তবে এটি বিহারের খুব নিকটে ছিল না।

বিহার থেকে ৫০০ গজ দূরে দিঘিটি দেখতে পাবেন। খাবারঘরঃ বিহারে সুনির্দিষ্টভাবে রান্না ঘর ও খাবার ঘর পাওয়া যায়নি। তবে পূর্ব ব্লকের বাইরের উঁচু যায়গায় হয়তো খাবার ঘর আর আর রান্না ঘর ছিল বলে অনুমান করা যায়। সেখান থেকে প্রচুর ছাঁই এবং হাঁড়ি –পাতিলের ভাঙ্গা টুকরা পাওয়া গেছে। শৌচাগারঃ মূল ভবনের সাথে সম্পৃক্ত কিন্তু বিহার ভবনের দক্ষিণ দিকে আবৃত পথ দ্বারা সংযুক্ত সম্মুখভাগে ৫টি কক্ষ পাওয়া যায়।

এগুলোর সামনে ছোট বারান্দা ছিল। বিশেষজ্ঞদের ধারণা এটি শৌচাগার হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এখানে কোন কেন্দ্রিয় মন্দিরের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। পূর্ব দক্ষিণ ও পশ্চিম ব্লকে ও ৩ টি কামরা মন্দির রুপে ব্যবহার করা হতো বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে দক্ষিণ ব্লকের কামরাটি ছিল বেশ বড়।

কেউ কেউ একে প্রধান মন্দির হিসেবেও মনে করেন। প্রধান মন্দিরঃ খুব সম্ভবত দক্ষিন দিকের কেন্দ্রীয় কক্ষটি ছিল প্রধান মন্দির। এ মন্দিরের সামনের প্যাভেলিয়নটি মন্ডপ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বড় উপাসনা কক্ষটির সামনে ছিল একটি মঞ্চ যার ছাদ নির্মিত হয়েছিল বারোটি স্তম্ভের উপর। মূল মন্দির ছিল দক্ষিণ দিকের সামনে।

প্রাপ্ত দ্রব্যসামগ্রীঃ খনন করার পর এখানে একটি ”বোধিসত্ব পদ্মপানি” এবং ”বোধিসত্ত মঞ্জুশ্রী” মুর্তি সীতাকোট বিহার থেকে প্রাপ্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রত্ননিদর্শন। এগুলো ব্রোঞ্জনির্মিত। এগুলো ৭ম-৮ম শতকে তৈরি বলে অনুমান করা হচ্ছে। এছাড়া এখানে পাওয়া গেছে মাটির পাত্রের ভাঙ্গা অংশ, মাটির দোয়াত, লোহার পেরেক নকশা করা মাটির তৈরি মাছ, মাটির পুতুল, নকশা করা ইট, ও লোহার রিং ও রড পাওয়া গেছে। এছাড়া পাওয়া গেছে লোহার খিল, নানা ধরণের দোয়াত।

এখানে কোন তাম্প্রলিপি বা শীলালিপি পাওয়া যায়নি। এটি ১৯৭২-৭৩ সালে প্রত্নতত্ত বিভাগের অধীনে খনন করা হয়। লোহার চুরি, বাঘের মুর্তিসহ এখানে পাওয়া যায় পশুর পায়ের চিহ্ন আঁকা ৩টি ইট, টেরাকোটার ৪টি গোলক, সাধারণ ৫টি ইট, লোহার তৈরি বালা, দন্ডচিহ্নিত আটটি ইট, পদ্মফুল আঁকা আঠারোটি ইট, ছত্রিশটি লোহার পেরেক। দিনাজপুর মিউজিয়ামে সীতাকোট বিহার থেকে প্রাপ্ত সামগ্রীগুলো রাখা হয়। কড়াই বিল দিনাজপুর শহর হতে পশ্চিমে ১৫ কিমি দূরে বিরল উপজেলায় কড়াই বিলের অবস্থান।

শীতকালে এখানে সাইবেরিয়া অঞ্চল হতে প্রচুর পাখির আগমন ঘটে। সিংড়া ফরেস্ট বীরগঞ্জ উপজেলার দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁও মহাসড়কের পূর্বে সিংড়া ফরেস্ট অবস্থিত। এই বনভূমিতে প্রচুর শালগাছ দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়া ইদানিং বন বিভাগের লাগানো ইউক্যালিপ্টাস ও আকাশমনি গাছ বনকে করেছে আরো সমৃদ্ধ। বনের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট একটি নদী দর্শনার্থীদের মন ভরিয়ে দেয়।

হিলি স্থলবন্দর দিনাজপুর জেলার হাকিমপুর উপজেলায় হিলি স্থলবন্দর অবস্থিত। এটি দিনাজপুর জেলা শহর থেকে ৬০ কি: মি: দক্ষিনে জেলা সীমানায় অবস্থিত। হিলি স্থলবন্দরের বাংলাদেশ অংশে রয়েছে দিনাজপুর জেলার হাকিমপুর উপজেলা এবং ভারত অংশে রয়েছে দক্ষিন দিনাজপুর জেলার বালুরঘাট। বন্দরের আমদানী ও রফতানী হয় সড়ক পথে। যেভাবে যেতে হবে প্রথমেই আপনাকে যেতে হবে দিনাজপুর।

বাস ও ট্রেন দুই ভাবেই যাওয়া যায়। ঢাকা থেকে দিনাজপুরের দূরত্ব সড়কপথে ৪১৪ কিলোমিটার এবং রেলপথে ৪৮৩ কিলোমিটার। এছাড়া খুলনা ও রাজশাহী থেকে সড়কপথ ও রেলপথে দিনাজপুর আসা যায়। ঢাকা থেকে দিনাজপুরগামী বাস ছাড়ে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত। এ পথে ভাল বাস সার্ভিস হলো- হানিফ এন্টারপ্রাইজ- ৮০১৩৭১৪, ৮০১৫৩৬৮, এস আর ট্রাভেলস-৮০১৩৭৯৩, ৮০১৯৩১২, কেয়া পরিবহন-৯০০০৮১২, এসএ পরিবহন-৯৩৩২০৫২, শ্যামলী পরিবহন-৯০০৩৩১।

কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন আন্ত:নগর দ্রুতযান ছাড়ে সন্ধ্যা ৭টা ৫গ মিনিটে। আর আন্ত:নগর একতা এক্সপ্রেস ছাড়ে সকাল ৯টা ৫০ মিনিটে। দিনাজপুর থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে দ্রুতযান এক্সপ্রেস ছাড়ে সন্ধ্যা ৬টা ১০ মিনিটে আর একতা বক্সেপ্রেস ছাড়ে সকাল ৬টা ৩৫ মিনিটে। কোথায় থাকবেন দিনাজপুর শহরে থাকার জন্য ভালো মানের হোটেল হচ্ছে পর্যটন, মোটেল। ফোন- ০৫৩১-৬৪৭১৮।

এছাড়া ঢাকায় পর্যটনের প্রধান কার্যালয় থেকেও এ মোটেলের বুকিং দিতে পারেন। ফোন- ৯৮৯৯২৮৮-৯১ । দিনাজপুরের পর্যটন মোটেলে এসি টুইনবেড ১৫০০ টাকা এবং এসি টুইনবেড ডিলাক্স কক্ষ ১৮০০ টাকা। এছাড়া দিনাজপুরের অন্যান্য সাধারণ মানের হোটেলে ১০০-৮০০ টাকায় রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা আছে। কয়েকটি সাধারণ মানের হোটেল হলো- মালদহ পট্টিতে হোটেল ডায়মন্ড, ফোন- ০৫৩১-৬৪৬২৯।

নিমতলায় হোটেল আল রশিদ-০৫৩১-৬৪২৫১। হোটেল নবীন- ০৫৩১-৬৪১৭৮, হোটেল রেহানা- ০৫৩১-৬৪৪১৪, নিউ হোটেল- ০৫৩১-৬৮১২২। তথ্য ও ছবিঃইন্টারনেট  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৭ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.