আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গুরু কাজী নজরুল ও আমি

অরুণালোক প্রেমিক কখনো বাঁচা মরার ভয় করে না। প্রেম দু'টোই পারেÑ বাঁচাতেও আবার মারতেও এবং এটা প্রেমিক জানে। একটা না একটা কিছু তো ঘটবেই ললাটে। যাই ঘটুক, প্রেমিক তার জন্য প্রস্তুত থাকে অষ্টপ্রহর। প্রেম মানেই নেশা, নেশা মানেই প্রেম।

নেশাটা থাকে প্রিয়ার মাঝে। প্রেমিক তা খোঁজে ঘুরে বেড়ায় অষ্টপ্রহর। প্রিয়াই তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। নেশার ঘোরে প্রেমের সাগরে ঝাঁপ দিতে পারে একমাত্র প্রেমিকই। প্রেমে যে বেহুঁশ ; তাঁর কাছে চরাচরের বাকি সব তুচ্ছ।

আমিও প্রেমিক, আমিও বেঁহুশ। প্রেমে বেহুঁশ হবার মন্ত্রটা যে শিখিয়ে গেলেন তিনি আর কেউ নন, তিনি আমার আমার গুরু নজরুল-, কাজী নজরুল, কাজী নজরুল ইসলাম। যাকে অনেকেই বিদ্রোহী বলে ডাকে, কেউ তাঁকে জানে প্রেমিক হিসেবে। আমার কাছে গুরু ধরা দিয়েছেন সর্বরূপে। বিরহ যমুনার বালুচরে আমার গুরু যে বাঁশিখানি ফেলে রেখে গেছেন সে বাঁশি আজ আমার হাতে।

আমি কুড়িয়ে নিয়েছি সে বাঁশি। আজ ধূলির ধরায় গুরু নেই, আছে তাঁর বাঁশি, তাঁর সুর, তাঁর ছন্দ, তাঁর বাণী। আমি এ বাঁশি বাজিয়ে তাঁকেই খুঁজে বেড়াতাম গুরু যাঁকে খুঁজে পেয়েছিলেন। জানতাম, তাকে আমি খুঁজে পাবোই। তাঁকে আসতেই হবে, আমার ডাকে সাড়া তাঁকে দিতেই হবে।

ঠিক তাইÑ, এরকম পথ চলতে চলতে আমি তাঁর দেখা পেয়েছি। তাকে দেখেই আমি চিনতে পেরেছি। গুরু যেমন বলে গেছেনÑ, “জানিলাম, আমি তোমা’ জন্মে চিনি/ পুজারিণী। ” আমিও তাঁকে চিনে নিয়েছি। আর তাই বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেছি তাকে দেখে।

এতো সুন্দর সে! এতো মনোহর!! তন্ময় হয়ে চেয়ে থেকেছি তাঁর দিকে নিষ্পলক, যেন চেতনহারা। সে-ও তেমনি, একবুক মরুতৃষা নিয়ে নির্ণিমেষ তাকিয়েছিল আমারই দিকে। তারপরÑ, এভাবে কতোটা সময় কেটে গেছে সে জানি না। এক সময় দেখলাম, অদ্ভুত এক আলোর দ্যুতিতে ছেয়ে গেলো তাঁর সমস্ত অবয়ব। সে আলোকচ্ছটা ঘিরে ধরলো আমার সমস্ত আমিত্বকে।

তারপর সে মোহনীয় হাসিতে ভেঙে পড়লো সর্বচেনার রূপ ধরে। তাঁর সে হাসির ঝঙ্কারে আমি যখন চেতনা ফিরে পেলাম, তখনই ভেতর থেকে কে যেন বলে উঠলোÑ ‘এ যে তোর কবিতা’! আহ! কবিতা! আমার কবিতা। কতোকাল খুঁজেছি তোমায়! তুমি কোথায় ছিলে এতোদিন! আমার হৃদয়ের একরাশ আকুলতা চোখ ভেঙে নামতে থাকলো, দেখলাম কবিতাও ঠিক একই আকুলতা ঢেলে দিচ্ছে ওর দু’টি চোখ থেকে। ভাল করে কবিতার পানে তাকাতেই দেখলাম, ওরা সারা অস্তিত্বে অত্যাচারের চিহ্ন। ছ্যাৎ করে উঠলো আমার বুকে! আর্তনাদ করে উঠলাম আমিÑ, একী কবিতা! তোমার এ কী হাল হয়েছে? আমায় বলো? কে তোমায় এভাবে আঘাত করেছে? কথা বলো তুমি কবিতা! নির্বাক কবিতা চোখের ভাষায় জানিয়ে দিলোÑ ‘আমি এতোকাল বন্দি ছিলাম ছন্দহীনের কাছে।

যে আমার কোমল-স্নিগ্ধ-সতেজ ও মায়াবী রূপটিকে বিকৃতি ঘটিয়ে চলেছিলো প্রতিনিয়ত। যার নির্দয় নিষ্পেষণে শ্রী-ছাঁদ হারাতে বসেছিলাম আমি। ম্লান হতে চলেছিলাম নিদারুণ নির্মমতায়। মুক্তি পাওয়ার সমস্ত রাস্তা বন্ধ দেখে যখন নিরাশ হয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে বসেছিলাম, হঠাৎ-ই তখন চির চেনা বাঁশির সুর শুনতে পেলাম। আমি চঞ্চল হয়ে উঠলামÑ, আহ! এ যে সেই বাঁশি! এতোকাল পরে কে বাজায় এ বাঁশি! এ যে সেই প্রেমময় বাঁশিÑ, যাঁর সুরে আমি যুগে যুগে বাঁধা পড়েছি! সর্বশক্তিতে বন্দিত্বের শিকল ছিঁড়ে ছুটে এসেছি সেই বংশি বাদকের কাছে।

তোমায় পেয়েছি আমি, তুমি আমায় নাও, যুগে যুগে আমি যে তোমারই’। আহ কবিতা! তোমায় পাওয়ার আনন্দে আমি ধন্য। আমার সাধনা সার্থক। আমি যে তোমায় আবার সাজাবো অতীতের সেই নন্দিতরূপে। আবার জাগরণ আসবে তোমার, আবার জাগবে জোয়ার।

তুমি দেখো কবিতাÑ, আমি তোমায় ছন্দোময় করে সাজাবোই। আমি আবার তোমার সেই স্বর্ণযুগকে ফিরিয়ে আনবো। এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার। আমার এ দৃপ্ত শপথের বাণী কবিতাকে যেন ছুঁয়ে গেলো মুহূর্তেই। ও’ যেন রেঙে উঠলো হাজার রঙে।

পূলক খেলে গেলো ও’র সমস্ত অস্তিত্বে। মুহূর্তেই চঞ্চলা হয়ে উঠলো ও’। বহুকাল পরে গুরুর সেই বাঁশিই কবিতাকে মুক্ত করে আনতে পেরেছে কেবল আমারই জন্যে। আর আমিÑ, কবিতাকে দেখে মুগ্ধ। এতো রূপ কবিতার! আহ! একরাশ মৌ মৌ করা সুরভি যেন ওকে ঘিরে রেখেছে।

আমি সে সুরভিতে বিবশ হতে চলেছি.......। কবিতা আমার প্রেমিকা। আজীবন প্রেমিকা। আমি কবিতার প্রেমে বেহুঁশ। কবিতার নেশায় বেতাল।

এতোকাল যে কবিতাকে আমি চেয়ে এসেছি গুরুর বাঁশি সুরে সুরে, আমি তাঁকে পেয়ে গেছি। কবিতা আজ আমার, শুধুই আমার। আরে বাহ! কবিতা যে ভারি চপলা! এতোকাল পরে কাছে এসেও ধরা দিই দিই করেও দিতে চায় না ও’। একী লুকোচুরি খেলা শুরু করেছে আমার সাথে! একটুকু দেখা দিয়ে, একটুকু রাঙা হাসি হেসে, একটুকু কথা কয়ে, একটু গন্ধ ঢেলে, একটু বর্ণ ছুঁইয়েই পালাতে চায়। বুঝেও বুঝেনা যে, ওঁর একটু একটু করে ঢেলে দেয়া রূপ, রস, গন্ধ, বর্ণ প্রেমিক হৃদয়ে কেমন নেশা জাগিয়ে দিতে পারে।

কিন্তু যতোই লুকোচুরি খেলুক, ধরা ওকে দিতেই হবে। ও’ যে নেশা আমার ভেতর জাগিয়ে দিয়েছে, তা যে ওকেই মেটাতে হবে। আমায় পরিতৃপ্তি না দিয়ে ও’ পালাবে কোথায়! আমাকে এ সর্বনাশা প্রেমের পথে তো ও’ই আমায় টেনে এনেছে। আমাকে রিক্ত, নিঃস্ব করেছে কবিতা। আমি কবিতার প্রেমে সর্বহারা হয়েছি।

সব ত্যাগ করেছি আমি কবিতার প্রেমে। ও’র জন্যই তো আমি সর্বত্যাগী। এ জগতে কিবা পরজগতে কিছু চাইনা আমার, কেবল কবিতা ছাড়া। ও’ তো আমার হৃদয়ের কথা জানেই! কবিতা জানে, আমার চেয়ে ভাল ওকে কেউ বাসবে না। আর আমিও জানি, কবিতা আমায় ফেরাতে পারবে না।

তাই হাজার লুকোচুরির মাঝেও কবিতা যতোক্ষণ আমার পাশে আছে আমি ততোক্ষণ পৃথিবীর বাদশা। এদিকে কবিতা আমার মুগ্ধতায় রোমাঞ্চিত হয়ে আমার ছোঁয়া কামনা করে চলেছে। খুব চাইছে, আমি ওকে জড়িয়ে ধরি নব বধূর মতো। কিন্তু আমি যে ভয় পাই। তাই শত ইচ্ছে থাকা সত্যেও ওকে ছুয়ে দিই না হারিয়ে ফেলার ভয়ে।

তাহলে যে ওকে ঘিরে আর বাণী গাঁথা হবে না। ওকে ছন্দোময় বাণীর ছকে ছাঁদা না পর্যন্ত যে ওকে আমি স্পর্শ করবো না। ওকে সর্বরঙে রাঙিয়ে তবেই বুকে তুলে নেবো। তার আগ পর্যন্ত আমি ও’র দর্শনেই সন্তুষ্ট। আমি যে অনেক কষ্টে ওকে খুঁজে পেয়েছি।

ওঁ’র উপস্থিতিটুকুই আমায় নেশাগ্রস্থ করে তোলেছে। নেশায় মদির চোখে আমি যখন কবিতার পানে চেয়ে থাকি ঠিক তখন ওঁ’র বাণী গুনগুন করে বাজতে থাকে আমার ভেতর, আমি তা-ই ছন্দে প্রকাশ করি। আমিতো ও’রই বাণী ফেরি করি যুগে যুগে। গুরু যেমন বলেছেনÑ ‘আমি যুগে যুগে আসি/ আসিয়াছি....’। আবার, অগ্রজ জীবনানন্দ দাস বলে গেছেনÑ ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়....’।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেনÑ ‘তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি/সকল খেলায় করবে খেলা এই আমি...। তাই অনন্তকাল ধরে কবিতার মাঝেই আমার বিচরণ। আমি ও’রই নেশা পান করে নেশাখোর হয়েছি। নেশাখোর হতে পেরে আমি হৃদয়ের দর্পণে সবকিছু দেখতে শিখেছি, চিনতে শিখেছি। কবিতাই আমায় নেশাখোর হতে শক্তি যুগিয়েছে।

সে শক্তিতে আমি নেশার কারিগরকেও চিনে নিয়েছি। যখন তাঁকেই চিনে নিয়েছি, তখন আমার স্বর্গের কোন লোভ নেই, নেই নরকের ভয়। নেশার কারিগর আমাকে নির্লোভ, নির্ভয় করেছেন। পৃথিবীর কোন দুঃখ দারিদ্র, হতাশা বঞ্চনা আমায় আর স্পর্শ করতে পারে না। আমি ওসব জয় করে নিয়েছি।

তাই প্রেমের সাগরে আমি ঝাঁপ দিতে পেরেছি সীমাহীন সাহসিকতায়। আজ আমি আর বাঁচা মরার পরোয়া করি না। আমি তো কবিÑ আমি তো প্রেমিক। তৈয়ব খান ১১-জানুয়ারি-২০১১ ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।