আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গয়নার বাক্স: বহুমাত্রিক একটি অসাধারণ চলচ্চিত্র

আমি স্বপ্ন দেখি একদিন বাংলাদেশ দুর্নীতিমুক্ত হবে সংসার আর চাকরির ব্যস্ততার কারণে সিনেমা দেখার সময় বিশেষ পাই না গত ৫ বছর ধরে। ইদানিং সহকর্মী বরুণ আর আকতার ভাইয়ের সংগ্রহশালা থেকে কিছু ভাল সিনেমা নিয়ে দেখি। গত সপ্তাহে এক হরতালের দিনে দুপুরের খাবার খেতে খেতে দেখতে শুরু করলাম “গয়নার বাক্স”। ভেবেছিলাম কিছুটা দেখে বন্ধ করে দেব। কিন্তু ঘটনার প্রবাহ আর পাত্র-পাত্রীর অভিনয় আমাকে টেনে নিয়ে গেল শেষ পর্যন্ত।

১৯৪৯ থেকে ১৯৭১ – কালের প্রবাহ আর একটি পরিবারের দিবা-রাত্রির বিচিত্র ঘটনা সহজ অথচ শিল্পিতরূপে পরিস্ফুট হয়েছে “গয়না বাক্স” চলচ্চিত্রে। শীর্ষেন্দুর উপন্যাস আর অপর্ণা সেন-এর চিত্রনাট্য, দুয়ে মিলে এক অনন্যসাধারণ সৃষ্টি। টাইটেল সং বা সূচনা সঙ্গীতটি ছিল রম্য ধাঁচের এবং অভিনব। এর কথা, সুর এবং ভিজুয়াল এফেক্ট দেখে শুরু থেকেই বোঝা যাচ্ছিল এ এক ভিন্ন মাত্রার চলচ্চিত্র। কাহিনীর শুরুতেই গয়নার বাক্সটির আবির্ভাব।

এবং তাকে ঘিরেই গল্প বর্তমান থেকে চলে গেল সুদূর অতীতে। একজন বাল্যবিধবার মনোকষ্ট আর একাকীত্বের গল্প বলতে গিয়ে নির্মাতা তৈরী করেছেন সেই সুদূর অতীতের এক অনবদ্য আবহ। সূক্ষ্মভাবে তুলে এনেছেন ভারত-ভাগের পরবর্তী সময়ের প্রায় সব অনুষঙ্গ। ইতিহাসের পাতা থেকে যেন উঠে এলো এক “বাঙ্গাল” পরিবার আর তাদের অবশিষ্ট জমিদারিত্বের দিনলিপি। ‘রাসমনি’ (মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়) এই চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্র, যিনি প্রায় পুরোটা সময় জুড়ে আবির্ভূত হয়েছেন ভূতের বেশে।

আর এই রকম ফ্যান্টাসী-নির্ভর চলচ্চিত্রে বাস্তবমূখী গল্প বলার যে দু:সাহস নির্মাতা অপর্ণা সেন দেখিয়েছেন, তার জন্যে তাঁকে সহস্র প্রণাম। ‘রাসমনি’ হলেন ‘সোমলতা’ (কংকনা সেন)-এর পিসি-শাশুড়ী। মৃত্যুর পর ভূত হয়ে তিনি তাঁর ৫০০ ভরি গয়নার বাক্স সবার অগোচরে দিলে গেলেন সোমলতাকে। আর ঘটনা এখান থেকে শুরু। বউ-শ্বাশুড়ির চিরাচরিত দ্বন্দ্ব এখানে পুরস্ফুট না হলেও তার কিছু আঁচ কোথাও কোথাও পাওয়া যায়।

রাসমনি সারা জীবন স্বামীর ভালবাসা থেকে বঞ্চিত। তাই সোমলতার স্বামীসোহাগ তার কাছ কাছে ঈর্ষার বিষয়। গয়নার বাক্সকে কেন্দ্র করে ঘটনার ঘনঘটা। তার সাথে যুক্ত হয়েছে তৎকালীন সমাজব্যবস্থার নানা চালচিত্র। এমন সুচারু সমন্বয় খুব বেশি চলচ্চিত্রে দেখা যায় না।

সেই সাথে আমার মন কেড়েছে সোমলতার স্বামী চন্দনের কাপড়ের ব্যবসায় সোমলতার অবদান, যা নারীর শিক্ষা ও স্বাধীনচেতা মনোভাবের ইতিবাচক প্রতিফলন। সেকালের অবস্থাপন্ন পুরুষদের জীবনযাত্রায় গণিকার আবির্ভাবকেও দারুণভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সেই সাথে রাসমনির দু:সাহসিক উচ্চারণ, “ক্যান? কেবল পুরুষগুলার রক্ষিতা থাকবো ক্যান? মাইয়া মাইনষের বুঝি সাধ-আহ্লাদ থাকবার পারে না?” পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার গালে এক জোরালো চপেটাঘাত। পরকাল নিয়ে রাসমনি’র সরল মন্তব্য “…অত যে পাপ-পূণ্য, স্বর্গ-নরক কইরা লম্ফ-ঝম্ফ করে মাইনষে, মইরা বুঝঝি, আসলে পাপ-পূণ্য বইলা কিসসু নাই …” শুনে শুরুতে আমার ধর্মভীরু মন কিছুটা ধাক্কা খেলেও বেশ কৌতুক অনুভব করেছি, বলতে দ্বিধা নেই। এপার বাংলা আর ওপার বাংলার মধ্যে আত্মার যে বাঁধন তা সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছেন অপর্ণা সেন।

সে জন্যে তাঁর প্রতি আমি চিরকৃতজ্ঞ। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন পশ্চিমবাংলাকে কীভাবে আলোড়িত করেছে, তার চিত্র প্রতিভাত হয়েছে সোমলতার কন্যা চৈতালী (শ্রাবন্তী)-র জীবনগাঁথায়। তার প্রেমিক একজন মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন তার কাছে প্রেমের দেয়ে দামী। এই সুযোগে একটি ব্যক্তিগত কথা বলি।

যে দু’টি গান কয়েক চরণ শুনতেই আমার চোখ ভিজে ওঠে, তার একটি হলো আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। তাই “গয়নার বাক্স”-র একটি দৃশ্যে যখন আহত মুক্তিযোদ্ধাদের দেখানো হচ্ছিলো, তখন আবহ সঙ্গীতের “কী শোভা, কী ছায়া গো/ কী স্নেহ, কী মায়া গো/ কী আঁচল বিছায়েছ/ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে…” লাইনগুলি আমার চোখ আর বুক দুটোকেই এক অপার্থিব আবেগে সিক্ত করে তুলছিল। হয়তো “গয়নার বাক্স” আমার চোখে অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র হবার এটিও একটি কারণ। “গয়নার বাক্স” কি প্রেমের ছবি, নাকি সামাজিক? কমেডি, নাকি ট্র্যাজেডি? নাকি বিপ্লবের? আমার কাছে “গয়নার বাক্স” একটি বহুমাত্রিক চলচ্চিত্র। এতে হাস্যরস যেমন আছে, কষ্টের আখ্যানও তেমনি আছে।

একদিকে যেমন আছে সেকালের মেয়েদের অসহায়ত্বের গল্প, অন্যদিকে স্বাধীনচেতা মেয়েদের মুক্তির স্বাদও পাওয়া যায় প্রকটভাবে, যখন চৈতালী স্কুটার চালায় বা ছাদে গিয়ে সিগারেট খায়। সোমলতা তাঁর স্বামীকে এতটাই ভালবেসেছিলেন যে তিনি পতিতালয়ে যান জেনেও তাঁকে ঘৃণা করতে পারেননি। আবার সেই সোমলতার প্রেমে যখন এক মুসলমান কবি প্রায় পাগল, তখন তিনি নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি ক্ষণিকের জন্যে হলেও। অন্যদিকে চৈতালী তার প্রেমিককে ভালবেসেছে ভীষণ, তবে বিয়েতেই যে তার পরিণতি, এমনটা মনে করে না সে। সেকালের প্রেক্ষাপটে কোন মেয়ে এভাবে ভাবত কি না, আমি সঠিক জানি না; তবু ভাল লেগেছে বলতে পারি নি:সংকোচে।

চলচ্চিত্র নির্মান সুকঠিন। তার চেয়ে বেশি কঠিন একটি সুন্দর সমাপ্তির মধ্য দিয়ে তার যবনিকাপাত। সেদিক দিয়েও “গয়নার বাক্স” একটি দারুণ দৃষ্টান্ত। দর্শকদের জন্যে একটি চমক অপেক্ষা করে এর শেষ দৃশ্যে। এক বাক্স গয়না শেষ পর্যন্ত কার বা কাদের হাতে যায়, তা জানতে হলে অপেক্ষা করতে হয় শেষ দৃশ্য পর্যন্ত।

নেপথ্যে হৃদয়কাড়া কবিতা আবৃত্তি আর দৃশ্যে গয়নাগুলির সর্বোৎকৃষ্ট সদ্ব্যবহার আমার কাছে এই চলচ্চিত্রের সেরা অংশ। - কাজী মিতুল ৯.৭.২০১৩ ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।