আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এই শহরের কোনো বিষন্ন কোণে...

প্রকৃতিকে করো তব দাস-চে দ্য আইডল (ব্লগার নং - ৩১৩৩৯) ওরা যখন এই শহরে এসে নামে; ওদের স্বাগতম জানায় ভোরের রোদ, বিষন্ন ও ঘুমাক্রান্ত কিছু মানুষ আর কমলাপুর রেলস্টেশানের ঢেউখেলানো চাতাল। বিশ্রী ও বিমূর্ত কাকেরা শহুরে সুর তুলেছিলো সমস্বরে। সারারাত নিরেট লোহার ট্র্যাক চুম্বন করতে করতে হঠাৎ কামড়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়া তূর্ণা নিশিথার পেট থেকে মানুষপিঁপড়ার সারিতে সেঁধিয়ে ওরাও নেমে আসে শক্ত ও নিষ্প্রাণ কংক্রীটতটে। মিনিট দশ পরেই স্টেশানলাগোয়া রেস্টুরেন্টে ওদেরকে পাঁচটা ডিমের ওমলেট আর পরোটা অর্ডার করতে দেখা যায়। সদ্য ধোয়া হাত-মুখ টিস্যু পেপারে মুছে তিনজন চেয়ে থাকে পরোটা ভাজার তাওয়ায়, বাকি দু'জন হালকা মেকাপে মুখ থেকে ঘুমচিহ্ন মুছে সতেজ হয়ে উঠার চেষ্টা চালায়।

এদের একজন সানিম। যেকোনো মুহুর্তে দৃশ্যের মধ্যে শরীরটাকে ভাসিয়ে রেখে মনটাকে ডুবিয়ে দিতে পারে, হারিয়ে যেতে পারে নিজস্ব নিরবতায়। তাওয়ায় ফুটতে থাকা তেলের ক্যানভাসে সানিম হারিয়ে যায়, হারিয়ে যেতে যেতে সে গত মধ্যরাতের স্টেশান দেখে, তখনো ওরা যাত্রা শুরু করেনি এমনকি সর্পিল ট্রেনের পেটে আশ্রয় নেয় নি, সে দেখে মাঈশার বাবা-মা কে, যাঁরা মেয়েকে এতদূর শহরে একলা পাঠাতে শংকিত হতে গিয়েও খুব চেনা ও নির্ভরযোগ্য চারজোড়া চোখের দিকে তাকিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে উঠেন। আসলেই কি কোন তফাত আছে মাঈশা আর ওদের মাঝে। এই যে ঝাঁকড়া চুলের ছেলেটা, যে মাঈশার জন্য অনেকগুলো কবিতা লিখেছে, মাঈশার জন্য তৈলচিত্র এঁকেছে আর সেসব মা-মেয়ে একসাথে পড়েছে আর হেসেছে, মাঈশার মা কবিতা আর চিত্রে মাঈশার জন্য সানিমের অপরিসীম ভালোবাসা টের পেয়েছেন, সাথে এটাও বুঝতে পেরেছেন যে ছেলেটার ভালোবাসা প্রেম হয়ে যায় নি, তারপর মাঈশাকে বলছিলেন একদিন বাসায় নিয়ে আসতে আর নিজ হাতে পায়েস রেঁধে খাইয়েছেন।

ডানপাশের ছেলেটা, রাফি, যার শার্টের হাতায় একটুখানি কালির দাগ, অগোছালো শার্টের ছেলেটার দৌড় জানেন তিনি। রাত জেগে জেগে ছেলেটা পোস্টার লিখে কিংবা ক্লাস ফাঁকি দিয়ে মিছিল-মানববন্ধন-পথসভায় যায় কিন্তু ছেলেটা পুতুল বানানোর মত করে সার্কিট বানায়, রোবটের মডেল বানায়। তৃতীয় ছেলেটা, আরিফ, যে ছেলেটা সিনেমা বানানোর স্বপ্ন দ্যাখে আবার পরীক্ষায় বরাবর প্রথম দিকটায় থাকে, মাঈশার মা ভেবে পান না ছেলেটা কেন চুপসে থাকে ওনার সামনে। মায়ের সামনে মাঈশার আরিফের উপস্থিতিবিষয়ক উদাসীনতাও ভাবিয়ে তোলে কিন্তু মেয়েকে কিছু বলেন নি কখনো, জানেন মেয়ে নিজেই বলবে যদি কিছু হয় আর যখন সময় হয়। এদের মধ্যে মাঈশার মায়ের সাথে অনুরাগ তৃণার, একেবারে মাঈশার সমানুপাতে।

কতদিন মুখে তুলে খাইয়ে দিতে হয়েছে তৃণাকেও। তবুও মায়ের মন নিশ্চিন্ত হতে চায় না। যতই বড় হয়ে যাক ওরা আর ভার্সিটি থেকে ডিগ্রি নিক, মায়ের কাছে সেই কোমল সন্তান। আরিফের ধাক্কা খেয়ে তাওয়ার ফুটন্ত তেল থেকে এক লাফে সামনের প্লেটভরা ডিমের ওমলেটে এসে পড়ে সানিম। কিন্তু সে পরোটা ছিঁড়ে মুখে দিতে পারে না।

মাঈশার মায়ের মুখটা বার বার ভেসে আসছে ওমলেটের ক্যানভাসে। মায়ের মমতাভরা মুখ কিছুতেই সরে যায় না আর সানিমের অপরাধবোধও কমে আসে না। কোনো একসময় নিজের মায়ের কানে মোহগ্রস্থ হয়ে ঢেলে দিয়েছিলো তরল লোহা, মা হয়তো ক্ষমা করে দিয়েছেন এতদিনে কিংবা পাগল ছেলেটার কথা কানেই তোলেন নি কোনরকম, তবুও সানিমের পাপবোধ কমে না, বাড়ি গেলে আগের মত মায়ের হাত থেকে অনায়াসে ভাত তুলে নিতে পারে না। মনে হয়, অধিকারহারা এক ভিখারী সে। সানিমের নিশ্চুপতা নতুন কিছু না বলেই বাকিরা নিজেরাই কোথায় যাবে, কোথায় থাকবে, ঠিক করে নেয়।

খাওয়া শেষ হয়ে গেলে তাদেরকে রিকশায় চড়তে দেখে একটা টোকাই, তারপর হাত পেতে দুটো টাকা ভিক্ষা চেয়ে দশটাকার নোট পেয়ে খুশি হয়ে উঠে, রোজ রোজ এরকম খুশি মানুষ পাওয়া যায় না। চলতে চলতে দুটো রিকশা থামে তারাবিহীন আবাসিক হোটেলে। দুটো রুম বুক করে স্নান সেরে ওরা লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে আর ঘুমিয়ে পড়ে। সাত কি আটটা ঘন্টার কাঁটা ঘুরতে দিয়ে যখন সূর্যের গরম চোখ ঠান্ডা হয়ে আসছে, তখন সানিম, মাঈশা আর তুর্ণাকে দেখা যায় বেরিয়ে আসতে। ময়লা জিন্স আর রঙউঠা টি-শার্টের সানিমকে যারা দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছে তারা অবাক হয়ে যেত এখন দেখে।

প্যান্টের মধ্যে বুক পর্যন্ত বোতাম আঁটা শার্ট গুঁজে শু মোড়া পায়ে পুরোপুরি কর্পোরেট। চুপি চুপি ওদের গা ঘেঁষে হাঁটলে বোঝা যায়, চাকরীর ইন্টারভিউতে যাচ্ছে তিন সদ্য বেকার। কিছু দূরের আলিশান বিল্ডিঙের লিফটে ওরা ঢুকে পড়ে কোথায় উঠে যায়, কার সামনে গিয়ে প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়, সেসবের কিছুই রাস্তায় ছুটে চলা বাসের যাত্রী কিংবা ফুটপাতের পান-সিগারেটের দোকানদার খেয়াল করে না তবে ঘন্টাখানেক পরে সিগারেটঅলা একটা সিগারেট বিক্রি করে আর সেটার মুখাগ্নি করে সানিম চলন্ত বাসের গায়ে ধোঁয়া ছুঁড়ে মারে। নিকোটিনের ঝাঁঝালো স্বাদে তার বিষন্নতা কেটে যায় অনেকখানি, তারপর হঠাৎ তার মনে হয় এই পথটা অনেক চেনা। এই পথে অনেকবার রিকশায় ভেসেছে, হেসেছে, লোকের চোখ ফাঁকি দিয়ে চুমু খেয়েছে।

সানিমের মস্তিষ্ক বেশীদূর উড়াল দিতে পারে না, মাঈশা এসে সিগারেট কিনে দিতে বলে একটা আর উত্তরে সানিম আধখাওয়া সিগারেট ড্রেনে ফেলে দিলে তূর্ণা হেসে উঠে। তারপর ওরা ফুটপাতে বানিয়ে বিক্রি করা চিতই পিঠা সর্ষেবাটা দিয়ে খায়, খেতে গিয়ে সরিষার ঝাঁঝ নাকে ঢুকে তুর্ণা হাঁচি আর কাশি দেয়, তারপর ওরা সানিমের দুই হাত ধরে নিজেদেরকে সানিমের জোড়া প্রেমিকা ঘোষণা করে ফুটপাত ধরে হেঁটে যায়। সেই সন্ধ্যায় পাঁচজন মিলে তুমুল আড্ডা দেয়। এক ফাঁকে রাফি দু'চারজনকে জানিয়ে রাখে এই শহরে আসার খবর, জেনে নেয় ট্রেড লাইসেন্স নেয়ার পদ্ধতি চাকরীর বদলে ব্যবসা করবে বলে। সানিম সারি সারি গাড়ির আলোকে জোনাকি কল্পনা করে আর তূর্ণা বাসায় জানায় চাকরী প্রাপ্তির খবর, যদিও তার খারাপ লাগে কারণ সানিম আর মাঈশার চাকরী হয় নি।

মেনে নিতে হচ্ছে, কখনো কখনো ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও মানুষকে স্বার্থপর হতে হয়। আর এসবের ফাঁকে মাঈশা আর আরিফ হাত ধরে হাঁটে, অর্থহীন প্রেমের কথা বলে। দু'চারজন পথচারী কিংবা ঘরে ফেরা কাক, যারা এদেরকে এক আধটু খেয়াল করছিলো, তারা সবাই ঘরে ফিরে যায় বলে এই পাঁচজনের বাকি রাতের খবর কারো জানা হয় না। তবে ধারণা করা যায়, হোটেলে ফিরে ঘুমিয়ে-জেগে রাত কাটায়। পরদিন বুড়োসকালে ওরা হোটেললাগোয়া রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে হোটেলের বয়ের সাথে ওদের কথা হয়, দুপুর বারোটার সময় হোটলের রুম ছেড়ে দিতে গেলে অভ্যর্থনাকারীর সাথে কথা হয় আর বিকেল পর্যন্ত অনেকগুলো বাড়িঅলার সাথে কথা হয়।

ওরা একটা বাসা খুঁজছে। এই শহরে অনেকগুলো বাসা খালি পড়ে আছে, মোড়ে মোড়ে ঝুলছে টু-লেট নোটিশ। কিন্তু কেউ ভাড়া দেয় না তিনটা ছেলে আর দুটা মেয়েকে দেখে, বাড়িঅলারা মানতে পারে না এরকম বন্ধুতা, তারপর শুধু তিনটা ছেলে কিংবা শুধু দুটা মেয়েকেও। ওরা একসময় ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ে ফুটপাতে। নিজেদেরকে প্রচন্ড হতাশ আর অসহায় হিসেবে আবিষ্কার করে।

ওরা কি খুব খারাপ? তারপর অনেকগুলো মানুষ ওদেরকে অতিক্রম করে যায়, দু'চারটে বখাটে ছেলে শিস দিয়ে যায়, কিছু কাক উড়ে যায়। তারপর সানিম হঠাৎ বলে, মাঈশা আয়! মাঈশা বুঝে উঠতে পারে না। তারপর সানিম হাত টেনে তুলে তাকে। বাকি তিনজন উঠতে গেলে সানিম ওদেরকে এখানেই বসে থাকতে বলে মাঈশার হাত ধরে টেনে নিয়ে যায়। মাঈশা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, কই যাস! আরিফ বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করে, যাস কই! কিন্তু ওরা কেউ জবাব পায় না।

কিছুদূর গিয়ে বলে, তোর একটা ফটো দে। মাঈশা ক্লান্ত হাতে একটা পাসপোর্ট সাইজ ফটো দেয় আর সানিম ব্যাগ ঘেঁটে এক তা কাগজ বের করে ঢুকে পড়ে ফটোকপি দোকানে। কিছক্ষণ পর আবার ওরা হাঁটে। তারপর ঢুকে পড়ে একটা বাড়িতে, যার কপালে লেখা, 'ফ্যামিলি বাসা ভাড়া হবে'। মাঈশা অবাক হয়।

'বাসাটা কার!' সানিম উত্তর দেয় না। উল্টো বলে,'ভিতরে ঢুকে আমি যা বলবো, দ্বিমত করবি না। ' দরজা খুলে বের হয়ে আসেন এক পৌঢ়। প্রশ্নবোধক ঝুলিয়ে রাখেন চোখে। 'আমরা আপনার বাসাটা ভাড়া নিতে চাই।

' সানিমের কন্ঠ অনেক স্থির শোনায় মাঈশার কানে। ' আমরা মাসখানেক আগে বিয়ে করেছি। ' মাঈশা এবার হা হয়ে যায়। বাড়িঅলার চোখে সন্দেহ ফুটে উঠে কি উঠে না, বলে,' ভেতরে আসো'। তারপর ওরা বাড়িঅলার সাথে কথা বলে, ভাড়া ঠিক করে, বাসা দেখে আর বাড়িঅলার চোখে ফুটে উঠা ও এতক্ষণ ধরে চেপে রাখা সন্দেহ নিরসন করে।

শেষোক্ত কাজটা সানিম একাই করে, মাঈশা কেবল দেখে সদ্য ফটোকপি করা কাগজটা বাড়িঅলার হাতে দিলে পৌঢ়কপালের ভাঁজ কিছুটা সোজা হয়ে আসে। সেইরাতে নতুন দম্পতির সাথে আসা তিনবন্ধুর পরিচয় নিয়ে বাকি তিনজন সানিম-মাঈশা কল্পিত দম্পতির নয়া সংসারে মাথা গুঁজে। সেই রাতে তূর্ণা নির্ভার ঘুম দেয়, রাফি আরো কিছু খোঁজখবর করে আর সানিমের রাতজাগা উদাস কানে মাঈশা-আরিফের মৃদু ঝগড়া বাজে। বাজুক। মাথা গোঁজার ঠাঁই টুকুন না পেলে এই মৃদুলয়ের ঝগড়া হত কীভাবে! এই শহরের কোনো বিষন্ন কোণে... (২) ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।