"প্রত্যেক সত্ত্বাকে মৃত্যু আস্বাদন করতে হবে। আর তোমরা কিয়ামতের দিন পরিপূর্ণ বদলা প্রাপ্ত হবে। তারপর যাকে দোযখ থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, নিঃসন্দেহে সে হল সফল। আর পার্থিব জীবন ধোঁকা ছাড়া অন্য কোন সম্পদ নয়। " আল ইমরান,আয়াত ১৮৫ নিনো একুইনো ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের আভ্যন্তরীন টার্মিনালে যখন পৌছালাম, তখন সন্ধ্যা প্রায় ৭টা।
বাইরে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে চললাম মাকাতি শহরের উদ্দেশ্যে। ওখানে গিয়ে হোটেল খুজব। ম্যানিলা ফিলিপিনসের রাজধানী হলেও এটাকে ওরা বিভিন্ন শহরে ভাগ করেছে। ব্যাপারটা আমার কাছে উত্তরা, গুলশান, মোহাম্মদপুর এই জাতীয় মনে হয়েছে। ম্যানিলার মধ্যে অনেকগুলো শহর বা সিটি আছে।
যেমন ম্যানিলা সিটি, মাকাতি সিটি, পাসাই সিটি, কুয়েজন সিটি, ইত্যাদি। একটি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের এক মহিলা আমাকে প্রায়ই মেইল করত ফিলিপিনস থেকে, সেই পরামর্শ দিয়েছিল, তোমরা মাকাতি সিটিতে থেকো, এটাই সিটি হার্ট ! পরে অবশ্য বুঝেছিলাম, এটাই হল একেবারে ব্যাবসা বাণিজ্য এবং অফিস আদালতের প্রাণকেন্দ্র ! মাকাতি এলাকায় পৌছে একটা হোটেলে উঠে পড়লাম। এবার ভাড়া কিছুটা কম, ১৭৯১ পেসো, হোটেলের মান বেশ ভাল। প্রথম যেই মহিলা আমাদের হোটেল এবং বিমান টিকেটের ব্যবস্থা করেছিল, তাকে ফোন করে বললাম, আমরা পরদিন একটা ম্যানিলা সিটি ট্যুর করতে চাই। মহিলার নাম মনে পড়েছে, "“নিডা”" !
কড়া রোদ, মনে হচ্ছে সূর্য এক হাত উপরে ! মাথার চান্দি গরম হয়ে যায় রোদে দাড়ালে।
নিডা সকাল দশটায় একটা ভ্যান (মাইক্রোবাস) নিয়ে হাজির। বলল, গতকাল রাতে নাকি সে আমাদের জন্য এয়ারপোর্টে দুই ঘন্টা অপেক্ষা করেছিল ! দুঃখ প্রকাশ করলাম, কারণ ভুলেই গিয়েছিলাম যে সে আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে ! ২৫০০ পেসোতে দুপুর দুইটা পর্যন্ত সিটি ট্যুর ঠিক করলাম। আবার মনে মনে বললাম, ভালই হয়েছে তোমার সাথে দেখা হয় নি, তাহলে তুমি নিশ্চয় আমাদের আবার ৩০০০ পেসোর হোটেলে তুলতে !
ম্যানিলা, মাকাতি এই শহরগুলোর যে জিনিসটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে, তা হল পরিচ্ছন্নতা। নিজের দেশকে সুন্দর পরিচ্ছন্ন রাখার জাতিগত যে মানসিকতা সেটা দেখলে বাংলাদেশের জন্য আমার দুঃখই হয়।
কবে আমরা এমন সচেতন হব?? !! ফিলিপিনসে থাকা অবস্থায় কোথায় আমি এক ইঞ্চি রাস্তা ভাংগা দেখিনি, ধুলাবালিতো দূরের কথা ! ফুটপাথ অনেক চওড়া।
প্রথমেই আমাদের নিয়ে গেল জাতীয় বীর এর মূর্তি দর্শনে।
এরপর জাতীয় স্কয়ার, কনভেনশন সেন্টার, সিনেট ভবন, সুপ্রিম কোর্ট এসব দেখাল।
জাতীয় স্কয়ার
এরপর আমাদের নিয়ে গেল এক ফিলিপিনসের “"আড়ং"” এ ! গলাকাটা দাম ! তারপরেও কয়েকটা জিনিস কিনলাম।
এই শার্টগুলো বারং কাপড়ের, কলা গাছের তন্তু দিয়ে তৈরী
ইউনিভার্সিটি অফ সন্টো টমাস ! এশিয়ার সবচেয়ে পূরাতন বিশ্ববিদ্যালয়। সেই ক্যাম্পাস একটু ঘুরে ফিরে দেখলাম।
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ছাত্রীদের ড্রেস থাকে এখানেই প্রথম দেখলাম !
ছাত্রীরা কোন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত
ড্রাইভারকে বললাম যে মাকাতির অফিস পাড়াতে একটু চক্কর দিয়ে আমাদের বাকলারান এলাকায় নামিয়ে দাও।
মাকাতি শহরে আকাশচুম্বী ভবন
এই হোটেলের এক্সটেরিয়র বেশ ভাল লেগেছে
ফিলিপিনস স্টক এক্সচেঞ্জ অফিস
বাকলারানে মূলত স্ট্রিট শপিং এর ব্যাবস্থা আর সাথে বংগবাজার স্টাইলের দোকানপাট আছে। তবে দোকানের জিনিসপত্রের কোয়ালিটি মাঝারি মানের এবং দামে কিছুটা কম বলে স্থানীয় লোকজনের ভালই ভীড় বাট্টা আছে। আসলে আমাদের হোটেল রিসেপশনের মেয়েটাই এই জায়গাটার কথা বলেছে।
আমাদের আরেকটি জায়গায় যাওয়ার ইচ্ছে, সেটা হল Mall of Asia বা সংক্ষেপে মোয়া ! বাকলারানে নেমে বুঝলাম সেটা মোয়ার কাছেই।
বিকেল নাগাদ জিপনি চড়ে মোয়া চলে এলাম।
এস এম গ্রুপের মল অফ এশিয়া ম্যানিলা বে এর কোল ঘেষে বিশাল জায়গা নিয়ে তৈরী, এটাই বোধহয় ফিলিপিনসের সবচেয়ে বড় মল। মলটি বে এর পাশে হওয়াতে এটা Hang Out এর জন্যও খুব ভাল জায়গা, অনেকটা আমাদের বসুন্ধরা সিটির মত !
এস এম মল থেকে ম্যানিলা বে
রাতের এস এম মল অফ এশিয়া
কিছু কেনাকাটা সেরে একটা ট্যাক্সি নিয়ে সেদিনের মত হোটেলে চলে এলাম।
রাতের খাবারটা আমরা সারতাম হোটেলের কাছে Andok’'s রেস্টুরেন্টে। আমার খাবার ছিল মূলত বাংগুস মাছের ডিশ, সাথে একটা ডিম পোচ, এক কাপ ভাত, হালকা পেপে সিদ্ধ আর একটা অরেঞ্জ ড্রিংকস ! মাছটা আমার কাছে দারুন লাগত।
১০ নভেম্বর ২০১১। ফিলিপিনস ছাড়ার আগে আমাদের শেষ দিন। এদিন আমাদের গন্তব্য ম্যানিলা থেকে প্রায় ঘন্টা দেড়েকের দূরত্বের শহর লস ব্যানস। আমার বাবা ছিলেন বাংলাদেশ ধান গবেষনা প্রতিষ্ঠানের (ব্রি) একজন বৈজ্ঞনিক কর্মকর্তা। অনেকে হয়ত জানেন, ফিলিপিনস এর লেগুনা এলাকার লস ব্যানস এ আন্তর্জাতিক ধান গবেষনা প্রতিষ্ঠান বা IRRI এর সদর দপ্তর।
এই ইরি’র সাথে ব্রি’র একটা কর্ম যোগাযোগ সব সময়ই আছে। আমার বাবা দু’বার গিয়েছিলেন ওখানে কোন সেমিনার বা সম্মেলনে যোগ দিতে। ইরির পাশ ঘেষেই আছে ইউনিভার্সিটি অফ ফিলিপিনস এর লস ব্যানস ক্যাম্পাস এবং গবেষনার জন্য এরাও ইরির সাথে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করে। ব্রি থেকে অনেকেই UP তে পিএইচডি করতে যায়, যারা ইরিতেই গবেষনা করে থাকে। তেমনি একজন আমার ব্রি ক্যাম্পাসের ছোট বোন এবং ব্লগার আরমিন২৯ , যে কিনা ইরিতে একজন পিএইচডি স্কলার, সেই লস ব্যানসের আমাদের হোস্ট ! উদ্দেশ্য ওর সহযোগিতায় ইরি, ইউপি এবং লস ব্যানস এলাকাটা ঘুরে দেখব।
সকালে রওনা দিতে একটু দেরি হয়ে যাওয়াতে প্রায় দুপুর ১২ টা বেজে গেল ওর ওখানে পৌছাতে। দুপুরে কোরবানীর গোস্ত দিয়ে গরম ভাত, কত দিন পর দেশী খাবারের স্বাদ !! হাভাতের মত পেট পুরে খেলাম ! ইউপি আর ইরি’র অফিস ঘুরে আমরা একটা জিপনি ভাড়া করলাম, ম্যাগনেটিক হিল, ন্যাশনাল আর্ট ইনিস্টিটিউট এর যেটা কিনা পাহাড়ের চূড়ায়, এসব দেখব বলে। আমরা বলতে আমি, আমার বন্ধু বাবু, ব্লগার আরমিন এবং তার স্বামী রুবেল ভাই। রুবেল ভাইও ইউপি তে পিএইচডি করছেন। সেই রকম মেধাবী দম্পতি !!
আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রধান ফটক
গবেষণার মাঠ
ইরি ল্যাব
ইরি অফিস
সবচেয়ে আশ্চর্যজনক জিনিস দেখলাম ম্যাগনেটিক হিল এ ! একটা পাহাড়ী ঢালে যেকোন গাড়ী যদি ইঞ্জিন বন্ধ করে থেমে থাকে, সেটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওপরে উঠে যায় ! তবে ইন্টারনেট ঘেটে জানা গেল, ওটা আসলে একটা Optical Illusion ! তবে যাই হোক না কেন, ব্যাপারটায় খুব মজা পেয়েছি !
এরপর চলে গেলাম ন্যাশনাল আর্টস সেন্টারে, পাহাড়ের চূড়ায় ! খুব সুন্দর জায়গায় তৈরী করেছে ওরা।
অসাধারণ লেগেছে চারপাশের পরিবেশ। ছেলে মেয়েরা ওখানে বিভিন্ন ইভেন্টের জন্য প্রাকটিস করছে।
আমাদের ভাড়া করা জিপনি, পেছনে ন্যাশনাল আর্টস সেন্টার
পাহাড়ের চূড়া থেকে মাউন্ট ম্যাকিলিং এর লাইং ল্যাডিকেও খুব ভালভাবে চোখে পড়ে। ছবি দেখুন, মনে হবে যেন একজন মহিলা শুয়ে আছে !
ঘোরাঘুরি শেষে আমরা লস ব্যানসের বিশেষ খাবার ‘বুকো পাই” খেলাম। বুকো হল ডাব।
ডাবের ভেতরে যেই হালকা সাদা রঙের মজাদার আস্তরণ থাকে, সেটা দিয়েই পিজার সাইজের পিঠা তৈরী করে থাকে ওরা। পিঠার মাঝে ওই সাদা শ্বাসের আস্তরণটি থাকে। লস ব্যানসের এই একটি দিন অনেক স্মরণীয় হয়ে থাকবে। লস ব্যানস সম্পর্কে সুন্দর একটি ব্লগ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
ফিলিপিনস ট্যুর এভাবেই শেষ হল।
প্রথম পোস্টে খরচ সংক্রান্ত প্রশ্ন ছিল। এখানে যতটুকু পারি বলছি।
# বিমান ভাড়াঃ ৫৩০০০ টাকা (মালয়শিয়া এয়ারলাইন্স)
# ভিসা ফিঃ ৩২০০ টাকা (পাচ দিন), ৪০০০ টাকা (দুই দিন)। বিস্তারিত এখানে ।
# হোটেল খরচঃ ১৫০০ পেসো থেকে শুরু, বাজেট হোটেল আছে, খোজ নিতে হবে।
পালাওয়ানে ১০০০ পেসো থেকে হোটেল পাওয়া যাবে।
# আভ্যন্তরীন বিমান ভাড়া বেশী। ম্যানিলা ~ পালাওয়ান ৯০০০ পেসো, ম্যানিলা ~ বুরাকাই ৯০০০ পেসো। ১ পেসো = ১.৮৫ টাকা (আনুমানিক)
# মাকাতি/ম্যানিলাতে ১০০ থেকে ১৫০ পেসোতে খাওয়া যাবে। পালাওয়ানে একটু বেশী পড়বে।
তবে জলিবি, এনডক্স এই জাতীয় রেস্টুরেন্টে ১০০ ~ ১৫০ তে খেতে পারবেন।
# ট্যাক্সিতে চলা ফেরা ব্যায়বহুল হবে। জিপনি/বাস ব্যাবহার করা ভাল। সবাই ইংরেজি বোঝে, সুতরাং সমস্যা হবে না। হাটাহাটি করে চলা ফেরার অনেক সুযোগ।
# ফিলিপিনস ত্যাগ করার সময় ইমিগ্রেশনের ঠিক আগে ৭৫০ পেসো টার্মিনাল ফি চেয়ে বসবে যেটাকে আমার কাছে একটা চরম ফাজলামো মনে হয়েছে। অতএব ৭৫০ পেসো আলাদা রেখে তারপর ফিলিপিনস ঘুরবেন। আমরা সব টাকা খরচ করে আসায় ডলার ভাংগাতে হয়েছিল!
আর কিছু মনে পড়ছে না। জিজ্ঞেস করলে সেভাবে জবাব দেয়ার চেষ্টা করব। সবাই ভাল থাকুন, সেই কামনা রইল।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।