আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অরুণাভ সরকারের কবিতা : আলো সবার বুকের মধ্যে এক্ষুণি তা জ্বালো

সাইফ শাহজাহান অলৌকিক আনন্দের ভার/বিধাতা যাহারে দেন/তার বক্ষে বেদনা অপার... হ্যাঁ, অপার বেদনা নিয়েই অলৌকিক আনন্দকে প্রকাশ করতে হয় কবিকে। প্রকাশ আর অপ্রকাশের দ্বন্দ্বে দীর্ণ হন কবি। অন্তর্গত রক্তক্ষরণে কবির বিষাদও হয়ে ওঠে উজ্জ্বল হীরকচ্ছটা। প্রাত্যহিকতার মলিন জগৎ কবির চেতনার রঙে পান্না হয় সবুজ, চুনি হয় লাল আর কবি সুন্দর বললে উদ্ভাসিত লাবণ্যে জগৎ সুন্দর হয়ে ওঠে। কবিতা বিষয়ে কবিদের নানা ভাষ্য প্রচলিত আছে।

‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়’ তাই কবিতাকে ছুটি দিয়ে দিয়েছেন যে কবি শেষ পর্যন্ত তার কাছে ‘পূর্ণিমার চাঁদও’ যে ‘ঝলসানো রুটি’ হয়ে মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনায় কবিতার আরেক মাত্রার উন্মোচন ঘটায় সেখানেই জীবনের চিরন্তন বিস্ময়। স্থূল ক্ষুধার জগৎ শিল্পের ক্ষুধায় জড়াজড়ি করে উত্তীর্ণ হয় অন্য মাত্রায়-- বোধের সেই উত্তীর্ণমাত্রায় কবিতা হয়ে চিরায়ত শিল্প। একজন প্রকৃত কবিই পারেন সেই মাত্রা স্পর্শ করে অতিক্রম করে যেতে। শিল্পের সেই চরৈবেতি যাত্রায় কবি অরুণাভ সরকার পরিপূর্ণ সেই দার্ঢ্য নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন নারীরা ফেরেনা তার সা¤প্রতিক কাব্য গ্রন্থ নিয়ে। নগরে বাউল এর পর এটি তার দ্বিতীয় কাব্য গ্রন্থ।

গত ঊনত্রিশ বছরে যার বই বেরিয়েছে মাত্র সাতটি, তার পাঁচটিই আবার শিশুতোষ। মাত্র দু’টি কাব্যগ্রন্থ এই কবির। যে-দেশে অতি তরুণরা কবিতা লিখতে শুরুই করে বই প্রকাশনার মাধ্যমে, সেই দেশে একজন আপাদমস্তক কবির ত্রিশ বছরের সম্বল দুটি কবিতার বই মাত্র। শুধু এই একটি মাত্র কারণে হলেও কবি অরুণাভ সরকারের কাব্য গ্রন্থ নারীরা ফেরেনা প্রকৃত কাব্যবোদ্ধা পাঠকের মনোযোগ দাবি করে নিঃসন্দেহে। বাংলাদেশে এই বিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে যাবতীয় আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক আত্মপ্রতারণা, চালাকির সঙ্গে সঙ্গে যুগপৎ কবিতা লেখাটাও একটা চাতুর্য আর প্রতারণার কর্ম হয়ে উঠেছে ; সেসময় কবি অরুণাভ সরকারের কবিতার বইয়ের নামকরণে অনেকে ঠোঁট ওল্টাবেন কিন্তু আখেরে তারা নিজেরাই ওল্টাবেন প্রকৃতপক্ষে।

বাংলা কবিতার আবহমান ধারার উত্তরাধিকার পরম দার্ঢ্যে ধারণ করেছেন অরুণ। একধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছেন প্রকৃত এবং সৎ কবিতাকে পাঠকের হৃদয়ের পলিমাটিতেÑ তাই অরুণাভ’র কবিতা পড়ে পাঠক তৃপ্ত হন। খুঁজে পান প্রকৃত কবিতা। শাশ্বত কাব্যবোধ যদি হয় একজন কবির আশ্রয়, তাহলে পাঠক কবিতার রসাস্বাদনে কখনও পরাঙ¥ুখ হন না। সত্যিকারের কবিতা পাঠকের মনন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ করে, পাঠক বারবার ফিরে আসে কবির পঙ্ক্তির কাছে-- যুগে যুগে কালে কালে-- সেখানেই কবির সার্থকতা।

অরুণাভ সরকার কবিতা লেখেন কবিতার কাছে অঙ্গীকারাবদ্ধ থেকে। প্রথমত, দ্বিতীয়ত, তৃতীয়ত এবং শেষ পর্যন্ত কবিতাই তাঁর অভীষ্ঠ। তাই তার নারীরা ফেরেনা’র প্রায় কবিতাই কবিতার পাঠককে ধরে রাখে তীব্রতায়। উনিশ শতকের সত্তর দশক থেকে যে কবির কাব্যযাত্রা তার মাত্র দুটি কবিতার বই, তবে সন্দেহ নেই যে দুটি বই-ই ভর্তি কবিতায়। কী অসাধারণ আর চিরকালীন লিরিক অরুণের ; একটি কথা/মুক্তো/তা/দিয়েছিলাম/Ñহারালে?/একটি মন/পুষ্প/তাও/পায়ের নিচে/মাড়ালে।

(এলিজি ১/নারীরা ফেরেনা, পৃ. ৬৪) তার কবিতায় ব্যক্তির রাগ-অনুরাগ-বিরহের পাশাপাশি এই তারবার্তাও জানান দেয় : সাড়ে সাত কোটি প্রায় পাকযন্ত্রে/না হরতাল নয়/লে-অফ ঘটেছে/আর সেইসব যন্ত্রজীবী/মাকড়-শিশুর দল/সাবধান/আপনার বেদীর দিকে/ছুটে যাচ্ছে দ্রুত। (তারবার্তা, পৃ.-৩১) তার কবিতার বইয়ের নাম নারীরা ফেরে নাÑ নারীরা হয়তো ফেরেনা সত্যি সত্যি কিন্তু তারও অধিক সত্যি তারা থেকে যায়, কবির হৃদয়ে থেকে যাওয়া সেই নারীরা হয়ে ওঠে শিল্পভাষ্য তথা কবিতা। কবি হৃদয়ে থেকে যাওয়া নারীদের নিয়ে অসংখ্য স্মরণীয় লিরিক লিখেছেন অরুণাভ সরকার। সেসব লিরিকের অনেকগুলোই রচনার সময় মুখে মুখে ফিরেছে সতীর্থ ও তরুণ কবিদের। সেগুলোর কিছু উল্লেখ করা আজও লোভনীয় : একটি ডাকে উড়েছিলাম তোমার চোখের অসীম নীলে/সেখানে ঝড় মেঘের ঘটাÑ তুমি কি তা বলেছিলে? (পৃ. ৮২) তাঁর আরেকটি লিরিক : ভালোবাসা দিলে ভালোবাসা পাবে/ ঘৃণা দিলে ঘৃণা।

/ তুমি বিস্মরণও নিতে পার; /শুধু আমি তা পারি না। (আমি যা পারি না ৭৯) কবি তা পারেন না বলেই না ফেরা নারীরা কুসুম হয়ে ফুটে থাকে কবিতার বাগানে, কবির সৃষ্টিরাজ্যে। কবি অরুণাভ সরকারের কবিতার বই প্রকাশ করে আগামী প্রকাশনী প্রশংসা পাওয়ার মতো একটি কাজ করেছে, তবে বইটির কিছু মুদ্রণপ্রমাদ পীড়াদায়ক। পরবর্তী সংস্করণে এই ত্রুটি আগামী প্রকাশনী সংশোধন করবে আশা করি। নারীরা ফেরে না।

অরুণাভ সরকার। প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০০৬। প্রকাশনায় আগামী প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ঢাকা। মূল্য ৯০ টাকা। শুচি সৈয়দ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।