আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

টিপাইমুখ বাধ প্রসংগে:প্রয়োজন সংগ্রামের আন্ত:সংযোগ(আপডেটেড)

আশ্বাস ও আশ্বস্ত হওয়ার রাজনীতি দিল্লীর আশ্বাস, ঢাকার আশ্বস্ত হওয়া আর বরাক নদীর ভাটির মণিপুর-মিজোরাম-বাংলাদেশের মানুষের প্রতিবাদ বিক্ষোভের মধ্যেই টিপাইমুখ বাধ নির্মাণের কাজ চলছে ধারাবাহিক ভাবে। সর্বশেষ গত ২২ অক্টোবর টিপাইমুখ বাধ ও জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য ভারতের ন্যাশানাল হাইড্রোইলেক্ট্রিক পাওয়ার কোম্পানি (এনএইচপিসি),সাটলুজ জলবিদ্যুৎ নিগম লিমিটেড (এসজেভিএন) এবং মনিপুর সরকারের মধ্যে বিনিয়োগ চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার খবর বাংলাদেশের মিডিয়ায় এসেছে গত ১৯ নভেম্বর। এনএইচপিসি’র ওয়েবসাইট থেকে দেখা যায় পরিকল্পনা অনুসারে ভারত সরকার অর্থ ছাড় করতে শুরু করলে মণিপুর রাজ্যের চারুচাদপুর জেলার বরাক নদীর উপর টিপাইমুখ নামক স্থানে ১৫০০ মেগাওয়াটের এই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটি নির্মাণ করতে সময় লাগবে ৮৭ মাস। (সূত্র:১) মিডিয়ায় এখন এই খবরটিকে “হঠাৎ চুক্তি” হিসেবে আখ্যায়িত করে পরিবেশন করা হলেও এর আগে গত ১৩ মে,২০১০ সালে সাপ্তাহিক বুধবারে “টিপাইমুখ বাধ নির্মাণে আরো একধাপ অগ্রগতি: সরকার নিরব” শীর্ষক লেখায় এই তিনটি কোম্পানির মধ্যে গত ২৮ এপ্রিল ২০১০ সালে টিপাইমুখ বাধ নির্মাণের ব্যাপারে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছিলো। সেময় বাংলাদেশের মিডিয়াগুলো শাসক শ্রেণীর সাথে তাল মিলিয়ে গত ২০১০ সালের ১২ জানুয়ারির বাংলাদেশ-ভারত যৌথ ইস্তেহারে মনমোহন সিং এর দেয়া “বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর কিছু করা হবেনা” জাতীয় ফাপা আশ্বাসের প্রচার চালাচ্ছিল, দেশের মানুষকে টিপাইমুখ বাধ নির্মাণের ধারবাহিক অগ্রগতি বিষয়টি জানতে দেয়নি- পাছে টিপাইমুখ বাধ ইস্যুটি ভারত-বাংলাদেশের ‘বন্ধুত্বের জোয়ার” এ বাধা হয়ে দাড়ায়! ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় ভারত-বাংলাদেশ যৌথ ইস্তেহারের আর্টিক্যাল ৩০ এ বলা হয়েছিলো: “ভারতীয় প্রধামন্ত্রী টিপাইমুখ প্রকল্পে বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর কোন পদক্ষেপ না নেয়ার আশ্বাস পূনর্ব্যক্ত করেছেন।

” এরপর ২০১১ সালে মনমোহন সিং এর বাংলাদেশ সফরের সময় ঘোষিত যৌথ ইস্তেহারে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেয়া মনমোহনের বক্তৃতায় একই “আশ্বাস” আবারও উচ্চারিত হয়। খেয়াল করার বিষয় এসব ঘোষণায় মনমোহণ কিন্তু কোথাও বলেননি, যে ভারত টিপাইমুখ বাধ নির্মাণ করবে না, বলেছে “বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর হয়” এমন কিছু করবে না। এটা তো নতুন কোন কথা নয়, টিপাইমুখ বাধ নির্মাণের পরিকল্পনার শুরু থেকেই ভারতের বক্তব্য হলো এটা ভাটি অঞ্চলের আসাম-মণিপুর-মিজোরাম কিংবা বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর তো নয়ই বরং এই বাধ নাকি বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি বন্যা নিয়ন্ত্রণ করে বাড়তি উপকার করবে। বাংলাদেশ এবং ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলের টিপাইমুখ বাধ বিরোধীদের কাছে নদীর প্রবাহ, অববাহিকার কৃষি ও মৎস সহ গোটা পরিবেশের জন্য যে বাধ ক্ষতিকর, ভারতের কাছে তা রীতিমত “উপকারি”। ফলে ধারাবাহিক ভাবে ভারত বাধ নির্মাণের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে আর বলছে বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর হয় এমন কিছু টিপাইমুখে তারা করবে না।

বাংলাদেশের শাসক শ্রেণীও ভারতের এই ফাপা আশ্বাস জনগণের কাছে প্রচার করছে। গত ২০০৯ সালে ভারতের টিপাইমুখ বাধ নির্মাণের তৎপরতার খবরে সারাদেশে তীব্র গণ-অসন্তোষের চাপে বাংলাদেশ থেকে একটি সংসদীয় প্রতিনিধিদল হেলিকপ্টারে করে টিপাইমুখ ঘুরে এসেও সেই একই আশ্বাসের বাণী শুনিয়েছিলো। শুধু তাই না, সাম্প্রতিক বিনিয়োগ চুক্তির খবরের প্রতিক্রিয়ায় সেই প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য সাংসদ আবদুর রহমান ১৯ নভেম্বর ২০১১ বিবিসির কাছে বলেছেন: “প্রতিনিধি দলে আমাদের আমাদের কারিগরি কমিটি ছিল, তারাও সে জিনিসটি তাদের কাছ থেকে বুঝেছে যে ওখানে ড্যাম বা বাধ নির্মাণ করা হলে বাংলাদেশ বরং উপকৃত হবে। কারণ বর্ষা মৌসুমে যখন পানি থাকবে, তখন বাংলাদেশ প্লাবিত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে রক্ষা পাবে এবং যখন শুস্ক মৌসুমে পানি থাকবে না, তখন বাংলাদেশ পানি সেখান থেকে পাবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বার্থ বরং রক্ষিতই হবে।

” দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে যারা টিপাইমুখ বাধ বিষয়ে তদন্ত করতে ভারত গিয়েছিলেন তারা নিজেরাও ভারতের সুরে সম্ভাব্য ক্ষতির হিসেবের বদলে উল্টো “উপকার” হওয়ার কথা বলছেন! যদিও তারা স্বীকার করেছেন ভারত “আরও সম্ভাব্যতা যাচাই এবং যৌথ সিদ্ধান্ত নেয়ার” প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো। এখন যখন দেরীতে হলেও মিডিয়াতে আসলো যে ভারত টিপাইমুখ বাধের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তখনও বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিক ভাবে কোন প্রতিবাদ করেনি, দিল্লীস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনার তারিক ই করিম এখনও তথ্য জানতে চাওয়ার পর্যায়ে রয়ে গেছেন, দেশে পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের বহি:প্রচার অনুবিভাগের মহাপরিচালক শামীম আহসানও “ভারতের সাথে যোগাযোগ” ও “বিস্তারিত তথ্য জানতে চাওয়া” পর্যায়ে থাকার কথা বলেছেন। অবশ্য কথিত তথ্য পাওয়ার আগেই ২৪ নভেম্বর পররাষ্ট্র মন্ত্রী দিপু মণি বলেছেন: “টিপাইমুখ প্রকল্পে বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হবে না বলে নয়া দিল্লি যে নিশ্চয়তা দিয়েছে তাতে ঢাকা ‘আশ্বস্ত’ হয়েছে। “ টিপাইমুখ ইতিবৃত্ত: আসামের কাছার অঞ্চলের মৌসুমি বন্যা প্রতিরোধের নামে মনিপুরের ২৭৫.৫০ বর্গকি.মি এলাকার ১৬টি গ্রাম পুরোপুরি ডুবিয়ে এবং আরও ৫১টি গ্র্রামকে আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ করে ৪০ হাজারেরও বেশী মানুষের জীবন জীবকা ও ঐতিহ্য-সংস্কৃতি ধ্বংস করার পরিকল্পনা মনিপুরবাসী কখনই মেনে নেয়নি। ফলে মনিপুরের বরাক নদীর উপর বাধ নির্মানের স্থান ক্রমশই পরিবর্তিত হতে থাকে- ১৯৫৫ সালে ময়নাধর, ১৯৬৪ সালে নারায়নধর এবং তার পর ভুবন্দর এবং সবশেষে ১৯৮০’র দশকে তুইভাই এবং বরাকনদীর সংগম স্থলের ৫০০ মিটার ভাটিতে বাংলাদেশের অমলসিদ পয়েন্ট থেকে ২০০ কিমি দূরে টিপাইমুখে বাধ নির্মানের পরিকল্পনা করা হয়।

লক্ষণীয় বিষয় হলো প্রথমে বাধটি ব্রম্মপুত্র ফ্লাড কনট্রোল বোর্ড বা বিএফসিবি’র আওতায় থাকলেও ১৯৮৫ সালে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর ১৯৯৯ সালে বাধটিকে নর্থ ইষ্টার্ণ ইলেক্ট্রিক পাওয়ার কর্পোরেশন বা নেপকো’র হাতে দিয়ে দেয়া হয়। (সূত্র:২) গত ২২ অক্টোবরের বিনিয়োগ চুক্তি থেকে দেখা যাচ্ছে এই বাধ নির্মাণের দ্বায়িত্ব এখন ভারতের ন্যাশানাল হাইড্রোইলেক্ট্রিক পাওয়ার কোম্পানি (এনএইচপিসি),সাটলুজ জলবিদ্যুৎ নিগম লিমিটেড (এসজেভিএন) এবং মনিপুর সরকারের জয়েন্ট ভেঞ্চারের মাধ্যমে সম্পন্ন হবে যেখানে এনএইচপিসি, এইচজিভিএন এবং মনিপুর সরকারের শেয়ার যথাক্রমে ৬৯%, ২৬% এবং ৫%। মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী বাধের উচ্চতা ১৬৮.২ মিটার এবং বেইস লোড ফ্যাক্টর ২৬.৭৫% অর্থাৎ ১৫০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ২৬.৭৫% বা ৪০১.২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সারা বছর ধরে পাওয়া যাবে যার মধ্যে মণিপুরের ভাগে পড়বে মাত্র ১২% বিদ্যূৎ অর্থাত ৪৮ মেগাওয়াট । (সূত্র: ৩)ফলে মণিপুরবাসীকে যতই ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ এর মূলা ঝোলানো হউক না কেন, সারা বছর ধরে ৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুতের বিনিময়ে জল-জীবন-জীবিকা-পরিবেশ-সংস্কৃতি ধ্বংসের প্রকল্পের বিরুদ্ধে তামেলং ও চারুচাদপুরের হামার এবং জেলিয়াংরং নাগা আদিবাসী গোষ্ঠী সহ সংখ্যাগরিষ্ঠ মণিপুরবাসী প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। ছবি:মানচিত্রে টিপাইমুখ বাধের অবস্থান, সূত্র: আইডব্লিউএম,২০০৫ জলবিদ্যুত, বন্যা নিয়ন্ত্রণ কিংবা সেচ প্রদান ইত্যাদি ঘোষিত উদ্দেশ্যের বাইরে রয়েছে বিশাল ও সম্পদশালী কিন্তু স্বায়ত্বশাসনের দাবীতে অস্থিতিশীল উত্তরাঞ্চলের জলজ শক্তি, গ্যাস, ইউরোনিয়াম ইত্যাদির উপরে দেরী হয়ে যাওয়ার আগেই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি একই সাথে সমগ্র উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সামরিক ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার বাসনা।

টিপাইমুখ বাধ সেই পরিকল্পনারই অংশ। মনিপুর বাসীর জন্য বিদ্যুত উৎপাদনের সুফলের কথা বলে ২০০৩ সালের ৯ জানুয়ারী টিপাইমুখ বাধের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকার এবং মনিপুর রাজ্য সরকারের মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হলেও খোদ মণিপুরবাসী সহ বাধের উজান এবং ভাটির উভয় অঞ্চলের জনগণের তীব্র বিরোধীতার মুখে এখনও নির্মাণ কাজ শুরু করতে পারেনি। ভারতীয় সামরিক বাহিনীর অধিনস্ত আধাসামরিক বাহিনী আসাম রাইফেলস বাধ রক্ষণাবেক্ষণের ঘোষণা দিলেও কাজ হয়নি। প্রতিরোধের মুখে ২০০৮ সালের ২৮ জুলাই থেকে রাজ্য সরকার আইন পাশ করে টিপাইমুখ বাধের নির্মান কাজের প্রয়োজনে নির্মাণ সামগ্রী আনা-নেয়ার কাজে ব্যবহ্রত মনবাহাদুর রোডের ৯৯ কিমি দূরত্বের প্রতি ৭ কিমি অন্তর সামরিক পোষ্ট স্থাপন করেছে। (সূত্র:৪) বাংলাদেশের জলপ্রবাহ ও প্লাবনভূমির উপর প্রতিক্রিয়া: নদীর বুকে বাঁধ দেয়া মানেই হলো নদীর চলন, নদী-খাত, জল প্রবাহের পরিমাণ ও ধরণ, পানির তাপমাত্রা, বহন করা পলি ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদন, নদীর দুপাশের ভূ-প্রকৃতি, পরিবেশ, জীব-বৈচিত্র, গাছপালা-বনভূমি, নদীর উপর নির্ভরশীল দুপারের মানুষের জীবন-জীবিকা ইত্যাদির পরিবর্তন ঘটা।

যেকারণে যে কোন বাধ দেয়ার আগে পরিবেশ ও জনজীবনের উপর সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া যাচাই করার একটা রীতি তৈরী করা হয়েছে। সে রিপোর্টের উপর ভিত্তি করেই সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা বাঁধটি হবে কি হবে না। টিপাইমুখ বাঁধের ক্ষেত্রে ভারত সরকার সে রীতি অনুযায়ী বহুমুখী জলবিদ্যুৎ প্রকল্পেরএকটা এনভায়রনমেন্টাল ইমপেক্ট এসেসমেন্ট বা ইআইএ রিপোর্ট তৈরী করলেও মুশকিল হলো সে রিপোর্টে কেবল বাঁধের উপরের অংশে এবং তার আশপাশের নদী-অববাহিকার উপর কি প্রতিক্রিয়া পড়বে তা যাচাই বাছাইয়ের কথা বলা হয়েছে কিন্তু বাঁধের নিম্ন অববাহিকায় অবস্থিত বাংলাদেশের উপর কি প্রতিক্রিয়া হবে তার কোন সমীক্ষা সেখানে নেই। ইতোপূর্বে যৌথ নদীকমিশনের বৈঠকে বার বার প্রতিশ্রুতি দিলেও বরাবরের মতোই সেগুলোকে পাত্তা না দিয়ে ভারত এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশের মোট জলপ্রবাহের উৎসের শতকরা ৯ ভাগ জল আসে যে বরাক নদী থেকে তার বুকে বিশাল বাধ নির্মাণ করে বিদ্যুৎ উৎপাদন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং সেচ প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজে। অবশ্য ভারতের এধরণের আচরণ নতুন নয়- বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্য দিয়ে যৌথভাবে বয়ে যাওয়া ৫৪ টি নদীর মধ্যে ৪৮ টির উপরই বিভিন্ন ভাবে একতরফা হস্তক্ষেপ করে চলেছে ভারত যার মধ্যে গঙ্গার উপর নির্মিত ফারক্কা ব্যারেজের প্রতিক্রিয়া সর্বাপেক্ষা ভয়ংকর, যে ব্যারেজের মাধ্যমে গড়ে ৪০,০০০ কিউসেক বা ১১৩৩ কিউমেক পরিমাণ পানি বাংলাদেশে প্রবেশের আগেই প্রত্যাহার করে ভগিরথি নদীতে চালনা করার ফলে উত্তারাঞ্চলের মরুকরণ করা হয়েছে।

১৯৭১ সালে এদেশের জনগণ যখন মুক্তিসংগ্রামে লড়ছে, ভারত তখন ফারাক্কা ব্যারেজ নির্মাণ সম্পন্ন করে এবং পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল থেকে ৩১ মে এই ১০ দিনের জন্য ৩১১ কিউমেক থেকে ৪৫৩ কিউমেক পানি পরীক্ষা মূলক ভাবে প্রত্যাহারের কথা বলে বাস্তবে ১১৩৩ কিউমেক পানি প্রত্যাহার করতে শুরু করে এবং গঙ্গা থেকে এভাবে পানি প্রত্যাহার সেই যে শুরু হয়েছে এখনও তা চলছে। মাঝে ফারক্কা অভিমুখে ভাসানীর লঙ মার্চ হলো, জনগণের আন্দোলনের তাপে ও চাপে ১৯৭৭ সালের ১৯৭৭ সালের নভেম্বরে ৫ বছর মেয়াদী পানি চুক্তি হলো, সেই চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে ১৯৮৫ নভেম্বরে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হলো এবং সর্বশেষ ১৯৯৬ সালে ভারত বাংলাদেশ পানিবণ্টন চুক্তি হলো কিন্তু বাংলাদেশ কখনই তার প্রাপ্য পানিটুকু আর পায়নি (সূত্র:৫), গঙ্গা নদী বরাবর কমপক্ষে চারশত জায়গায় উত্তর প্রদেশ এবং বিহারে সেচ কাজের জন্য ফারক্কায় নদী আসার আগেই ২৫,০০০ কিউসেক থেকে ৪৫,০০০ কিউসেক পানি তুলে নেয় ভারত। (সূত্র:৬) শুধু গঙ্গা নয়, তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, মনু, মহুরী, খোয়াই, গোমতী এই ৭টি নদীর ব্যাপারেও বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের ন্যায্য দাবীর প্রতি কোন সন্মান রাখেনি ভারত। আর এখন এই টিপাইমুখ প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশের সুরমা-কুশিয়ারা-মেঘনা নদীর পানির নিয়ন্ত্রণ তুলে নেয়ার ভারতীয় পরিকল্পনার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের প্রতিক্রিয়ার মুখে ভারত বন্যা নিয়ন্ত্রণের নতুন মুলা ঝুলিয়েছে। বলা হচ্ছে বর্ষা মৌসুমে ১৫.৫ বিলিয়ন ঘনমিটারের জলাধারে বিপুল পরিমাণে "বাড়তি" পানি ধরে রাখার ফলে একদিকে যেমন বর্ষা মৌসুমে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল বন্যার হাত থেকে "রক্ষা" পাবে অন্যাদিকে শুকনো মৌসুমে সেই জলাধারের সঞ্চয় থেকে পরিমাণ মত পানি নীচের দিকে প্রবাহিত করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ফলে বরাক নদীতে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী পানি প্রবাহিত হবে ফলে ঐ অঞ্চল খরার হাত থেকে রক্ষা পাবে।

এখন অতীতের সমস্ত অভিজ্ঞতা ভুলে গিয়ে আমরা যদি ধরেও নেই ভারত তার কথা মতই কাজ করবে, তাহলে যে প্রশ্ন উঠে আসে তা হলো, ভারতের প্রতিশ্রুতি মতো এভাবে মাগনা "বন্যানিয়ন্ত্রণের" প্রতিক্রিয়া কি হবে, ভরা মৌসুমে নদীতে পানি কম থাকা আর শুকনা মৌসুমে পানি বেশী থাকলে সেটা জল-জীবন-পরিবেশের জন্য কি ভালো না খারাপ? ছবি:মানচিত্রে সুরমা-কুশিয়ারা-বরাক অববাহিকা, সূত্র: আইডব্লিউএম,২০০৫ ভারত পানি বাড়া কমার কথা বললেও বাংলাদেশ কখন কোথায় কতটুকু পানি পাবে এবং কিভাবে পাবে তার কোন হিসাব আমাদেরকে দেখায় নি। ইনটিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং এর তিনজন গবেষক ভারতের পরিকলনা অনুসরণ করে এই পানির পরিমাণ বাড়া-কমার একটা হিসাব বের করেছে এবং তার সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়াও নিরুপন করার চেষ্টা চালিয়েছে। আমরা এই গবেষণা রিপোর্ট এবং বন্য ও নদী-নদী বিষয়ক জনগণের জ্ঞানকে সম্বল করে সেই পানি বাড়া কমার পরিমাণ ও তার সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার একটা হিসেব হাজির করতে পারি (সূত্র:৭): বর্ষামৌসুমে বন্যা নিয়ন্ত্রণ? টিপাইমুখ বাধ যখন পূর্ণ কার্যক্ষম থাকবে তখন বরাক নদী থেকে অমলসিধ পয়েন্টে সুরমা-কুশিয়ারা-মেঘনা নদীর দিকে পানি প্রবাহ জুন মাসে ১০%, জুলাই মাসে ২৩%, আগষ্ট মাসে ১৬% এবং সেপ্টেম্বর মাসে ১৫% কমে যাবে। কুশিয়ারা নদীর পানির উচ্চতা অমলসিধ স্টেশনে কমবে জুলাই মাসের দিকে গড়ে ১ মিটারেরও বেশী আর ফেঞ্চুগঞ্জ, শেরপুর ও মারকুলি স্টেশনে কমবে যথাক্রমে ০.২৫ মিটার, ০.১৫ মিটার এবং ০.১ মিটার করে। অন্যদিকে একই সময়ে সুরমা নদীর পানির উচতা সিলেট এবং কানাইয়ের ঘাট স্টেশনে কমবে যথাক্রমে ০.২৫ মিটার এবং ০.৭৫ মিটার করে।

এভাবে স্বাভাবিক ও কাংখিত বন্যার পানির পরিমাণ উল্ল্যেখযোগ্য পরিমান কমাতে পারলেও ভারতের পরিকল্পনা মতো টিপাইমুখ বাধের জলাধার এত পানি ধরে রাখতে পারবে না যে ৫ বা ১০ বা ২০ বছর পর পর যে ভীষণ বন্যা হয় তার পানির উচ্চতা উল্ল্যেখ যোগ্য পরিমানে কমে যাবে। এরকমটি কেন ঘটবে? আসলে একটা বহুমুখী বাঁধকে কার্যকর এবং ফলপ্রসুভাবে পরিচালনার ক্ষেত্রে অনেকগুলো পরস্পর বিরোধী কার্যাবলীর মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে হয়। যেমন: যদি কার্যকর বন্য নিয়ন্ত্রণ করতে হয় তবে বর্ষার শুরুতে বাঁধের জলাধারের পানির পরিমাণ রাখতে হবে সর্বনিম্ন, যেন পরিবর্তীতে পুরো বর্ষা জুড়ে যে অতিরিক্ত পানি উজান থেকে প্রবাহিত হবে তা ধরে রাখার মত যথেষ্ট জায়গা জলাধারে থাকে। আর তাই যদি হয়, তবে ঐ সময়ে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উতপাদন করা যাবে না কেননা সর্বোচ্চ বিদ্যূৎ উৎপাদনের জন্য জলাধারে পানির উচ্চতাও সর্বোচ্চ রাখা দরকার। আর তা করতে গেলে আবার বর্ষার শুরু থেকে বাঁধের জলাধারে বেশী পানি ধরে রাখতে হবে ফলে অতিবৃষ্টি বা ঢল নামলে তখন আর সেই বিপুল বাড়তি জলরাশি ধরে রাখার মতো জায়গা থাকবে না।

অতিবৃষ্টি বা ঢলের পানির হাত থেকে বাঁধকে বাচাতে হলে তড়িঘড়ি করে বাধের স্পিল ওয়ে গেট খুলে দিতে হবে। ২০০০ সালে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল হঠাৎ করে বন্যায় ডুবে যায়। এই হঠাৎ বন্যার পানির উৎস ছিল পশ্চিম বঙ্গের বেশ কিছু বাঁধ, যেগুলোর ধারণ ক্ষমতা অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার কারণে পানি ছেড়ে দিতে হয়েছিল ভাটির দিকে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, দুনিয়ার বিভিন্ন জায়গাতেই এরকম অসংখ্য উদাহরণ আছে। যেমন: ১৯৮৩ এর এল নিনোর সময়, আবাহাওয়া পূর্বাভাসে রকিমাউন্টেনের ঝর্ণার ঢল নামার ব্যাপারটি সময় থাকতে ধরতে পারেনি।

কলরাডো নদীর বাধগুলোতে তখন বাধ পরিচালনাকারী অন্যান্য সময়ের মতোই সর্বোচ্চ পানি ধরে রাখে। ফলে যখন ঢল নামতে শুরু করে তখন ঢলের বাড়তি পানি ধরে রাখার কোন উপায় ছিল না- পানি বাঁধকে বাইপাস করে স্পিলওয়ে দিয়ে নামতে শুরু করলেও বাঁধের উপর প্রচন্ড চাপ পড়ে। অ্যারিজোনার গ্লেন ক্যানিয়ন বাঁধের পাথরের একটা বড় অংশ তখন বন্যার পানির প্রবাহে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে যায়। (সূত্র: ড: এম মনিরুল কাদের মির্জা,নিউএজ,৫ অগাষ্ট, ২০০৯) টিপাইমুখ বাঁধ যে অঞ্চলে অবস্থিত ভারতের সেই উত্তর-পূর্বাঞ্চল দীর্ঘ বর্ষাকাল এবং প্রবল বৃষ্টিপাতের জন্য বিখ্যাত। ফলে বাঁধ পরিবর্তী পর্যায়ে এধরণের ঘটা খুবই স্বাভাবিক।

IWM এর বিশ্লেষণে দেখা যায় প্রতি ১০ বছরে একবার আসে এরকম বড় বন্যার পানি অমলসিদ পয়েন্টে কমাতে পারবে মাত্র ১৩% (যার ফলে পানির উচ্চতা কমবে মাত্র ০.৫ মিটার) কিংবা প্রতি ২০ বছরে একবার আসে এরকম বন্যার ক্ষেত্রে মাত্র ৩% (যার ফলে পানির উচ্চতা কমবে মাত্র ০.১১ মিটার) যেখানে স্বাভাবিক গড়পরতা বন্যার ক্ষেত্রে এ পানি হ্রাসের হার হলো ২৩ থেকে ২৭% (যার ফলে উচতা কমবে ১ থেকে ১.২৫ মিটার) । এভাবে প্রয়োজনীয় বন্যার পানি অতিরিক্ত কমিয়ে দেয়া কিন্তু অপ্রয়োজনীয় এবং ভয়ংকর বন্যার বেলায় কার্যকর ভূমিকা না রাখার ফলে: ## এ অঞ্চলের প্লাবনভূমির প্লাবনের ধরণ, মৌসুম এবং প্লাবিত হওয়ার পরিমান ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বর্ষা মৌসুমে সুরমা ও কুশিয়ারার প্রাকৃতিক জলপ্রবাহ শুষ্ক করার ফলে কমপক্ষে ৭ টি জেলা- সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, ব্রাক্ষণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোণার ধান উতপাদন ব্যাহত হবে- যে জেলাগুলোতে দেশের উল্ল্যেখযোগ্য পরিমাণ ধান উতপাদন হয়। (সূত্র:৮) এর মধ্যে সিলেট ও মৌলভীবাজার এলাকাতেই প্লাবনভূমির পরিমাণ কমে যাবে যথাক্রমে ৩০,১২৩ হেক্টর(২৬% ) এবং ৫,২২০ হেক্টর( ১১% )। ## বাধ নির্মাণের পর থেকে সুরমা-কুশিয়ারার উজানের ৭১% এলাকাই আর স্বাভাবিক মৌসুমে জলমগ্ন হবে না।

কুশিয়ারা নদী প্রায় ৬৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে তার ডান পাশের প্লাবনভূমি হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। ## শুকনো মৌসুমে কুশিয়ার বাম তীরে কুশিয়ারা-বরদাল হাওর পুরোপুরি শুকিয়ে যাবে। কাউয়ার দিঘী হাওর এর ২,৯৭৯ হেক্টর(২৬% )জলাভূমি হারাবে। নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহ থেকে এভাবে পানি সরিয়ে নেয়ার ফলে পানি প্রবাহের পরিমাণগত পরিবর্তনের সাথে সাথে গুণগত পরিবর্তন ঘটবে, বহন করা পলির পরিবহন এবং নদীর তলায় জমা পলির বৈশিষ্ট পাল্টে যাবে এবং এর ফলে অবশেষে সমগ্র পরিবেশের বাস্তুসংস্থানই পাল্টে যাবে। আর সুরমা-কুশিয়ারা নদী প্রবাহ তার বিশাল প্লাবনভূমির সাথে সংযোগ তো হারাবেই, সেই সাথে সেই প্লাবন ভূমিও একসময় নেই হয়ে যাবে, মৎস-জীববিদরা যে ঘটনাকে বলে থাকেন "প্লাবন নদী" থেকে "জলাধার নদীতে" পরিণত হওয়া।

প্লাবনভূমির পরিমাণ এবং গভীর জলাবদ্ধ জমি থেকে অগভীর জলাবদ্ধ জমিতে পরিণত হওয়ার ফলে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অন্যতম সম্পদ হাওর-বাওড়’গুলো ধ্বংস হয়ে যাবে। নদীর পানির বাড়া-কমার একটা প্রাকৃতিক ছন্দ থাকে। ইকোলজিষ্ট পিটার বেইলির(Peter Bayle) ভাষায় এ হলো ফ্লাড-পাল্স (Flood-Pulse)। এই ফ্লাড-পাল্স বা বন্যার স্পন্দনই হলো নদী ও নদী-অববাহিকা অঞ্চলের বাড়তি উৎপাদনশীলতা ও জৈব-বৈচিত্রের আসল কারণ। এর কারণেই সাগরের তুলনায় প্রতি একক ক্ষেত্রফল এলাকার প্লাবনভূমিতে গাছ-গাছালির বৈচিত্র্য থাকে ৬৫ গুণ বেশি।

পিটার বেইলির হিসেব কষেছেন,অববাহিকা সমৃদ্ধ নদীতে অববাহিকা বিহীন নদীর তুলনায় মাছ উৎপাদন হয় ১০০গুণ বেশি এবং লেক বা জলাধারের তুলনায় এর পরিমাণ প্রতি হেক্টরে ৪গুণ। ফলে বোঝাই যায় যে, বার্ষিক পানি বাড়া-কমার প্রাকৃতিক চক্রের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখেই নদী এবং তার অববাহিকা অঞ্চলের ইকোসিস্টেম বা বাস্তসংস্থান গড়ে উঠে। কাজেই নদী ও নদী-অববাহিকার এই পারস্পরিক সম্পর্ক টিকে থাকার উপরই নদীর প্রজাতি বৈচিত্রের টিকে থাকা নির্ভর করে। ম্যাট্রিক ম্যাককালির(Matrick McCulli)ভাষায়: " অসংখ্য জলজ প্রজাতি তাদের প্রজনন, বাচ্চা জন্মদান, মাইগ্রেশান সহ জীবন চক্রের গুরুত্বপূর্ণ ধাপগুলোর ব্যাপারে ঋতুগত খরা কিংবা পানি ও পুষ্টির স্পন্দনের উপর নির্ভর করে। বাৎসরিক বন্যার ফলে জলাভূমিতে কেবল পানিই জমে না, সেই সাথে জমা হয় প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান।

সেই সাথে গেরস্থালি ও বন্য পশুপাখির জৈব বর্জ্য নদীতে ভেসে গিয়ে নদীকে সমৃদ্ধ করে। বন্যার ফলে নদী থেকে মাছের ডিম এবং পোনা জলাভূমিতে গিয়ে আশ্রয় নেয় এবং ডিম ফুটে ও পোনা বড় হয়ে পরবর্তি বন্যার সময় নদীতে ফিরে যায়। " বন্যা-বাহিত পলির ব্যাপারটিও মাথায় রাখা দরকার। বর্ষা মৌসুমে নদী তো কেবল পানিই বহন করে না, ক্ষয়িষ্ণু দুই তীর এবং নদী বক্ষ থেকে কেটে নেয়া ক্ষুদ্র-বৃহৎ কঠিন পদার্থও বহন করে চলে, যার একটা বড় অংশই হলো পলি। পলি বহন করতে থাকা নদী যখন বর্ষা মৌসুমে দুই তীর প্লাবিত করে অববাহিকায় ঢুকে পড়ে তখন নদীর উপরের স্তরে থাকা কাদা ও হিউমাস জমিতে থিতু হয়ে জমিকে উর্বর করে তুলে।

এভাবে হাজার বছর ধরে চলে আসা প্রক্রিয়াকে আমাদের দেশের চাষীরা উপকারী বলেই মনে করে আসছে। এখন নদীর বুকে বাধ দিয়ে বর্ষা মৌসুমে নদীর স্বাভাবিক পানি কমিয়ে দিয়ে নদীকে যদি তার খাতের মধ্যেই ধরে রাখা হয় তাহলে স্বাভাবিক ভাবেই নদীর দু'কুলের প্লাবনভূমি নদীর বহন করে আনা পলি থেকে বঞ্চিত হয়ে ক্রমশ অনুর্বর হতে থাকবে কৃষকের উপর যার প্রতিক্রিয়া হবে দ্বিবিধ: প্রথমত, প্লাবন অববাহিকার বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ভীষণ রকম হ্রাস পাবে এবং দ্বিতীয়ত, এই ক্রমহ্রাসমান উৎপাদন ক্ষমতা ধরে রাখতে গিয়ে কৃষক বাধ্য হবে জমিতে আরো বেশি পরিমাণ রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে যা সার্বিক বিচারে আর্থসামাজিক এবং পরিবেশগত বিচারে পুরো পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলবে । অন্যদিকে এই অতিরিক্ত পলি নদীর বুকে জমা হয়ে নদীকে ক্রমশ অগভীর করে তুলবে। ফলে কোন সময়ে যদি বরাক নদীর উৎস স্থলে অত্যধিক বৃষ্টিপাত হয় কিংবা অন্যান্য কারণে হঠাৎ পাহাড়ি ঢল নামে এবং সেই বাড়তি পানির চাপ থেকে বাধকে বাচানোর জন্য যদি হঠাৎ বাধের স্পিলওয়ে খুলে দিতে হয় তাহলে ক্রমশ অগভীর নদী সেই অতিরিক্ত পানি বহন করতে না পেরে ভীষণ প্লাবনে দুকুল ভাসিয়ে দেবে। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল শিক্ষক ড. জহির বিন আলমের ভাষায়: ".......হয়তো বাঁধটি বর্ষার স্বাভাবিক বন্যাকে নিয়ন্ত্রণ করবে।

কিন্তু যখন পানির উচ্চতা আসলেই ভয়ংকর রকম বেড়ে যাবে তখন কিন্তু খোদ বাঁধটিকে বাচানোর জন্যই বাধের গেটগুলো খুলে দিতে হবে। যার ফলে নদীর নিম্ন অববাহিকায় আরো বড় ধরনের বন্যা হবে। "(সূত্র:৯) শুকনা মৌসুমে বাড়তি পানি? ভারত যদি তার কথা মত কাজ করে তাহলে IWM এর হিসেব মত সাধারণ ভাবে শুকনো মৌসুমে অমলসিধ পয়েন্টে বরাক নদীর পানিপ্রবাহ ১২১% বাড়বে এবং এর ফলে নদীর উচ্চতা বাড়বে ১.৪৮ মিটার। সবচেয়ে বেশি পানি বাড়বে জানুয়ারী মাসে যখন গড় পানিপ্রবাহ ২২২ কিউমেক বা কিউবিক মিটার/সেকেন্ড (৯৯%) বাড়বে এবং উচ্চতা বাড়বে ২.০৯ মিটার। তবে ফেব্রুয়ারী ও মার্চে পানি প্রবাহ জানুয়ারীর মত এত বেশী বৃদ্ধি না পেলেও মোটামুটি ভাবে যথাক্রমে ১৬০ কিউমেক এবং ৫৫ কিউমেক করে বাড়বে।

কিন্তু ১৯৭৭ থেকে ১৯৮০ সালের সময়টাতে যেমন পরপর তিনটা ভীষণ শুকনো মৌসুম এসেছিল, সেরকম পরপর শুকনো মৌসুমের বেলায় প্রথম মৌসুমে বাড়তি পানি সর্বরাহ করতে পারলেও দ্বিতীয় মৌসুমে পূর্ব মৌসুমের পানি স্বল্পতার প্রভাবে জলাধারে এমন পরিমাণ পানি থাকবে না যে বাড়তি পানি সর্বরাহ করা যাবে, জলাধারে পানির উচ্চতা একটি নির্দিষ্ট মাত্রার নীচে নেমে গেলে টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় পানির চাপ পাওয়া যাবে না। এরকম পরিস্থিতিতে মার্চ-এপ্রিল মাসে পানির পরিমাণ মারাত্মক কমে যেতে পারে। অমলসিধ পয়েন্টে মার্চ ও এপ্রিল মাসে যথাক্রমে মাত্র ৩৮ কিউমেক এবং ২৪৪ কিউমেক পানি পাওয়া যাবে যা বাধ-পূর্ব পরিস্থিতিতে প্রাপ্য পানির যথাক্রমে মাত্র ৭৪% এবং ২২% । আমরা এ আশংকা বাদ দিয়ে যদি ধরেও নেই ভারতের কথা মত শুকনো মৌসুমে অমলসিদ পয়েন্টে ১২১% পানি বাড়বে, সেটা কি হাওর অঞ্চলের জন্য মঙ্গল জনক হবে? বছরে বেশির ভাগ সময় পানির নীচে থাকা ২৫ হাজার বর্গকিলোমিটারের হাওর অঞ্চলের উপর কিন্তু প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ২ কোটি লোকের জীবিকা নির্ভরশীল। এ অঞ্চলের লোকজন জীবিকার জন্য মূলত মাছ ধরে এবং শুকনো মৌসুমে কৃষিকাজ করে।

শুকনো মৌসুমে কৃষিকাজ বলতে হাওর অঞ্চলে বোরো ধান চাষ। হাওর অঞ্চল ছাড়া এই উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ি এলাকায় তেমন কোন ধান চাষ করা যায় না। যেকারণে আশুগঞ্জ, ভৈরব এবং অন্যান্য অঞ্চলের চাল-কলগুলো ধানের জন্য এ অঞ্চলের উপর নির্ভরশীল। শুকনো মৌসুমে যখন হাওরের পানি কমে যায় তখন তারা বোর আবাদ করে আর বর্ষা আসার আগেই সে ফসল ঘরে তোলে। বর্ষায় পলি জমে উর্বর হাওরের বুকে তখন সহজেই বোরর বাম্পার ফলন ঘটে।

এখন টিপাইমুখ বাধের ফলে শুকনো মৌসুমেও যদি ভারতের "বদান্যতায়" হাওর অঞ্চল পানিতে পূর্ণ থাকে তাহলে কৃষক আগের মত আর বোর ধান আবাদ করতে পারবে না। (সূত্র:১০) ফুলেরতল ব্যারেজের মাধ্যমে পানি প্রত্যাহার: যে শুকলা কমিশনের(Shukla Commission) এর কারিগরি পরামর্শ মতে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে, সেই একই কমিশনের আরেকটা সুপারিশ ছিল টিপাইমুখ থেকে ৯৫ কিমি ভাটিতে ফুলের তলে একটা ব্যারেজ নির্মাণ করা যার মাধ্যমে আসামের কাছার অঞ্চলে সেচ প্রদান করা হবে। ছবি:মানচিত্রে প্রস্তাবিত ফুলের তল ব্যারেজের অবস্থান, সূত্র: আইডব্লিউএম,২০০৫ ফারাক্কা ব্যারেজের অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশের জনগণ খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পারছে ফুলেরতল ব্যারেজের প্রতিক্রিয়া কি হবে কিন্তু ভারত বরাবরই ফুলের তল ব্যারেজ নির্মাণের কথা অস্বীকার করে আসছে। আমরা পরিস্কার বলতে চাই বরাবরের মতোই এটাও ভারতের স্রেফ ভাওতাবাজি, ফুলেরতলে ব্যারেজ নির্মাণের পরিকলনা রয়েছে বলেই টিপাইমুখ বাধের এনভাইরনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট বা ইআইএ রিপোর্টের ১ম অধ্যায়েই বলা হচ্ছে: “There is a proposal to construct a pick-up barrage at Fulertal, 95 km down stream of dam site, which will act as diurnal storage of 1120 cumec inclusive of power release to irrigate subsequently a gross command area of 1,20,337 ha.”(সূত্র:১১) অর্থাৎ ফুলেরতল ব্যারেজ বরাক নদী থেকে প্রয়োজন হলে প্রতি সেকেন্ডে ১১২০ ঘনমিটার পানি প্রত্যাহার করতে পারবে। এখানে উল্ল্যেখ করা দরকার ফারাক্কা ব্যারেজের মাধ্যমে ভারত প্রতি সেকেন্ডে সর্বোচ ১১৩৩ ঘনমিটার পানি ভাগিরথী নদীতে সরিয়ে নেয় অর্থাৎ ফুলের তল ব্যারেজ তৈরী হলে তা থেকে ফারক্কার প্রায় সমপরিমাণ পানি প্রত্যাহার করতে পারবে ভারত।

এখন দেখা যাক, এই পরিমাণ পানি বরাক নদীর বর্ষাকালীন পানির ঠিক কত অংশ: ইআইএ রিপোর্টের ৩য় অধ্যায়ের টেবিল ৩.১৬ অনুসারে, ভরা মৌসুমে আসামের লক্ষিপুরে বরাকনদীর পানি প্রবাহের নিরাপদ পরিমাণ হলো ২৭৬০ কিউমেক এবং বদরপুর ঘাটের কাছে (অমলসিধ থেকে ১০ কিমি আগের স্থান) এর পরিমাণ ৩৪৪০ কিউমেক। এই ডাটা থেকে দেখা যায়, পুরোপুরি কার্যক্ষম থাকলে, ফুলের তল ব্যারেজের মাধ্যমে লক্ষীপুর অঞ্চলের কাছে বরাক নদী থেকে ৪১% এবং বদরপুরঘাটের কাছ থেকে ৩৩% পানি প্রত্যাহার করে নেয়া সম্ভব। অন্যাদিকে শুকনো মৌসুমে বরাক নদীর প্রবাহের পরিমাণ গড়ে ১৭৫ থেকে ২৫০ কিউমেক। ভারতের প্রতিশ্রুতি মোতাবেক শুকনা মৌসুমে যদি পানির পরিমাণ বেড়ে এমনকি যদি ৫০০ কিউমেকও হয় তাহলেও পুরো কার্যক্ষম ফুলেরতল ব্যারেজ বরাক নদীকে একেবারে পানিশূণ্য করে দিতে সক্ষম হবে যার ফলে শুকনো মৌসুমে এমনও হতে পারে যে বাংলাদেশ হয়তো ১ ফোটা পানিও পাবে না! বাঁধের জলাধারের প্রভাবে ভূমিকম্প প্রবণতার বৃদ্ধি: বাধের জলাধারে যে বিপুল পরিমাণে পানি জমা করা হয়, বাঁধের ভিত্তি ভূমি এবং এর আশপাশের শিলাস্তরের উপর তার চাপের পরিমাণও হয় ব্যাপক। অল্প একটু অঞ্চলে এই বিপুল চাপ পড়ার কারণে সে চাপ ইতোমধ্যেই ঐ অঞ্চলে থাকা শিলাস্তরের ফাটলকে সক্রিয় করে তুলতে পারে।

এই ঘটনাটি কখনও তাৎক্ষণিক ভাবে বাঁধ চালু হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে কিংবা শুকনো ও ভরা মৌসুমে চাপের কম বেশী হতে হতে বাঁধ চালুর অনেক পরেও হতে পারে। এ প্রক্রিয়ায় মাটির নীচের সচ্ছিদ্র শিলাস্তরের ফাঁকে ফাঁকে জমে থাকা পানির যে চাপ(porous pressure) থাকে তা বাঁধের পানির ভারে এবং শিলাস্তরে চুইয়ে যাওয়া বাড়তি পানির প্রভাবে স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায়। এ porous pressure বেড়ে যাওয়া ছাড়াও বাড়তি পানির রাসায়নিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার কারণেও ফাটলের দুদিকের শিলাস্তর যা এমনিতেই টেকটোনিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার কারণে পরস্পর থেকে দুরে সরে যেতে চায় কিন্তু পরস্পরের মধ্যকার ঘর্ষনের শক্তির কারণে একত্রিতই থাকে, সেটা এবার আর বাড়তি চাপ সহ্য করতে না পেরে চ্যূতি বা স্লিপ-স্ট্রাইকের সৃষ্টি করে- ফলে ভূমিকম্পের কেন্দ্র সৃষ্টি হয়ে সেখান থেকে ভূমিকম্প চারিদিকে ছড়িয়ে পরে। জলাধারের প্রভাবে এভাবে কোন অঞ্চলে ভূমিকম্প প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার বিষয়টিকে বলা হয় Reservoir Induced Seismicity( RIS) (সূত্র:১২)। এভাবে ভূমিকম্প বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি প্রথম নজরে আসে ১৯৩২ সালে আলজেরিয়ার “কুয়েড ফড্ডা” বাধের ক্ষেত্রে।

পরবর্তিতে এ পযন্ত বিশ্বের বিভিন্ন ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চলে এধরনের বাঁধের সাথে ভূমিকম্প বেড়ে যাওয়ার নজির পাওয়া গেছে কমপক্ষে ৭০টি। ভারতের কাছে বিষয়টি অজনা থাকার কথা নয় কেননা এ যাবত কালে বিশ্বের সবচেয়ে তীব্র মাত্রার জলাধার প্রভাবিত ভূমিকম্প(RIS) হয়েছে খোদ ভারতের মহারাষ্ট্রের কয়না বাধের কারণে। ১৯৬৭ সালের ১১ ডিসেম্বর ঘটা ৬.৩ মাত্রার এই ভূমিকম্পটি এমনকি তার কেন্দ্র থেকে ২৩০ কিমি দূরেও তীব্র আঘাত হেনেছিল । (সূত্র: ১৩) এতসব জেনেশুনেও ভারত যে জায়গায় টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করছে সেটা হলো সারা দুনিয়ার মধ্যে ছয়টা ভয়ংকর ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকার মধ্যে একটা- উত্তর-পূর্ব ভারত ছাড়া অন্যান্য অঞ্চলগুলো হলো হলো ক্যালিফর্নিয়া,জাপান, মেক্সিকো, তুরস্ক ও তাইওয়ান। টিপাইমুখ বাঁধের ১০০-২০০ কিমি ব্যাসার্ধের মধ্যে গত ১০০-২০০ বছরে পাঁচ মাত্রা বা তারও বেশী মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে ১০০’রও বেশী।

দেখা গেছে ১৫০ বছরের মধ্যে টিপাইমুখের ১০০ কি.মি ব্যাসার্ধের মধ্যে ৭+ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে ২টি এবং এর মধ্যে একটি তো হয়েছে ১৯৫৭ সালে টিপাইমুখ থেকে মাত্র ৭৫ কি.মি দুরে। ১৪ এ অঞ্চলটিতে এত বেশী ভূমিকম্পের কারণ হলো অঞ্চলটি যে সুরমা-গ্রুপ শিলাস্তর দ্বারা গঠিত তার বৈশিষ্টই হলো অসংখ্য ফাটল আর চ্যুতি। পুরো বরাক অববাহিকা এলাকাটিতেই রয়েছে অসংখ্য ফল্ট লাইন যা ঐ এলাকার নদী এবং শাখা নদীগুলোর গতি প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করে। প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধের একেবারে অক্ষ বা axis টিই অবস্থিত হলো বহুল পরিচিত তাইথু(Taithu) ফল্টের উপর অবস্থিত যা সম্ভাব্য ক্রিয়াশীল একটি ফল্ট এবং ভবিষ্যতের যে কোন ভূমিকম্পের কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে। লেখা দীর্ঘ হয়ে যাওয়ায় বাকিটা মন্তব্য আকারে নীচে দেয়া হলো ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.