আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রজাপতি - মুভি রিভিউঃ যদি পুরাতন প্রেম ঢাকা পড়ে যায় নব প্রেম জালে......

আমার এই পথ চলাতেই আনন্দ অনলাইনের বাংলাদেশিদের মধ্যে কয়জন হলে গিয়ে বাংলা ছবি দেখেন ? উত্তরটা এরকম আসতে পারেঃ সুস্থ ধারার চলচ্চিত্র হলে দেখি। সুস্থ ধারার চলচ্চিত্র কী জিনিস ? বিরাট অংশের মতামত আসতে পারেঃ যে ছবিতে উদ্ভট ধনী-গরিবের প্রেম নেই, চৌধুরী সাহেবরা নায়কের বাবাকে হত্যা করে না, উড়াধুরা মারপিট থাকে না এবং মেদবহুল নায়িকার শরীর দেখানো চাকভুম চাকভুম "যৌবন আমার লাল টমেটো" টাইপ মাথা খারাপ করা গান থাকে না। এই সামান্য কয়েকটা অবাস্তব বিষয় বাদ দিলেই কিন্তু বাংলা চলচ্চিত্র দেখতে সিনেমা হলে প্রচুর মানুষ আসে। একটা সিনেমার কাছ থেকে আমাদের বাঙালির চাহিদা খুবই কম। মনপুরার মত অতি সাধারণ ছবি দেশে যখন মারকাটারি ব্যবসা করে, বিষয়টা তখন পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়।

যাই হোক, গতানুগতিক "তোর ঘরে কি মা-বোন নেই" জাতীয় গল্পের বাইরে টুকটুক করে সুস্থ ধারার চলচ্চিত্র কিন্তু দেশে কম হলো না। কতটুকু এগিয়েছে এর মধ্যে আমাদের ছবিগুলো ? এই কয়দিনে ফিল্ম লাইনে আমাদের অর্জন কতটুকু হলো ? সময় সম্ভবত এসে গেছে এসব বিষয় বিবেচনা করে দেখার। আমাদের সমাজস্বীকৃত মাপকাঠি অনুযায়ী একটা সুস্থ ধারার ছবি মুক্তি পেয়েছে এই কোরবানির ঈদে। সেই ছবিটা নিয়েই আলোচনা করা যাক। আলোচনা ডিটেইল হবে, যারা পড়বেন তাদের একটু ধৈর্য্য রাখতে হবে।

রেডি ? শুরু করি তাহলে। ছবির নাম প্রজাপতি। পরিচালক মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজ। মিউজিক হাবীবের করা, ক্যামেরাতে খায়ের খন্দকার। অভিনয়ে মোশাররফ করিম, জাহিদ হাসান, মৌসুমী, সোহেল খান, কচি খন্দকার প্রমুখ।

ছবির পরিচালক মোস্তফা কামাল রাজ হচ্ছে মোস্তফা সারোয়ার ফারুকীর ভাই-বেরাদার গ্রুপের ছেলে। ফারুকী গ্রুপের যে জনপ্রিয়তা ছিলো, সেটা ধ্বংসের জন্য আমি এই লোককে দায়ী করবো। একটার পর একটা মিনিংলেস এক ঘন্টার নাটক আর গোটা দুয়েক ফাউল সিরিয়াল করেছে এই রাজ। তার বক্তব্য অনুযায়ী, নাটক বানিয়ে সে হাত পাকিয়েছে এবং তার পরে এসেছে ফিল্ম লাইনে। অতীত যাই হোক, বর্তমানে আসা যাক।

ছবির গল্পটার আউটলাইন হচ্ছে এরকমঃ জাহিদ হাসান পাঁড় জুয়াড়ি, যে কোনওদিনই জুয়াতে জেতে না। তার বউ মৌসুমী একটা চাকরি করে, স্বামীকে সে কয়েকবার আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে টাকা এনে দিয়েছে ব্যবসা করার জন্য, কিন্তু জুয়ার নেশায় জাহিদ সব খুইয়েছে। মোশাররফ বিশাল বড়লোক, বাবা-মা নেই। থাকে একমাত্র ভাইয়ের সাথে। দিনরাত পাগলামো করে এবং মদ খায়।

একদিন জাহিদের পরিচয় হয় মোশাররফের সাথে। জাহিদের অভ্যাস হচ্ছে, টাকা না থাকলে সে পথে-ঘাটে কোথাও বসে কাঁঠাল পাতা তাসের মত করে ধরে নিজে-নিজেই জুয়া খেলার অভিনয় করতে থাকে। মোশাররফ তাকে বলে, জাহিদ খেলবে, টাকা যা লাগে দেবে মোশাররফ এবং সে পাশে বসে খেলা দেখবে। মোশাররফের উদ্দেশ্য পরিষ্কার হয় না, জাহিদকেও এই নিয়ে ভাবতে দেখা যায় না। এভাবে কয়েক দিনে মোশাররফের কাছ থেকে সাড়ে আর লক্ষ টাকা ধার নেয় জাহিদ।

বলে জুয়াতে জিতে ফিরিয়ে দেবে। একদিন জুয়া খেলার সময় জাহিদের হাতে ভালো কার্ড আসে। সে মোশাররফের কাছে আবার টাকা ধার চায়, মোশাররফের কাছে টাকা থাকা সত্ত্বেও সে দিতে রাজি হয় না। জুয়ার নেশায় পেয়ে বসেছে তখন জাহিদকে। হাতে ভালো কার্ড থাকায় সে ওভার কনফিডেন্ট থাকে।

সে যে কোনও মূল্যে মোশাররফের কাছ থেকে টাকা চায়। এখানে সামান্য টুইস্ট, মহাভারত থেকে বিষয়টা ইন্সপায়ার্ড হতে পারে। মোশাররফের সাথে জাহিদের চুক্তি হয়, জাহিদ যদি হেরে যায়, তাহলে জাহিদ নিজের স্ত্রী, মোশাররফকে দিয়ে দেবে। শুরু হয় খেলা। এখন কি জাহিদ জিতবে ? না হারবে ? যদি হারে তাহলে কী হবে ? এই হচ্ছে গল্প।

ছবি দেখতে বসলে আমরা ছবির চরিত্রগুলোর একটা সুন্দর এন্ট্রি আশা করি। নায়ক নায়িকার ফার্স্ট লুক ছবির সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি করে দেয়। কিন্তু মোশাররফ করিম আর মৌসুমীর এন্ট্রির প্রতি পরিচালক কোনও গুরুত্বই দেননি। ছবির শুরুতেই নায়ক মোশাররফ একজন টুয়েন্টি ফোর সেভেন ম্যানের মত সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে থাকে। এটা কি ছবি দেখতে আসা মানুষকে আশাহত করে না ? তাকা দিয়ে টিকিট কেটে মানুষ নায়ককে দেখতে আসে, কোনও রাম-শাম-যদু-মধু-কদুকে দেখতে আসে না।

সেই তুলনায় জাহিদ হাসানের এন্ট্রিটা ফাটাফাটি হয়েছে। চেহারায় খোঁচা-খোঁচা দাড়ি, মুখে সিগারেট, হাতে তাস আর জাংক জুয়েলারির সাথে জাহিদকে সাঙ্ঘাতিক দেখাচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো কোনও মাস্তান জাতীয় চরিত্র করতে যাচ্ছেন জাহিদ, পরে ধারণাটা যদিও ভেঙে যায়। ছবির শুরুর আধা ঘন্টা মোশাররফের পাগলামি আর জাহিদের জুয়া খেলা দেখানোতেই যায়, কাহিনী এগোতে শুরু করে এরপর থেকে। আমি মিডিয়া লাইনের খবরাখবর মোটামুটি রাখি।

ফিল্মের ক্যামেরাম্যান হচ্ছেন খায়ের খন্দকার। খায়ের এক্সপার্ট ক্যামেরাম্যান। মিডিয়াতে কিছু ক্যামেরাম্যান আছেন, এদের নিলে টেকনিকাল কাজ নিয়ে পরিচালককে কোনও টেনশন নিতে হয় না। কোন অ্যাঙ্গেল থেকে শট নিতে হবে, কতটুকু নিতে হবে, লাইটিংটা কেমন হতে হবে - এসব ক্যামেরাম্যানরাই সামলে নেন। এমন ক্যামেরাম্যানদের তালিকায় আছেন অপু রোজারিও, রাশেদ হাসান, কামরুল হাসান খসরু, রায়হান খান এবং খায়ের খন্দকার।

রাজের নাটকগুলো দেখলে বোঝা যায়, টেকনিকাল সাইড সম্পর্কে সে কিছুই জানে না। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে কীভাবে যে ক্যামেরাম্যানকেও ডিরেকশন দেয়ার একটা ব্যাপার থাকে ? ক্যামেরাম্যান যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে শট নিলে ডিরেক্টরের মুন্সিয়ানা দেখানোর জায়গাটা কোথায় থাকে ? এই ফিল্মেও তাই দেখা গেলো। খায়ের খন্দকার যথেষ্টই ভালো করেছেন ক্যামেরার কাজ, কিন্তু লাইটিংয়ে করে ফেলেছেন সমস্যা। ফিল্মের লাইটিং দেখে মনে হয় টিভি নাটক দেখছি। লাইটিং ফিল্মে বিশাল গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।

একটা মানুষ দুই ঘন্টা বসে ছবি দেখবে, তার চোখটাকে আরাম না দিলে সে ছবি দেখে শান্তি পাবে কীভাবে ? আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমাদের দেশে নাটক-সিনেমা, কোনও জায়গাতেই লাইট ডিরেক্টর নামে কেউ থাকে না। ডিরেক্টর ভালো হলে লাইটে কিছু পরিবর্তন আনেন। তা না হলে ক্যামেরাম্যান আর লাইট সাপ্লাই কোম্পানির ছেলেরা মিলে যে জগাখিচুড়ি পাকায়, তাই দিয়েই চলতে থাকে। উদাহরণ দিতে পারি আমি সঞ্জয় লীলা বানসালির ছবিগুলোর, বিশেষ করে সাওয়ারিয়া আর গুজারিশ। লাইটিং দিয়েই যে একটা ছবির দৃশ্যগুলোকে শিল্পের স্তরে ওঠানো যায়, মানুষের চোখকে সুন্দর কিছু সময় উপহার দেয়া যায়, সেটা এই ছবিগুলো খুব ভালোভাবে প্রমাণ করেছে।

ছবির এডিটিং করেছেন জাহাঙ্গীর হোসেন এবং ফরহাদ আহমেদ। এডিটিং ছবির প্রথমদিকে একদমই ভালো হয়নি, দৃশ্যগুলো লাফিয়ে লাফিয়ে পার হয়েছে। পরে গিয়ে অবশ্য ভালো এডিটিং দেখা গেছে। এই হচ্ছে মোটামুটি টেকনিকাল সাইডের কথাবার্তা। আসা যাক চলচ্চিত্রের পর্দার ভেতরে।

ফারুকী গ্রুপের কোনও কাজের আলোচনায় যে বিষয়টা অবধারিতভাবে চলে আসে, সেটা হচ্ছে ভাষার ব্যবহার। ফারুকী গ্রুপ তাদের কাজ বাস্তবসম্মত করার জন্য শুদ্ধ ভাষার জায়গায় মানুষের সাধারণ মৌখিক ভাষাটা ব্যবহার করে থাকে। এখানেই হয়ে গেছে সমস্যা। আমরা জানি যে, ভাই-বেরাদারদের নাটকের স্ক্রিপ্ট থাকে না, পরিচালকের মাথায় থাকে পুরো আইডিয়া। তিনি অভিনেতাকে দৃশ্য বুঝিয়ে দেন, অভিনেতা তার নিজের মত করে অভিনয় করে।

এই স্বাধীনতাটা একদিক দিয়ে ভালো। কিন্তু আরেকদিক দিয়ে ক্ষতি করে ফেলেছে। এখন প্রচুর অভিনেতা সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন তার ল্যাঙ্গুয়েজ ডেলিভারি নিয়ে। যার কারণে দেখা যায়, নাটকের এক দৃশ্যে যে অভিনেতা বলছেন, "যেতে যেতে পথে হলো দেরি", তিনিই আরেক দৃশ্যে বলছেন, "যাইতে যাইতে রাস্তায় হয়া গেলো দেরি"। বিষয়টা তখন খাপছাড়া-খাপছাড়া লাগে।

এইযে সিদ্ধান্তহীনতাটা ফারুকী গ্রুপ তৈরি করে দিয়েছে, এটা ভাঙতে অনেক সময় লাগবে বলেই আমার মনে হয়। কারণ, আজকাল অনেক সনাতনী পরিচালক বাস্তবসম্মত নাটক বানানোর জন্য ফারুকীকে অনুসরণ ( বা অনুকরণ ) করছে। কিন্তু স্ক্রিপ্টের নাটকীয়তা রয়ে যাওয়ার ফলে শিল্পীরা সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না যে, কীভাবে ডায়লগটা দেয়া উচিত। একই সমস্যায় পড়েছেন নায়িকা মৌসুমী। এক জায়গায় তিনি ডায়লগ দিচ্ছেন, "আমার হাতটা একটু ধরবা ?" আরেক জায়গায় বলছেন, "তুমি কি রাতে খাবে না ?" তথৈবচ অবস্থা জাহিদ হাসানের এবং মোশাররফের ভাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করা অভিনেতার।

যেখানে যা প্রয়োজন ঠিক সেইমত ডায়লগ দিয়ে গেছেন মোশাররফ, কচি খন্দকার এবং সোহেল খান। ছোট ক্যারেক্টার হলেও কচি খন্দরকার-সোহেল খানরা অভিনয় ভালো করেছেন। মন ভরিয়ে দেয় মোশাররফের অভিনয়। বিশেষ করে জুয়ার টেবিলে বারবার হারার পরেও যখন তিনি জাহিদ হাসানকে খেলে যেতে ইঙ্গিত দেন, সেই জায়গাটার এক্সপ্রেশনগুলোতে মোশাররফ একদম ফাটিয়ে দিয়েছেন। এক্সপ্রেশনের দিক দিয়ে মোশাররফের মধ্যে হুমায়ুন ফরিদীর ছায়া দেখা যায়।

আমার ধারণা, অনেক দূর যাবেন এই অভিনেতা। লম্বা রেসের ঘোড়ার এই মোশাররফ, আমাদের পরিচালকদের অনেকেই যদিও তার পূর্ণ অপব্যবহার করে থাকেন। একটা ব্যাপার হয়তো অনেকেই খেয়াল করে থাকবেন। মৌসুমীর প্রাইম টাইমে তার সৌন্দর্যটা বোঝা যায়নি। বলতেই হচ্ছে, আজকাল এই নায়িকা এতই সুন্দরী হয়েছেন, যে বারবার দেখতে ইচ্ছা করে।

ঠিক বিপরীত হয়েছেন তার হাসবেন্ড ওমর সানী, এই ছবির পরিবেশক। দিনদিন তিনি দেখতে ভোম্বল থেকে ভোম্বলতর হচ্ছেন। বাংলা ছবির নায়িকাদের স্থূল দেহগঠন নিয়ে আমাদের আফসোসটা অনেক পুরনো। একটু মেদ সচেতন কেন হননা নায়িকারা ? কী এমন সমস্যা হয় একটা ছবির খাতিরে ফিগারটা একটু মেইনটেইন করলে ? আপনি যদি সুন্দর হন, তাহলে আপনার ছবি দেখতে লোক আসবে, নাকী যদি দেখতে আটার বস্তার মত হন তাহলে লোক আসবে ? এই সাধারণ ব্যাপারটা মাথায় ঢোকে না ? জাহিদ হাসানের চরিত্র অনুযায়ী অভিনয় খারাপ করেননি, তবে আজকাল তার কমেডি জমছে না। কাতুকুতু দিয়ে লোক হাসানো হয়তো হুমায়ুন আহমেদের স্বর্ণযুগের "আজ রবিবার" নাটকের সময় চলতো, কিন্তু আজকাল লোক হাসাতে গেলে হাই-ভোল্টেজ পাঞ্চ মারতে হয়।

সেই জায়গাটায় জাহিদ হাসান ঠিক জমাতে পারেননি। বেশ কিছু দৃশ্যে তার অভিনয়, অতি-অভিনয় এবং ভাঁড়ামো বলে মনে হয়েছে। গানের দৃশ্য চিত্রায়নে মৌসুমীর সাথে জাহিদ হাসান। এটা কেমন কম্বিনেশন হলো ? প্রেমের গানের চিত্রায়নের সাথে নায়িকা হিসেবে মৌসুমী মিলে যায়, কিন্তু জাহিদের মত কৌতুকাভিনেতা গোত্রীয় লোককে সেখানে নায়ক হিসেবে রেখে পরিচালক সাহেব দর্শকদের সাথে কৌতুক করলেন কীনা, সেটা বোঝা গেলো না। ছবিতে প্রেমের গান যেগুলো আছে, সেগুলো না রাখলেও কোনও ক্ষতি ছিলো না, ছবি যা আছে তাই থেকে যেতো।

পরিচালকদের ভেবে দেখা দরকার, এটা কোন ধরনের কনসেপ্টের ওপর দিয়ে চলছি আমরা ? ভারতীয় উপমহাদেশীয় ছবি মানে যে সেখানে নাচ-গান থাকতেই হবে, এমন কোনও কথা আছে কি ? ছবির কাহিনী গান ডিমান্ড না করলেও দিনের পর দিন আমরা অকারণে ছবির মধ্যে গান ঢোকাচ্ছি। উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক একটা শার্ট। খুবই সুন্দর শার্ট, কিন্তু আপনার গায়ে ফিট করছে না, শার্টটাতে আপনাকে দেখতে ভালো লাগছে না। তাহলে শুধু শুধু সেই শার্ট পরার কোনও মানে হয় ? ছবির গানগুলো হাবীবের কম্পোজ করা। ৬ টা গান আছে, তার মধ্যে ৪ টা গান হাবীবের নিজের ধাঁচের সফট মেলোডিয়াস গান।

এই গানগুলো গেয়েছে হাবীব, বালাম, ন্যান্সি আর কণা। প্রশংসা করতেই হয় ন্যান্সির চমৎকার মিষ্টি গলার, দু'দিকেই বসবাস গানটা সে গেয়েছেও অসাধারণ। এই মেয়েটাকে আরও ভালোভাবে ব্যবহার করা দরকার। কণাও ভালো গেয়েছে। তবে হাবীব আর বালামের গলা শুনলেই বোঝা যায়, ইহা ভোকর্ডার প্রযুক্তির অবদান।

এদের নাক-সর্বস্ব গলাও যখন প্রযুক্তির আশীর্বাদে কানে মধুবর্ষণ করে, তখন প্রযুক্তির এক গালে চুমু খেয়ে আরেক গালে ঠাস করে চড় মারতে ইচ্ছা করে। ৫ নাম্বার গানটা কুমার বিশ্বজিতের গাওয়া, সম্ভবত ছবির বেস্ট গান এটাই। তবে হাবীবের আরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন। গানের মিউজিকে একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। শিং থাকলেই গুঁতো দিতে নেই।

চোদ্দ রকম ইলেক্ট্রনিক মিউজিকের ব্যবহার জানা মানেই এই নয় যে, যাবতীয় ঝানাক-পাটাক প্রত্যেকটা গানের মধ্যে ভরে দিতে হবে। তৌসিফ, অর্ণবদের গানগুলো শুনে দেখেন হাবীব, পরিমিতিবোধ বলে একটা ব্যাপার আছে। সেটা থাকাটা খুব দরকার, অন্তত বাংলাদেশের হাইয়েস্ট পেইড মিউজিশিয়ানের জন্য তো অবশ্যই। সাধারণত হাবীবের গানের কথা লিখে থাকেন সাকী আহমেদ আর সুস্মিতা বিশ্বাস সাথী, সম্ভবত এবার কবির বকুলও লিখেছেন। মেলোডিয়াস গানের জন্য লিরিক ভালোই লিখেছেন তারা, কিন্তু ৬ নম্বর গান "টাকা", টুইস্ট এখানেই।

গানটা গেয়েছেন সিঁথি সাহা ও ফেরদৌস ওয়াহিদ। গানের কথাগুলো এরকমঃ ফেরদৌস ওয়াহিদ ভার্সঃ "Money money, brighter than sunset Money money, sweeter than honey" সিঁথি সাহা ভার্সঃ "টাকার প্রেমে পড়ি আমি মনের প্রেমে নয় টাকার মানুষ আমার প্রিয় মনের মানুষ নয় চাইরে টাকা, আরে শাকালাকা। " কথাগুলো শুনে মনে হতে পারে, চিরাচরিত ডিপজল গোত্রীয় বাংলা ছবির অশ্লীল ঝাকানাকা শুরু হতে যাচ্ছে। উঁহু, ধারণা ভুল। মিউজিকে হাবিব আছে, খুব খিয়াল কৈরা ! গানটা RNB (রিদম অ্যান্ড ব্লুজ) ধাঁচের, ব্যবহার করা হয়েছে ক্লাবের ভেতরে জুয়া খেলার সময়।

অ্যাপ্লিকেশন ঠিকঠাক, মদ-জুয়ার ক্লাবে রিদম অ্যান্ড ব্লুজ বা র‍্যাপ ধাঁচের গানই চলে সাধারণত। যাই হোক, এই গানের চিত্রায়ন হিসেবে আমরা কেমন দৃশ্য ভিজুয়ালাইজ করতে পারি ? মনে হতে পারে, কোনও আইটেম গার্ল নেচে নেচে গান গাইছে ক্লাবের ভেতরে, আর কোনও গ্যাংস্টার বা ডন জাতীয় লোক ফেরদৌস ওয়াহিদের লাইনগুলো আয়েশ করে গাইছে। কিন্তু তেমন তো দেখা গেলো না। এখানে একটা আইটেম নাচ হতে পারতো, কিন্তু পরিচালক সুযোগটা ব্যবহার করতে পারেননি। গানটা ছবিতে কে গাইছে সেটাও পরিষ্কার না, ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে শোনা যাচ্ছে শুধু।

পর্দায় দেখা গেছে জুয়াড়িরা একের পর এক সিগারেট খেয়ে যাচ্ছেন গানের সাথে। চটুল ঢংয়ের একটা ভালো মিউজিক ভিডিও হতে পারতো, যা ছবির প্রচারেও ব্যবহার করা যেতো। পরিচালক সম্ভবত দর্শকের কথা মাথায় রেখে ভেবেছিলেন, দুষ্টু গান ঢোকালে তার ছবি থেকে "সুস্থ ধারার ছবি" তকমাটা চলে যাবে। এই মানসিকতা পরিবর্তিত হওয়া প্রয়োজন। চটুলতা আর অশ্লীলতা এক বিষয় নয়, সেটা বাংলাদেশের পরিচালক-দর্শকদের বুঝতে আরও সময় লাগবে।

এভাবেই আস্তে আস্তে চলতে থাকে ছবি। বাংলা ছবিতে সাধারণত হুট করে ইন্টারভ্যাল দেয়া হয়, এই ছবিতে হয়নি। দুই ঘন্টার ছবি, কাহিনীতে অর্ধেক সময় ধরে প্যাঁচ লাগানো হয়েছে, আর বাকি অর্ধেক সময় প্যাঁচটা খোলার চেষ্টা করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত দর্শকদের হাতে সিদ্ধান্তের দায়ভার দিয়ে দায়সারাভাবে ছবিটা শেষ করেছেন। একদম শেষে দুই লাইনের প্রবাদ কবিতা দিয়ে পরিচালক যে ম্যাসেজটা দিতে চাইলেন, সেটাও ঠিক মেলেনি কনসেপ্টের সাথে।

ছবির শেষ দৃশ্যে দেখা যায়, বয়স্ক মৌসুমী গ্রামের বাচ্চাদের পড়াচ্ছেন। কেন পড়াচ্ছেন ? যুক্তি কী ? যিনি একটা চাকরি করতেন, তার হঠাৎ গ্রামে গিয়ে সমাজ সেবা করার করার দরকার পড়লো কেন ? এরকম আরও কয়েকটা লজিকাল ভুল ধরা যেতে পারে ছবিটাতেঃ ১। মা-বাবা বহু আগে মারা গেছেন, তাহলে মোশাররফ এত বড়লোক কীভাবে হলো ? তার পেশা কী ? পৈত্রিক সূত্রে সে বড়লোকই যদি হতো, তাহলে মৌসুমীর ফ্যামিলি জাহিদ হাসানের মত ছেলের সাথে মৌসুমীকে বিয়ে দিলো কেন ? ২। মোশাররফ ভদকা খেয়ে মাতলামো করে, অথচ দেখা যাচ্ছে তার সামনে রাখা ভদকার বোতল প্রায় ভরা। মাতলামি করার জন্য বেশ ভালো পরিমাণ ভদকা খেতে হয়।

তাহলে মোশাররফের আচরণটা মাতলামো না ইচ্ছাকৃত ? ৩। জাহিদ হাসান-মৌসুমী দম্পতির কোনও সন্তান নেই কেন ? জাহিদ-মৌসুমী দু'জনের কেউই এমন কিছু ইয়াং নন। বাচ্চা যদি না হয়, তবে তা নিয়ে তারা চিন্তিত নন কেন ? ( এটার একটা ব্যাখ্যা এরকম হতে পারেঃ মৌসুমীর বিয়েপূর্ব সম্পর্কটা বিয়ের কারণে ভাঙে। সেই পুরনো সম্পর্কটা বিয়ের পরে নতুন করে জোড়া লাগানোর সম্ভাব্যতার ক্ষেত্রে মৌসুমীকে একটু ভার্জিন-ভার্জিন ফ্লেভারের মধ্যে রাখা আবশ্যক। তার ওপর বিয়ে পরবর্তী সম্পর্কের ক্ষেত্রে সন্তান একটা বাধা, সেজন্য সম্ভবত পরিচালক ইচ্ছা করেই তা রাখেননি।

ফলে রাস্তা ক্লিয়ার থেকেছে। ) ৪। মৌসুমী কী এমন চাকরি করে যে এত আলিশান বাসায় থাকে ? চাকরিই যদি করে, তাহলে ঠিকঠাক তাকে অফিসে যেতে দেখা যায় না কেন ? ৫। বাড়িওয়ালা কচি খন্দকার পার্ভার্ট হওয়ার পরেও মৌসুমী জাহিদকে কেন বিষয়টা জানায় না ? ( কচি খন্দকারের চরিত্রটা না থাকলেও কোনও সমস্যা ছিলো কি ? টেলিফিল্ম জাতিয় গল্পকে চুইংগামের মত টেনে ভেতরে অবান্তর বিষয় ঢুকিয়ে সিনেমা বানানোর প্রচেষ্টা এটা। ) ৬।

বাড়িওয়ালা পার্ভার্ট, তাহলে জাহিদ-মৌসুমী দম্পতি বাসা পাল্টায় না কেন ? ওই বাসাতেই থাকতে হবে, এমন কোনও কথা তো নেই। বাংলাদেশে ছবি নির্মাণের এটা একটা বিরাট সুবিধা। মানুষ ছবির এত প্যাঁচ বোঝে না, ভালো ছবি এই দেশের মানুষ দেখেছেই কম। তাই চালে-ডালে মিশিয়ে মোটামুটি সুস্বাদু একটা খিচুড়ি বানিয়ে দিলেই হলো। ছবির পরিপূর্ণ ব্যবচ্ছেদ এখানে হয়না।

চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের চলচ্চিত্র সমালোচনা করার অভ্যাস নেই, করলেও তার প্রকাশ পত্র-পত্রিকায় প্রায় দেখাই যায় না। চলচ্চিত্র পরিচালকদের মধ্যে কেউ কেউ পত্র-পত্রিকায় মাঝে মাঝে অন্যান্য ছবির সমালোচনার নামে যা করেন, তা হচ্ছে তৈলমর্দন। সমালোচনা তারা করেন না এই ভয়ে যে, যদি বাজারের সবার সাথে তার ব্যক্তিসম্পর্ক খারাপ হয়ে যায় ! এই সমালোচকদের মুখে ছাই দিয়ে প্রজাপতি ধুন্ধুমার ব্যবসা করছে। মুক্তি পেয়েছে মাত্র দুটো হলে, বলাকা আর স্টার সিনেপ্লেক্সে। মুক্তির প্রথম এক সপ্তাহ দুটোই হাউজফুল চলেছে।

গানগুলোও বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বোঝা যায়, দেশের মানুষ সহজ বিনোদনের জন্য এখনও হলে গিয়ে ছবি দেখতে চায়। গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে মোটামুটি কিছু একটাও যদি বানানো যায়, তাও দর্শক দেখবে, দেখবেই। তবে যেহেতু পরিচালকের প্রথম পরিচালনা, তাই এগুলোতে ছোট-খাটো ভুল-ত্রুটি থাকতেই পারে। আরও হাত পাকাতে হবে মুস্তফা কামাল রাজকে, গল্পে আনতে হবে আরও অনেক-অনেক বৈচিত্র।

সব মিলিয়ে ছবিটা এমন কিছু ভাল হয়নি, আবার খুব যে খারাপ হয়েছে তাও না। কম বাজেটের ছবি। এক প্যাকেট পপকর্ণ আর এক কাপ কফি নিয়ে সিনেমা হলে বসেন, সময় কেটে যাবে। আক্ষেপ একটাই, চলচ্চিত্র যেখানে "শিল্প", সেখানে এই ছবিটা নতুন কিছু যোগ করতে পারেনি, শুধু সময় কাটানো বিনোদনের খোরাক হয়ে রয়ে গেছে।  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.