আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রাশিয়ার চিঠিঃ দ্বিতীয় পত্র (ভ্রমণ কাহিনী)

ভ্রমণ কাহিনী লিখিতে বসিয়াছি। নাম যা দিয়াছি আমার নিজের কাছেই একটু অদ্ভুত ঠেকে বৈকি। রাশিয়ার চিঠিঃ দ্বিতীয় পত্র। কিন্তু কি করিব প্রথম পত্র যে রবি ঠাকুর বহু আগেই লিখিয়া রাখিয়াছেন। তাই দ্বিতীয় পত্রের দিকে মনোযোগী হইলাম।

যদিও রবি ঠাকুর তাঁহার রাশিয়ার চিঠি তে ভ্রমণের দিকে নজর না দিয়া ওই সময়কার রাশিয়ার সহিত, ভারত বর্ষের তুলনাতেই বেশি ব্যস্ত সময় কাটাইয়াছেন। তাই আমি আর ওই দিকে যাইব না। রুশ সরকারের বৃত্তি লইয়া যে যাত্রা শুরু করিলাম তাহাই মূলত দেশের বাইরে আমার প্রথম যাত্রা। সেই সুবাদে ছোট বেলা হইতেই বিমানে চড়িবার যে সুপ্ত বাসনা মনের কোন এক কোণে লুকাইয়া ছিল তা ও মিটিল। সঙ্গী বলিতে বাক্স পেটরা আর আমার মতোই বৃত্তি প্রাপ্ত বন্ধু গন।

আমাদের বিমান বন্দর নামক নাট্য মঞ্চে অনেক চরাই উতরাই পার করিয়া যখন বিমানে উঠিলাম তখন আর বিমান লইয়া ছোট বেলার রোমাঞ্চ কাজ করিল না। তার চেয়ে বরং নেটওয়ার্ক ধরিয়া রাখার দিকেই বেশি মনোযোগী হইয়া পরিলাম। এত কথা বলিয়া আসিয়াও বিমানে উঠিয়া মনে হইল কত কি জানি বাকি ছিল বলিবার। হুঁশ ফিরিল বিমান বালার অনুরোধে। বাধ্য হইয়া মোবাইল নামক যন্ত্রের গলা টিপিয়া ধরিতে হইল।

এখানে একটু বলিয়া রাখা বাঞ্ছনীয় যে ফেয়ার এন্ড লাভলী এর বিজ্ঞাপন দেখিতে দেখিতে বিমান বালা সম্পর্কে যে কৌতূহল সৃষ্টি হইয়া ছিল তাও প্রথম বারের মতো মিটাইয়া লইলাম এই যাত্রায়। এর পর দিক নির্দেশনা অনুযায়ী নিজেকে কষিয়া বাধিয়া লইলাম বিমানের আসনের সহিত। প্রথম বার তো অবজ্ঞা করিবার মতো সাহস হইল না। ততক্ষনে উপলব্ধি করিলাম যে বেশ একটা হোমরা চোমরা ভাব নিজের মধ্যে আসিয়া পরিয়াছে। এর পর আর বিমানের ভেতরকার বর্ণনা বাড়াইব না।

একটু খানি বলিয়া রাখি প্রথম বিমান যাত্রা হিসাবে আমার বন্ধু মহলে বিমানের ভাড়া উসুলের অঘোষিত প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা গিয়াছিল এবং তা শেষ পর্যন্ত মদ গ্রহণ অব্দি গড়াইয়াছিল। যাহার ফল অবশ্য খুব একটা ভালো হয় নাই। সে অভিজ্ঞতা আরেক দিন তুলিয়া ধরিব। জি পি এস নামক যন্ত্রের পর্দায় চোখ রাখিতে রাখিতে এক সময় বুঝিলাম আমাদের ট্রানজিটের সময় হইয়া গিয়াছে। কাঁচের জানালা দিয়া অবলকন করিয়া যাহা দেখিলাম মাথা ঘুরাইবার জন্য যথেষ্ট।

পুস্তকের জ্ঞান হইতে আরব দেশ সম্পর্কে আমার যে ধারনা ছিল তা নিমিষেই উবিয়া গেলো। অবাক বিস্ময় লইয়া দেখিলাম দোহা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। বালুর বুকে যেন এক খণ্ড ডিজিটাল স্বর্গ। আমি ভাষাটা এইভাবেই ব্যাবহার করিলাম। ওই বিমান বন্দরে দেখিলাম ভারতীয়, পাকিস্তানি, নেপালি অনেকেই কাজ করিতেছে।

কিন্তু বাঙ্গালী খুজিয়া পাইলাম না। যাই হোক যাত্রা বিরতি দিয়া আবার বিমানে চাপিলাম। এইবারে বিমানের সহিত যাত্রী ও বেমালুম পরিবর্তন হইয়া গেলো রহিয়া গেলাম শুধু আমরা বন্ধুরা। যাত্রী যা দেখিলাম তাতে মনের ভাব যে কি রুপ হইল তা প্রকাশ করিতে পারিব বইলা বোধ হয় না। এত এত সাদা চামড়া তাহার সহিত সল্প বসন ধাঁধায় পরিয়া গেলাম।

কিন্তু আমার পাশের যাত্রী আবার গাত্র বর্ণে এই পরিবেশে পুরাই বিপরীত। তাহাকে ঠিকানা জিজ্ঞাসা করিতে জানিতে পারিলাম। নাইজেরিয়া, মস্কো যাওয়া সে ব্যবসার কাজে। এরপর আর তেমন কথা বার্তা জমিল না। গায়ের উপর কম্বল টানিয়া ভদ্র লোক শরীর হেলাইয়া দিলেন সিটে।

বোধ করিলাম এরকম যাওয়া আসা প্রায় করা হয়। বলিয়া রাখি আকার আকৃতিতে নাইজেরিয়ান ভদ্র লোক আমার প্রায় দিগুণই হইবে। জানালার পাশে সিট হওয়ায় আমার মনে হইল আমাকে প্রায় গিলিয়া ফেলিয়াছে ঘুমন্ত বিশাল দেহি ভদ্র লোক। নড়া চড়া করিবার কথা বেমালুম ভুলিয়া রইলাম। কেমন জানি শ্বাসরোধ শ্বাসরোধ ভাব হইতে লাগিল।

তাই বাধ্য হইয়া অপেক্ষার প্রহর গুনিতে লাগিলাম। এক সময় পৌঁছাইয়া গেলাম কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। মস্কৌ। না না মস্কো। মস্কৌ, এইভাবে তো রবি ঠাকুর লিখিয়াছেন।

মস্কো দামোদেদোভা এয়ারপোর্ট। রাত প্রায় তখন ১০ টা। বিমান মাটি ছুইবার আগে জানালা দিয়া রাতের মস্কো দেখিবার সুযোগ হইয়াছিল। চোখে যাহা পরিয়াছিল তাহাকে এই ভাবে বলা যায় বোধ করি অমাবস্যার আকাশ জুড়িয়া এক ঝাক নক্ষত্র। বিমান বন্দরের সব ভেজাল সারিয়া যখন গেইট পর্যন্ত আসিলাম দেখিলাম গায়ে গতরে নাইজেরিয়ান ভদ্র লোকের মতই এক জন রুশ ভদ্র লোক দাঁড়াইয়া আছেন হাতে আমার নাম লিখা প্ল্যাকার্ড।

তার সাথে আরও তিনজন দাঁড়াইয়া আছে আমার তিন বন্ধুর নাম লইয়া। প্রথমে একটু অবাক হইলাম। আলাদা আলাদা লোক কেন হইবে। পরে জানিতে পারলাম একেক শহরে একেক জনের ইউনিভার্সিটি হওয়ায় আলাদা আলাদা ভাবে আমাদের লইয়া যাওয়া হইবে। শেষ বারের মতো সংক্ষিপ্ত বিদায় লইয়া আমরা আলাদা হইয়া গেলাম।

বলা হয় নাই আমার ইউনিভার্সিটি হইল রোস্তভ স্টেট মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটি। এ প্রসঙ্গে বলিয়া রাখি আমাদের দেশের একমাত্র মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির বর্তমান উপাচার্য ও এই বিশ্ববিদ্যালয় হইতে চিকিৎসাবিদ্যা গ্রহণ সম্পন্ন করিয়াছেন। আমার বাক্স পেটরা সব একাই বহন করিয়া ও অনেক টা দৌড়াইতে লাগিলেন রুশ ভদ্র লোক। আমি হাত পা ঝারা অবস্থাতেও তাহার সহিত হাটিয়া পারিলাম না। অবশেষে অনেকটা পথ পারি দিয়া আমরা পৌঁছাইয়া গেলাম গাড়ি পার্কিং পর্যন্ত।

এইবার বিস্মিত হইবার পালা। এ যে রিতিমত বি এম ডব্লিউ। গুলশানে দূতাবাস পাড়ায় দুই একটা দেখিবার সুযোগ হইয়াছিল। কিন্তু আমি এখন ইহার যাত্রী হইব ভাবিতেই মনটা আনন্দে ভরিয়া উঠিল। আমাকে যে ভদ্র লোক রিসিভ করিয়াছিলেন ইংরেজিতে তাঁহার জ্ঞান ছিল প্রায় শূনের কাছা কাছি।

তাই কথা বার্তা আমাদের খুব একটা জমিল না। তবে রাস্তায় উনি আমাকে একটা ইন্সটিটিউট দেখাইয়াছিলেন। মস্কো ইন্সটিটিউট অব ফিজিক্স। মনে মনে ভাবিলাম এই সেই বিদ্যাপীঠ যাহা হইতে বহু নোবেল আসিয়াছে। শ্রদ্ধাপূর্ণ ভালো লাগায় ভরিয়া উঠিল মন।

মস্কো ইউরোপের শহর হইলেও দেখিলাম আমাদের দেশের মতই মস্কোতেও যানজট আছে। তবে পার্থক্য এই যে তাহার দীর্ঘ সুত্রিতা কম। চওড়া রাস্তার দু পাশ জুড়িয়া সবুজের সমারোহ। রঙের দিক হইতে সবুজের ঘনত্ব অবশ্য তুলনামুলুক কম মনে হইল। শীত আসিয়া পরায় বোধ করি এমনটা হইয়াছে।

অনেক টা গাড়ি পথ পাড়ি দিয়া এক সময় আসিয়া পরিলাম গন্তব্যে। রেল স্টেশন। সেও এক দেখিবার মতো জিনিস বটে। প্রযুক্তি আর ঐতিহ্যের অদ্ভুত মিশেল। শুধু ব্যাপ্তিতেই নয় বিশালতায় ও যেন দেশের নাম রাখিয়াছে।

ওই খানেই পরিচয় হইল আরও তিন ছাত্রের সাথে। ওরা ও আমার ইউনিভার্সিটিতেই যাইবে। দেশের নাম জিজ্ঞাসা করায় উত্তর যাহা জানিলাম; প্রথমে খুঁজিয়া পাইলাম না। ভৌগলিক জ্ঞান বরাবরই খুব একটা খারাপ না আমার কিন্তু বুরুন্ডি নামক দেশ প্রথম শুনিলাম। তার পর টুক টাক আলাপ চারিতা সারিয়া লইলাম।

স্টেশনে পানির পিপাসা বোধ হওয়ায় গেলাম পানি কিনিতে। এক বোতল পানির দাম মিটাইতে গিয়া স্বদেশী মুদ্রায় আমার প্রায় শ দুয়েক বের হইয়া গেলো। কি আর করা। এ যে মস্কো, ব্যয়বহুল নগরের তালিকায় যে এর নাম আছে। নির্দিষ্ট সময়ে উঠিয়া পরিলাম আমরা চার জন ট্রেনে।

একটি কামরা আমরা পাইয়াছিলাম যাহাতে চারটি বিছানার ব্যবস্থা ছিল। একটু খানি গুছাইয়া লইয়া আমি আমার নির্দিষ্ট বিছানায় শুইয়া পরিলাম। দীর্ঘ পরিভ্রমণে শরীর যে বড় ক্লান্ত। বলিয়া রাখি এখন আমার গন্তব্য রোস্তভ অন ডন শহর। মস্কো হইতে দুরত্বে প্রায় ১১০০ কিলো ।

এক দিন লাগিবে ট্রেনে। সকালে ঘুম ভাঙ্গিল চোখে সূর্য কিরন পরায়। জানালা দিয়া বাইরে তাকাইয়া দেখি যতদূর চোখ যায় শুধু মাঠ আর মাঠ। দৃষ্টি সীমা থামিল গিয়া একেবারে দিগন্তে। বহু দূরে মাঝে মধ্যে দুই একটা বাড়ী ঘর দেখা যায়।

ছাদের লাল টালি গুলা দূর হইতেও বেশ বুঝা যায়। একটা জিনিস লক্ষ্য করিলাম। ওদের এই মাঠ গুলাতে আমার দেশের মতো কোন আইল নাই। সম্ভবত সোভিয়েত আমলের কম্যুনিজমের সাক্ষী হইবে। না ও হইতে পারে।

ভ্রমণ কাহিনিতে নাকি খাবার দাবারের একটা বড় ভূমিকা থাকে। এই পর্যন্ত যা গলাধকরন করিয়াছি তাহার বর্ণনা না দেওয়াই ভালো। বিমানের খাদ্য আমার কাছে খুব একটা সুবিধের ঠেকে নাই। এইখানে একটু দেওয়া যাইতে পারে। ট্রেনে সকাল বেলা আমাদেরকে দেওয়া হইল গ্রিল করা মুরগী আর ব্রেড।

ব্রেড বলাই ভালো রুটি বলিলে এই ক্ষেত্রে ভুল হইবে। কারণ ইহা যে আসলেই ব্রেড আমার দেশের রুটি নয়। সেই সাথে দেওয়া হইল চা আর চকোলেট। এই গ্রিল চিকেনের কথা আমার অনেক দিন মনে থাকিবে। দেখিতে দেশের মতো হইলেও মশলা ছাড়া হওয়ায় তা যে কতটা অখাদ্য ছিল এই মুহূর্তে ভাষায় বর্ণনা করিতে পারিব না।

কোন মতে চা তে ব্রেড ভিজাইয়া প্রাতঃ রাশ সারিয়া লইলাম । এর পর চকোলেট লইয়া বসিলাম। পাশে দেখিলাম বুরুন্ডির ছেলেগুলা বেশ আগ্রহ লইয়া মুরগী খাইতেছে। অন্য দিকে মুখ ফিরাইয়া লইলাম। খাওয়া দাওয়া সারিয়া জানালা দিয়া অনেক্ষন দিনের রাশিয়া উপভোগ করিলাম।

ট্রেনের মৃদু কিন্তু ছন্দময় ঝাঁকুনিতে কিছুক্ষন পর দেখি চোখ মেলিয়া রাখিতে পারিতেছিনা। কাজ নাই যেহেতু আবার দিলাম ঘুম। এই ঘুমে আবার বিকেল চার টা। টয়লেটে গিয়া ফ্রেশ ট্রেশ হইয়া আসিয়া খাওয়া দাওয়া সারিলাম। তারপর বুরুন্ডিয়ানদের সাথে আড্ডা দিতে লাগিলাম।

জানিতে পারিলাম ওরা তিনজন ওদের দেশের এই ব্যাচের নাকি সবচেয়ে মেধাবী সকল। বলিয়া রাখি সেই সোভিয়েত আমল হইতেই আফ্রিকানদের আবার রাশিয়া প্রীতি দেখিবার মতো। শুনিলাম আফ্রিকার অনেক হোমরা চোমরাই নাকি রাশিয়া ফেরত, তা সে লোকালই হোক আর পলিটিকালই হোক। আমাদের এই লক্ষহীন আড্ডা চলিতে থাকিল গন্তব্যে পৌঁছা পর্যন্ত। ততক্ষনে অনেক কিছু জানিলাম; অনেক কিছু জানাইলাম ও।

বেশ মধুর একটা সময় কাটিল। রাত প্রায় বারোটার দিকে আমরা পৌঁছাইয়া গেলাম রোস্তভ স্টেশনে। দেখি আমাকে রিসিভ করিবার জন্য দুই বাঙ্গালী ভাই দাঁড়াইয়া আছে। এই চব্বিশ ঘণ্টাতেই কেমন জানি হাপাইয়া উঠিয়াছিলাম। বাংলা বলতে পারি নাই বলিয়া।

তাদের সহিত বাংলায় কথা বলিয়া যেন ধরে প্রান ফিরিয়া পাইলাম। এরপর আমরা ট্যাক্সি লইয়া রওনা হইলাম ভার্সিটির হলের উদ্দেশে। অনেক বলিবার ছিল কিন্তু বলিতে পারিলাম না। তবে শেষ মেষ ওই সময়ে আমার মনে যা ছিল তা বলিবার লোভ সামলাইতে পারিতেছি না। তখন মনের ভেতর কেবলই বাজিতে ছিল; আসিয়া পরিলাম, অবশেষে আমি আসিয়া পরিলাম গোর্কি তলস্তয়ের দেশে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.