আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গোলাপ কাঁটা

আমি অনেক আগে নাগরিক এর একটা মঞ্চ নাটক দেখেছিলাম 'ঈর্ষা' । মাত্র তিন জন পাত্র-পাত্রী । জামাল উদ্দিন হোসেন,সারা জাকের ও খালেদ খান । মাত্র তিনজন অভিনেতা অভিনেত্রী ও এত বড় বড় সংলাপ হওয়া সত্ত্বেও অসাধারন একটা নাটক । না দেখলে বোঝা যাবে না যে কত সুন্দর হতে পারে মঞ্চ নাটক ।

প্রেম জীবনে ঈর্ষা যে তীব্র অনুভূতি'র,সেটা আমি টের পেলাম তখনই আমার এক বন্ধু'র একদিন,এক বৃষ্টি রেণু দিনে । ঘটনার পাত্র পাত্রী তিন জন । দুজন মেয়ে ও একজন ছেলে । প্রিয় পাঠক,মুহূর্তেই ত্রিভুজ আকৃতির কিছু ভেবে বসবেন না । এ তিন জনই আমার খুব কাছের মানুষ,প্রিয় মুখ ।

বর্তমানে সংসার ট্রেনে দূর-পাল্লা’র স্টেশন অভিমূখে । চোখের কোণে ঈগল পাখির পায়ের ছাপের মতো বয়সী মানচিত্র । পিঠে সংসারের ভারী ব্যাগ । যার সাথে যার সম্পর্ক তথাকথিত পরিণতির দিকে এগুতে পারতো,হয়নি শেষমেষ কিছুই । কালের যাত্রায় দুয়ার খোলা ধ্বনি’র মতো মিলিয়ে গেছে প্রত্যেকে নিজের গন্তব্যে ।

আমি সে সময়ে নাটক করে বেড়াই । হল জীবন শেষ । ম্যাজিস্ট্রেসী’র যোগদান পত্র পকেটে । মধ্যবিত্তীয় সুখ সুখ আমার চিবুকে । বিশ্ববিদ্যালয় থিয়েটারের ‘চিরকুমার সভা’র মহড়া চলছে,নতুন আঙ্গিকে ।

চট্টগ্রাম শহরে আমার থাকবার জায়গা নেই । এরকম একদিন উন্মূল দিনে আমার আশ্রয় মেলে অভিনেতা,নির্দেশক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কামাল উদ্দীন নীলু স্যারের বাসায় । নাজনীন ভাবী বললেন : আমাদের বাসায় এসে থাক । তুই যখন ডিসি হবি তখন তোর বাসায় গিয়ে আমরা থাকবো । কাটাকাটি ।

আমি মহা আনন্দে রাজী হয়ে যাই । সারাদিন টো টো আর বিকেল হলে চির কুমার সভা নাটকের মহড়া । সেদিন মহড়া হচ্ছিল নীলু স্যারের বাসায়,কাজীর দেউড়ীতে । সন্ধ্যা নামি নামি করছে । অংশু থোয়াই চৌধুরী মানে আমাদের অং’দা সঙ্গীত নিয়ে কাজ করছিলেন ।

হঠাৎ অং’দা আমার বন্ধু মিজানকে (চির কুমার সভা নাটকের অন্যতম কুমার) বলেন : চল মিজান,আমার বাসায়,সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালিয়ে আসি । অং’দা নীলু স্যারের পাশের ফ্ল্যাটে থাকতেন । মিজানকে নিয়ে চলে গেলেন ওনার ফ্ল্যাটে । আমার খুব রাগ হলো,আমাকে ডাকলেন না বলে । আমি তারপরও অং’দাকে বললাম “আমি আসি অং’দা” ? অং’দা কঠিন করে আমাকে নিষেধ করলেন ।

অং’দা আবার আমার বড় ভাইয়ের বন্ধু বলে আমার সাথে কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখতেন । কিছুক্ষণ পর দেখি আমাদের মিজান অল্প পান করে এসেছে । খুব ফুরফুরে । জিজ্ঞেস করলাম : কি খেলি ? : হেভী জিনিষ । চার চোয়ানী ।

দারুন । চার চোয়ানী এক ধরনের পাহাড়ী মদ । একদম টলটলে পানির মতো । অসম্ভব কড়া । চারবার ফিল্টার করা হয় বলে ওটার নাম চার চোয়ানী ।

শুনে আমার মিজানকে খুব ঈর্ষা হলো,অং’দার উপর খুব রাগ হলো । কি করা যায় ? সুযোগের অপেক্ষায় রইলাম । একটু রাত হতে এক ফাকে অং’দার বাসায় ঢুকে দেখি অং’দা বাথরুমে,গোসল করছে । পানি পড়ার শব্দ । আমি চার চোয়ানী খুঁজতে লেগে গেলাম ।

হঠাৎ আবিস্কার করি বোতল মহাশয় খাটের নীচে । কোনরকম কিছু না ভেবেই ঢক করে গিলে ফেললাম এক ঢোক । সর্বনাশ । এ দেখি আগুনের শলাকা । ভয়ংকর তীব্র ।

মনে হলো আমার বুকের ভেতর গনগনে আগুন । পুড়ে যাচ্ছে সব । আমি একসময় ভাসতে থাকি হাওয়ায় হাওয়ায়,পেঁজা তুলো’র মতো । মাথার ভেতর উড়তে থাকে নাম না জানা কবিতার দ্যোতনা,অনুরণন । নাগরিকের সেই নাটকের সংলাপ,চরিত্র আমার মাথায় খেলে যায় প্রজাপতির রেণু’র মতো ।

আমার নিজস্ব আয়নায় কেঁপে ওঠে আমার এই তিনজন বন্ধু’র মুখ । প্রিয় মুখ । সে রাতে লিখে ফেলি এই প্রিয় কবিতা । এই গোলাপ কাঁটা । গোলাপ কাঁটা আপনি যখন আমার সামনে ওর গল্প করেন,মাঝে মাঝে হো হো করে হাসেন,দেখে আমার কষ্ট হয় ।

শুনেছি এক সাথে রিক্সায় চড়ে শিল্পকলা একাডেমীতে গিয়েছেন,নাটক দেখতে । কি কান্ড ! এসব বুঝেও আপনি রিপিট করেন । হোয়াট ইজ দিজ ? সেবার পহেলা বৈশাখের আগের রাতে ওদের বাসায় প্রচুর খেয়ে এসে কি রসিয়ে রসিয়ে আমার সামনে গল্প করলেন : এ্যাত্তো বড় রুই মাছ ! মাছে বেশ তেল ছিল । মনে হয় এখনো ঠোঁটে তেল লেগে আছে । আরো ছিল বারো পদের পিঠা ।

আমি গটগট করে হেঁটে চলে আসি । আপনি একটুও ভ্রুক্ষেপ করেননি । এবার যাব না যাব না করেও আপনার বাসায় শুক্রবার সকালে গিয়ে হাজির । আপনি একটুও অবাক হোননি । নিষ্ঠুর লোকেরাই কেবল অবাক হয় না ।

আমার খুব ভাল্লেগেছে যখন দেখি-আমার দেয়া মাটির খরগোসের বাচ্চাগুলো চমৎকার সাজিয়ে রেখেছেন । এক টিন বিস্কুট কিনে দিয়েছিলাম,সব খেয়ে ফেলেছেন । রাক্ষস ! তারপর একটু শোব বলে আমার সামনে শুয়ে পড়লেন বিছানায় । আমি খানিকটা বিব্রত হচ্ছিলাম । আপনাকে খানিক শুকনো মনে হচ্ছিল ।

ইচ্ছে হচ্ছিল কপালে হাত দিয়ে দেখি,জ্বর কিনা । অমা এক সময় দেখি মৃদু নাক ডাকছেন । বাইরে বৃষ্টি । কতক্ষণ টেবিলের ওপর আপনার অনুদিত কীটস পড়ছিলাম । এক সময় বোর লাগে ।

আপনার পায়ের কাছে গুটিশুটি মেরে পড়েছিল চমৎকার এক নকশী কাঁথা । আপনার গায়ে ওটা চাপিয়ে দিলাম । হঠাৎ খেয়াল হলো-কাঁথাটা সত্যি খুব সুন্দর । কে দিল ? কে দিল আপনাকে নকশী কাঁথাটা ? নিশ্চয়ই ও । বুকের কাছে সেফটি পিন দিয়ে অভিমানটুকু আটকে রইলো ।

বাইরে তখনো বৃষ্টি,আপনি ঘুমিয়ে । আমি একটা গোলাপ কাঁটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ি । ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।