আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ড্রোন – চালক বিহীন যুদ্ধ বিমান।

প্রবাসী যখন ক্লাস সেভেন এইটে পড়ি তখন কৃত্তিবাসের রামায়ন ছিল আমার অবসরের বিনোদন। রামায়নের গল্পগুলো রুপকথার মতই সুখপাঠ্য ছিল। উড়ন্ত রথে রাবনের সীতা অপহরন, লঙ্কার যুদ্ধে রাবন পুত্র ইন্দ্রজিতের মেঘের আড়াল থেকে যুদ্ধ ইত্যাদি ঘটনা বেশ রোমাঞ্চকর মনে হত । আকাশপথে চলাচল বা যুদ্ধ সেই অতীত কাল থেকেই মানুষ চিন্তা করত। আর এখন তো যুদ্ধে জয় পরাজয়ের নির্ধারক হয়ে দাড়িয়েছে বিমান শক্তি।

১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রথম দু তিন দিনের পর যখন পাকিস্তানের বিমান বাহিনী কার্যত নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল বলা চলে তখন থেকেই পাকিস্তানীদের জন্য পরাজয় হয়ে দাড়ালো সময়ের ব্যাপার মাত্র। ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধে ১ লক্ষের ও অধিক বার বিমান হামলা চালানোর পর আমেরিকান পদাতিক বাহিনী যখন ইরাকে ঢুকল সাদ্দাম বাহিনী তখন সামান্যতম প্রতিরোধ গড়তে পারে নি। সদ্য শেষ হওয়া লিবিয়ার যুদ্ধে ও ন্যাটো বিমান আক্রমনের কারনেই গাদ্দাফীকে চলে যেতে হয়েছে। বিমান বাহিনীতে আধুনিকতম সংযোজন হল পাইলটবিহীন যুদ্ধবিমান। এই বিমানে নেই কোন পাইলট বা ক্রু।

১৯৫৯ সালে আমেরিকান বিমান বাহিনী প্রথম এই মনুষ্যবিহীন বিমান তৈরীর কাজে হাত দেয়। ১৯৬৪ সালের ভিয়েতনাম যুদ্ধে টনকিন উপসাগরে প্রথম ব্যবহার হয় এই পাইলটবিহীণ যুদ্ধবিমান। এরপর ১৯৭৩ সালে আমেরিকান সেনাবাহিনী প্রথাম স্বীকার করে ভিয়েতনাম যুদ্ধে মানুষবিহীন বিমান ব্যবহারের কথা। ১৯৭৩ সালের আরব ইজরায়েল যুদ্ধে সিরিয়ার মিসাইল ব্যাটারী যখন একের পর এক ইজরায়েলী বিমানকে ধারে কাছে ভিড়তে দিচ্ছে না তখন এই ইজরায়েলী Unmanned air vehicle (UAV) ই সিরিয়ার বিমান প্রতিরক্ষাকে সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে ইজরায়েলকে রক্ষা করেছিল। ১৯৮২ সালের লেবানন যুদ্ধে ইজরায়েল ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে এই পাইলটবিহীন বিমান।

১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধে আমেরিকান সেনাবাহিনী আরো অধিক মাত্রায় ব্যবহার করে এই পাইলটবিহীন বিমান। আফগানিস্তান যুদ্ধে “ ড্রোন” বিমান হামলা পর্বতসঙ্কুল দুর্গম গিরিপথে তালেবান যোদ্ধাদের উপর নিখুত নিশানায় হামলা চালিয়ে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ছে তালেবানদের। যতই দিন যাচ্ছে বিমান বাহিনীতে পাইলটবিহীন বিমান বেশী করে গুরুত্ব পাচ্ছে। বিভিন্ন নাম দেওয়া হয়েছে এই বিমানের Unmanned air vehicle, Unmanned aircraft system, Remotely piloted aircraft,ইত্যাদি। এই বিমান Unmanned air vehicle, বা UAV বেশী পরিচিত হলেও যেহেতু এই বিমানের সাথে, উপগ্রহ, গ্রাউন্ড স্টেশান, কম্পিউটার, ডাটা লিঙ্ক ইত্যাদি ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে একে Unmanned aircraft system বা UAS অধিক সমিচীন মনে হয়।

যুদ্ধক্ষেত্রে আক্রমনের জন্য ব্যবহ্রিত যয়ে যে চালকবিহীন বিমান তা হল unmanned combat air vehicle (UCAV) বা combat drone। প্রচলিত বিমানযুদ্ধে পাইলটের জীবনহানি বা শত্রুর হাতে বন্দী হওয়ার যে আশঙ্কা থাকে তা এড়াতেই এই পাইলটবিহীন যুদ্ধবিমান। কিন্তু পাইলটের কাজ কি এই বিমানের পক্ষে করা সম্ভব? ড্রোন শব্দের আভিধানিক অর্থ হল গুঞ্জন। এর চলার শব্দের সাথে মৌমাছির গুনগুনের মিল থাকার কারনেই এই নাম। পাইলটবিহীন বিমানকে তাদের কাজ অনুসারে ৬ ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে ১)টার্গেট বিমান ২)গোয়েন্দা বিমান ৩)আক্রমন বা কমব্যাট বিমান ৪)পরিবহন বিমান ৫)গবেষনা এবং উন্নয়ন বিমান ৬) বেসামরিক এবং বানিজ্যিক বিমান।

একটি আনম্যানড এয়ারক্রাফট সিস্টেমে যা থাকে ১) চালক বিহীন বিমান ২) গ্রাউন্ড কন্ট্রোল সিস্টেম ৩) ডাটা লিঙ্ক । চালক বিহীন বিমান থেকে তথ্য সংগ্রহ করে উপগ্রহ তা পাঠিয়ে দেয় ভূমিতে অবস্থিত রিসিভারে। রিসিভার থেকে তা যায় গ্রাউন্ড কন্ট্রোল সিস্টেমে। এই গ্রাউন্ড কন্ট্রোলে থাকেন পাইলট। কম্পিউটারের সাহায্যে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষন করে নির্দেশ দেন যা মুহুর্তের মধ্যে পৌছে যায় বিমানে এবং বিমান পাইলটের নির্দেশ পালন করে।

পুরো ঘটনাতে সময় লাগে মাত্র ২ সেকেন্ড। উদাহরনস্বরুপ বলা যেতে পারে আর,কিউ-৭ শ্যাডো চালক বিহীন চালক বিহীন বিমান সিস্টেমে থাকে ( RQ-7 Shadow UAS ) চারটে চালক বিহীন বিমান, দুটো গ্রাউন্ড কন্ট্রোল সিস্টেম( GCS), একটী ভ্রাম্যমান গ্রাউন্ড কন্ট্রোল সিস্টেম, একটি লাঞ্চার, একটি গ্রাউন্ড ডাটা টার্মিনাল( Ground Data Terminals , GDTs), যা উপগ্রহ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে, একটি দূর নিয়ন্ত্রিত ভিডিও টার্মিনাল যেখানে বসে পাইলট সমস্ত কিছু দেখতে পান এবং সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। সুবিধাঃ-১) চালকের আসনে একজন প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত পাইলটের দরকার পড়ে না। ২) মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর পরিবেশে চালক বিহীন বিমান কাজ করতে পারে। ৩) ৩০ ঘন্টা পর্যন্ত আকাশে থেকে, দিন রাত, এমনকি অন্ধকারের মধ্যেও তা কাজ করতে পারে।

৪) কুয়াশা বা মেঘের মধ্যেও সঠিকভাবে দ্রুততর সময়ে বারবার স্ক্যান করতে পারে। ৬) কোন এলাকার, মোবাইল ফোন, রেডিও বা টেলিভিশন সঙ্কেতকেও পর্যবেক্ষন করতে পারে। চালক বিহীন বিমান বেশী ব্যবহৃত হয় সামরিক ক্ষেত্রেঃ- নিরাপত্তাঃ-  নিরাপত্তা এবং নিয়ন্ত্রন  আকাশ পথে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহে।  বিমান চলাচল এবং নিরাপত্তা পর্যবেক্ষনে। যুদ্ধক্ষেত্রে সার্বিক ব্যাবস্থাপনায়।

 রাসায়নিক, জীবানু অস্ত্র , বিকিরন বা পারমানবিক ঝুকির মধ্যে ব্যবহার।  টেলিকমুনিকেশান।  গ্রাউন্ড কন্ট্রোল সিস্টেমের সাথে যোগাযোগ হারালেও চালক বিহীন বিমান স্বয়ংক্রিয়ভাবে মিশন শেষ করতে সক্ষম। অনুসন্ধান এবং উদ্ধার তৎপরতায়ঃ • পাহাড় পর্বত, মরুভূমি বা যে কোন পরিবেশে উদ্ধার ও অনুসন্ধান। • উদ্ধার সামগ্রী সরবরাহে।

• উদ্ধার এলাকা চিহ্নিত করতে পর্যবেক্ষনেঃ  জাহাজ এবং নৌ চলাচল পর্যবেক্ষনে।  বায়ু দুষন মাত্রা নির্ধারনে।  দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায়। যে সমস্ত অস্ত্র বহন করে থাকেঃ  আকাশ থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য মিসাইল  এন্টি ট্যাঙ্ক মিসাইল  আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য মিসাইল।  নিয়ন্ত্রনযোগ্য গোলা ।

ইত্যাদি ক্রুজ মিসাইল এবং চালকবিহীন বিমান এই দুই অস্ত্রই নিক্ষেপের পর তা তাদের ইচ্ছেমত গতিপথ পরিবর্তন করতে এবং সুবিধামত আঘাত হানতে পারে পার্থক্য হল মিসাইল নিজেই একটা অস্ত্র এবং আঘাত হানার পর তা ধ্বংশপ্রাপ্ত হয় কিন্তু চালক বিহীন বিমান আঘাত হেনে ফিরে আসে এবং তা বারংবার ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যেহেতু চালক থাকে না সেহেতু চালকের জন্য যে সমস্ত সুবিধা থাকা দরকার যেমন ককপিট, অক্সিজেন সিলিন্ডার, প্যারাসুট ইত্যদির ও দরকার পড়ে না। ফলে চালক বিহীন বিমান বেশী পরিমান গোলাবারুদ ,মিসাইল ইত্যাদি অস্ত্রশস্ত্র বহন করতে পারে। আকার এবং আকৃতিতে মনুষবিহীন এই বিমান বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। সবচে ছোট গুলো মাত্র কয়েক পাউন্ড ওজনের খেলনা বিমানের সমান আবার বড় গুলো বোয়িং বিমানের সমান আকারের এবং ৪০,০০০ পাউন্ড ওজনের হয়ে থাকে।

মানুষবিহীন এই বিমানকে আবার উচ্চতা, গতিবেগ এবং রেঞ্জ অনুযায়ী বিভিন্নভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে  হাতে ধরা (রেঞ্জ-২কি,মিঃ উচ্চতা ৬০০ মিটার)  কাছের(Close ) - (১৫,০০ মিটার উচ্চতা রেঞ্জ-১০কি মি)  ন্যাটো টাইপ (NATO type)- ৩,০০০ মিটার উচ্চতা এবং ৫০ কিঃমিঃ রেঞ্জ)  কৌশলগত (Tactical ) – উচ্চতা (৫,৫০০০ মিটার উচ্চতা এবং ১৬০ কিলোমিটার রেঞ্জ) মেল-MALE (medium altitude, long endurance) – ৯,০০০ মিটার উচ্চতা এবং ২০০ কিলোমিটার রেঞ্জ।  মেল HALE (high altitude, long endurance) –উচ্চতা ৯,১০০ মিটার এবং রেঞ্জ – যে কোন দুরত্ব থেকে নিয়ন্ত্রন যোগ্য।  হাইপারসনিক- HYPERSONIC উচ্চগতির সুপারসনিক গতিবেগ ১-৫ ম্যাক বা হাইপারসনিক ( ৫ম্যাক এর অতিরিক্ত গতিবেগ,১৫,০০০ মিটারের বেশী উচ্চতায় উড়তে সক্ষম- রেঞ্জ- ২০০ কিঃমী এর বেশী)  পৃথিবীর কক্ষপথে উড়তে সক্ষম এবং গতিবেগ ২৫ ম্যাক এর চেয়ে বেশী। সনিক হল যা শব্দের সমান গতির, সুপারসনিক শব্দের চেয়ে ১.২ থেকে ৫ গুন বেশী গতি সম্পন্ন, হাইপার সনিক শব্দের থেকে ৫-১০ গুন বেগ, এবং হাই হাইপারসনিক হল শব্দের চেয়ে ১০ গুনের অধিক গতিবেগ সম্পন্ন। চালক বিহীন বিমানের ব্যবহার শুরু হয়েছিল সামরিক বাহিনীতে এখন তা বেসামরিক কাজেও ব্যাবহৃত হচ্ছে।

আমেরিকাতে প্রায় ৫০ টা কোম্পানী এখন চালক বিহীন বিমান তৈরী করছে । প্রায় ১৫১ টি মডেল রয়েছে চালক বিহীন বিমানের। অবিশ্বাস্য গতিতে বাড়ছে চালক বিহীন বিমানের উৎপাদন ব্যবহার এবং সুযোগ সুবিধা ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।