আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মুহম্মদ জাফর ইকবাল

ভিনি ভিসি ভিডি অর্থাৎ তিনি এলেন, দেখলেন ও জয় করলেনঃ এক জাফর ইকবালের (সে সময়ের আধুনিকতম চিত্র নায়ক) অকাল প্রয়ানের কাছাকাছি সময়েই আর এক জাফর ইকবালের উদয় হলো বাংলার আকাশে। মুহম্মদ জাফর ইকবাল, এই নামটি জানতাম আশির দশকের শেষ ভাগেই, হুমায়ুন আহমেদের কোন এক লেখা থেকে। নব্বই দশকের মাঝামাঝি কোন এক সময়ে জানতে পারলাম প্রখ্যাত লেখক হুমায়ুন আহমেদের ভাই সুদুর আমেরিকা থেকে লোভনিয় চাকরির মায়া ত্যাগ করে বরাবরের জন্য দেশে ফিরে এসেছেন। তাঁর কিছু লেখাও পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতে শুরু করলো। মূলত এগুলি সবইছিল বৈজ্ঞানিক কল্প-কাহিনি।

বিটিভিতেও তার বৈজ্ঞানিক কল্পনা নির্ভর ধারাবাহিক নাটক প্রচার হওয়া শুরু হলো। হুমায়ুন আহমেদের ভাই বলে নয়, লেখার গুনেই তিনি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তবে পাঠকের কাছে দ্রুত পৌঁছানোর ক্ষেত্রে হুমায়ুন আহমেদের ভাই পরিচয় যে যথেষ্ট সাহায্য করেছে তা বলাই বাহুল্য। আর অবদান ছিল ভোরের কাগজ এবং প্রথম আলোর। কিভাবে তিনি জয় করলেন? দ্রুত তাঁর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকলো।

গল্পকার থেকে তিনি রূপান্তরিত হতে থাকলেন প্রবন্ধকারে। বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডে তিনি নেতৃত্বের স্থানে পৌঁছে গেলেন দ্রুত। সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসের নাম সর্বজন শ্রদ্ধেয়া শহিদ-জননি জাহানারা ইমামের নামে করার আন্দোলনে তিনি অগ্রনি ভুমিকা পালন করেন। তারপর থেকে তাঁর লেখা মূলতঃ স্বাধিনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এবং জামাত-শিবির ও বি,এন,পি'র বিপক্ষে শক্ত অবস্থান নেয়। (বি, এন, পি- কারন তারা জামাত শিবিরের পৃষ্টপোষক) ।

এছাড়াও তরুন প্রজন্মকে বিজ্ঞান মনস্ক করে গড়ে তোলার পক্ষে তিনি প্রথম আলোর সহযোগিতায় বিবিধ কর্মকান্ডে নেতৃত্বদেন। এছাড়াও বাংলাভাষাকে কম্পিউটার ও ইন্টারনেটে ব্যবহার উপযোগি করে তোলার জন্য শাবি তে গবেষনা চলছে। ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোন ব্যবহার করে ভর্তি ফরম পুরন ও ফলাফল প্রকাশে তাঁর অবদার রয়েছে। তত্বাবধায়ক সরকারের সময় তথ্য-প্রযুক্তি নীতি প্রনয়নে তাঁর বিশেষ অবদান রয়েছে। বর্তমান সরকারের শুরুর দিকে যখন জনগনকে নিত্য-নতুন চমক দেয়ায় সরকার ব্যস্ত এবং অবশেষে সময় আগিয়ে-পিছিয়ে এক মহা লেজে গোবরে অবস্থা, ঠিক তখন জাফর ইকবাল এমন এক জ্বালাময়ি লেখা লিখলেন যে (এখানে ক্লিক করুন) , পরদিন ই খবর পেলাম সময় তার আগের অবস্থানে ফিরে গেছে! এখানে ক্লিক করুন এই মুহম্মদ জাফর ইকবাল সমকালিন তরুন প্রজন্মের এক বৃহদাংশের কাছে অসাধারন জনপ্রিয়।

সমস্যা কোথায়? এই পর্যন্ত মোটা দাগে দেখা যাচ্ছে তিনি এমন কোন কিছু করেননি যার জন্য তাঁকে এহেন তীব্র সমালোচনা বা পাঠক বিরাগের কারন হতে হবে। তবে সুক্ষ বিচারে কিছু আছে যা আলোচনার দাবি রাখে এবং আমি নিচে তার ক্ষুদ্র প্রয়াস নিয়েছি। সমস্যা ১: আমাদের অসহিষ্ঞুতাঃ আমরা জাতিগতভাবেই কাউকে নিরপেক্ষ থাকতে দেইনা বোধহয়। আপনি শেখ মুজিব কে বঙ্গবন্ধু বললেন তো আপনি ভারতের দালাল। অন্যদিকে খালেদা জিয়ার বিগত সরকারের কোন কাজকে ভাল কাজ বললেন তো আপনি রাজাকার।

এর বাইরে যেন কিছু হতে নেই! কিছু হতে পারে না! সাধারনত দেখা যায়, রাজনীতিতে মতলববাজ মানুষের সংখ্যা বেশী। তারা বিরোধী পক্ষকে যে কোন প্রকারে কাবু করতে চায়। তাই যে কোন বিচ্যুতি পেলেই আদা-জল খেয়ে লাগে তাকে ইস্যু করে রাজনীতি করতে। এই প্রবনতা সংক্রামক ব্যধির মতো সাধারন মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে গেছে। আমরা আমাদের বিশ্বাসের বাইরে কিছু দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়ি উদ্দেশ্যহীনভাবে।

অথচ ভাবিনা রাজনীতিকরা একই কাজ করেন কিছু উদ্দেশ্য নিয়ে। সমস্যা ২: চাপিয়ে দেয়ার নাম গনতন্ত্রঃ ৭২ এর সংবিধানের মূল নীতিগুলিই নাকি মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতি ছিল। জনগন নাকি এই নীতিগুলিই বাস্তবায়নের জন্য যুদ্ধ করেছে। এখন কে বললো একথা। একথার কোন ভিত্তি কি আছে? কোন গনভোট কি হয়েছিল? না হয়নি।

তবু আমরা যা মনে করি, তোমরা জনগন ও তাই মনে করবে। এই হলো গনতন্ত্র! এভাবে বিভিন্ন বিষয়ে নিজের মতকে জনতার মত বলে চাপিয়ে দেয়ার প্রবনতা আমাদের মধ্যে প্রবল ভাবে আছে। সমস্যা ৩: প্রগতিশীলতার নাম ধর্মহীনতাঃ সাধারন মানুষের মতো যারা নিজেদের প্রগতিশীল বলে দাবি করেন তারাও মুড়ি-মুড়কি এক করে ফেলেন। কু-সংস্কার, গোড়ামির বিরুদ্ধে বলতে গিয়ে তারা অনেক সময় ধর্মের বিরুদ্ধেই বলতে শুরু করেন। দাড়ি, টুপি পরা লোক, কিংবা বোরকা পরা মহিলা তাদের এলার্জির কারন।

তাঁরা জানেনই না অনেক ধর্মপ্রান মানুষই সমাজে অনেক 'পজিটিভ' ভুমিকা রেখে চলেছেন। ধর্ম বা হেজাব তাঁদের কাছে কোন বাঁধা নয় আদৌ। এই প্রগতিশীলগন বাস্তবতার চাইতে পুরোন, বস্তা-পচা থিওরিতেই অধিক আস্থা রাখেন। একজন ব্লগার যেমন বলেছেন, তাঁর ছোট বোন জাফর ইকবালের লেখার একজন ভক্ত আবার সে বোরকা পরতেও ভালবাসে, যা তার ওপর জোর করে চাপিয়ে দেয়া হয়নি। এটাই তাকে সাচ্ছন্দ দেয়।

এখন এনিয়েতো কারো কিছু বলার থাকতে পারে না। এই মেয়ে একজন শিক্ষিত মেয়ে হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে, সমাজের অগ্রগতিতে অবদান রাখতে পারে। বোরকা সেখানে কোন বাধা হওয়ার কথা নয়। এই বিষয়টা আমাদের প্রগতিশীলতার ব্যাপারিদের বুঝতে হবে। আমি মনে করিনা আমাদের সমাজের মেয়েরা বাধ্য হয়ে বোরকা পরছে।

বরং যারা বোরকা পরতে সাচ্ছন্দ বোধ করে তাদেরকে এই প্রগতিশীল নামধারীরা একধরনের টিজিং এর ফাঁদে ফেলে বোরকা ছাড়তে বাধ্য করছে। আমি মনে করি প্রগতিশীলরা যা বলবেন তা অবশ্যই প্রগতিশীলতায় পরিপূর্ণ থাকবে কিন্তু সাধারনের অনুভুতির দিকেও একটু খেয়াল রাখবেন। সবসময় যদি মনে করেন এই সাধারন মানুষ অশিক্ষিত (প্রচলিত অর্থে) বিধায় তারা কিছুই বোঝেনা, তাদের সবকিছুই কু-সংস্কারযাত, তারা যাই করে সবকিছুই তাদের উপর মোল্লাদের চাপিয়ে দেয়া তবে ভুল করবেন। একটা কথা মনে রাখবেন, আপনাদের চাইতে মোল্লারা সাধারনমানুষের বেশি কাছের মানুষ হতে পেরেছে। আমরা কি চাই? আমরা কি চাই সবাই কেবল ইসলামের পক্ষেই কথা বলবে? এদেশে অন্ততঃ শতকরা বিশভাগ অমুসলিম আছেন তাঁদের কোন কারন নেই ইসলামের রীতি, নীতিগুলোর পক্ষে অবস্থানের।

অন্যদিকে যারা সচেতন ভাবে সমাজ, রাষ্ট্রনিয়ে ভাবেন তাঁরা কখনোই কোন নির্দিষ্ট একটি ধর্মের নিয়মনীতি দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালনার প্রেশকিপশন দিতে পারেন না, যেখানে একাধিক ধর্মের মানুষ সেই দেশে বাস করে এবং মনে করে তাদের জন্মভূমিতে তাদের সেই অধিকারই রয়েছে যা রয়েছে সংখ্যাগুরুদের। ফের জাফর ইকবালঃ সাম্প্রতিক একটি লেখায় তিনি বোরখা বা হিজাব সম্পর্কে কিছু বলেছেন যা নিয়ে বেশ সমালোচনা শুরু হয়েছে। আমি মনে করি তাঁর আর একটু সহনশীল হওয়া উচিৎ ছিল। পশ্চিমাদের চশমায় নয় নিজেদের খোলা চোখে বিষয়টা দেখা উচিৎ। এখন এই সুযোগ নিয়ে একশ্রেণীর ব্লগার তাঁর মেয়ের বিষয়টিকে টেনে এনেছে।

আমি এর তীব্র প্রতিবাদ করি। প্রথমত তাঁর মেয়ে তাঁর (মেয়ের) সমাজের বাস্তবতায় যা করেছেন তার মধ্যে কোন অন্যায় নেই। আমরা কি পুরো আমেরিকা, ইউরোপ, ল্যাটিন আমেরিকাবাসির জীবন যাত্রা নিয়ে কথা বলার অধিকার রাখি? বরং বলা যায় উল্টোটা করার জন্য (আমেরিকায় বসে হিজাব পালন করে চললে) যে ধরনের পারিবারিক শিক্ষার দরকার হয় তা তাঁকে সঙ্গত কারনেই দেয়ার প্রয়োজন জাফর ইকবাল মনে করেননি। সঙ্গত বলছি একারনে যে, তিনি যে ধরনের বিশ্বাস ধারন করেন তাঁর সাথে এটা মিলতো না। আমরা অবশ্যই জাফর ইকবালের কাছে সেটা আশা করিনা।

আমাদের যদি তাঁর বিশ্বাসের কোন অংশ ভালো না লাগে তবে আমরা সেটা করবো না, মানবো না, অথবা লিখে প্রতিবাদ করবো। কিন্তু তাঁর মেয়ের জীবন ধারা নিয়ে (যে একজন আমেরিকান এবং সে ধারায় লালিত পালিত) তাঁকে কেন আক্রমন করবো? জাফর ইকবাল সাধারনত সাম্প্রতিক ও জলন্ত ইস্যুগুলো নিয়ে লিখে থাকেন। অনেকে বলেন জাফর ইকবাল সাম্প্রতিক কিছু কিছু ইস্যুতে কোন লেখা লেখেন নি। তাঁর ভক্তরা ঐসকল বিষয়ে তাঁর কোন মতামত জানতে পারেনি। যেমন, ফালানি হত্যা সহ বর্ডারে বি,এস,এফ কর্তৃক বাংলাদেশী হত্যা, ভারত কর্তৃক টিপাইমুখ বাঁধ দেয়ার চেষ্টা, শেয়ার বাজার ইস্যু ইত্যাদি।

এখন একজন লেখক কি লিখবেন, কখন লিখবেন সেটা তো তাঁর ব্যাক্তিগত ব্যাপার। কেউ তো তা চাপিয়ে দিতে পারেন না। তা হলে তো গনতন্ত্র থাকে না। কে কি লিখলো না তা নিয়ে না ভেবে বরং কে কি লিখেছে তা নিয়েই আমাদের ভাবা উচিৎ এবং অসহিষ্ঞুতা পরিহার করে কেবল যুক্তি ও লেখার মাধ্যমে তার আলোচনা করা উচিৎ। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।