আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মুহম্মদ জাফর ইকবাল এবং আমি

দিতে পারো একশ ফানুস এনে! আজন্ম সলজ্জ সাধ, একদিন আকাশে কিছু ফানুস উড়াই ... ... ...

ক্লাস ফোরে থাকতে প্রথমবারের মত তিন গোয়েন্দার প্রেমে পড়ি। তখন তিন গোয়েন্দার বই পড়ার জন্য পাগল হয়ে যেতাম। যে যেটা করতে বলত,সেটা করতেই রাজি ছিলাম। কিন্তু দুঃখের কথা,কেউ কিছু করতে বলত না। একদিন,আমার বাবা শহরে যাবে।

যাবার সময় আমাকে বলল,”বাপি,আমার সাথে যাবে?”আমার বাবা আমাকে ‘বাপি’ বলে ডাকত। আমি রাজি হলাম এক শর্তে,আমাকে আন্দরকিল্লা নিয়ে যেতে হবে। বাবা রাজি হল। আমি আর বাবা অফিসের গাড়ি করে শহরে গেলাম। বাবা অফিসে নেমে গেল,আর নবী আংকেল (যিনি গাড়ি চালাচ্ছিলেন) আমাকে নিয়ে গেলেন আন্দরকিল্লা।

সেখানে যাবার পর তিনি আমাকে নিয়ে দোকানে দোকানে ঘুরতে লাগলেন বই কেনার জন্য। আমি তখন খুঁজছিলাম তিন গোয়েন্দার বই। দোকানের পর দোকান চষে ফেললাম,কিন্তু সে বই আর পাই না। শেষে এক দোকানে গিয়ে পেলাম ‘হাত কাটা রবিন’ নামে একটা বই। লেখকের নাম আর দেখলাম না,তিন গোয়েন্দার বই মনে করে কিনে ফেললাম।

কেনার সময় মনে হচ্ছিল,রবিনের আবার হাত কাটল কখন?কিন্তু ভাবনাটাকে বাড়তে দিইনি,বগলদাবা করে বইটা বাসায় চলে আসি। রাতে পড়তে বসি। পড়া শুরুর পর মনে হল,বইটা তিন গোয়েন্দার না। এরপর যখন কাহিনীর ভিতরে গেলাম,তখন পুরোপুরি বুঝে গেলাম সেটা তিন গোয়েন্দার কাহিনী না। তখন আমার উচিৎ ছিল,বইটা না পড়ে রেখে দেওয়া।

কিন্তু পারিনি। মন্ত্রমুগ্ধের মত পুরো বই পড়ে ফেললাম। পড়ার পর মনে হল,কে এই জাদুগর যে আমাকে এতটাক্ষণ জাদু করে রাখলো?বইয়ের লেখকের নামটা জোরে জোরে পড়লাম,মুহম্মদ জাফর ইকবাল। এভাবেই তাঁর সাথে আমার পরিচয় ঘটে। ‘হাত কাটা রবিন’ বইটা পড়ার পর আমি কয়েকদিন ঘোরের মধ্যে ছিলাম।

আমার মনে হচ্ছিল,আমিও রবিন,টুকুদের দলের এক সদস্য। আমিও তাদের সাথে ফুটবল খেলি,গুপ্তধন খুঁজি,ডাকাত ধরি,নৌকা বাই। এ ঘোরের হাত থেকে মুক্তি পেতে আমার বেশ সময় লাগে। এরপর যা করি,তা বেশ অবাককর। আমি একটা দল গঠন করা আরম্ভ করি।

যে দলের কাজ হবে টুকুদের মত খেলা,গুপ্তধন খোঁজা এবং বিভিন্ন অ্যাডভেঞ্চার করা। কিন্তু দল গঠন প্রক্রিয়া ভালো না হওয়ায় সেটা ভেঙে যায়। দল ভাঙলেও মুহম্মদ জাফর ইকবালের প্রতি আমার ভালোবাসা,শ্রদ্ধা একদম ভাঙেনি বা কমেনি। আমি তাঁর সেই রুদ্ধশ্বাসকর বইটা পড়ার পর পাগল হয়ে যাই তাঁর বাকি বইগুলো পড়ার জন্য। আমার ভাগ্য ভালো যে আমি তাঁর বইগুলো সংগ্রহ করতে পারি।

কখনো এখান থেকে,কখনো সেখান থাকে। তাঁর কোন বই পাবার পর আমি একটানে পরে ফেলি,কোন ছাড় দিই না। এভাবেই আমি পড়েছি ‘আমার বন্ধু রাশেদ’,’জারুল চৌধুরীর মানিকজোড়’,’দীপু নাম্বার টু’,’বৃষ্টির ঠিকানা’,’দস্যি কজন’,’টি-রেক্সের সন্ধানে’,’আমি তপু’ বা ‘শান্তা পরিবার’। কোন কোন বই পড়ে কান্না করেছি,কোন কোনটা পড়ে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেয়েছি। আবার কখনো অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধে বিভোর হয়েছি।

ছোট বেলায় একবার ’দীপু নাম্বার টু’ নামক এক মুভি দেখেছিলাম। সেটা দেখে একবার কান্না আসছিল তো আরেকবার শিহরিত হচ্ছিলাম। তখন পুরোপুরি মুগ্ধ হয়েছিলাম সেটা দেখে। পরে জেনেছি সেটা মুহম্মদ জাফর ইকবালের লেখা। জানার পর শ্রদ্ধার কারণে মাথা নত হয়ে গিয়েছিল।

তখন ভেবেছিলাম এত চমৎকার লেখা তিনি লেখেন কিভাবে? ক্লাস সিক্সে থাকতে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘আমি তপু’ বইটা। সেটা সংগ্রহ করে আমি পড়তে আরম্ভ করি। পড়া শেষ করে যখন বইটা বন্ধ করি,তখন আবিষ্কার করি আমার দুই চোখের কোণে জল! এভাবেই তিনি আমাকে বহু বার কান্না করিয়েছেন। আবার বহুবার হাসিওছেন। এভাবেই তিনি আমাকে তাঁর ভক্ত বানিয়ে ফেলেছেন,মস্ত বড় ভক্ত।

সর্বশেষ বার পড়েছি তাঁর লেখা ‘রাশা’। খুব আনন্দ পেয়েছি। অনেক দিন পর ভালো বই পড়লে সবারই ভালো লাগে,আমারও লেগেছিল। তবে তাঁর বিপক্ষে আমার একটি অভিযোগ আছে। সেটা হচ্ছে তিনি এখন মাঝে মাঝে আইডিয়া কপি করে লেখেন।

সর্বশেষবার এমন করেছেন তিনি গত রোজার ঈদে দেশ টিভিতে প্রচারিত ‘লোডশেডিং এবং গোপন কথা’ এর সময়। আমি প্রথমে নাটকটা দেখে মুগ্ধ হয়ে যাই। তখন ভাবছিলাম যে তাঁর পুরাতন কারিশমা আবার ফিরে এসেছে। কিন্তু কয়েকদিন পর পেপার ঘাঁটতে গিয়ে দেখি নাটকটার কাহিনী এক হলিউডের মুভি থেকে নেওয়া!আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই। আরেকটা হচ্ছে ‘আমি তপু’ এর বেলায়।

এর কাহিনী তিনি A child called it নামক এক বই থেকে নিয়েছেন। বইটার লেখক Dave Pelzer. তিনি কপি করার মত এক মস্ত বড় অপরাধ করার পরও আমি তাঁর সৃষ্টিকে,তাঁর কর্মকে পছন্দ করি। কারণ তিনি আমাকে বই পড়তে শিখিয়েছেন। এ মস্ত বড় কাজটা যে করতে পারে,তাঁকে কি ভুলে থাকা যায় নাকি অপছন্দ করে থাকা যায়? আমি যখন ক্লাস সিক্সে,তখন পেপার মারফত জানতে পারি তিনি 'মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনো' নামক এক অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে আসবেন। সেবার তাঁকে দেখার জন্য আমি,আমার বাবা আর এক ভাই যাই 'নাসিরাবাদ বয়েজ হাই স্কুল' এ।

ইচ্ছে ছিল,কথা বলব। কিন্তু পারিনি। সাহসে কুলায়নি। আমার ভাইটিকে দিয়ে অটোগ্রাফ সংগ্রহ করিয়েছিলাম কেবল,আর কিছু করতে পারিনি। 'গণিত অলিম্পিয়াড' আমার কাছে ছিল স্বপ্নের মত।

এর পিছনে ছিল দুটি কারণ। একটি হচ্ছে গণিত আমার প্রিয় বিষয়,আরেকটি হচ্ছে মুহম্মদ জাফর ইকবাল সেই অনুষ্ঠানের একজন বিশেষ অতিথি। কিন্তু তিনি এখন আর আসেননা,তাই অলিম্পিয়াডও আমার কাছে রসকষহীন এক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। স্যার,আপনি কি জানেন যে আপনি আমাকে লেখক হতে প্রেরণা যুগিয়েছেন?আপনি কি জানেন যে আমি আপনার ‘রঙিন চশমা’ পড়ে জীবন সম্পর্কে জানতে পেরেছি?আপনি কি জানেন আপনি আমার মত হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ কিশোরকে মুক্তিযুদ্ধের সম্পর্কে সচেতন করেছেন? অবশেষে আপনি কি জানেন বাবা ছাঁড়া কিভাবে বাঁচা যায় আমি তা আপনাকে দেখে শিখছি? আমি জানি আপনি এর কিছুই জানেন না। আমি আপনাকে কতশত কথা বলতে চেয়েছি,আপনি তাও জানেন না।

আপনি নিষ্ঠুরের মত সবসময় দূরে দূরে থেকে গেছেন,সবসময়। আপনার লেখা নাটক আমি সর্বদা মনোযোগ সহকারে দেখি এবং প্রায় সময়ই লক্ষ্য করি নাটকের মান ভালো নয়। তখন মন খারাপ হয়ে যায়। আপনার লেখা অনেক সুন্দর কাহিনী বাজে পরিচালকের হাতে পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। তবুও আপনি নাটক লিখেছেন।

আপনার এ নিরলস অধ্যবসায়ের কারণে আমরা তাই পেয়েছি ‘শুকনো ফুল রঙিন ফুল’ এর মত চমৎকার কিছু নাটক। আপনার লেখা কত সায়েন্স ফিকশন যে আমি পড়েছি!গণনা করা তা যায় না। আপনার লেখা সেগুলো পড়ে আমার এমন বদঅভ্যাস হয়েছে যে আমি অন্য কারোর সায়েন্স ফিকশান আর পড়তে পারি না। আপনার লেখা ‘লাবু এলো শহরে’ এবং ‘কাজলের দিনরাত্রি’ এ দুটি উপন্যাস মুভি হতে চলেছে। আমি অধীর আগ্রহে এ দুটির জন্য অপেক্ষা করছি।

আমি আসলে আপনার সাথে দেখা করার অপেক্ষায় আছি। এটাই আমার চাওয়া। বি: দ্র: আমি গত পোষ্টে 'আবিল (দ্যা লিরিক বয়)' কে বলেছিলাম যাতে সে আমার পোষ্টে মন্তব্য করার সময় কোন লিঙ্ক না দেয়। সে বলেছিল যে সে আর দিবে না। কিন্তু আমি এখন চাচ্ছি সেই সকল পোষ্টের লিঙ্ক যেগুলো স্যারকে নিয়ে লেখা হয়েছে।

আশা করি ব্লগাররা আমাকে সাহায্য করবেন।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।