আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যুদ্ধে আমেরিকান সেনাদের গণহত্যা : আমেরিকার এক সেনার মায়ের বক্তব্য :

পৃথিবীর কাছে তুমি হয়তো কিছুই নও, কিন্তু কারও কাছে তুমিই তার পৃথিবী" যুদ্ধের সময় সেনারা বেসামরিক লোকজনদের হত্যা করে কেন এ প্রশ্নটি বহু পুরনো। সম্প্রতি আমেরিকার সেনাবাহিনীর 'ফিফথ স্ট্রাইকার ব্রিগেডে'র বিরুদ্ধে আফগানিস্তানে নির্বিচারে সাধারণ মানুষ হত্যার অভিযোগে সার্জেন্ট ক্যালভিন গিবস্কে সামরিক আদালতে বিচার প্রক্রিয়ায় নেয়া হয়েছে। ফলে নতুন করে আবার প্রশ্নটি মাথাচাড়া দিয়েছে। দেখা গেছে, আগ্রাসী সেনাবাহিনীর হাতে বেসামরিক নাগরিক হত্যা একটি সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে আজকাল। যুদ্ধরত বাহিনীগুলোর মাঠ পর্যায়ের কমান্ডারদের মানসিকতাও এ জন্য বহুলাংশে দায়ী।

আমেরিকান সেনাবাহিনীর পাঁচ সদস্যের বিরুদ্ধে ২০১০ সালে আফগানিস্তানে নিষ্ঠুরভাবে বহু বেসামরিক নাগরিককে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। আফগানিস্তান ও ইরাকে আমেরিকান সেনাবাহিনীর পুরুষ ও নারী সদস্যদের কার্যকলাপ এক মর্মান্তিক উপাখ্যান। ছোট-বড় যা-ই হোক না কেন, এ নিষ্ঠুরতার ঘটনা সেখানে ঘটছে বারবার। সেনাবাহিনীর এসব কর্মকা-কে নৈতিক পদস্খলন হিসেবে বর্ণনা করা যেতে পারে। অর্থাৎ দৃশ্যত সাধারণভাবে ভালো আচরণবিশিষ্ট সেনাদলের মধ্যে খারাপ কাজের লোকও রয়েছে।

অন্যভাবে বলা যায়, এ নিষ্ঠুরতার পেছনে সেনাবাহিনীর গঠন ও কাঠামোগত কারণও রয়েছে। এর মধ্যে নিম্নমানের প্রশিক্ষণ, আগ্রাসী সেনাকমান্ডার এবং এসব অনাচারে সায় দেয়ার মতো সেনারা উল্লেখযোগ্য। এছাড়া যুদ্ধের গতি-প্রকৃতিও একটি বড় কারণ। যুদ্ধ এখন শত্রুপক্ষের সেনা এবং বেসামরিক নাগরিকদের মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সেনাদের দৈনন্দিন অভিযান, বাড়ি বাড়ি তল্লাশি, সড়ক অবরোধ, হামলাকারী সাঁজোয়াযানের বহর প্রভৃতি সেনাদের বেসামরিক নাগরিকদের ওপর নির্যাতন চালাতে উৎসাহিত করে।

আফগানিস্তান এবং ইরাকে আমেরিকার সেনাদের 'কিল টিম' এবং অন্যান্য হত্যাকা-ের ঘটনার সঙ্গে প্রধানত তিনটি কারণ জড়িত। এক. সেনাবাহিনীর মধ্যে কিছু হঠকারী লোকজন রয়েছে। সে কারণে এ যুক্তি সহজেই দেয়া যায় যুদ্ধনীতি বা কৌশলের মধ্যে থেকে এসব সেনারা উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করে থাকে। দুই. ড্রাগ ও অ্যালকোহল ব্যবহারের ফলে সেনাবাহিনীর একাংশের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়, ফলে তারা দিগ্বিদিকশূন্য কার্যকলাপ করে। 'কিল টিমের' ক্ষেত্রে এ ঘটনাই ঘটেছে ফলে দাবি প্রসিকিউটরদের।

তিন. এছাড়া যুদ্ধের সময় নিয়ন্ত্রণহীন এবং বিচ্ছৃঙ্খল সেনাবাহিনীর নির্বিচার ও যুক্তিহীন আচরণের ফলে ঘটে বেসামরিক নাগরিকদের হত্যাযজ্ঞ। কোরিয়ার নো গান রি এলাকায় ১৯৫০ সালের যুদ্ধে অন্তত ১০০ বেসামরিক নাগরিকের ওপর গণহত্যা চালানো হয়। ঘটনার ৫০ বছর পর জানা যায়, সেখানে কোনো হঠকারী যোদ্ধা দ্বারা এমন হত্যাকা- ঘটেনি। সেটি ছিল পরিকল্পিত। একইভাবে ১৯৬৮ ভিয়েতনামের সেই লেই মেইয়ে আমেরিকান বাহিনী একইদিনে অন্তত ৪০০ মানুষের ওপর গণহত্যা চালায়।

এর আগেরদিনও এসব সেনার মধ্যে কোনো উচ্ছৃঙ্খল আচরণ লক্ষ্য করা যায়নি। বিশ্লেষকরা বলেন, সেনাবাহিনীর কাঠামোগত অবস্থানকে এক্ষেত্রে সাধারণভাবে দায়ী করা হয়ে থাকে। কেননা যুদ্ধের আইন সম্পর্কে যথেষ্ট প্রশিক্ষণ দেয়ার চেয়ে সেনাদের প্রশিক্ষিত করা হয় সফলভাবে হত্যার বিষয়ে। ইরাকে আমেরিকার সেনাবাহিনীর ওপর এক জরিপে এক-তৃতীয়াংশ মেরিনসেনা এবং নিয়মিত বাহিনীতে দয়িত্বরত এক-চতুর্থাংশ সদস্য অকপটে বলেছেন, তাদের কমান্ডাররা বেসামরিক জনগণের প্রতি ভালো আচরণ করার বিষয়ে কোনো নির্দেশনা দেননি। ২০০৭ সালের অপর এক জরিপে দেখা গেছে, ৩৮ শতাংশ মেরিন এবং ৪৭ শতাংশ সেনাসদস্য বলেছেন, সাধারণ জনগণের প্রতি মর্যাদা ও শ্রদ্ধা দেখানো উচিত।

অন্যদিকে এক তৃতীয়াংশের অভিমত হচ্ছে, তথ্য আদায়ের জন্য বেসামরিক লোকদের ওপর নির্যাতন চালানো অনুমোদনযোগ্য। আর ১৭ শতাংশ মনে করেন, বেসামরিক সব মানুষই সন্ত্রাসী, ভিয়েতনাম যুদ্ধে সেনা অধিনায়কদের মতামতও ছিল এরকমই। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় শত্রুপক্ষের হতাহতের সংখ্যা বেশি করার জন্য চাপে ছিলেন সেনা কমান্ডাররা। ফলে তারা উন্মত্তের মতো হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছেন সে সময়। ১৯৬৭ সালে সেনা অফিসার প্রার্থীদের ওপর এক জরিপে দেখা যেছে, তাদের অর্ধেকই তথ্য আদায়ের জন্য বেসামরিক নাগরিকদের ওপর নির্যাতনের পক্ষে।

১৯৭০ সালে আর একটি বড় রকমের জরিপে দেখা যায়, ১৫ শতাংশ সেনাকমান্ডার এবং তালিকাভুক্ত সেনাদের মধ্যে যুদ্ধের আইনকানুন সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষায় যেসব আইনকানুনের বিষয়ে তাদের প্রশ্ন হয়েছিল তার ভুল উত্তর দিয়েছিল এক-তৃতীয়াংশ সেনা অথচ একই সময়ে হত্যাকারী হিসেবে তাদের প্রশিক্ষণ ছিল খুবই উঁচুমানের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুদ্ধক্ষেত্রে বেসামরিক নাগরিক হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া দরকার, যাতে হত্যাকা-ে জড়িতরা তাদের শত্রুদের দুর্ভাগ্যের বর্ণনা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজেরা অনুতপ্ত হওয়ার সুযোগ পায়। জরিপে দেখা গেছে, ইরাকে যুদ্ধরত আমেরিকান সেনাবাহিনীর অর্ধেক সদস্যই গবেষকদের বলেন, তারা বেসামরিক নাগরিক হত্যাকা-ের তথ্য জানেন এবং তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। অন্যদিকে ১০ শতাংশ স্বীকার করেন, তারা বেসামরিক নাগরিকদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছেন।

এদিকে এ ধরনের কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেই আমেরিকান সেনাদের বারবার দেশে দেশে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। সার্জেন্ট গিবসকে তৃতীয় দফায় দায়িত্ব পালনের জন্য দেশের বাইরে আফগানিস্তানে পাঠানো হয়। এর আগে প্রথমবারের মতো তাকে পাঠানো হয়েছিল ইরাকে। এটি অব্যাহত ক্লান্তিকর এবং এর পরিণতি ঘটে মারাত্মক। এটা কারোরই জানা নেই, ইরাক ও আফগানিস্তানে কতো লোক আমেরিকান সেনাদের হাতে নিহত হয়েছে।

এছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন যুদ্ধে নিহতদের পরিসংখ্যানও যথেষ্ট নয়। তবে ইরাকে জরিপের ফল বিশ্লেষণ করে অনুমান করা যায়, এ সংখ্যা কয়েক লাখ। আর আফগানিস্তানে তা প্রায় লাখের কাছাকাছি। এসব ঘটনার জন্য সহিংসতার অজুহাত তোলা হয়েছে। কিন্তু যুদ্ধজোটের কেউই এর দায় এড়াতে পারে না।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সেনাবাহিনীর মধ্যে এ প্রবণতা দূর করার উপায় খুব সহজ নয়। উন্নত প্রশিক্ষণ, বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষার আইন সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণা, জনগণের সংগ্রামের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন_এসবকিছু এক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। কিন্তু এরপরও সেনাবাহিনীকে বিভিন্নমুখী দ্বন্দ্ব ও চাপের মধ্যে থাকতে হয়। এসবই যুদ্ধের ক্ষেত্রে বেশি সহিংসতা ছড়াতে কাজ করে। ভিয়েতনামের মেই লেই গণহত্যার অনুসন্ধানী সাংবাদিক আমেরিকার ইন্ডিয়ানা রাজ্যের এক সেনার মায়ের সঙ্গে কথা বলতে গেলে ছেলে সম্পর্কে তিনি বলেন, 'আমি তাদের হাতে একটি ভালো তরুণকে তুলে দিয়েছিলাম, আর তারা ফেরত দিয়েছে একজন খুনী।

' সূত্র : বিবিসি অনলাইন ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।