আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

উচ্চশিক্ষা প্রসঙ্গে

একটি বৈষম্যহীন, শোষণহীন, অসাম্প্রদায়ীক ও ঐক্যবদ্ধ পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি উচ্চশিক্ষা নিয়ে লিখতে গেলে প্রথমে শিক্ষা নিয়ে কিছু কথা পরিস্কার করে নেয়া দরকার। শিক্ষা প্রশ্নে দু’টি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমটি হচ্ছে শিক্ষার নীতিগত প্রশ্ন। অর্থ্যাৎ কাদের জন্য শিক্ষা, কি হবে শিক্ষার বিষয়বস্তু, শিক্ষার উদ্দেশ্যই বা কি। এ বিষয়টির সাথে জড়িয়ে আছে কোন আর্থ সামাজিক অবস্থায় কোন শ্রেণীচরিত্রের শাসকদের দ্বারা শিক্ষা পাচ্ছি, তারা শিক্ষাকে কতখানি গুরুত্ব দিচ্ছে এবং শিক্ষার দায়-দায়িত্ব ও ব্যয়ভার কতখানি বহন করছে ।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে শিক্ষার পদ্ধতিগত বিষয়। যেমনঃ শিক্ষাদান রীতি কেমন হবে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক কেমন হবে, শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও শিক্ষার গুন মান যাচাই কিভাবে হবে। শিক্ষকদের শিক্ষাদান ও শিক্ষার্থীদের শিক্ষাগ্রহনে তথা দেহে মনে পরিপূর্ণ বিকাশের জন্যে কি ধরণের প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন থাকবে। শিক্ষার সিলেবাস কাদের দ্বারা, কিভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়ম বিধি কি রকম হবে ইত্যাদি বিষয় শিক্ষার পদ্ধতিগত বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত।

এখন উপরের আলোচনা সাপেক্ষে আমরা যদি চিন্তা করি তাহলে দেখব আমাদের দেশের শিক্ষাটা যদিও বলা হয় ‘সবার’ জন্য কিন্তু মূলত সেটা শুধুমাত্র যারা সেই শিক্ষার ব্যয় বহন করতে সক্ষম তাদের জন্যে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালিত হবার কথা স্বাধীনভাবে নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রেখে সেখানে এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও স্বাধীনভাবে চলে না বা চলতে পারে না। বাংলাদেশের সংবিধাণের স্বীকৃতি অনুযায়ী শিক্ষা আমাদের মৌলিক অধিকার। কিন্তু এখনও দেশের পঞ্চাশ ভাগ মানুষ শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত। শিক্ষা খাতে এখনও সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেয়া হয় না, বাজেটে গুরুত্ব পায় সামরিক খাত।

যে গনতন্ত্রের জন্যে একাত্তরে যুদ্ধ হলো নব্বইয়ে গন-অভ্যুত্থান হল সেই গনতন্ত্রের জন্যে হলেও শিক্ষা সবার জন্য সুলভ হবার কথা ছিল। অথচ ব্যাপারটা সেরকম হয়নি। বরং শিক্ষা বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা ক্রমশ সাধারণের নাগালের বাইরে চলে গেছে। আমাদের দেশে শিক্ষার স্তর হিসেবে মোটামুটি তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। প্রাথমিক শিক্ষা, মাধ্যমিক শিক্ষা এবং উচ্চশিক্ষা।

আমরা যদি এক স্তরের শিক্ষার্থী সংখ্যা পরের স্তরের সাথে তুলনা করি তাহলে দেখব আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাটা মূলত পিরামিড আকৃ্তির। অর্থ্যাৎ প্রাথমিক শিক্ষায় অংশগ্রহনের যে হার সেটা মাধ্যমিক স্তরে এসে কমে যায় আবার মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থী সংখ্যা উচ্চশিক্ষা স্তরে এলে আরো কমে যায়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় মুখে “সবার জন্য শিক্ষা” বলা হলেও বাস্তবে এটা সবার জন্যে ‘প্রাথমিক’ শিক্ষায় সীমাবদ্ধ। উচ্চশিক্ষার হাল হকিকত ২০০৯ সালের ইউজিসি’র হিসেব অনুযয়ী দেশের চালু মোট পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ৩১টি, যেখানে সর্বমোট ১৩,৮২,২১৬ জন শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত ছিল। সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী ছিল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ১১,১৯,২৭৫ জন।

সর্বনিম্ন ছিল পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯ জন। অপরদিকে ২০০৯ সালে দেশে মোট প্রাইভেট বিশ্ববিদ্ব্যালয় ছিল ৫১টি, শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিল ২,০০,৯৩৯ জন। ১৯৯৮ সালে দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ৯টি, ২০০১ সালে বেড়ে হয় ১৫টি এখন দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে ৩১টি। ২০০৬ সালের ইউজিসি কর্তৃক গৃহীত কৌশলপত্রে ২০২৬ সাল নাগাদ উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে মোট ছাত্রসংখ্যা ৩.৫ মিলিয়ন এবং এ জন্যে আরো ২৮টি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কথা বলা হয়েছিল। এটা করতে গিয়ে দেশের কয়েকটি ঐতিহাসিক কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রুপান্তর করা হয়েছে।

বিআইটিগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে। ‘বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’ হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে এক অদ্ভুত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যা কিনা নামে পাবলিক কিন্তু বাস্তবে প্রাইভেট। এই প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গড়ে উঠছে পূর্ণাঙ্গ অবকাঠামো ও পর্যাপ্ত সংখ্যক দক্ষ জনবল ছাড়াই। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রীদের আবাসণ সংকট রয়েছে, রয়েছে লাইব্রেরীতে পর্যাপ্ত বইয়ের সংকট। গুনতে হচ্ছে উচ্চহারে ফিস।

এই উচ্চহারে ফিস গুনেও সময়মত পড়াশুনা শেষ করে বের হবার সম্ভাবনা খুবই কম। এসকল নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যথেষ্ঠ পরিচিতির অভাবে ভাইভা বোর্ডে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। আবার নতুন নতুন প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হলেও মেডিকেল কলেজ কিন্তু সেভাবে স্থাপন করা হচ্ছে না। এমনকি স্থাপিত কোন কোন মেডিকেল কলেজে যন্ত্রপাতির অভাবে ক্লাস না হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। দেশে এখন বছরে প্রায় ২২০০ জন শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষায় সরকারী মেডিকেল কলেজগুলোতে পড়াশুনা করতে পারে।

এর বাইরেও কয়েকটা বেসরকারী মেডিকেল কলেজ আছে। তবে বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই অভিযোগের অন্ত নেই। সরকারী মেডিকেল কলেজগুলোতে শুধু যন্ত্রপাতির অভাবই নয় বিশেষজ্ঞ শিক্ষকেরও সংকট রয়েছে ব্যপকভাবে। দৃষ্টি ফেরানো যাক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। দেশের ৫১টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব কয়টাতেই গুরুত্ব পেয়েছে ক্যারিয়ারমুখী বিষয়গুলো।

এখানে মূল্যায়ন হয়নি বিজ্ঞানের বা কলার গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক বিষয়গুলো। ২০০৯ সালের এক হিসাবের দিকে লক্ষ্য করা যাক, বিষয়------------শিক্ষার্থী (শতকরা) ব্যবসায় প্রশাসণ -----------------৪৮ বিজ্ঞান----------------------------২৯ আইন-----------------------------০৭ অর্থনীতি-------------------------০.৯১ কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান--------১৩ উপরের ছকটি থেকে খুব সহজেই বলা যায় এসব বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেসকল বিষয়েই গুরুতে দেয়া হয় যেগুলো চাকুরীর বাজারে চাহিদা আছে। আর বিজ্ঞান বলতে যেসকল বিষয় এর অন্তর্ভূক্ত সেগুলো হচ্ছে বিভিন্ন প্রায়োগিক বিজ্ঞান। এখানে মৌলিক বিজ্ঞানের জায়গা তেমন একটা নেই। এসকল বিশ্ববিদ্যালয়ে যতটা গুরুত্ব দিয়ে বিবিএ, এমবিএ আর কম্পিউটার সায়েন্স পড়ানো হয় ততটা না হলেও তার শতভাগের এক ভাগ গুরুত্ব দিয়েও নিজস্ব সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের চর্চা করা হয় না।

ফলে এসব জায়গায় অবশ্যম্ভাবী ভাবে গড়ে উঠেছে বিজাতীয় সংস্কৃতির ধারক বাহক একদল মানুষ। তৈরি হচ্ছে বিচ্যুত করপোরেট মানসিকতার এক বাণিজ্যিক উচ্চশিক্ষার সংস্কৃতি। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৯২ সালে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় আইন কার্যকর হওয়ার পর থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ১৬ বছরে তিন চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ খোলা হয়েছে। এসকল বিশ্ববিদ্যালয়ে সে সকল বিভাগই খোলা হয় যার বাজারে চাহিদা আছে। লাভজনক মনে না হলে সেই বিষয়ের বিভাগ খোলা হয় না বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে।

উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন খাত নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষন করলে যে কারো পক্ষে বলে দেয়া সম্ভব এখানে সুনির্দিষ্ট কোন পরিকল্পনা নেই। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে শিক্ষা পরিণত হয়েছে পণ্যে। যার টাকা আছে সে দোকানে গিয়ে যেমন পণ্য কিনে বাসায় আসে। তেমনি আজকে শিক্ষাও টাকা না থাকলে অর্জন করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। এমনকি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও দফায় দফায় ব্যয় বৃদ্ধি সাধারন পরিবারের সন্তানদেরকে উচ্চশিক্ষাবিমুখ করছে।

অবহেলিত গবেষনা খাত আমাদের দেশে ট্যাকনিক্যালি জ্ঞানী অনেক মানুষ থাকলেও মৌলিক জ্ঞান তেমন তৈরী হচ্ছে না। অক্সফোর্ড অভিধানে University শব্দের যে অর্থ দেয়া আছে তা হল “a high-level educational institution in which students study for degrees and academic research is done” অর্থ্যাৎ বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে এমন একটি উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান যেখানে ছাত্র-ছাত্রীরা ডিগ্রি অর্জন এবং গবেষনার কাজ করে থাকে। অর্থ্যাৎ বিশ্ববিদ্যালয় শুধুমাত্র ডিগ্রি অর্জনের স্থান নয় এটা গবেষনারও স্থান। অথচ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকালে আমরা কি দেখতে পাই ? আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কি মাত্রায় গবেষনা হয় সেটা আমরা সবাই কম বেশি জানি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যদি নতুন নতুন জ্ঞান তৈরি না হয় তাহলে তার প্রভাব অবশ্যই নিচের স্তরের দিকে পড়ে।

গবেষনা না হবার পেছনে অর্থ সংকট বড় একটি কারণ। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষনা খাতে বরাদ্দ দেয়া হয় অতি সামান্য তা পাবলিকই হোক আর প্রাইভেট। শিক্ষকরা নিজের পকেটের টাকা খরচ করে গবেষনা করতে আগ্রহী হন না। ফলে গবেষনাও হয় না। সবচেয়ে ভয়ংকর তথ্য হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষনা খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ পুরোটা আবার গবেষনা খাতে ব্যয়ও করা হয় না।

কারণ হিসেবে দেখানো হয় ইউজিসি’র অন্যান্য বরাদ্দ কম দেয়া। আবার শিক্ষকরাও গবেষনায় অতটা আগ্রহী না হওয়ায় বরাদ্দের টাকা সব ব্যয় করাও সম্ভব হয় না বছর শেষে। শিক্ষকরা তাদের গবেষনা সঠিক মূল্য পান না বিধায় তারা গবেষনা করার চাইতে বিভিন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেয়া বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করতেই বেশি আগ্রহী হয়ে থাকেন। যদিও এটাকে আবার অনেকে গবেষনা নাম দিতে চান। আবার গবেষনা যে একেবারেই হচ্ছে না তাও না।

হচ্ছে তবে সেটা সমাজের জন্যে নয়, হচ্ছে করপোরেট স্বার্থে। চিকিৎসা, কৃ্ষি, ফার্মেসী, রসায়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে গবেষনা হচ্ছে। কিন্তু লাভের ফল নিয়ে যাচ্ছে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো। শিক্ষার মান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিমাপক হল গবেষনা। কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা/এমনকি গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে পরিমাপ করতে হলে দেখতে হবে গবেষনায় এর অবদান কি ? গবেষনা ব্যতিত, নতুন নতুন জ্ঞান নির্মাণ না করে কোন সমাজে শিক্ষার মান বৃ্দ্ধি সম্ভব নয়।

আমি মনে করি আমাদের সমাজ যে একটা স্রোতহীন ডোবার মত হয়ে যাচ্ছে তার একটা কারণ এই গবেষনা না হওয়া, নতুন জ্ঞান তৈরী না হওয়া। আবার অনেকে সুযোগ এবং পরিবেশের অভাবে বিদেশে চলে যাচ্ছে। অনেকে তাদের অর্জিত জ্ঞান কাজে লাগানোর কিংবা উপযুক্ত সম্মানী না পেয়ে বর্তমানে ইউরোপ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছে। এদের যে দেশপ্রেমের অভাব আছে ব্যাপারটা কিন্তু এরকম না। দেশে এরা কাজের সুযোগ পাচ্ছেন না কিংবা পেলেও উপযুক্ত সম্মানী পাচ্ছেন না।

এই যে মেধা পাচার তা ঠেকানোর জন্য এখনই গবেষনায় অধিক গুরুত্ব দেয়া উচিত। গবেষনার জন্য যা যা প্রয়োজন তা দেয়া উচিত এবং এদের যোগ্যতা অনুযায়ী কাজের ব্যবস্থা করা উচিত উপযুক্ত সম্মানী সহকারে। নইলে মেধা তৈরীর ক্ষেত্রে যে শূন্যতা তা অদূর ভবিষ্যতে কাটানো সম্ভব হবে না। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রয়োজনেই আমাদের এই মেধা পাচার রোধে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহন করা দরকার। এত সংকটঃ সমাধান কোথায় ? আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকালে বোঝা যায় উচ্চশিক্ষা কি পরিমান সংকটে আছে।

শিক্ষার মান, শিক্ষক সংকট, শ্রেণীকক্ষ সংকট, পরীক্ষার হল সংকট, অসুস্থ ছাত্র রাজনীতি, শিক্ষক রাজনীতির নিত্য ছোবল সব মিলিয়ে এক ধরণের অস্থিরতা কাজ করছে আমাদের শিক্ষাঙ্গনে। অবস্থা দেখে মনে হয় এর কোন সমাধান নেই, যেমনটা চলছে তেমনটাই চলবে। সিলেবাসে নতুনত্ব নেই, বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার তাড়া নেই, লাইব্রেরীতে বই সংকট, নতুন আপডেটকৃত বইয়ের অভাব, জ্ঞান আহরণের জন্যে না পড়ে ডিগ্রি অর্জনের জন্যে পড়া এই তো আমাদের শিক্ষার মান। আমাদের শিক্ষকেরা উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে ইউরোপ আমেরিকায় গিয়ে আমাদের কথা ভুলে যান। কেউ কেউ একটু বেশি অর্থ উপার্যনের লোভে ক্লাস নেয়া বাদ দিয়ে ক্লাস নেন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে, কলসান্টেন্সি করেন বিদেশী দাতা প্রতিষ্ঠানের হয়ে।

আর আমরা ভুগি শিক্ষক সংকটে। আবার অনেক শিক্ষক ক্লাস নিতে চাইলেও উপায় নেই, শ্রেণীকক্ষ সংকট। পরীক্ষা নিতে চাইলেই পরীক্ষা নেয়া যায় না। আগে থেকে বুকিং দিয়ে রাখতে হয়, নইলে পরীক্ষা দেয়া হবে না। আবার পরীক্ষার তারিখ ঘোষনা হলেই যে পরীক্ষা হবে তার নিশ্চয়তা নেই সরকারী দলের দুই পক্ষের মধ্যে লেগে যেতে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ।

এই অবস্থায় পরীক্ষা দেয়ার চাইতে ঘরে বসে থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ মনে করেন অনেকে। সব মিলিয়ে এক জগা খিচুরী অবস্থা আমাদের শিক্ষাঙ্গনের। ডাকসুসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্র সংসদের নির্বাচন হয় না প্রায় দুই দশকেরও বেশী সময় ধরে। প্রায় সকল ক্যাম্পাসেই ছাত্র রাজনীতি এখন পেশি নির্ভর, দলবাজী-ঘুটিবাজি নির্ভর। অপরদিকে ছাত্র রাজনীতির প্রগতিশীল ধারা প্রতিনিয়ত দুর্বল হচ্ছে।

ছাত্রদের অধিকার দাবী দাওয়া নিয়ে বলার মত লোকদের সংখ্যা দিন দিন কমছে। একই অবস্থা শিক্ষক রাজনীতির ক্ষেত্রে। সমাজের অংশ হিসেবে একজন শিক্ষক অবশ্যই একটি রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারী হতে পারেন। তার মতাদর্শ প্রচারও করতে পারেন। কিন্তু একজন শিক্ষকের কাছে নিশ্চয়ই দলবাজী আশা করা যায় না।

অথচ আমাদের দেশে ঠিক এটিই হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েও এইসকল দলবাজীর কারণে তারা যেমন নিজেদের ক্ষতি করছেন তারচেয়ে ক্ষতি করছেন ছাত্রদের, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের। সব শিক্ষক যে এমনটা করেন এমন কিন্তু না। কিন্তু যারা করেন তারাই শক্তিশালী। শেষ কথা এত এত সংকটের সমাধান কি আদৌ আছে ? আমি মনে করি আছে।

এবং সেটা বাস্তবায়নের জন্যে প্রয়োজন ছাত্র-শিক্ষক-সরকারের ত্রি-পক্ষীয় উদ্যোগ। সরকারের উচিত উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে একটা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহন করা। কোন বিদেশী দাতা প্রতিষ্ঠানের দেখিয়ে দেয়া কৌশলপত্র নয় বরং শিক্ষাবিদ, রাজনৈতিক কর্মী, ছাত্র রাজনৈতিক সংগঠন সমুহ শিক্ষক এবং সমাজের অন্যান্য পেশাজীবিদের সাথে নিয়ে একটা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করা। শিক্ষাঙ্গন থেকে সন্ত্রাসী সকল ছাত্রের ছাত্রত্ব বাতিল করে ক্যাম্পাস থেকে বহিস্কার করে অবিলম্বে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদগুলোতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। শিক্ষকদের বিভিন্ন রঙের রাজনীতি বন্ধ করে দেশের স্বার্থে এগিয়ে আসা উচিত।

আমাদের সকলের প্রচেষ্টাতেই আমাদের শিক্ষাঙ্গনের সকল সংকটের সমাধান সম্ভব। আমরা যদি বাষট্টি, ঊনসত্তর, একাত্তরে নব্বইয়ে পারি, তাহলে এখন পারব না কেন ? অবশ্যই পারব আমরা তো সংখ্যায় অনেক বেশি। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.