আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মায়ান সভ্যতার নতুন তথ্য ।

আমি আমাকে চিনি না লেখক কাজী জহিরুল ইসলাম কবি, জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক কর্মকর্তা এর তথ্য হতে সংগৃহিত। মধ্য আমেরিকার মায়া সভ্যতার প্রতিভূ নতুন সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম এক আশ্চর্য মেক্সিকোর চিচেন ইতসা। ইউরোপ যখন অন্ধকার যুগে নিমজ্জিত, সেই খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০ সালে মায়া সভ্যতা বিকাশ লাভ করে মধ্য আমেরিকায়। মেক্সিকো এবং গুয়েতেমালার গহিন জঙ্গলে বিস্তৃত চুনাপাথরের পাহাড়ে ইউকাতান পেনিনসুলায় রয়েছে অসংখ্য রহস্যময় মন্দির, পাথরের দেয়াল, পিরামিড এবং বিশাল বিশাল পিলারের সারি। ইউকাতানের চিচেন ইতসাই ছিল মায়া সভ্যতার রাজধানী।

আজ থেকে ৪ হাজার বছর আগে মায়ারাই আবিষ্কার করে অঙ্ক শাস্ত্র এবং পঞ্জিকা, অতি বিস্ময়কর স্থাপত্যশিল্পও ছিল মায়াদের করায়ত্ত। সেই সব স্থাপত্যশিল্প চিচেন ইতসায় স্বমহিমায় আজও দাঁড়িয়ে আছে, সগৌরবে ঘোষণা করছে ঐশ্বর্যশীল মায়া সভ্যতার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। প্রতœতাত্ত্বিকরা গবেষণা করে দেখেছেন, মায়ান স্থাপত্য শিল্পীরা কোনও ধরনের লোহার যন্ত্রপাতি বা ট্রপিকল জাতীয় চাকা ব্যবহার না করে, এমনকি ইজিপশিয়ান ফারাওদের মতো জীব-জন্তুর সাহায্য না নিয়ে গহিন জঙ্গলের ভেতর মাইলের পর মাইল ধরে নির্মাণ করেছেন বিশাল বিশাল একেকটা স্থাপত্য কর্ম। যেগুলোর মধ্য এল কাস্তিলো, দি টেম্পল অব দি ওয়ারিওরস, দি অবজার্ভেটরি, দি নিউনারি এবং দি বল কোর্ট বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রস্তরশিল্প নির্মাণে মায়াদের ছিল অভাবনীয় দক্ষতা।

যার নজির মেলে চিচেন ইতসা ছাড়াও পালেঙ্ক, তুলুম, কোপান এবং উক্সমলে। মায়া সভ্যতা ইউকাতান পেনিনসুলায় বিকাশ লাভ করলেও পুরো মেসোআমেরিকাতেই ওদের আধিপত্য ছিল। অনেকে বিশ্বাস করেন মায়াদের উৎপত্তি আজ থেকে ২০ হাজার বছর আগে। মায়া সভ্যতার যেসব অত্যুজ্জ্বল নিদর্শন এখন চিচেন ইতসায় রয়েছে সেগুলো ২৫০ থেকে ১০০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে নির্মিত বলে ধারণা করা হয়। তখন ইউকাতানে ৭০ লাখ মায়া আধিবাসী বসবাস করত।

পৃথিবীর অনেক প্রাচীন সভ্যতার মতো মায়া সভ্যতা একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। এখনও সাড়ে ৩ লাখ মায়া অধিবাসী ইউকাতানে বসবাস করছে। মধ্য আমেরিকার এসব আদিবাসী পৃথিবীর একটি বিরল ভাষা ইউকাটেক-মায়ানসে কথা বলে। ষোড়শ শতকে স্প্যানিশ ইনভেডররা মেক্সিকো, গুয়েতেমালা দখল করে নিলে মায়া সভ্যতার সঙ্গে সঙ্গে মায়ানস ভাষাও বিলীন হতে থাকে। অধিবাসী ঔপনিবেশিক প্রভুদের ভাষা, স্প্যানিশে কথা বলতে শুরু করে।

পুরো মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকায় স্প্যানিশরা এত আধিপত্য বিস্তার করে যে এ অঞ্চলে একমাত্র স্প্যানিশ ছাড়া আর কোনও আদি ভাষার চিহ্নমাত্রও নেই। এখানে উল্লেখ্য, একমাত্র পর্তুগিজ উপনিবেশ ব্রাজিল ছাড়া সমগ্র মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা জয় করে নেয় স্প্যানিশরা। স্প্যানিশদের এত আধিপত্য সত্ত্বেও এখনও যে সাড়ে ৩ লাখ মানুষ মায়ানস ভাষায় কথা বলে এটাই এক বিস্ময়। মায়াদের সম্পর্কে আরও একটি কথা এখানে না বললেই নয়, নানারকম জাদু-মন্ত্রে মায়ারা বিশ্বাস করত, মন্ত্রের ইন্দ্রজাল তৈরিতে ওরা ছিল অতিশয় দক্ষ। হয়তো এ মায়া সভ্যতা থেকেই ভারত উপমহাদেশের অধিবাসীরা ‘মায়া’ শব্দটি নিয়েছে, যার অর্থ হল এক ধরনের মোহ, ইন্দ্রজালও বলা যায়।

চিচেন ইতসার প্রধান আকর্ষণ হল ‘দি পিরামিড অব কুকুলকান’। এর অন্য নাম হল এল কাস্তিলো। এল কাস্তিলো বা পিরামিড অব কুকুলকান নির্মিত হয়েছে ৮০০ খ্রিস্টাব্দে। এল কাস্তিলোর বিশেষত্ব হল এর চতুর্দিকে মূল প্লাটফর্মের ওপর ৯১টি করে সিঁড়ি রয়েছে। যার যোগফল দাঁড়ায় ৩৬৫।

মায়ারা যে পঞ্জিকা আবিষ্কার করেছে পিরামিড অব কুকুলকান নির্মাণ করে হয়তো তারই স্বাক্ষর রেখে গেছে। শুধু তাই নয়, এর চতুর্দিকে রয়েছে ৫২টি করে প্যানেল, বিশেষজ্ঞদের মতে, যা প্রতিনিধিত্ব করে কসমিক চক্রের ৫২ বছর। সৌরপঞ্জিকাও একই কথা বলে। কুকুলকান পিরামিডের রয়েছে নয়টি স্তর, গবেষকরা মনে করেন এ নয়টি স্তর মায়া বিশ্বাস অনুযায়ী প্রতিনিধিত্ব করে নয়টি স্বর্গের। মায়ারা সূর্যকে দেবতা হিসেবে পূজা করত, কুকুলকান পিরামিডের চূড়ায় নির্মিত মন্দিরটির নাম দিয়েছে সূর্য দেবতার মন্দির।

আমি মনে করি, কুকুলকান পিরামিডের নয়টি স্তর হল সূর্যের নয়টি গ্রহ আর ৫২টি প্যানেল হল বছরের ৫২টি সপ্তাহ। বিষয়টি আবিষ্কার করে আমি কিন্তু বিস্ময়ে কেঁপে উঠছি। সেই সুদূর ৮০০ খ্রিস্টাব্দে বা তারও আগে মায়া সভ্যতার জ্ঞানী-গুণী লোকরা আবিষ্কার করে ফেলেছিল সৌরজগতের নয়টি গ্রহের অস্তিত্ব। বিস্ময়কর নয় কি? বছরে দুটি উৎসব হয় কুকুলকান পিরামিডে। ২১ মার্চ বর্ণিল আলো-আঁধারির এক অদ্ভুত খেলা দেখতে ওখানে জড়ো হয় হাজার হাজার মানুষ।

তখন দেখা যায় এক সুবৃহৎ সরীসৃপ গড়াতে গড়াতে পিরামিডের পায়ের কাছে নেমে আসছে। ২১ সেপ্টেম্বর ঘটে তার উল্টো ঘটনা। তখন দেখা যায়, সরীসৃপটি উঠে যাচ্ছে উপরের দিকে, প্রবেশ করছে সূর্য মন্দিরের ভেতর। নৃতাত্ত্বিক গবেষকরা বলছেন, একটি ফসল বোনার সময় আর অন্যটি ফসল কাটার। আমি কিন্তু আরও একটি অর্থ খুঁজে পাই।

২১ মার্চে যখন সরীসৃপের আকারে আলোর ফোয়ারা নেমে আসে পিরামিডের নিচে তখন সূর্য তার আলোর দুয়ার খুলে দিয়ে পৃথিবীকে আলোকিত করে, অর্থাৎ দিবসের সূচনা হয় আর ২১ সেপ্টেম্বর যখন সরীসৃপ ওঠে যায় উপরের দিকে তখন সূর্য তার আলো ফিরিয়ে নিয়ে পৃথিবীতে রাত নামায়। এর আরও একটি ইঙ্গিত রয়েছে। ২১ মার্চ আলোর দুয়ার খুলে দিয়ে সূর্য দেবতা অধিবাসীকে জানিয়ে দেন আজ থেকে দিনগুলো বড় হতে শুরু করবে ঠিক একইভাবে ছয় মাস পরে ২১ সেপ্টেম্বর আলো গুটিয়ে নিয়ে সূর্য দেবতা তার ভক্তদের জানান দেন আজ থেকে রাতগুলো বড় হতে শুরু করবে। মায়া সভ্যতার রাজধানী চিচেন ইতসার মূল আকর্ষণ এল কাস্তিলো বা কুকুলকান পিরামিড নিয়ে যত ভাবছি ততই বিস্মিত হচ্ছি। জ্ঞান-বিজ্ঞানে কত অগ্রসর ছিল মায়ারা।

এখানে বিজ্ঞান, ধর্ম, মানবসভ্যতা সব যেন একাকার। না কি প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী ওদের ছিল অসীম জাদুবল, সেই জাদুবলে জেনেছিল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এসব অপার রহস্য। গবেষকদের কথা যদি ঠিক হয় যে ওরা এসব প্রস্তর নির্মিত স্থাপত্যশিল্প তৈরি করতে কোনও ধরনের মেটাল যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেনি, এগুলোকে ওপরে তুলতে সাহায্য নেয়নি কোনও জীব-জন্তুর বা টুপিকলের, তাহলে কিভাবে করল এসব? এ প্রশ্নের জবাব কি? ওরা কি তাহলে এসব নির্মাণ করেছে জাদুবলে? বিষয়টি সত্যিই ভাবায়। অন্য আকর্ষণীয় বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ‘দি টেম্পল অব দ্য ওরিয়রস’। অসংখ্য পাথরের থাম দাঁড়িয়ে আছে, এরই ভেতর এক সৈনিকের প্রতিকৃতি, বিশ্রামের ভঙ্গিতে বসে আছেন।

এটি মায়া টলটেকা-স্থাপত্যকর্মের অন্যতম এক আকর্ষণ হিসেবে বিবেচিত। পর্যটক মাত্রই এখানে ভিড় করেন। মধ্যযুগীয় সপ্তাশ্চর্যের তালিকায় চিচেন ইতসা ছিল না। এটি নতুন সংযোজন। এ সংযোজন যে কতখানি যুক্তিযুক্ত তা মেক্সিকোর ইউকাতান পেনিনসুলায় না গেলে আর নিজের চোখে মায়া সভ্যতার বিস্ময়কর স্থাপত্যশিল্পের বিচরণভূমি চিচেন ইতসা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।