আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এক বাংলাদেশী তরুণের কাহিনী- পর্ব-১

এই লেখার একটি ভূমিকা থাকা দরকার। তরুণটির সঙ্গে আমার পরিচয় ফেসবুকে। অন্য আরো অনেকের মতো এই তরুণ একদিন আমাকে একটি মেসেজ পাঠালো। লিখেছিল, ‘সালাম নেবেন। অনেকদিন থেকেই আপনার কাছে লিখবো লিখবো ভাবছি কিন্তু লেখা হয়ে ওঠছে না।

কি লিখবো আমি? লিখেতে গেলেই সব ব্যাক্তিগত বিষয় চলে আসে, গুছিয়ে লিখতে পারিনা। অযথা বাক্য ব্যয় হয়। দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যাই, লেখা ঠিক হবে কিনা। ’ মানুষের কথা শোনার আগ্রহ আমার বরাবরের। তারপর তার সঙ্গে আমার অনেক কথা হয়।

এখানে কিছুটা তুলে দিলাম। দেখুন তো, ছেলেটি বর্তমান তরুণ সমাজের প্রতিনিধি কিনা? ‘ক্লাশে আমি ছিলাম ফার্স্টবয়। গ্রামের স্কুল। নিন্মমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হওয়ায় বাড়িতে আমাকে সহায়তা করার মতো কেউ ছিল না। শিক্ষকের সহায়তাও খুব পেতাম না।

নিজের চেষ্টাতেই লেখাপড়া করতে হতো। আমার মনে আছে স্কুলে পরে যাওয়ার মতো আমার ভালো কোন জামা ছিলনা। দ্বিতীয় শ্রেণীতে যেদিন ফলাফল ঘোষণা অনুষ্ঠান হবে সেদিন আমি আমার সমবয়সী মামাতো ভাইয়ের শার্ট ধার করে পড়ে স্কুলে গিয়েছিলাম। আমাদের স্থানীয় এমপি সেদিনের সে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন। ফলাফল ঘোষণার সময় সবার আগে আমার নাম ঘোষণা করলেন স্যার।

এমপি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি হয়েছো? এতো ঘাবড়ে গিয়েছিলাম যে, চট করে উত্তর দিতে পারিনি। ২০০২ সালে বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র হিসেবে জিপিএ ৪ পেয়ে এসএসসি পাস করি। ওই বছরই আমাদের গ্রামের কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলো। কলেজ কর্তৃপক্ষের ইচ্ছার কাছে নিজের ইচ্ছা বিসর্জন দিতে হলো। আমাকে ভর্তি করা হলো বিজ্ঞান বিভাগে।

আমার ইচ্ছা ছিলো ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে পড়ার। আমার বয়সী অনেকের মতো আমিও ভুল করলাম। পড়াশোনার সাথে তাল মেলাতে না পারায় প্রথমবারে তো এইচএসসি পাসই করতে পারলাম না। দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দিয়ে পাস করলেও ভালো কোথাও ভর্তি হওয়ার মতো যোগাত্য থাকলো না। শেষে এক বন্ধুর দেখাদেখি সরকারি বাঙলা কলেজে ভর্তি হলাম ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে।

ছোটবেলা থেকে ইংরেজির প্রতি ঝোঁক ছিল। যাই হোক, তিন বছরের কোর্স শেষ করতে জীবনের সাতটি বছর হারিয়ে গেলো। শুরুটা কিন্তু ভালোই করেছিলাম। কিন্তু তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় এক মানসিক চাপে পড়ে যাই। আমার বাবা বাড়িতে গরু পালতেন।

২০০৬ সালের দিকে বাবা হাটে গরু কিনতে গিয়ে অজ্ঞান পার্টির খপ্পড়ে পড়েন। বাবাকে পাঁচ দিন হাসপাতালে রেখে সুস্থ করতে হয়। কিন্তু তখনো আমরা জানি না বাবার শরীরের মধ্যে কেমিকেলের বিষক্রিয়ায় কতো বড় ক্ষতি হয়েছে। ঘটনাটি ধরা পড়ল ২০০৮ সালে। অজ্ঞান হওয়ার ওই ঘটনার পর বাবা পেটে একটু একটু ব্যথা অনুভব করতেন।

কিন্তু বিষয়টিকে তিনি গুরুত্ব দেননি। ২০০৮ সালে মাঝামাঝি তিনি গুরুতর অসুস্থ হলে এলাকার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কোন রোগ ধরা পড়েনি। কিন্তু ডাক্তারদের সন্দেহ হলো। তারা বায়োপসি টেস্ট করানোর জন্য ঢাকায় রেফার করলেন।

এখানে এসে বাবার অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সার ধরা পড়লো। অ্যাডভান্স স্টেজ। তখন মিরপুর থেকে বাড়িতে ফিরলাম। কারণ বড় দুই ভাই তখন মধ্যপ্রাচ্যে দক্ষ শ্রমিকের কাজ করেন। অসুস্থ বাবাকে দেখার মতো কেউ নেই।

আমিই তাকে নিয়ে হাসপাতালে যাই। অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সার হলো ক্যান্সারের মধ্যে ভয়াবহতম ক্যান্সার। এধরণের রোগীকে চিকিৎসা না করালে রোগী ভয়ংকর যন্ত্রণা পেয়ে থাকেন। বাবাকে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে নিয়ে দৌড়ানো শুরু করলাম । অনেক অভিজ্ঞতা হলো আমার।

অসহায় রোগীদের নিয়ে ডাক্তার ও ক্লিনিককের মালিকরা কিরকম ব্যবসা করে তাও দেখলাম। দেখলাম জাতীয় ক্যান্সার হাসপাতালে রোগীদের কিরকম সেবা দেয়া হয়। বাবাকে আমি সেখানে একবারই নিয়েছিলাম। আমার বড় দুই ভাই-ই তখন মধ্যপ্রাচ্যের দুই দেশে ভালো অবস্থানে কাজ করেন। ওনাদের পাঠানো টাকায় বাবার চিকিৎসা হয়েছে।

তারপর ধারও করতে হয়েছে। এমনও হয়েছে বাবাকে হাসপাতালে রেখে আমি তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা দিতে গিয়েছি। তার শরীরের অন্যকোন রোগ ছিলনা। ক্যান্সারটাও হতো না যদি তাকে অজ্ঞান পার্টি তাকে ক্যামিকেল না খাওয়াতো। বাবাকে হারালাম।

৬৫ বছর বয়সে আমার বাবা মারা যান ২০০৯ সালের মার্চে। আমার তৃতীয় বর্ষের ফলাফল খারাপ হলো । সেকেন্ড ক্লাশ থেকে অনেক মার্কস পিছিয়ে ছিলাম। মানোন্নয়ন দিলাম, তাতেও ব্যবধান কিছু রয়েই গেলো। এরপর আর শহরে ফিরে যেতে পারিনি।

শহরে আমি যে অবস্থান তৈরি করেছিলাম তা আর অবশিষ্ট ছিলনা। শহরে থাকা-খাওয়ার যে খরচ তা পরিবার থেকে বহন করার সামর্থ্য আর অবশিষ্ট ছিল না। কারণ ততোদিনে অনেক টাকা ঋণ জমে গেছে। পরবর্তী দুই বছর গ্রামেই থেকে গেলাম। ফাইনাল পরীক্ষার ৬/৭ মাস আগে চলে এলাম সাভারে, অনেকটা নিজের খরচ নিজে চালানো তাগিদে।

এখন মনেহয় সিদ্ধান্তটা বোধহয় ভুলই ছিল। এখানে এসে নতুন চ্যালেঞ্জ। তিনটা প্রাইভেট টিউশন করতে হতো আমার সব খরচ জোগানোর জন্য। এদের সব কটিই ছিল বাচ্চা। এদেরকে সপ্তাহে ছয় দিনেই পড়াতে হতো।

এদের পড়িয়ে, এবং সাভার হতে কলেজে গিয়ে ফাইনাল ইয়ারের ক্লাশ করে এবং নিউ মার্কেটে স্যারের বাসায় সহায়ক পড়া পড়তে গিয়ে আমার নিজের পড়ার সময় থাকতো না। যে ব্যাচেলর হাউজে থাকতাম সেটা ছিল ব্যবসায়ীক ভিত্তিতে মালিকানায় পরিচালিত মেস। ওখানে হোটেলের মতো খাবার অর্ডার দিয়ে খেতে হতো। ওখানকার খাবারের মান এতোই খারাপ ছিল যে প্রথম দুই মাসের মধ্যেই আমি শুকিয়ে গিয়েছিলাম, টাকার অভাবে না খেয়েও থেকেছি অনেক রাতে। তারপর অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে পরীক্ষা দিতে পারলাম।

কিন্তু পরীক্ষার রুটিন ছিল অভূতপূর্ব! সবাই বলাবলি করছিল এমন রুটিন নাকি কখনো অনার্স পরীক্ষার হয়নি। যাই হোক রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে প্রায় ২ ঘন্টা বাসে বাদুর ঝোলা হয়ে অনেক জ্যাম পেরিয়ে সাভার হতে তিতুমীর কলেজে গিয়ে পরীক্ষা দেওয়ার কাজটি সারলাম। এটা যে কতো কঠিন ব্যাপার ছিল তা কেবল মাত্র ভুক্তভোগীই জানবে, আর কেউ বুঝবে না। আমার রেজাল্ট এখনো হয়নি। আমি আশাবাদী সেকেন্ড ক্লাশ হয়ে যাবে।

বাকিটা উপরওয়ালা জানেন। এখন জীবনটাকে খুব অর্থহীন মনে হয়। ’ (চলবে) Click This Link ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।