আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জামায়াতে ইসলামী আগাগোড়াই একটি অবৈধ সংগঠন

২৮ মার্চ দুপুরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যুদ্ধাপরাধী ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় দেওয়ার পর থেকে দেশজুড়ে অনেকদিন জামায়াতের সহিংসতা চলেছে। সে সঙ্গে তারা আমাদের যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর নানা ধরনের নাশকতা চালিয়েছে। আমাদের অর্থনীতির মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিতে ও জনমনে আতঙ্ক তৈরির চেষ্টা চালিয়েছে ওরা। পুলিশ সদস্যদের পর্যন্ত হত্যা করা হয়েছে। একটি দেশে এমন অরাজতা চলতে পারে না।

স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে জামায়াতে ইসলামীর মতো যুদ্ধাপরাধ সংঘটনকারী একটি দল এভাবে রাজনৈতিক তৎপরতা চালানোর অধিকার রাখে না। আমি তো বলব ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরেই দলটি এ অধিকার হারিয়েছে। ওইদিন ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি বাহিনি আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেছিল এটা আমরা জানি। কিন্তু এটা অনেকেই খেয়াল করেন না যে সে দলিলে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছিল যে, পাকিস্তানি বাহিনি তার সব অক্সিলারি ফোর্সসহ আত্মসমর্পণ করছে। এখানে অক্সিলারি ফোর্স বলতে বোঝানো হচ্ছে রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনিকে।

এ তিন বাহিনির পিতৃসংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীও এদেশে রাজনৈতিক তৎপরতা চালানোর অধিকার হারিয়েছে। একে আরও জোরালো করার জন্য বাহাত্তরের সংবিধানের আর্টিকেল ৩৮-য়ে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, ধর্মের নাম ব্যবহার করে কোনো ধরনের রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ। এসব আইনগত দিক ছাড়াও বাস্তব অবস্থার দিক থেকে জামায়াতে ইসলামীকে রাজনীতি করতে দেওয়ার সুযোগ ছিল না। তাদের অনেক নেতা তখন জেলে ও আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকলেও, দেশের বাইরে থেকে কেউ কেউ তখনও বাংলাদেশবিরোধী নানা তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর সাংগঠনিক তৎপরতা বৈধ করে দেওয়া হল।

এরই ফলে নানা সমঝোতার মাধ্যমে জামায়াত আবার রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হওয়ার সুযোগ পেল। জিয়াউর রহমান এ ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। এ জন্যই পরে আমরা দেখেছি যে, জিয়াউর রহমানের এ ব্যবস্থা বৈধ ছিল কিনা সেটা কোর্টে উপস্থাপন করা হলে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে এ মর্মে রায় দেন যে, সংশোধনীটি ছিল অবৈধ। শুধু তাই নয়, এ সংশোধনীর মাধ্যমে গৃহীত সব পদক্ষেপ অবৈধ ঘোষিত হল। রায়ে আরও বলা হল, আমাদের বাহাত্তরের সংবিধানের ধারাগুলোতে প্রত্যাবর্তন করতে হবে।

এ রায়ের ফলে অবস্থাটা এই দাঁড়াল যে, কার্যত আর্টিকেল ৩৮ পুনঃপ্রবর্তিত হল। তখন আইনমন্ত্রী জনসমক্ষেই বলেছিলেন যে, কোর্টের এ রায়ের ফলে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়ে গেল। কিন্তু বাস্তবে কোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী বাহাত্তরের সংবিধানে আর্টিকেল ৩৮-য়ের যে বয়ানটি ছিল, সেটিকে হুবহু সংবিধানে না ঢুকিয়ে পঞ্চদশ সংশোধনীতে তাতে কিছুটা পরিবর্তন আনা হল। এটা এমনভাবে করা হল যে, এর ফলে বাহাত্তরের সংবিধানের অধীন জামায়াতে ইসলামী যেমন স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল- এখন আর সেটা রইল না। ওই অর্থে এটাই সত্য যে, জামায়াতে ইসলামীকে একবার বৈধতা দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান, আরেকবার একে বৈধ করলেন মহাজোট সরকার।

কিন্তু কোর্ট আমাদের জানিয়েছেন যে ওইভাবে এদের বৈধতা দেওয়া যায় না। প্রথমবার জানিয়েছেন এভাবে যে পঞ্চম সংশোধনী বৈধ ছিল না। দ্বিতীয়বার যদিও এটা কোর্টে উত্থাপিত হয়নি, তবে হলেও এটা বোঝা যায় যে, একই রায় আসত- আর তা হল, রাষ্ট্রের অন্যতম আদর্শ বা মূলনীতি যদি হয় ধর্মনিরপেক্ষতা তাহলে বাহাত্তরেরর আর্টিকেল ৩৮-এ হাত দেওয়া যায় না। এ জন্যই আমি বলব, জামায়াতে ইসলামী আগাগোড়াই একটি অবৈধ সংগঠন- সেই একাত্তর সাল থেকেই। একে যে বৈধতা দেওয়া হয়েছে সেটা প্রথমবারও ছিল অবৈধ, দ্বিতীয়বারও তাই।

অন্য আরেকটি দিক থেকে আমি মনে করি জামায়াত অবৈধ একটি সংগঠন। বিশ্ব ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাব যে, যে সব সংগঠন গণহত্যা পরিচালনা করেছিল সেগুলো যুদ্ধাপরাধী হিসেবে গণ্য হযেছে। আর প্রমাণিত যুদ্ধাপরাধী কোনো সংগঠন এমনিতেই অবৈধ হয়ে যায়। যুদ্ধাপরাধের দায়ে জার্মানিতে নাজি পার্টিকে এবং বর্ণবাদী কাজকর্মের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে ক্লু-ক্লাক্স-ক্লান নামের একটি পার্টিকে অনন্তকালের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশেও সন্ত্রাসী কাজকর্ম পরিচালনার জন্য হিজবুত তাহরির ও হরকাতুল জিহাদের মতো সংগঠন চিরতরে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

সর্বশেষ যে যুক্তি আমি দেব তা হল, জামায়াতে ইসলামী কোনো রাজনৈতিক দল নয়, এটি একটি সন্ত্রাসী সংগঠন। যদি আল কাযেদা বা তালেবানের মতো সন্ত্রাসী সংগঠনকে বিশ্বজুড়ে নিষিদ্ধ করা হয়, তবে জামায়াতকেও করা উচিত। কারণ তারাও একইভাবে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন। অথচ বিস্ময়কর ব্যাপার এটাই যে, জামায়াতের মতো একটি সন্ত্রাসী সংগঠনের গণতান্ত্রিক অধিকারের পক্ষে কথা বলছেন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। তাতে এটাই প্রমাণ হয় যে, তারা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কোনো রকম নীতি-নৈতিকতার ধার ধারেন না।

নিজেদের যখন যেভাবে সুবিধা সেভাবে নৈতিকতার কথা বলেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এ ধরনের সুবিধাবাদী নৈতিকতা আমাদের মেনে নেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। একটি দেশ কীভাবে চলবে, জাতীয় পর্যাযে কী কী পদক্ষেপ নেবে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার সে দেশের জনগণের। সম্প্রতি শাহবাগের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমাদের দেশের জনগণ রায় দিয়েছে যে, জামায়াত একটি যুদ্ধাপরাধী সংগঠন বলে এদেশে এদের রাজনীতি করার কোনো অধিকার নেই। ওই সংগঠনটি গত কয়েক মাস ধরে যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচাল করার জন্য সহিংসতা ও তাণ্ডব চালাচ্ছে- এমনকি রাষ্ট্রীয় আইনের মাধ্যমে বৈধ একটি ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে যেভাবে যুদ্ধে অবতীর্ণ হচ্ছে তাতে তারা নিজেদের সন্ত্রাসী সংগঠন বলেই প্রমাণ দিচ্ছে।

এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তারা রাষ্ট্রদ্রোহিতাও করছে। কয়েক বছর আগেও এরা গান পাউডার ও রগকাটার রাজনীতি করত। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে জামায়াত গত কয়েক দশকে কেন এভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠল? আমাদের রাজনীতিবিদরাই-বা কেন দলমত নির্বশেষে জামায়াতকে রাজনীতিতে শক্তিশালী করে তুলেছেন? এর জন্য আমি মূলত দায়ী করব মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে। ওরা জামায়াতকে বরাবরই একটি মডারেট মুসলিম দল বলে মনে করে এসেছে। ফলে ওরা জামায়োতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে।

সে সঙ্গে আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর তারা জামায়াতের সঙ্গে সহাবস্থানের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়েছে। সম্প্রতি মার্কিন রাষ্ট্রদূত জামায়াতের সঙ্গে সংলাপে বসার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে আহ্বান জানিয়েছেন। একাত্তরে আমাদের মুক্তিসংগ্রামের ব্যাপারে একই ধরনের ভূমিকা রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। একই ভাষায় কথা বলেছে ওরা। আমাদের প্রধান দলগুলো মূলত রাজনীতি করার সুবিধার্থে যুক্তরাষ্ট্রকে চটাতে চায় না।

কারণ তাহলে তারা ক্ষমতায় যেতে পারবে না বলে ভয় পায়। আর এ জন্যই বড় দলগুলো নানা সময়ে জামায়াতকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ওদের কোলে টেনে নিয়েছে। আর আওয়ামী লীগ সবসময় চেষ্টা করেছে জামায়াত যাতে তাদের কাছে না থাকলেও বিএনপির কাছ থেকে দূরে থাকে। দু’দলের এ ধরনের আত্মঘাতী কৌশলের ফলে জামায়াত বস্তুত, বিএনপির কাঁধে ভর করে আমাদের রাজনীতিতে জায়েজ হয়েছে।

আর কৌশলগত ঐক্যের নামে আওয়ামী লীগ ওদের সঙ্গে সংলাপ করে ওদের অবস্থান পাকাপোক্ত করেছে। রাজনীতিতে এভাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার পর জামায়াত প্রয়োজনমতো নিজেদের বিকাশ ঘটিয়েছে। গত জোট সরকারের আমলে জামায়াত প্রশাসনের মাধ্যমে সমাজে গভীরভা্বে অনুপ্রবেশ করেছে। ওই দলের দুজন তখন সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে জামায়াত তাদের বিশাল অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে, বছরে যার পরিমাণ ১২ হাজার কোটি টাকা।

এ অর্থ দিয়ে এরা দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একটি অংশ এদের লবিংয়ের ফলে প্রভাবিত হয়েছে। হাজার কোটি ডলার খরচ করে এরা এসব লবিংকে নিজেদের অনুকূলে ব্যবহার করেছে। এমন একটি প্রতিকূল পরিস্থিতিতেই আমাদের তারুণ্য হাল ধরল। ক’দিন আগেও অনেকেই বলত যে, এখনকার তারুণ্য অতীতের দিকে তাকাতে চায় না, কারণ তাতে জাতি বিভক্ত হয়ে যাবে।

এ ধরনের প্রতিটি কথা মিথ্যে বলে প্রমাণিত হয়েছে। শাহবাগে সমবেত হয়ে তরুণরা বলে দিয়েছে যে, আসলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে যাবে। এ তরুণরাই একদিন বয়োজ্যেষ্ঠ হবে। তাদের হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত রয়ে যাবে এ চেতনা। আর এভাবেই জনগণের কণ্ঠ সোচ্চার থাকলে একাত্তরের ঘৃণিত যুদ্ধাপরাধীদের প্রাপ্য সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা যাবে।

জামায়াতের লবিংয়ের দ্বারা প্রভাবিত হযে বিশেষ করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যারা বলেন যে, মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার মাধ্যমে মানবাধিকারের লঙ্ঘন হয়, তাদের উদ্দেশে বলব- গণহত্যার অপরাধের মাত্রা ভিন্ন। অবশ্য এটা তারা খুব ভালো করেই জানেন। আর তাই এখন জামায়াতের যুদ্ধাপরাধী নেতাদের পক্ষে ওরা চিৎকার-চেঁচামেচি করলেও, একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী ত্রিশ লাখ মানুষকে হত্যা করার পরও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল টু শব্দটি করেনি। বরং যুদ্ধশেষে পাকসেনাদের যখন বন্দী করা হল তখন ওরা ওই সেনাদের মানবাধিকার রক্ষার্থে বাংলাদেশে একটি মিশন পাঠিয়েছিল! তাদের অতীতের এসব ভ্রান্তি ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কর্মকাণ্ড বলে দেয় যে, যুদ্ধাপরাধী ও জামায়াত প্রসঙ্গে তারা এ ধরনের ভূমিকাই সবসময় পালন করবে। আফগানিস্তানের তালেবানরাও তাদেরই সৃষ্টি।

তাই আমরা মনে করি, আমাদের জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে আগামীতে এ দেশে জামায়াতের রাজনীতি করার সুযোগ কতটুকু থাকবে কি থাকবে না। সম্প্রতি ট্রাইব্যুনালের আইনে কিছু পরিবর্তন আনার ফলে যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতকে অভিযোগের কাঠগড়ায দাঁড় করানোর যে পরিস্থিতি তৈরি হযেছে তাতে এ দলের নেতারা গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত হবেন। জাতিও দায়মুক্ত হবে। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)। বিডিনিউজ২৪.কম ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.