আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে পা দেবেন না : কাজী জাকের হোসেন

আমার ভুবন কান পেতে রয় ... ... দ্বীপ নিভে যায় সকলই ঘুমায় মোর আঁখি রহে জাগিয়া এটা জাকের স্যারের সর্বশেষ লেখা। ২৪ জুন ২০১১ দৈনিক নয়াদিগন্তে প্রকাশিত। লেখাটি গুরুত্বপুর্ন মনে হয়েছে। তাই এখানে শেয়ার করলাম। -------------------------------------------------------------- ১. (ক) ইংরেজি 'ইনডেজিনাসindigenous' শব্দটির বৈজ্ঞানিক পরিভাষা হচ্ছে ‘আদিবাসী’।

বিশ্বের যেখানে যারা প্রথম থেকে বাস করে আসছে তারাই সেখানকার আদিবাসী। এ শব্দটির বিকল্প হচ্ছে ‘ঊসিয়মধ’, যার বাংলা পরিভাষা হচ্ছে ‘বহিরাগত’। (খ) পার্বত্য চট্টগ্রামের বেশির ভাগ মানুষ হচ্ছে মঙ্গোলীয় (বা Mangolid Human type¬ - এদের মধ্যে অন্তত ১২টি Sub-types আছে)। এরা যদি প্রথম থেকেই ওই এলাকার অভিবাসী হয়, তবে তারা ওখানকার ‘আদিবাসী’। একইভাবে বাংলাদেশের সমতলের মানুষ হচ্ছে ককেশীয় (বাcaut) আদিবাসী।

(গ) আমরা আরো জানি, দেশ বিভাগের আগে শেরেবাংলা যখন বঙ্গপ্রদেশের চিফ মিনিস্টার, তখন জমিদারিপ্রথা বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। তখন থেকে এ প্রদেশে রাজা, মহারাজা বা জমিদার সব বিলীন হয়ে যায়, আমরা রাজা-প্রজা সবাই সমান হয়ে যাই। তবে ব্রিটিশের সুপরিচিত ডিভাইড অ্যান্ড রুল নীতিমালায় পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের মঙ্গোলীয় মানব গোষ্ঠীর (সব সাব টাইপসহ) আবাসভূমিকে অদ্ভুত এক ‘উপজাতীয়’ আখ্যা দিয়ে ওই অঞ্চলকে তিনটি সার্কেলে ভাগ করে, যেমন চাকমা সার্কেল, মগ সার্কেল এবং বোমাং সার্কেল। তারা প্রত্যেক সার্কেলের জন্য একজন চিফ বা রাজা নিয়োগ করে। প্রত্যেক সার্কেলকে কয়েকটি মৌজায় এবং প্রত্যেক মৌজাকে অনেকগুলো পাড়ায় ভাগ করে।

প্রত্যেক মৌজায় একজন হেডম্যান এবং প্রত্যেক পাড়ায় একজন কারবারি নিযুক্ত হয়। চিফ বা রাজাদের বংশানুক্রমিকভাবে সরকার নিয়োগ দেয় এবং মৌজার হেডম্যান ও পাড়ার কারবারিকে রাজা নিয়োগ দেন। পাড়ার সাধারণ মানুষ থেকে কারবারি খাজনা উসুল আদায় করে হেডম্যানকে দেয় এবং হেডম্যান তা রাজার কাছে জমা দেন। রাজা তার অংশ কেটে রেখে বাকিটা সরকারি ট্রেজারিতে জমা দেন। (ঘ) জমিদারিপ্রথা চলে গেলেও পাহাড়ি অঞ্চলের বংশানুক্রমিক রাজার অবস্থান চলে আসছে।

এখন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সব মানুষ সমান। কিন্তু পার্বত্য সার্কেলগুলোর রাজারা তাদের কৌলিন্য হারানোর ভয়ে ‘আদিবাসী’ শব্দটির ভুল ও মতলবি অর্থ করে নিজেদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে ঘোষণা করছে। তারাই যদি বাংলাদেশের ‘আদিবাসী’ হয়, তবে আমরা সবাই বহিরাগত হয়ে যাব। পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো এত শতাব্দী ধরে আফ্রো-এশিয়া-আমেরিকার দেশগুলোকে শোষণ করে আসছে। আমেরিকার আদিবাসীদের এবং Australian aborigine-দের তাদের নিজেদের দেশে রিজার্ভে আবদ্ধ করে রেখেছে।

আমাদের দেশে কিছু বিদেশী ও দেশী এনজিও পাহাড়িদের সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আমাদের কিছু বুদ্ধিজীবীর সাম্প্রতিক কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে, তারা মানব ইতিহাস এবং আদি বিস্তৃতির কোনো খবরই রাখেন না। সামাজিক ও আর্থিক দুর্বলতার কারণে কিছু কিছু মানবগোষ্ঠী পেছনে পড়ে থাকলেও পৃথিবীর সব মানব এক ও অভিন্ন। ৩. গত ২০০৮ সালের ২ ডিসেম্বর দৈনিক নয়া দিগন্তে ‘আদিবাসী’ কথাটির ওপর ভিত্তি করে, আমাদের বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী নিয়ে আমি আলোচনা করেছিলাম। প্রফেসর সি এস কুন ১৯৫০ সালে ১৪৯২ সালের বিশ্বব্যাপী জনগোষ্ঠীর যে ছয়টি Human types চিহ্নিত করেন, তাদের তৎকালীন সম্ভাব্য বিস্তৃতি নিয়ে আলোচনা করেছেন।

তার আলোচনার ভিত্তিতেই উপরি উক্ত প্রবনধ লিখেছিলাম। তবে তার সাথে আমি কোনো ম্যাপ যোগ করিনি। সে প্রবনধটিই মূলত আজকে আবার আমার আলোচনায় এনেছি এবং সেই সাথে Human types-এর বিস্তৃতির একটি ম্যাপ যোগ করেছি। আশা করি, এতে বিষয়টি বুঝতে পাঠক-পাঠিকাদের সুবিধা হবে। ‘আদিবাসী’ শব্দটি নিয়ে সম্প্রতি সর্বস্তরে যে অনাবশ্যক বিতর্ক শুরু হয়েছে, তাতে আমাদের দেশ ও জনগণের জন্য কঠিন সমস্যা দেখা দিতে পারে, সে জন্য আজকের প্রবনধটি লিখলাম।

আমাদের আইনমন্ত্রীর সাম্প্রতিক একটি বক্তব্যে উৎসাহিত হয়েই লিখছি। ১. আমার আজকের নিবনেধর শিরোনাম দেখে পাঠকদের অনেকেই হয়তো চমকে যাবেন। কিন্তু কেন এমন শিরোনাম দিলাম, তার সপক্ষে সমমানিত পাঠকদের সামনে আমার বক্তব্য তুলে ধরব। লেখকের মতামত প্রকাশের সুযোগ দেয়ার গৌরবময় ঐতিহ্য নয়া দিগন্তের আছে। একান্ত বাধ্য হয়ে এসব বক্তব্য তুলে ধরতে যাচ্ছি।

বিষবৃক্ষকে অঙ্কুরেই উপড়ে ফেলা উচিত। অন্যথায় এটি এক সময় বিরাট মহীরুহে পরিণত হয়ে দেশ ও জাতির জন্য ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করছি এবং যতই ভাবছি, ততই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ছি। দেখতে পাচ্ছি, বেশ কিছু দেশী-বিদেশী লোক, বেশ কিছু এনজিও, সেই সাথে ইচ্ছাকৃতভাবে অসৎ উদ্দেশ্যে অথবা সামর্থ্য না বুঝে আমাদের দেশের কিছু প্রতিষ্ঠান, এমনকি রাজনীতিবিদও সেই বিষবৃক্ষের গোড়ায় পানি ঢেলে, সার দিয়ে সেটিকে বড় করে তুলছেন এবং সযত্নে রক্ষা করার চেষ্টা করছেন। ২. বিশ্বের মানবগোষ্ঠী বায়োজিওগ্রাফি আমাদের প্রাণিবিদ্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা।

ফাইটোজিওগ্রাফি (Phytogeograph) হচ্ছে উদ্ভিদের ভৌগোলিক বিস্তার এবং জুওজিওগ্রাফি (Zoogeography) হচ্ছে প্রাণীদের ভৌগোলিক বিস্তার। এ দু’টি শব্দ মিলে হচ্ছে বায়োজিওগ্রাফি বা জীবভূগোল। এ শাখার মাধ্যমে আমরা সমগ্র বিশ্বের উদ্ভিদ ও প্রাণীর বর্তমান বিস্তৃতির তথ্য জানতে পারি। জীববিজ্ঞানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ। এটা আজকাল অন্যান্য বিষয়ের সাথেও যুক্ত হয়েছে।

তবে জীববিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীদের কাছে এটি যত গুরুত্বপূর্ণ, অন্যদের কাছে সম্ভবত ততটা নয়। তবুও আজকাল ‘টক অব দ্য টাইম’ হয়ে গেছে ‘পরিবেশ’। প্রাকৃতিক পরিবেশের দু’টি অংশ আছে। একটি হচ্ছে অজৈব পরিবেশ। এটি আলো, বাতাস, তাপ ইত্যাদির সমন্বয়ে গঠিত।

আরেকটি অংশ হচ্ছে জৈবপরিবেশ। ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, উদ্ভিদ ও প্রাণীর সমন্বয়ে এ জৈবপরিবেশ গঠিত। অজৈব পরিবেশের ওপর ভিত্তি করে একটি এলাকায় যে উদ্ভিদ ও প্রাণীর আবির্ভাব, সেগুলোকে ইংরেজিতে বলা হয় Indigenous. মানুষের ক্ষেত্রে এ শব্দটি ব্যবহার করে বলা হয় Indigenous people. এই indigenous শব্দটির ভিন্ন অর্থ হচ্ছে primitive বা Native এসব শব্দেরও কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। পৃথিবীর মানুষের মধ্যে যে বিস্ময়কর বৈচিত্র্য দেখা যায়, তা অন্য কোনো প্রাণীতে দেখা যায় না। সীমাহীন বৈচিত্র্য থাকা সত্ত্বেও সব মানুষ জীববিজ্ঞানের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, একই প্রজাতিভুক্ত।

অন্য কোনো একটি প্রাণিপ্রজাতির মধ্যে এমন বৈচিত্র্য দেখা যায় না। প্রাণীদের শ্রেণিবিন্যাসে একটি গোত্র বা Family-কে একাধিক ‘গন’ (Genus) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। গনকে আবার প্রজাতি species-এ চিহ্নিত করা হয় এবং প্রজাতিকে আবার উপপ্রজাতি বা Sub-species-এ বিভক্ত করা হয়। কিন্তু সব মানুষ একই গোত্রের একই প্রজাতির। তার মধ্যে কোনো উপপ্রজাতিও চিহ্নিত করা হয় না।

যেমনটা আগেই বলেছি, মানুষের মধ্যে বৈচিত্র্যের শেষ নেই। দেহের আকার-আকৃতি, মাথার আকার-আকৃতি, মুখাবয়বের ভিন্নতা, চোয়াল, নাক ও ঠোঁটের আকৃতি, চোয়ালের হাড়ের আকৃতি, ভুরুর পরিমাণ, মাথার চুলের আকার-আকৃতি ও রঙ, দেহের কেশের পরিমাণ এবং দেহের বর্ণের ভিত্তিতে বিজ্ঞানীরা মানবজাতিকে বিভিন্ন Type বা গোষ্ঠীতে চিহ্নিত করেছেন। এসব human type-কে আবার বিভিন্ন sub-type এবং sub-sub-type-এও চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। তবে এসব human type- চিহ্নিতকরণ কোনো প্রকার বৈজ্ঞানিক শ্রেণিবিন্যাস নয়। ড. সি এস কুন (Dr. C S Coon) ১৯৫০ ও ১৯৫৭ এবং ড. এস কোল (Dr. S Cole) ১৯৬৩ সালে, উপরোল্লিখিত বৈশিষ্ট্যগুলোর ভিত্তিতে মানবজাতির প্রধান ছয়টি Human types চিহ্নিত করেছেন।

Human types-কে আবার sub-type এবং sub-sub-types-এও চিহ্নিত করেছেন। প্রথম টাইপ হচ্ছে ‘নিগ্রোয়েড’ Negroid। এদের আমরা সাধারণভাবে নিগ্রো বলে জানি। এদের আদি বাস সাহারার দক্ষিণে আফ্রিকা মহাদেশে। দ্বিতীয় হচ্ছে ‘ককেশয়েড’ টাইপ।

এদের সাধারণভাবে বলা হয় শ্বেতাঙ্গ। তবে এরা শ্বেতাঙ্গ থেকে বাদামিও হয়ে থাকে। এদের আদিবাস ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, আফগানিস্তান হয়ে বাংলাদেশসহ ভারতের সব সমতল ভূমিতে। তৃতীয় হচ্ছে ‘মঙ্গোলয়েড’। সাধারণভাবে এরা হলুদ টাইপ বলে পরিচিত।

তিব্বত, চীন, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তাদের আদি বাসস্থান। মঙ্গোলয়েড টাইপ ধীরে ধীরে বেরিং প্রণালী অতিক্রম করে আমেরিকার বিশাল অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা এবং মেরু অঞ্চলের এসকিমোরা সবাই মঙ্গোলীয়। ১৪৯২ সালে কলম্বাস আমেরিকা উপস্থিত হয়ে এ মঙ্গোলীয়দেরই সাক্ষাৎ পান। তবে তিনি ভেবেছিলেন, ইন্ডিয়া পৌঁছে গেছেন, তাই ওই সব লোককে ভুল করে রেড ইন্ডিয়ান বলে আখ্যায়িত করেন।

কারণ তাদের দেহবর্ণ গাঢ় বাদামি। চতুর্থ টাইপ হচ্ছে অস্ট্রায়েড। এদের Australian Aborigine বা অস্ট্রেলীয় কৃষ্ণাঙ্গ বলা হয়। বাকি দু’টি ছোট টাইপ হচ্ছে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপবাসী এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বুশম্যান। (গ) ‘আদিবাসী’ কাকে বলে? ইংরেজি Indigenous শব্দটির বাংলা অর্থ কী? বাংলা ১৩৪৫ সালের আধুনিক বাংলা ভাষার অভিধান, রাজশেখর বসুর চলন্তিকা অভিধানে ‘আদিবাসী’ শব্দটি দেখতে না পেয়ে হতবাক হয়েছি।

তবে আমাদের বাংলা একাডেমীর বাংলা ১৪০৬ সালের অভিধানে ‘আদিবাসী’ শব্দটি পেয়েছি। তার অর্থ কি এমন হতে পারে যে, আজকাল আমরা ‘আদিবাসী’ ‘আদিবাসী’ বলে চিৎকার দিয়ে বেড়াচ্ছি অথচ মাত্র ৬১ বছর আগে এ শব্দটি আমাদের বাংলা ভাষায় প্রচলিত ছিল না! ইংরেজিতে যে অর্থে Indigenous people বলা হয়ে থাকে, বাংলায় সে অর্থেই আমরা ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার করে থাকি। এতে দোষের কিছু নেই। নিগ্রোরা আফ্রিকা মহাদেশে (সাহারার দক্ষিণে) আদিবাসী। শ্বেতাঙ্গরা ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশের সমতলের আদিবাসী।

Australian Aborigine অর্থ, অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী। মঙ্গোলীয়রা তিব্বত, চীন, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আদিবাসী এবং তারা কলম্বাসের হাজার হাজার বছর আগে আমেরিকার মহাদেশগুলোয় ছড়িয়ে পড়েছিল বলে সেখানকারও আদিবাসী। মঙ্গোলীয় আদিবাসীরা দক্ষিণ দিকে হিমালয়ের পাহাড়ি এলাকা, আসাম ও মিয়ানমারেও ছড়িয়ে পড়েছিল। মিয়ানমার থেকে তারা পশ্চিমে বিস্তৃত হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু এলাকায়ও ছড়িয়ে পড়ে। ইউরোপের শ্বেতাঙ্গ ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো যখন আফ্রিকা, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকায় আধিপত্য বিস্তার করে উপনিবেশ স্থাপন করে, তখন থেকেই indigenous শব্দটি জোরেশোরে ব্যবহৃত হতে থাকে।

বোধগম্য কারণেই তারা বুঝতে পারে যে, বিভিন্ন দেশের স্থানীয় লোকজন থেকে তারা অনেক ভিন্ন এবং বেশি ক্ষমতাধর। indigenous শব্দটির বিপরীতে আরেকটি শব্দ আছে এবং তা হচ্ছে Exotic। ভিন্ন কোনো মহাদেশের কোনো গাছপালা বা প্রাণী যদি আমরা আমাদের দেশে চালু করি, তবে তাকে বলব Exotic plant or animal. এই Exotic শব্দটির বাংলা অর্থ হচ্ছে ‘বিদেশী’ বা বহিরাগত। ইতিহাসবিদেরা জানেন এবং আমরা প্রাণিভূগোলের ছাত্রছাত্রীরাও জানি, ইউরোপীয়রা আফ্রিকার নিগ্রোদের ঘরছাড়া করে দেশের অনাবাদি কঠিন এলাকায় Reserve Area-তে পাঠিয়ে দিয়েছিল। তাদের উর্বর জায়গায় এই বিদেশীরা নিজেদের খামার গড়ে তোলে এবং পর্বতের উর্বর অংশ Reserve forest or National park হিসেবে গড়ে তোলে।

একইভাবে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের আদিবাসীদের অনুর্বর এলাকায় পাঠিয়ে দেয় এবং আমেরিকায়ও ঠিক তা-ই ঘটেছে। ওই সব মহাদেশের আদিবাসীরা আপন ঘরে পর হয়ে কঠিন জীবন যাপন করতে থাকে। আর ইউরোপের লোকজনকেই আমরা অস্ট্রেলিয়ান, নিউজিল্যান্ডার, আমেরিকান ইত্যাদি হিসেবে দেখতে পাই। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে ধীরে ধীরে অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে। আফ্রিকার নিগ্রোরা স্বাধীন হতে থাকে।

আমরা এখন শুনতে পাই, জায়গার অধিকার নিয়ে মামলা করে অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকার জপঢ়পড়ংপ এলাকার জাগ্রত আদিবাসীরাও তাদের হারানো জায়গা ফিরে পেতে শুরু করেছে। এখন ওই সব দেশের বহিরাগতরা স্থানীয়দের মন জয় করার জন্য ‘আদিবাসী’দের স্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত। ভারতীয় উপমহাদেশের ব্যাপারটা কিছুটা ভিন্ন। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি পার্বত্য অঞ্চলের মঙ্গোলীয়দের ‘আদিবাসী’ বলে চিহ্নিত করেছিল এবং সেভাবে তাদের পৃথক পন্থায় শাসন করতে থাকে। উপমহাদেশের সমতলের বিচিত্র বৈশিষ্ট্যের মানুষকে ককেশীয় বা শ্বেতাঙ্গ টাইপ বলে স্বীকার করে নিতে তাদের সমমানে বাধে।

আবার এদের ‘আদিবাসী’ বলতেও ইতস্তত করে। তাই নতুন শব্দ ব্যবহার করতে থাকে; তা হলো, ‘নেটিভ’। আসলে Native-এর ভিন্ন অর্থ, তা আগেও বলেছি। ব্রিটিশ আমলে- এমনকি পাকিস্তান আমলেও জেলা প্রশাসকদের বলা হতো ম্যাজিস্ট্রেট। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসককে বলা হতো ‘হাইকমিশনার’ এবং তার ক্ষমতাও ছিল অনেক বেশি।

অর্থাৎ আমরা ছিলাম দ্বৈত শাসনভুক্ত। (ঘ) বাংলাদেশীঃ আমরা সবাই আদিবাসী ইংরেজিতে আরো দু’টি শব্দ আছে, যা আমরা সাধারণভাবে ব্যবহার করে থাকি। একটি হচ্ছে Migration এবং অন্যটি mmigration । সাধারণ অর্থে শব্দ দু’টি যে উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়, প্রাণিভূগোলে সে অর্থে ব্যবহার করা হয় না। মানুষ যখন Migrate করে তখন বলা হয় ভিন্ন দেশে স্থায়ীভাবে বাস করতে যাওয়া।

তারা নতুন দেশে বিদেশী বা পরদেশী বলে অভিহিত হয়। সে অর্থে যারা ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড বা আমেরিকায় গেছে, তারা সবাই immigrant.. ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাসে সেসব দেশের মালিক আর আদিবাসীরা এখনো বাস করছে Reserve Area -তে। কেউ কি এটা অস্বীকার করতে পারবে? আবার এখন যেসব এশীয় বা আফ্রিকান ইউরোপ, আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়ায় যায় তারা হয়ে যায় immigrant এবং সেসব দেশে বসবাস করতে গেলে তাদের নানা লাঞ্ছনা-যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়- এমনকি আজকাল সেখানে যাওয়ার ক্ষেত্রেও শত বাধা। প্রাণীদের ক্ষেত্রে বিশেষ করে পাখিদের ক্ষেত্রেও migration শব্দটি ব্যবহার করা হয়। এর অর্থ হচ্ছে, পাখিরা বছরের একটি বিশেষ সময় অন্য দেশে অতিবাহিত করে আগের স্থানে ফিরে যায় এবং তখন প্রজননসহ বাকি কাজ সেরে নেয়।

এটি প্রতি বছরই ঘটে। অর্থাৎ migration বা অভিপ্রয়াণী পাখিদের কোনো স্থায়ী বাসস্থান নেই, তাদের আছে winter quarter, যেখানে শীতের দিনগুলো কাটায় এবং summer quarter, যেখানে প্রজননকাল কাটায়। আশা করি, পাঠক এই গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য উপলব্ধি করতে পেরেছেন। প্রথম দিকে যে ব্যাখ্যা দিয়েছি, তাতে আশা করি সপষ্ট হয়েছে যে, Human types হিসেবে ভারতীয় উপমহাদেশে দু’টি টাইপ আছে। একটি হলো ককেশয়েড টাইপ এবং অন্যটি মঙ্গোলয়েড টাইপ।

এখানে একটি কথা বলা দরকার, দক্ষিণ ভারত ও শ্রীলঙ্কার তামিল এবং আন্দামান নিকোবরের আদিবাসী সম্বনেধ বিভিন্ন বিজ্ঞানীর বিভিন্ন মত আছে। আমি দেখানোর চেষ্টা করেছি, শ্বেতাঙ্গ বা ককেশয়েড টাইপ ইউরোপ, সাহারা অঞ্চল, মধ্যপ্রাচ্য ও আফগানিস্তান হয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের সমতল অঞ্চলে অবস্থান নিয়েছিল। তাই তারা এসব অঞ্চলের আদিবাসী। আবার মঙ্গোলীয়রা এক দিকে আমেরিকায় পৌঁছে যায় এবং অন্য দিকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বে হিমালয় পার্বত্য অঞ্চল, আসামসহ পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। এরা এসব অঞ্চলের আদিবাসী।

মিয়ানমার থেকে এই মঙ্গোলীয় টাইপ আদিবাসীরা পূর্ব দিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। সমতল আগেই ককেশীয়দের দখলে চলে যায়। মঙ্গোলীয়দের আসার আগে যদি ককেশীয়রা হিমালয়, আসাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম পর্যন্ত অবস্থান নিয়ে থাকে, তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের মঙ্গোলীয়রা বাংলাদেশের এ এলাকায় immigrant হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এসব এলাকায় যারাই প্রথমে এসে থাকে, তারাই ওই অঞ্চলের আদিবাসী। তাহলে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশী আমরা সবাই আদিবাসী; শুধু মঙ্গোলীয়রা নয়।

বাংলার সমতলের আদিবাসীরা অর্থাৎ বাঙালিরা পার্বত্য চট্টগ্রামসহ যেকোনো এলাকায় বসবাস করার অধিকার রাখে, তেমনি পাহাড়ি এলাকার আদিবাসীরাও বাংলাদেশের যেকোনো এলাকায় বাস করার সমান অধিকার রাখে। এ ক্ষেত্রে কেউ বাধা দিতে পারবে না। দিলে তা হবে অন্যায়। লেখকঃ প্রখ্যাত বিজ্ঞানী, প্রফেসর ইমেরিটাস-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এবছরের (২০১১) ২১ জুন ইন্তেকাল করেছেন।

এলেখাটি মৃত্যুর আগের দিন লেখা।  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.