আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কপোতাক্ষের পানিতে ডুবছে ডিজিটাল বাংলাদেশ

আকাশটা ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে মহাকবি মাইকেল মধুসুদন দত্ত তাঁর প্রিয় নদকে নিয়ে লিখেছিলেন বিখ্যাত সনেট কপোতাক্ষ নদ আজ সেই কপোতাক্ষ পাড়ের মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই সেখানকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ডুবে আছে অথবা আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার হওয়ায় বন্ধ শিক্ষা কার্যক্রম আর জন্য দায়ী কিছু নদীখেকো দানব, যাদের কেউ কেউ নদী দখল করে কেটেছে পুকুর কেউবা ঘের দিয়ে চাষ করছে চিংড়ি যার ফলে কপোতাক্ষ হারিয়েছে তার গতি। পলি জমে নিম্নাংশে ভরাট হচ্ছে মাইলের পর মাইল। সৃষ্টি করেছে দুর্ভোগ। খরায় পানি থাকে না। বর্ষায় ভাসিয়ে দেয় দুই পাড়।

সৃষ্টি করে দীর্ঘস্থায়ী পানিবদ্ধতা। এই করুণ অবস্থা থেকে কপোতাক্ষকে বাঁচানো দরকার। দরকার এর দুই পাড়ের মানুষগুলোকেও বাঁচানো। কপোতাক্ষের পানিতে ডুবছে ডিজিটাল বাংলাদেশ বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসেছে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে। স্বপ্লটা বিশাল।

আর এই বিশাল স্বপ্নকে বাস্তব করতে সরকারের আন্তরিকতাও লক্ষ্যণীয়। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে গ্রহণ করা হচ্ছে একের পর এক পদেক্ষপ। কিন্তু মানুষের পেটে ক্ষুধা রেখে তো আর ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া সম্ভব না। তাই তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সাথে তাল মিলিয়ে ক্ষুধা ও দারিদ্র মুক্ত দেশ গড়তে সরকার গ্রামীণ অর্থনীতি তথা দেশের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির উন্নয়নেও ভূমিকা রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কোথাও কোথাও এর সুফলও মিলছে।

তবে সরকারের আড়াই বছরের কর্মকান্ড বিবেচনা করলে এটা বলতেই হয় যে, উন্নয়ন প্রকল্পের সুষম বন্টন হচ্ছে না। যার ফলে দেশের কোন কোন অঞ্চলের মানুষের কাছে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা তো দূরের কথা, তিন বেলা খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকাই তাদের কাছে এখনো স্বপ্নের মত ব্যাপার। বিশেষ করে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের কপোতাক্ষ পাড়ের মানুষের কাছে এখন বেঁচে থাকার সংগ্রামটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘ দিন ধরে কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতায় কৃষিপ্রধান এই অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডটাই ভেঙ্গে গেছে। আর এ সমস্যাটাও একদিনের নয়, গত দশ বছর ধরেই চলছে পানিবদ্ধতার এই ধারাবাহিকতা।

দিন যত যাচ্ছে সমস্যা ততই প্রকট হচ্ছে। প্রতিবারের ন্যায় এবারো দীর্ঘ সময় ধরে তলিয়ে আছে কপোতাক্ষ নদের দুই পাড়ের বিশাল এলাকা। প্রায় দুই মাস ধরে এই এলাকার মানুষের ফসলের জমি, ঘর-বাড়ি, রাস্তা-ঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সবই তলিয়ে আছে কপোতাক্ষ নদের পানিতে। গ্রামের পর গ্রাম পানিতে তলিয়ে আছে, অথচ পান করার উপযোগী এক ফোঁটা পানি নেই। এই অঞ্চলে মানুষের করুণ অবস্থা মনেকরিয়ে দেয়, ইংরেজ কবি Samuel Taylor Coleridge এর লেখা The Ancient Mariner কবিতার বিখ্যাত চড়ণ- Water, water, every where, And all the boards did shrink; Water, water, every where, Nor any drop to drink. কোথাও একটু শুকনো জায়গা নেই, তাই কারো স্বজন মারা গেলে কবরের মাটির জন্য লাশ কাধেঁ নিয়ে পানির মধ্যে দিয়ে ছুটতে হয় দূরদূরান্তের গ্রামে।

আবাল-বৃদ্ধা-বনিতা নির্বিচারে কোন উঁচু রাস্তার ধারে কিংবা আশ্রয়কেন্দ্রের তাবুতে পার করতে হচ্ছে দিনের পর দিন। তাই দেশের অন্যান্য এলাকার মানুষ যেভাবেই চিন্তা করুক না কেন, এই অঞ্চলের মানুষের কাছে কপোতাক্ষের পানিতে ডুবে আছে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন। মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত তার বিখ্যাত সনেট ‘কপোতাক্ষ নদ’-এ যাকে ‘দুগ্ধ-স্রোতরূপী তুমি জন্মভূমি-স্তনে’ বলে আখ্যায়িত করেছেন আজ লবণাক্ত এবং দূষিত পানিতে ডুবে আছে সেই কপোতাক্ষের দুই পাড়ের মানুষ! ভাবতেই অবাক লাগে, এক দশক আগেও যে কপোতাক্ষ তার দুই পাড়ের মানুষের ক্ষুধা নিবারণে অন্ন যুগিয়েছে, আমিষের চাহিদা মিটিয়ে মাছের যোগান দিয়ে, মালামাল পরিবহনে তার বুকে করে বয়ে নিয়ে গেছে বিচিত্র সব জলযান, তৃষ্ণা মিটাতে দিয়েছে সুপেয় পানি আজ সেই কপোতাক্ষই মানুষের জীবনে নিয়ে এসেছে দুঃসহনীয় কষ্ট। এখন শুষ্ক মৌসুমে পানি থাকে না তাই কৃষক তার জমিতেও পানির যোগান দিতে পারে না। তাই ফসলও হয় না আগের মত।

নদীর নিম্নাংশ ভরাট হয়ে গেছে, উজানের নদী থেকেও বিচ্ছিন্ন কপোতাক্ষ। একে একে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে তার দোহিতাসম ৮০ টি সংযোগ খাল। এক সময় মধুসূদন সুদূর ফ্রান্সে বসে যে নদীর কলধ্বনি শুনতে পেতেন আজ তার তীরে বসেও সে মন্ত্রধ্বনি শুনার অবস্থা আর নেই। রূপ-রস-যৌবন সব হারিয়ে কপোতাক্ষ জীর্ণ শীর্ণ কায়া নিয়ে যেন মাইকেলের সেই কবিতাকেই উপহাস করে যাচ্ছে। কপোতাক্ষের এই করুণ পরিণতির জন্য অবশ্য অন্য কেউ দায়ী নয়, দায়ী মানুষরূপী কিছু নদীখেকো দানব।

নদী দখল করে পুকুর কেটেছে কেউ, কেউবা বসিয়েছে ইটের ভাটা, বাজার বসিয়ে বাণিজ্যও হচ্ছে,আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে চিংড়ির ঘের! ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে তারা একটু একটু করে গিলে খেয়েছে কপোতাক্ষের রূপ-যৌবন। কখনোবা উন্নয়ন প্রকল্পের নামে হত্যা করা হয়েছে তাকে। অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত ব্রিজ, কালবার্ট এবং সুইচগেইটও এর জন্য কম দায়ী নয়। এই ধারাবাহিকতা চলতে থাকলে, খুব বেশি দিন আর অপেক্ষা করতে হবে না। তার আগেই হারিয়ে যাবে এর অস্তিত্ব।

তখন মানুষ মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা পড়েই জানার চেষ্টা করবে যে কপোতাক্ষ নামে এই দেশে একটা নদী ছিল! যাইহোক, কপোতাক্ষ তার মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে গেছে, মৃত্যুর আগে তার ঘৃণা আর প্রতিশোধের লাভা ছড়িয়ে দিয়েছে চার পাশে। বর্ষার পানিকে সাগরে না পাঠিয়ে ডুবিয়ে দিয়েছে দুই পাড়। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ডুবিয়ে রেখেছে বিশাল এলাকা। পানি কমিটির জরিপ মতে, যশোর, খুলনা, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ ও চুয়াডাঙ্গা জেলার ১৪ টি উপজেলার ৭১ টি ইউনিয়নের ৮০২ টি গ্রাম ডুবে আছে কপোতাক্ষের পানিতে। ডুবে থাকা জমির পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৪৭ হাজার হেক্টর আর ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের সংখ্যা, ১৫ লাখেরও বেশি।

গত ঈদুল ফিতরের আগে থেকেই এই দুর্ভোগ শুরু হয়েছে। এখনো শেষ হয়নি। হয়ত ঈদুল আযহার আনন্দও আসবে না এই দুর্গতদের মাঝে। ঈদের দিনেও হয়ত এই এলাকার মানুষদের ঘরে চুলা জ্বলবে না। তাদের শিশুদের তাকিয়ে থাকতে হবে, ত্রাণের এতটুকু খিচুড়ির দিকে।

যশোরের চৌগাছা উপজেলার তাহিরপুর থেকে শুরু হয়ে প্রায় ৩৬৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য পাড়ি দিয়ে ভাটির দিকে সুন্দরবনে আড়পাংগাশিয়া নদীর সাথে একত্রিত হয়ে বঙ্গোপসাগরের মালঞ্চ মোহনায় মিশেছে কপোতাক্ষ। কিন্তু এখন এর বিশাল অংশই ভরাট হয়ে গেছে। কপোতাক্ষের এই করুণ পরিণতি একদিনে তৈরি হয়নি। এর ইতিহাস অনেক পুরোনো হলেও গত দশ বছর ধরে মাত্রা ছাড়িয়েছে। প্রথম দিকে উজানের নদী থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে স্রোত হারাতে থাকে কপোতাক্ষ।

ফলে নিচের দিকে জমতে থাকে পলি। পলি জমায় যশোরের ঝাঁপা থেকে খুলনার কপিলমুনি পর্যন্ত ৮০ কিলোমিটার এতটাই ভরাট হয়েগেছে যে এখন আর জোয়ার-ভাটাই হয় না। কপিলমুনি থেকে আগড়ঘাটা পর্যন্ত আরো প্রায় ১৮ কিলোমিটারও ভরাট হওয়ার পথে। এ সমস্যা দূরীকরণের জন্য বিভিন্ন সময় প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু তাতে কোন সুফল আসেনি।

বরং সমস্যা আরো ঘনীভূত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসীর অভিজ্ঞতা হলো, কপোতাক্ষ খননে সরকার কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। সেই টাকা ব্যায়ে খননও করা হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। কারণ প্রত্যেকবারই খনন করে খননের মাটি আবার কপোতাক্ষের বুকেই ফেলা হয়েছে।

তাই একদিকে খনন করা হয়েছে অন্যদিকে কপোতাক্ষ ভরাট হয়েছে। তাছাড়া সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে সমস্যা দূরীকরণের পরিবর্তে নতুন নতুন প্রকল্প গ্রহণের পথ তৈরিতেই মনোযোগী ছিলেন বেশি। তাই খননের নামে এতদিন লুটপাট হয়েছে কোটি কোটি টাকা। এতে তারা সফলও হয়েছেন, দিনে দিনে সমস্যা প্রকট হয়েছে, বেড়েছে বরাদ্দও। ২০০৪-০৫ অর্থ বছরে যেখানে ১৪ কোটি টাকা ব্যায়ে সমস্যা দূরীকরণ সম্ভব ভাবা হতো এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৬২ কোটি টাকায়।

এতেও কিছু হবে কিনা কে জানে? তবে প্রকল্প বাস্তবায়নে সততা এবং আন্তরিকতা না থাকলে এ বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়েও কপোতাক্ষ পাড়বাসীর মুখে হাসি ফুটানো সম্ভব হবে না এটা নিশ্চিত। গত সংসদ নির্বাচনের আগে আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহাজোটের নেত্রী হিসেবে এই অঞ্চলের মানুষদের কাছে ওয়াদা করেছিলেন, যে মহাজোট বিজয়ী হলে তিনি কপোতাক্ষ খনন করে এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান করবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, তিনি ক্ষমতায় যাওয়ার পর আড়াই বছরেও সে কথা স্মরণ করতে পারেন নি। যখন স্মরণ করলেন, তখন ১৫ লাখের বেশি মানুষের ঘর-বাড়ি দুর্গন্ধ আর ময়লা যুক্ত পানির নিচে! ক্ষতিগ্রস্থদের আহাজারি, আন্দোলন, প্রতিবাদ যখন দেশী-বিদেশী প্রিন্ট, ইলেক্ট্রনিক অনলাইন মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ল তখনই টনক নড়ল সংশ্লিষ্টদের। বরাদ্দ হলো বিপুল পরিমাণ অর্থের।

সেই অর্থে পানি উন্নয়ন বোর্ড চমকপ্রদ সব প্রকল্প বাস্তবায়নের তৎপর বলেও শুনা যাচ্ছে। কিন্তু ভোক্তভোগীরা এতেও আশঙ্কা মুক্ত হতে পারছে না। তাদের মনে ভয়, নদী খননের নামে এই অর্থও অপরিকল্পিতভাবে ব্যয় হবে। ফলে সাময়িক উন্নতি হলেও তাদের ভোগান্তির স্থায়ী সমাধান হবে না। কেননা পানি উন্নয়ন বোর্ড আগের মতই খননকৃত মাটি আবার নদীতে ফেলার পরিকল্পনা নিয়েই এগুচ্ছে! তাই প্রধানমন্ত্রীকেই দৃষ্টি দিতে হবে নির্বাচন পূর্ব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে।

নদী দখল থেকে নিবৃত করতে হবে দাপুটে নেতাকর্মীদের। তা নাহলে, বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যায় হলেও আবারো বর্ষায় ডুববে এই এলাকা। সেই সাথে কপোতাক্ষের পানিতে ডুববে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নও।  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।