আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নার্গিসকে লেখা কবি নজরুলের ঐতিহাসিক চিঠি-৩

যাক যা বলছিলাম তাই বলি। Ñ গান গেয়ে কেন আমার মনে হলো আমার অন্তর্যামী বুঝি আমার আঁখির আগে এসে নীরবে জল-ছল-ছল চোখে দাঁড়িয়ে। চোখের জল মুছে সামনে চাইতেইÑ ও খোদা! কে তুমি দাঁড়িয়ে অমন করুণ চোখে আমার পানে চেয়ে? আহা, চটুল চোখের কালো তারা দুটি তাদের দুষ্টুমি চঞ্চলতা ভুলে গিয়ে ব্যথায় যেন নিথর হয়ে গেছে! সে পাগল-চোখের কাজল আঁখি পাতা যেন জল-ভরাতুর। ওগো আমার অন্তর্যামী! তুমি কি সত্য-সত্যই এই সাঁঝের তিমিরে আমার আঁখির আগে এসে দাঁড়ালে? হে আমার দেবতা! তবে কি আমার আজিকার এ সন্ধ্যা-আরতি বিফলে যায় নি? আমি আমার সব কিছু ভুলে কেমন যেন আত্মবিস্মৃতের মতো বলে উঠলুম, তুমি আমার চেয়ে কাউকে বেশি ভালোবাসতে পারবে না! কেমন? কোনো কথা না বলে তুমি আমার কোলের ওপরকার বালিশটিতে এসে মুখ লকুালে। কেন? লজ্জায়।

না সুখে? না ব্যথায়? জানি না, কেন। তাই তো আজ আমার এত দুঃখ আর এত প্রাণ পোড়ানি। তোমার প্রাণের কথা তুমি কোন দিনই একটি কথাতেও জানাওনি, তাই তো আজ আমার বুক জুড়ে এত না জানার ব্যথা। অনেক সাধ্য-সাধনায় তুমি মুখ তুলে চাইলে, কিন্তু বললে না, কেন অমন করে মুখ লুকালে। সে দিন একটিবার যদি মিথ্যা করেও বলতেÑ হে আমার চির-জনমের প্রিয়! যে, ...।

না,Ñ না, যাক সে কথা। এইখানে একটা মজার খবর দিই তোমাকে। এই হাজত-ঘরে বসেও আমার এমন অসময়ে মনে হচ্ছে, যেন আমি এইজন কবি। রোসো, এখনই হেসে লুটিয়ে পড়ো না! তোমার চেয়ে আমি ভালো করেই জানি যে, আমার কবি না হওয়ার জন্যে যা কিছু চেষ্টা চরিত্তির করার প্রয়োজন, তার কোনটাই বাদ দেননি ভগবান। তাই আমার বাহির-ভিতর সব কিছুই যেন খোট্টাই মুল্লুকের চোট্টাই ভেইয়্যার মতোই কাঠখোট্ট! তবু যদি আমি কবি হতুম, তা হলে আমার এই ভাবটাকে কী সুন্দর করেই না বলতুম,Ñ শুধু অনাদর শুধু অবহেলা শুধু অপমান! ভালোবাসা?Ñ সে শুধু কথার কথা রে! অপমান কেনা শুধু! প্রাণ দিলে পায়ে দলে যাবে তোর প্রাণ! শুধু অনাদর, শুধু অবহেলা, শুধু অপমান! যাক যা হইনি, কপাল ঠুকলেও আর তা হচ্ছিনে।

এখন যা আছি, তাই নিয়ে আলোচনা করা যাক। দাঁড়াও অভিমান অভিমান করে চেঁচিয়ে হয় তো ও-কথাটার অপমানই করছি আমি। নয় কি? আমার মতন হয়তো তুমিও ভাবছ, কার ওপর এ অভিমান আমার? কে আমায় এ অধিকার দিয়েছে এত অভিমান দেখাবার? একবিন্দু ভালোবাসা পেলাম না, অথচ এক সিন্ধু অভিমান নিয়ে বসে আছি! তবু শুনে আশ্চর্য হবে তুমি যে, সত্যি সত্যি আমার বড্ড অভিমান হয় যার ওপর অভিমান করি, সে আমার এ অভিমান দেখে হাসবে, না দুপায়ে মাড়িয়ে চলে যাবে, সে-দিকে ভ্রƒক্ষেপও করি না। চেয়েও দেখি না, আমার এত ভালোবাসার সম্মান সে রাখবে কি না, শুধু নিজের ভালোবাসার গরবে আর অন্ধতায় মনে করি, সেও আমায় ভালোবাসে! তাই আজ আমার এত লাঞ্ছনা ঘরে-বাইরে! অনেক পথিক-বালা এ পথিকের পথের ব্যথা মুছিয়ে দিতে চেয়েছিল, হয়তো ভালোও বেসেছিল (শুনে হেসো না,) আমি কিন্তু ফিরেও চাইনি তাদের পানে। ওর মধ্যে আমার কতকটা গরবও ছিল।

মনে হত, এ বালিকা তো আমার সাথে পা মিলিয়ে চলতে পারবে না, অনর্থক কেন তার জীবনটাকে ব্যর্থ করে দেবো? যে-সে এসে আমার মতন বাঁধন হারা বিদ্রোহীর মনটাকে এত অল্প সাধনায় জয় করে নেবে, এও যেন সাইতে পারতুম না। তাই কোনো হতভাগীর মনে আমার ছাপ লেগেছে বুঝতে পারলেই আমি অমনি দূরেÑ অনেক দূরে সরে যেতুম; আর দেখতুম, তার এ আকর্ষণের জোর কতÑ সে সত্যি আমায় ভালোবাসে, না একটু করুণা করে, না ওটা মোহ? ঐ দূরে সরে যাবার আর একটা কারণ ছিল যে, আমাদের কাউকে যেন কোনোদিন অনুতাপ করতে না হয় শেষে কোনো ভুলের জন্যে। আমার এক জায়গায় বড় দুর্বলতা আছে। স্নেহের হাতে আমার মতো এমন করে কেউ বুঝি আত্মসমর্পণ করতে পারে না। তাই কেউ স্নেহ করছে বুঝলেই অমনি বাঁধা পড়বার ভয়ে আমি পালিয়ে যেতুম।

ওই দূরে গিয়ে কিন্তু অনেকেরই ভুল ধরা প’ড়ে গেছে। অনেকেই নাকি আমায় ভালোবেসেছিল, কিন্তু তাদের সকলেরই মনে মিথ্যেটা আমি দেখতে পেয়েছিলুম ঐ দূরে সরে গিয়েই। তাদের কেউ আমায় তার জীবন ভরে পেতে চায়নি। আমি পথিক, তাই পথের মাঝে, আমায় একটুক্ষণের জন্যে পেতে চেয়েছিল মাত্র। তাই কেউ আমায় কোনোদিনই তার হাতের নাগালের মধ্যেও পেলে না।

অনেকে বলে, হয়ত এটাও আমার অভিমান। জানি না। কিন্তু দু’এক জায়গায় একটু আত্মবিস্তৃত হয়ে যেই নিকটে আসতে চেয়েছি, অমনি সে আমার দেবতার আমার ভালোবাসার বুকে জোর পদাঘাত করেছে, তবু কি তুমি বলবে, ও আমার অহেতুক অভিমান? এইখানে একটা কথা মনে রেখ কিন্তু যে, এই যে যারা আমায় পেতে চেয়েছিল, তাদের সকলেই আগে আমায় ভালোবেসেছিল, আমি কখনো তাদের ভালোবাসিনি! ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৭ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।