আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প: রাসেল টি স্টল

প্রকৃতিকে করো তব দাস-চে দ্য আইডল (ব্লগার নং - ৩১৩৩৯) আমাদের বাড়িগুলো যে সড়কের ধারে বালিকার কানের মাকড়ির মত শ্রী হয়ে, সে সড়কটা যেখানটায় একটু বেঁকে গেছে আর উত্তর ও দক্ষিণ থেকে দুটো কাঁচামাটির রাস্তা এসে মিশেছে পুব-পশ্চিমে কালো সাপের মত শুয়ে থাকা এবড়োখেবড়ো পীচের সড়কে, সে সংযোগের বগলে কদমের তলায় টিনের যে চৌচালায় আমরা রোজ সকাল থেকে দুপুর আর বিকেল থেকে রাত করি, সেটার কপালে টিনের সাইনবোর্ডে অপটু হাতে লেখা, সাদার উপর লাল আর নীল রঙে, 'রাসেল টি স্টল, এখানে চা,বিসকুট,চানাচুর, সিগারেট ইত্যাদি পাওয়া যায়। প্রো: মো: রাসেল। শিশুতলা, চরকালী, কোম্পানীগঞ্জ, নোয়াখালী। ', আর আমরা বলি রাসেইল্লার দোকান, সেখানে আজ ২১ইঞ্চি রঙিন টেলিভিশনে চ্যানেলগুলো বারবার পরিবর্তিত হয়ে যায় রিমোটের দখলকারীর সাপেক্ষে। আমরা দেখি, দক্ষিণের কাঁচাসড়ক ধরে সিকি মাইল গেলে রাস্তার পাশে যে দোচালা টিনের ঘর, যে ঘরের সামনে উলঙ্গ দুটা বাচ্চা খেলা করে আর মাথা আর বুকের কাপড় ফেলে গোবরকাঠি বানায় এক মহিলা, তার স্বামী হাফিজ, যে দিনের কিছু অংশ রিকশা চালায় আর বাকি অংশ চেয়ারে ঠ্যাং তুলে বসে থাকে রাসেইল্লার দোকানে, সে রিমোটের দখল পেয়ে টুপ করে ঢুকে পড়ে খবরের চ্যানেলে আর বলে,'সরকারের মায়েরে বাপ, চ্যাইলের কেজি কত কৈরা, হেই খবর আছেনি,মাইনসে ভাত পায় না, খালি উন্নয়নের গপ মারে!', সাথে হয়তো কেউ যোগ করে, সে হয়তো উত্তরদিকের কাঁচা রাস্তার বাসিন্দা তাম্বিরা, যে ঢাকায় পাঁচ টনী ট্রাক চালায় আর ট্রাক চালানো কে কঠিন মরদের কাজ ভেবে সুখ পায়, সে মাথা দোলায় আর বলে,'খালি কি চ্যাইল ড্যাইল, রাস্তা টাস্তা ভাঙি ঐরান কারবার, গাড়ির চাক্কা হরলে আর উডবার চায় না', বলতে বলতে রিমোট কেড়ে নিয়ে ছাড়ে হিন্দী নাচ, তখন হয়তো মুন্নী বদনাম হুয়ি'র তলপেটে ভাঁজ উঠে কিংবা জিলেবি বাই স্বচ্ছ কাপড়ের তলে কেবল অন্তর্বাস পরে নাচে।

নাচের শব্দে চোখ তুলে তাকায় মুনাফ, অস্ফুটে বলে, 'কত বড় দুদ রে মাগীর',তারপর হয়তো তার মনে পড়ে রাসেলের দোকানে আজ গরুর দুধ জ্বাল হচ্ছে চায়ের জন্য আর তখন সরভাসা চায়ের অর্ডার দিয়ে তামাশা করে জ্বলা দেয়া দুধের উৎপাদকের আবাস নিয়ে। সে সন্দেহ পোষণ করে যে এই দুধ যার ওলান থেকে আসছে, সে রাসেলের গোয়ালে থাকে না, থাকে রাসেলের ঘরে, রাসেলের সাথে এক বিছানায়। আমরা হাসতে হাসতে না বোঝার ভান করি আর দেখি, টেলিভিশনে অন্তর্বাসপ্রদর্শনী নাচের বদলে আসে ছায়াছন্দ, আসে রাজ্জাক, আয়নাতে ঐ মুখ দেখবে যখন। আমরা শুনতে পাই, মুনাফ গাল দিয়ে উঠে। রিমোট তখন নিয়ন্ত্রণ করে অন্য একজন, রমিজ।

রমিজ উত্তর করে না। চ্যানেল গুলো পাল্টে পাল্টে যায় আর বিরক্ত হয়ে মেরিজ সিগারেটের মুখাগ্নি করে সালাউদ্দীন। তার হয়তো মনে হয়, রমিজ সরকারী দল করে বলে ইচ্ছামত চ্যানেল পাল্টাচ্ছে আর সেজন্যই হয়তো বলে,'রমিজ্যা, সরকারি দল করছ দেইখা বাল নি অইছস, চ্যানেল পাল্ডাস ক্যা হুদাই!' রমিজ কিছুটা বোধহয় মেনে নেয় আর অনুচ্চ কন্ঠে বলে,'তোর বিরোধী দল কোন বালডা ফালায়?সংসদে বেইল না পাইয়া রাস্তায় চিল্লাস আবার রিমোটের দখল চাস। ' আমাদের মনে হয় ঝগড়া জমে উঠতে পারে এবার, আবার আমরা অবাক হই এই ভেবে, এরা কেউ আজকের জন্য শ্রম বিক্রি করতে না পেরে এখানে অলস সময় কাটায়, কেউ রিকশা চালানোর ফাঁকে খানিক জিরিয়ে নেয়, অথচ এরাই সরকারকে গালি দেয় চালের দাম কমে না বলে, রাস্তা ঠিক হয় না বলে,রাজাকারের বিচার হয় না বলে। এরাই আবার গালি দেয় বিরোধীদল কে, হরতাল দেয় বলে।

এরা ঝগড়া করে, গালাগালিটাকে উপস্থাপনার কৌশল আর ভিন্নতা হিসেবে নিলে মোটামুটি সংসদীয় পদ্ধতিতেই ঝগড়া করে। ঝগড়ার আবরণে আগাগোড়া গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখে, তারপর একসাথে চা খায়, বিড়ি খায় আর ফাঁকতালে কেউ হয়তো রিমোট টিপে চালায় বাংলা সিনেমা। তখন এরাই আবার নায়িকার পাছা আর স্তন নিয়ে সরেস মন্তব্য করে, নায়িকা থেকে রমিজ কিংবা মুনাফ কিংবা রাসেলের বৌয়ের স্তনের কথা বলে। আমরা এসব শুনতে শুনতে হঠাৎ উত্তেজনাবোধ করি আর হয়তো উত্তেজনা প্রশমণের জন্যই ফস করে সিগারেট ধরিয়ে ঘন ঘন টান মারতে থাকি কিন্তু তখনো ওরা আদিকৌতুক করে চলে উত্তেজনা ছাড়াই। আমরা বিস্মিত হই, ওরা কীভাবে এরকম নির্মোহ ভঙ্গিতে মোহের কথা বলে! আমরা জানতে পারি না, এদের জীবনে শ্রমবিক্রি কিংবা রিকশা কিংবা সিএনজি-ট্রাক চালানো কিংবা রাসেইল্লার দোকান কিংবা তাদের বৌগুলো, যারা বছর বছর পোয়াতি হয়ে যায় আর সংসার বাড়ায়, কেউই ওদের জীবনে অন্যগুলোকে ছাপিয়ে উঠতে পারে না বলে সবই খোলা।

আমাদের আরো জানা হয় না, এগুলোতেই ওদের জীবন আবদ্ধ, এগুলোই ওদের রোজকার বিনোদন। আমরা তখন দেখি, টেলিভিশনের পর্দায় নায়কের এক ঘুষিতে ভিলেন দেয়াল ভেঙে উল্টিয়ে পড়ে কিংবা নায়কের গালে মায়ের চড়মারার দৃশ্যেও শব্দ হয় ভিষুমাইক, আমরা তখন হেসে উঠি আর রমিজ রা বলে, বালের নায়ক। তখন রাসেলের দোকানে দৃশ্যপটে ঢুকে পড়ে কয়েকজন আগন্তুক, কেউ প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে,কেউ মাতব্বরীয় স্টাইলে লুঙ্গিকে একটু উচিয়ে ধরে, কেউ টিশার্ট ঠিক করতে করতে। মোড়ের আশপাশেই সবার বাড়ি। নামগুলোও আমাদের জানা।

মাহমুদ, বিরোধীদলীয় ছাত্রসংগঠনের সভাপতি পদপ্রার্থী, ওয়াজেদ, সরকারী জোটের দ্বিতীয় শরিকদলের উপজেলা নেতা, ইমতিয়াজ, মাইনকাচিপায় পড়া এক ছাত্রসংগঠনের কর্মী,রিয়াদ, সরকার দলীয় ছাত্রসংগঠনের নেতা, জিহান, ঢাকায় বামদলীয় কর্মী কিংবা নেতা। এদেরকে রমিজরা, মুনাফরা,সালাউদ্দীন রা সালাম দেয়,বসার জায়গা করে দেয়। ওরা খোঁজখবর নেয়। ওয়াজেদ হয়তো খবরদারি করে মুনাফের উপর, গতকাল কেন সে দুঘন্টা কম কাজ করেছে ক্ষেতে, হয়তো গাল দিয়েই বলে, 'গীর হুত, টাকা তো কম নেস না, কাম খালি বৌরেই করস, না?'। আমরা তখন কিছু মনে করি না।

আমাদের মনে হয়, এরকম গালি দেবার ও খাবার অধিকার ওয়াজেদ ও মুনাফের আছে। আমরা তখন দেখি,সবার জন্য চায়ের অর্ডার পড়ে। হয়তো এক ফাঁকে মাহমুদ সালাউদ্দীনের কানে কানে বলে, 'ইর নাম্বার ওয়ার্ড ম্যানেজ অইছে, বিকেলে রিপইন্নারে জিগাইস, সভাপতির পদে এহনো দাঁড়াইতে চায় কি না!' আমরা তখন ছাত্রসংগঠনটির সভাপতি পদে অছাত্র মাহমুদের সম্ভাবনা বেড়ে যেতে দেখি। তারপর সে হয়তো ফস করে সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে আর সাথে সাথে রিয়াদ সিগারেট টেনে নিয়ে রিং ছাড়ে। ইতস্তত করে ধরিয়ে ফেলে জিহানও।

আর তখন অধূমপায়ী ওয়াজেদ ক্ষেপে উঠে আর বলে, 'বাল খাস!' আর ইমতিয়াজ রিমোট টেনে নিয়ে নায়কের বদলে হাজির করে জাকির নায়েক কে। তখন হঠাৎ রিমোট হাত বদল হয় আর জিহান অস্ফুটে জোকার নালায়েক বলে পাল্টায় চ্যানেল, সেখানে তখন তেল-গ্যাস নিয়ে চলে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন। তখন মাহমুদ বলে উঠে,'দ্যাখ, তোগো সরকার দেশের গ্যাস সব ইন্ডিয়ারে দিতাছে, মানুষ অহন ভাতে মরতাছে, কিছুদিন পর আন্ধারে ডুইবা মরবো, আরো নাহি দেশের মইধ্যে ইন্ডিয়ার আর্মির গাড়ি চইলবো!'। তখন হয়তো রিয়াদ গলা চড়ায়,'তোগো সরকার কোন কামডা করছিলো! দেশের টাকা বিদেশে পাডাইছোস, কাঁচাবাজারেও দশ পারসেন দিতে হইতো, এহন কই গেলো রাজপুত হালায়, ফখরুদ্দীনের বাঁশ খাইয়া ভাগসে ক্যা!' মাহমুদ হয়তো পাল্টা তর্ক করতে চায় কিন্তু জিহান থামিয়ে বলে, 'কচুর নেতা তোমরা, গ্যাস ইন্ডিয়ার কাছে না, আম্রিকারে দিতাছে, তোগো দুই দলের নেতারাই তলে তলে আম্রিকার লগে হুইস্কি খায়, আর আমরা মরি পুলিশের বাড়ি খাইয়া!' ইমতিয়াজ মন্তব্য করে, 'ক্যা, গ্যাসের দাম বাড়ানের লাইগা হরতাল অইলো না!' জিহান ক্ষ্যাপে এবার,'কচু অইছে। বাড়ির জন্য হরতাল দ্যায়, গ্যাসচুক্তি নিয়া কিছু কয় না, কইলে তো আম্রিকা রাগ অইবো, আর এই হরতাল তো তোগো রাজাকারগুলারে বাঁচানের লাইগা।

' তখন হঠাৎ চায়ের কাপে সুড়ুৎ টান দিয়ে ওয়াজেদ বলে,'তুই অইলি বামদল, তুই চিল্লাইলেও কি, ন চিল্লাইলেও কি,তোর দলের বেইল আছে নি!' আমরা আর রমিজ রা, মুনাফ রা, রাসেল রা মিলে আশাবাদী হয়ে উঠি চমৎকার একটা ঝগড়া দেখার আশায়, কিন্তু আমরা হতাশ হই যখন দেখি তারা পরস্পরকে সিগারেটের ভাগ দ্যায়, স্কুলফেরত একটা মেয়েকে দেখে একে অপরকে ইশারা করে। তখন হঠাৎ রিমোট টা নিচে পড়ে যায় আর ব্যাটারী খুলে আসে আর তাই রিমোট কাজ করে না বলে অনবরত বিজ্ঞাপন চলতে থাকে। সেখানে চিকনা ছেলে, বাট্টু ছেলে রা দুধ খেয়ে মোটা হয়, লম্বা হয়। বগল দেখিয়ে সুগন্ধীর গুণবর্ণনা করে স্বল্পবসনা। তারপর হঠাৎ মাহমুদ রা, ওয়াজেদ রা,জিহান কিংবা রিয়াদ-ইমতিয়াজ রা উঠে পড়ে আর রমিজ রা, মুনাফ রা মন্তব্য করে যে পাঁচজন পাঁচদল করেও একসাথে হাঁটে, সিগারেট খায়, চা খায়।

অন্য কেউ তখন মন্তব্য করে , সবগুলাই তো নেতা, তলে তলে সব ঠিক। পুটকি মারা যায় কেবল পাবলিকের। তখন হঠাৎ রিমোট কাজ করতে শুরু করে বলে চ্যানেলগুলো বদলাতে শুরু করে আবার। তখন হয়তো দুপুরের সংবাদ চলে আর প্রধানমন্ত্রী হাসে উন্নয়নে সুখে আর ওরা তখন গালি দেয় চালের জন্য, রাস্তার জন্য। আবার হয়তো সরকারকে টেনে নামানোর ঘোষণা দেয় বিরোধীদলীয় নেত্রী।

ওরাই তখন আবার গালি দেয় হরতালের জন্য, দূর্নীতির জন্য। তারপর আমরা উঠে পড়ি। আমাদের পা কালো সাপ ধরে এগিয়ে চলে আর পেছনে পড়ে যেতে থাকে সাইনবোর্ড, রাসেল টি স্টল। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.