আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নিউট্রিনোদের চোখে আইনস্টাইন ও তার পদার্থবিদ্যাঃ সার্নের বিস্ময়কর ফলাফলের দর্শনগত বিশ্লেষণ

কথা কম বলতে ভালবাসি। নিউট্রিনোদের চোখে আইনস্টাইন ও তার পদার্থবিদ্যাঃ সার্নের বিস্ময়কর ফলাফল সাদাত হাসান নিলয় ও অনির্বান ইসলাম গত ২২সেপ্টেম্বর ২০১১ একটা খবরে চমকে উঠে বৈজ্ঞানিক সমাজ। খবরটা ছিল, আলোর গতির চেয়েও বেশি গতির কণা পাওয়া গিয়েছে। অথচ আইনস্টাইন যে বলেছিলেন, আলোর গতির চেয়ে বেশি গতির কণার অস্তিত্ব অবাস্তব। কারণ তাহলে ঐ কণার ভর হবে অসীম।

তাহলে কি সেই কণা অর্থাৎ নিউট্রিনো আমাদের সব বিজ্ঞানের সূত্র অর্থহীন করে দিল? আইনস্টাইনের সূত্র কি মিথ্যা হয়ে গেল? void(1); প্রশ্নের সঠিকতা-প্রশ্নের দর্শন বাস্তবে এই প্রশ্নটাই সঠিক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করে না। বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় পদার্থবিদ স্টিফেন হকিংএর কাছে সাংবাদিকেরা ছুটে গেলে তিনি বলেন, ‘এই বিষয়টা এখনো মন্তব্য করার স্তরে ওঠেনি। আরো পরীক্ষণ দরকার ও পরিষ্কারভাবে বিষয়টা প্রকাশিত হওয়া দরকার। ‘ অথচ অনেক পত্রিকা কিন্তু পরের দিনই লিখে দিল, আইনস্টাইন প্রশ্নের মুখোমুখি! এখানে কিছু বিষয় স্পষ্ট করা দরকার যা সরাসরি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি বা দর্শনের সাথে সম্পর্কিত। বিজ্ঞানের কাজ তত্ত্বের সাধারণীকরণ তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বা যে কোন মৌলিক বিজ্ঞানের শাখাই প্রথমে কোন বিষয়কে স্বীকার্য হিসেবে ধরে নিয়ে বিকশিত হয়।

এই স্বীকার্যগুলো বা সূত্রগুলো বিজ্ঞানীরা তাদের পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতা থেকে দাঁড়া করান শুরুতে। সবসময় এই সূত্রগুলো পরীক্ষার রাস্তাও পাওয়া যায় না উপযুক্ত প্রযুক্তির অভাবে। তখন ঐ তত্ত্ব বা স্বীকার্যটি ধরে নিয়ে কাজ এগোতে থাকে। একসময় যদি পরীক্ষার ফলাফল যদি ঐ তত্ত্বের সাথে মিলে যায় তাহলে ধরে নেয়া হয় তত্ত্বটি ঠিক। আবার ভূল হলে, হয় শুধরে নেয়া হয় প্রয়োজনীয় অংশ বা পুরোটাই বাদ দিয়ে নতুন তত্ত্বের ডাক পড়ে।

যে তত্ত্ব খারিজ হয়ে যায় সেটাই নতুন তত্ত্বের ভ্রুণ হিসেবে কাজ করে। সেই নতুন তত্ত্বও কিছুদিন পথ দেখিয়ে আরো নিখুঁত ফল প্রাযুক্তিক উৎকর্ষের সহায়তায়। তত্ত্ব যত আধুনিক, সে তত বেশি জিনিষের ব্যাখ্যা দিতে পারে। একে আমরা বলি সাধারণীকরন। যেমন একসময় ভাবা হত পৃথিবীর ঘূর্ণনের নিয়ম এক আর বাকি গ্রহ-নক্ষত্রের চলা ফেরা দেবতাদের ইচ্ছা মোতাবেক।

ফলে তাদের জন্য নিয়ম আলাদা আলাদা। নিউটন সাহেব এসে বললেন, আমাদের জন্য পদার্থবিদ্যার যা নিয়ম, নক্ষত্রের জন্যও তাই। এটা ছিল এক্সট্রা-টেরেস্ট্রিয়াল(পৃথিবীর বাইরের) ও টেরেস্ট্রিয়াল(পৃথিবীর) পদার্থবিদ্যার সাধারণীকরণ। মহামতি আইনস্টাইন দেখালেন, এমন নিয়ম আছে যা শুধু বস্তুর চরিত্র নয়, শক্তি ও বস্তুকে একসাথেই ব্যাখ্যা করতে পারে। অথচ আগে ভাবা হত বস্তু আর শক্তি দুটো ভিন্ন জিনিষ।

এটা আরো বড় পরিসরে সাধারণীকরণ। আইনস্টাইনের তত্ত্ব নিউটনের তত্ত্বের পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ হিসেবে রূপ নেয়। সুতরাং, কোন সঠিক তত্ত্ব আগের সময়ে ভাবা সঠিক তত্ত্বকে উচ্ছেদ করে না বা মুছে ফেলে না। বরং আগের তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা তুলে ধরে একে নতুন আরো সঠিকতর রূপে প্রকাশ করে। চিরকালই বিজ্ঞানের জগতে এই তত্ত্বের ভাঙ্গাগড়া চলবে।

ফলে নিউট্রিনোর যদি কোন চরিত্র ব্যাখ্যা করতে আইনস্টাইনের তত্ত্ব অসমর্থ হয় তবে নতুন তত্ত্ব এসে কোনদিন তাকে ব্যাখ্যা করবে। এবং তা অবশ্যই আইনস্টাইনের নির্মিত তাত্ত্বিক পদার্ধবিদ্যার নিয়মের ভিতের উপর দাঁড়িয়েই। কি ছিল সার্নের বিজ্ঞানীদের বক্তব্য সেপ্টেম্বরের ২৩ তারিখেই সার্ন নামক ইউরোপিয়ান বিখ্যাত গবেষণা সংস্থাটি তাদের এই গবেষণার ফলাফল বিষয়ে পুনঃনিরীক্ষণের আহ্ববান জানায় বিশ্ববাসীকে তাদের ওয়েবে সাইটে। সার্নের বিবরণ অনুযায়ী, সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় তাদের নিউট্রিনো উৎপাদক যন্ত্র থেকে ১৫হাজার নিউট্রিনো সম্পর্কিত পরীক্ষা নিরিক্ষা করেছে। ছুঁড়ে দেয়া নিউট্রিনো ৭৩০ কিলোমিটার পার হয়ে আসার পর ইটালীর সান গ্রোসোতে অবস্থিত নিউট্রিনো সংবেদনশীল ডিটেক্টর যন্ত্র অপেরা(অসিলেশন প্রজেক্ট উইথ ইমালশন-ট্র্যাকিং অ্যাপারেটাস) তে এসে অস্তিত্বের জানান দেয়।

দেখা যায়, যে সময়ে এই নিউট্রিনো এসে পৌঁছেছে তা আলোর গতিতে আসলে যা লাগতো তার তুলনায় ৬০ন্যানোসেকেন্ড কম। অর্থাৎ আলোর আগেই চলে আসে নিউট্রিনো। এই ফলাফলে অবাক বিজ্ঞানীরা ছয় মাস ধরে বার বার ভুল বের করার চেষ্টা করেছেন। কোন ভুল না পেয়ে অবশেষে তারা এই ফলাফল প্রকাশ করেন। যদিও একজন জার্মান বিজ্ঞানী ক্যারেন হ্যাগনার এই ফলাফল কেন আরো পরীক্ষা করে প্রকাশ করা হল না, সেই বক্তব্য দিয়ে পদত্যাগ করেছেন ঐ প্রজেক্ট থেকে।

ভবিষ্যত তত্ত্ব নির্মাণের পথ প্রথমত বলা দরকার, সার্নের গবেষণাগারে যে ফল আমরা পেয়েছি তা ধরে কোনভাবেই কোন সিদ্ধান্তে যাওয়া যাবে না। আইনস্টাইনের তত্ত্ব এখন পর্যন্ত এই ঘটনা ব্যতিত পৃথিবীর বাকি সকল ঘটনার নিখুঁত ব্যাখ্যা দিয়ে আসছে। ফলে পৃথিবীর অন্যান্য একাধিক গবেষণাগারে সার্নের অনুরূপ আয়োজন ও পরীক্ষায় সার্নের অনুরূপ ফলাফল আসলে তবেই কাজ শুরু করা যাবে। অতঃপর এমন তত্ত্ব নির্মাণ করতে হবে যা নতুন ফলাফলসহ এর আগের সমস্ত পদার্থবিদ্যার ঘটনাকে ব্যাখ্যা করতে পারে। তবেই বলা যাবে, আইনস্টাইনের তত্ত্ব এবার উত্তরণ লাভ করেছে।

যদি এই ফলাফল ঠিক হয়? যে বিষয়ে স্তিফেন হকিং নিরুত্তর সেই বিষয়ে আলোচনা করতে যাওয়া ধৃষ্টতা ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে এটা বলা দরকার, নিউট্রিনো প্রায় ভরহীন একটা কণা যার ধর্ম এখনো পুরোপুরি আবিষ্কৃত নয়। এই কণা সূর্যের থেকে এসে আমাদের শরীরের ভেতর দিয়ে চলে যায় প্রতিনিয়তই। এর ধর্ম আবিষ্কার পদার্থবিদ্যায় যুগান্তকারী আবিষ্কার ঘটিয়ে দিলেও সম্ভবত সাধারণ মানুষের জীবনে তেমন কোন ছাপ ফেলতে পারবে না অদূর ভবিষ্যতে। পরের ধাপের প্রতীক্ষায় বিজ্ঞানীরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যে MINOS নামক একটি পরীক্ষায় নিউট্রিনোর উপর গবেষণা চালানো হবে অদূর ভবিষ্যতেই।

ফার্মিল্যাবে উৎপাদিত নিউট্রিনো নিয়ে গবেষণা হয় এখানে। অন্যদিকে জাপানের T2K ল্যাবেও চালানো হবে একই ধরণের পরীক্ষা। এদের ফলাফলের উপর নির্ভর করছে পরের ধাপে এই আলোচনা কোন দিকে মোড় নিবে। কিন্তু একটা বিষয় সুনিশ্চিত যে , বিজ্ঞানের কোন তত্ত্বই অনন্তকাল টিকে থাকে না। মানুষের প্রক্ক্রিতিকে জানার অদম্য চেষ্টার সামনে বিজ্ঞান নামক শব্দটির অর্থ তাই প্রতিনিয়তই বদলে যায়।

কিন্তু সেই পরিবর্তন রাতারাতি কোন বিষয় না, একে অপরকে খারিজ করার বিষয় না। জ্ঞানের সুস্থির, ধারাবাহিক ও যৌক্তিক বিকাশ মাত্র। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।