আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গোরক্ষনাথের মন্দিরে একরাত.....

হাউকাউ পার্টি সময়টা ছিল ২০০৭ এর শেষ দিকে, মাস্টার্সের পর দুই বছর মোটামুটি প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা বিহীন থাকার পরে এম ফিলে ভর্তি হয়ে গেলাম। প্রথম পর্ব পরীক্ষা শেষে শুরু করলাম ফিল্ড ওয়ার্ক , তারই কাজে এক শীতের শুরুতে তিনদিনের ছুটি নিয়ে দু'জনে চলে গেলাম নঁওগার পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারে। এখানে টেরাকোটা আর পাথরের ভাস্কর্যের আছে দারুন সংগ্রহ। পাহাড়পুর রেস্ট হাউজটাও চমৎকার , যাবার আগেই প্রত্নতত্ব অধিদপ্তর থেকে অনুমতি নিয়ে যাবার কারণে থাকতে কোন সমস্যাই হলো না। রেস্ট হাউজের বারান্দা থেকে জোনাক জ্বলা রাতের পটভূমিতে বিহারের কেন্দ্রীয় মন্দিরটাকে মনে হচ্ছিল ভিসুভিয়াস পর্বতের মত।

রাতে বাবুর্চির হাতের ঝাল ঝাল মুরগীর মাংস, আর কই মাছ ভাজি দিয়ে ভাত খেয়ে পরের দিনের ট্যুর প্লান করে শুয়ে পরলাম তারাতারি। ভোর থেকেই ঘুরলাম জগদ্দল বিহার, দেখলাম ভিমের পন্টি আর আগ্রা-দ্বিগুন আর্কিওলজিকাল সাইট গুলো। তারপর শেষ বিকালে পৌঁছলাম যোগীর ঘোপ নামের ছোট্ট গ্রামে। এখানেও আছে বেশ বড়সর একটা আনএক্সেভেটেড সাইট। ঢিবির আশেপাশের লোকজন ঢিবির উপর থেকে মাটি কেটে নিয়ে যাওয়াও মাঝে মাঝে সৃষ্টি হয়ে গেছে বড় বড় গর্ত ।

আর তার ভেতর থেকে কংকালের মতো বেরিয়ে আছে পাথরের স্লাব, প্রাচীন দেয়ালের ভগ্নাবশেষ, টেরোকোটা ফলকের অংশ। যেভাবে মানুষ কোদাল চালাচ্ছে তাতে মনে হয় না সামনের বছর আর এটাকে পাবো । সেই ভেবে যতটুক সম্ভব ডকুমেন্টেশন করে নিচ্ছিলাম, এই করতে করতে কখন যে সন্ধ্যা হয়ে গেলো টেরই পাইনি। এদিকে আলোর অভাবে ঠিক মতো ছবিও আসছে না, কি করা যায় ভাবতে ভাবতে পাশ দিয়ে যাওয়া এক গ্রামবাসীকে শুধালাম, ভাই এখানে রাত কাটাবার মতো নিরাপদ কোন জায়গা পাওয়া যাবে? সে যেন প্রথমে বুঝতেই চাইলো না কি বলছি, পরে যখন বুঝিয়ে বললাম, তখন বলে তেমন তো কোন জায়গা নেই বাবা, সবই ঝাপড়া ঘর বাড়ি নিজেদের। কি আর করা হতাশ হয়ে যখন ফিরে যাবো ভাবছি, তখন একজন পরামর্শ দিল এ গ্রামের একমাত্র দালান বাড়ি , জমিদার বাড়িতে যেতে।

মুল মালিকেরা অবশ্য অনেক আগেই চলে গেছেন , এখণ তাদের দূরসম্পর্কের কোন এক আত্মীয়া থাকেন ওখানে । তাকে বোঝাতে পারলে হয়তোবা কোন ব্যাবস্থা করে দিতে পারেন থাকার। শুনে আর দাড়ালাম না আমরা, চলে গেলাম সাথে সাথে। দূর থেকে বাড়িটা দেখে দমে গেলাম অনেকটা, এখানে কি মানুষ থাকে!! যাই হোক অনেক কষ্টে বুঝানোর পরে একরাত থাকার ব্যাবস্থা করে দিলেন তারা প্রায় পরিত্যক্ত জমিদার বাড়ির দ্বোতালার এক ঘরে। তখনও কি জানতাম কি এক দমবন্ধ করা রহস্য অপেক্ষা করছে ওখানে আমাদের জন্য!!! বাড়িতে বিদ্যুত নেই, একটা হারিকেন জ্বলিয়ে দিয়ে গেলো বাচ্চা মত একটা মেয়ে।

হাতমুখ ধুয়ে তার সাথেই উপরের চলে এলাম আমরা। মাথার উপরে অদ্ভুত রকমের বড় বড় আস্ত গাছের কাঠের কড়িবরগা ওয়ালা মাঝারি আকারের একটা ঘরে থাকতে দেয়া হয়েছে আমাদের। দেয়ালের ইট গুলো যেন মুখ ভেংচে তাকিয়ে আছে। সারা ঘরের মধ্যে একটাই বড় কুলুঙ্গি মতো জানালা, কোন গ্রিল নেই, ঠান্ডা বাতাস আসছে সেদিক দিয়ে। ওদিকে দিয়ে নীচে তাকাতে চোখে পরলো দরদালানের আশেপাশে ভংগ্ন, অর্ধভগ্ন সব স্থাপনা, এক পাশে সম্ভবত ইট দিয়ে বানানো বড় বড় দুটো চুলা।

সারাদিনের পরিশ্রমের কারণে পা দুটো যেনো ব্যাথায় টনটন করছিল, তাই শুয়ে পড়লাম তারাতরি। তবে কেন যেন ঘুম আসছিল না, এমন একটা বাড়ি, আশের পাশের ঝোপঝাড় থেকে ভেসে আসা নানা রকম পোকার ডাক পরিবেশটাকে যেন থমথমে করে তুলছিল। পাশে সোহার বাবা আগেই ঘুমে কাদা, এই সব সাতপাচ ভাবতে ভাবতে আমিও ঘুমিয়ে গেলাম একসময়। এরপর রাত তখন কত প্রহর হবে কে জানে , হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলো, কেমন একটা অস্বস্তি নিয়ে উঠে বসলাম। সমস্ত চরাচর নিস্তব্দ, দেয়ালে হারিকেনের কাপাকাপা আলোর নানা রখম ভৌতিক নকশা, তার মধ্যে জানালা গলে ঘরের ভেতরে ঢুকছে চাঁদের মিষ্টি আলো।

আজ যে পূর্নিমা মনেই ছিলা না। জানলার পাশে গিয়ে দাড়ালাম , দূরে বিলের পানি জোছনার রূপোর মতো ঝক ঝক করছে। মনে হলো এই দৃশ্য একা একা দেখা ঠিক হবে না, ডেকে তুললাম সঙ্গীকে তারপর দু'জনে মিলে চওড়া সিড়ি বেয়ে উঠে গেলাম ছাদে। জোৎস্নার ভেসে যাচ্ছে চরাচর, এর মধ্যে চোখে পড়লো নীচে বাড়ির আধা ভাঙ্গা প্রবেশদ্বার, এর পাশেই সম্ভবত একটা বেশ গহীন কুয়ো মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ গ্রিক এক্রোপলিসের মতো কিছু স্ট্রাকচার। এত গুলো প্রবেশদ্বার দেখে মনে হলো এটাও কোন একটা মন্দিরই হবে।

ঠান্ডা হওয়া বইছে, ঝিঝির অর্কেস্ট্রা আর সেই সাথে ভয় ভয় ভালো লাগার একটা মিশ্র অনুভূতি। সে বললো, চলো নীচে যাই হেটে আসি একটু। কিছু না ভেবেই দু'জনায় নেমে পড়লাম তারপর হেটে গেলাম সেই মন্দিরটার দিকে। কিছুক্ষন হেটে ভাবলাম এইবার ফিরে যাই ঘরে, ঠিক সেই সময়ে হঠাৎ কেমন যেন বদলে গেলো পরিবেশটা। প্রথম বুঝতে পারছিলাম না এমন লাগছে কেন, পরে খেয়াল করলাম সমস্ত পোকার ডাক বন্ধ হয়ে গেছে, বাতাসটাও পরে গেছে।

খুব বেশি চুপচাপ হয়ে পরেছে যেনো পৃথিবী, কারো অনাকাঙ্কিত আগমনে সবাই যেন চমকে গিয়ে চুপ হয়ে গেছে! এমন সময় কি মনে করে পিছন দিকে তাকালাম আর তাকিয়েই আমি জমে গেলাম একদম, শক্ত করে চেপে ধরলাম সঙ্গীর হাত। আমাদের ঠিক দশ হাত পেছনেই বিশাল দুটো গোখরা প্রায় লেজের উপরে দাড়িয়ে ফনা দোলাচ্ছে, চাঁদের রূপালি আলো তাদের কালো পিচ্ছিল গায়ে ঝলক্বে ঝলকে উঠছে যেন। এক দৃষ্টিতে তারা তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে, একেই কি বলে সাপের মতো শীতল চাহনী! আমরা দু'জনে স্থানুর মতো দাড়িয়ে আছি, পা নড়ছে না। কতক্ষন সেভাবে ছিলাম জানি না, হঠাৎ চোখে পড়লে তাদের দোলায়মান শরীরের পিছনে মন্দিরের কুলঙ্গীর যে পেডোস্টালে পুজা দেয়া হয়, ওঠার উপরে তীব্র সাদা আলোর মতো জ্বল জ্বল করছে কি যেন। আমরা সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে আছি সেদিকে।

এক সময় সেই সাদা আলোর তীব্রতা কমতে থাকলো, কমতে কমতে একেবারে নেই হয়ে গলো, তখন সম্বিত ফিরে পেয়ে দেখালম সাপ দুটোও নেই। তখন হুশ এলো আমাদের, হাচরেপাচের দৌড়ে চলে এলাম ঘরে। সারারাত দুজেন নির্বাক হয়ে বসে থাকলাম, কি দেখলাম আমরা এটা! সকালের দিকে একটু ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম বোধহয়, উলু আর ঘন্টার শব্দে ঘুম ভাঙ্গলো। জানালার কাছে গিয়ে দেখি গারদের লাল পেরে শাড়ি পরে একজন পুঁজো করছেন গতকালের সেই মন্দিরে। তারাতারি নেমে এলাম নিচে, পুঁজো শেষে জিজ্ঞেস করলাম তাকে কিসের মন্দির এটা, সে বললো গোরক্ষ নাথের।

প্রতি বৈশাখ মাসে এখানে গোরক্ষনাথের বড় পুজো হয়। সবিতা দিদি মানে সেই মহিলা এরপরে আমাদের একটু চা খাওয়ালেন, তারপর আমাদের নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখালেন সব। এই জামিদার বাড়ির আশেপাশে আছে বেশ কিছু মন্দিররের ধবংসাবশে, মন্দিরের পাওয়া পাথরের ঠুকরো, দরজার কারুকাজ ইত্যাদি দেখে ধারনা করা হয় এগুলো একাদশ -দ্বাদশ শতকের (সোর্স: মোশাররফ করিম)। তবে জমিদার বাড়িটার স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য দেখে একে লেট কলোনিয়াল সময়ের মনে হয়েছে আমার। একটা মন্দির প্রায় অক্ষত আছে, সেটাকে ওরা বলে শিব মন্দির।

শিউলি আর কলকে ফুলে ছাওয়া এই মন্দিরের ভেতরে প্রায় ১.৩৭ মি: উচু একটি ব্লাক ব্যাসল্টে শিবলিঙ্গ আছে। যদিও প্রত্নত্ত্বত্ত অধিদপ্তরের প্রাক্তন ডিরেক্টের মোশাররফ করিমের মতে এটা একটা ভোটিভ স্তুপ, এর গায়ে অনেক গুলো দেবদেবী মুর্তি আছে, তাদের একটিকে তিনি তারা দেবী হিসাবে চিন্থিত করেছেন। এর পাশের আরেকটা মন্দিরে আছে ব্লাক ব্যাসল্টেরই গৌরীপট্ট। দুপুর নাগাদ সব মাপজোক, ছবি তোলা আর দেখা দেখির কাজ শেষ হয়ে গেল। কিন্তু সব কিছুর মধ্যেও মনের ভেতর থেকে গতরাতের সেই ঘটনাটা কিছুতেই সরাতে পারছিলাম না।

শেষে দেনোমেনো করে দিদিকে বলেই ফেললাম সেই ঘটনা, সব শুনে সে স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলেন আমাদের দিকে। তারপর বললেন, জমিদার বাবুরা চলে যাবার পরে এই পরিত্যাক্ত বাড়িতে যোগীরা আস্তানা বানায়। পাহাড়পুর, মহাস্স্থনগড় এই দু'জায়গাতেরই যোগীদের বিচরনের প্রমাণ পাওয়া যায়, সেই যোগীদের শেষ ধারাটা এসে আস্তানা করে এখানে আর তাদের নামেই পরে এই গ্রামের নাম করণ হয়। উনবিংশ শতকের শেষ পর্যন্ত তাদের অস্তিত্ব ছিল এই গ্রামে। আর যোগীরা হলেন একটা বিশেষ ধর্মমতের গোষ্টী যাদের নিজেদের বিশেষ ধর্ম বিশ্বাস আর আচার আছে।

তবে তাদের এই ধর্ম বিশ্বাসে শাক্ত্য, শৈব্য আর তান্ত্রীক বৌদ্ধ ধর্মের বিশেষ প্রভাব আছে। যোগীদের প্রতিটা গোষ্ঠিতে একটা আলাদা আলাদা একজন করে গুরু থাকেন, এই গুরুই তাদের ধর্ম আর আচার শিক্ষা দেয়। তো এই বাড়িতে তাদের এমনই একজন গুরু গোরক্ষনাথের পুঁজো হতো এক সময়ে, এখনো হয় প্রতি বৈশাখে। সেই পুঁজোয় যদি কোন আচারে ভুল হয় তাহলে নাকি মন্দিরের ভূগর্ভস্ত কক্ষ থেকে বের হয়ে আসে দুটো বিশাল কৃষ্ণ বর্ণের গোখরা। যুগের পর যুগ থেকে নাকি তার বাস করছে ঐ মন্দিরের ভূগর্ভস্থ একটা কক্ষে! নীচের চৌকা প্রকোষ্ট থেকেই নাকি বের হয় তারা।

আমরা স্তব্ধ হয়ে শুনছিলাম তার কথা, তাহলে গতকাল রাতে যে সাপ দুটোকে দেখলাম এরাই কি সেই সাপ!! কেন বের হয়ে আসলে তবে অকারণে? কেনই বা এভাবে আমাদের সামনে হাজির হলো, আর কেনইবা আবার হঠাৎ উধাও হয়ে গেলো! যদি পুজো দেখতে চান তাহলে সামনের বছরে বৈশাখে আসবেন কিন্তু, হাসিমুখে বললেন সাবিতা দিদি। আচ্ছা চেষ্টা করবো, আসার কথা দিয়ে সরু মাটির রাস্তা দিয়ে ফিরে এলাম আমরা । হাটতে হাটতে একবার পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখি ভাঙ্গা জমিদার বাড়ির দোড় গোরায় সবুজের চালচিত্রে দাড়িয়ে স্মিত মুখে আমদের চলে যওয়া দেখছেন গোরক্ষনাথ মন্দিরের সেবিকা।  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.