আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আধিয়ার ২য় খন্ড

তোমাদের পাগল বন্ধু আধিয়ার ১ম খন্ড রাতের খাবার খেয়ে বারান্দায় বসে আছি আমি, সাত্তার সাহেব ও তাঁর স্ত্রী জয়গুন নাহার। বাহিরে গুড়ি গুড়ি মিহি বৃষ্টি, হাল্কা বাতাস। কারেন্ট আসেনি এখনো। আমি বসেছি চেয়ারে। সাত্তার সাহেব মাদুর বিছিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসেছেন।

হুক্কা টানছেন। গুড়গুড় শব্দ হচ্ছে। চারপাশে মিষ্টি জাফরানের ঘ্রাণ। জয়গুন নাহার স্বামীর পাশে বসে পানের খিলি সাজাচ্ছেন। “এরপর কি হল? তাজল মারা যাবার পরের ঘটনা?” কৌতুহলি কন্ঠে জানতে চাইলাম আমি।

হুকার পাইপে বারদুয়েক টান দিয়ে এক রাশ ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে আমার দিকে তাকালেন সাত্তার সাহেব, চোখে বিচিত্র একটা দৃষ্টি, “এরপরের ঘটনাটা একটু আজব -অবাস্তব বলে মনে হবে তোমার”। জয়গুন নাহারকে দেখলাম সামান্য ভীত চোখে অন্ধকার জমিটার দিকে তাকালেন একবার। চাপা গলায় বললেন, “রাত বিরাতে কিসব শুরু করলা? জামাই মানুষ, ভয় টয় পাবে তো!” “আরে পাবে না। সাহস আছে ছেলের”। আমার দিকে তাকালেন।

আমি ঢোক গিললাম। “তাজল শেখ মারা যাওয়ার দিনের ঘটনা। কবরটা দেয়া হয়েছিল এখান থেকে এক মাইলের মত পূবে একটা গোরস্থানে। অল্প কয়েকটা কবর মাত্র সেখানে। বেশিদিন হয়নি ওখানে গোরস্থানের জন্য জমি দেয়া হয়েছে।

জঙ্গল ধরনের জায়গা। বড় বড় বাঁশঝাড় আর ঝোপে ভরা। দিনের বেলাতেই যেতে কেমন লাগে যেন। রাতের বেলাতো ওটার ধারে কাছ দিয়েও মানুষ যায় না। তাজলের কবরটা দেয়া হল জঙ্গলের মাঝামাঝি একটা জায়গায়।

সরু পথ কেটে জঙ্গলের ভেতর তাজনের কবর পর্যন্ত নেয়া হয়েছিল। তাজলের জানাযার সময় অনেক মানুষ এসেছিল ওকে দেখতে। তাই কবর দিতে দিতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। প্রচন্ড গরম পড়েছিল সেদিন। কবর দিতে গিয়ে সবাই ঘেমে নেয়ে একাকার।

সন্ধ্যার দিকে বৃষ্টির ভাব শুরু হল। ঘন মেঘে ঢেকে গেছে আকাশ। থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, গর্জন করছে গম্ভীর স্বরে। গোরস্থানের বাঁশঝাড়গুলো একবার এদিক দুলছে আরেকবার ওদিক। দাফনের কাজ শেষে সবাই মোনাজাত ধরেছি সবে এমন সময় বৃষ্টি নামল চারপাশ ঝাপিয়ে।

এমনিতেই সন্ধ্যা তার ওপর ঘন মেঘের জন্য চারপাশে অন্ধকার নেমে এসেছে। জানাযার নামাজে মুসল্লি যতজন হয়েছিল-দাফনের সময় এসেছে একেবারেই কম। মাত্র আটজন। ইমাম সাহেব সবে হাত তুলে দোয়া পড়ানো শুরু করেছেন তখন নামল বৃষ্টি। আমরা কবরটা চারপাশ থেকে ঘিরে মোনাজাত করছি।

বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়াতে খারাপ লাগছে না। গরমের হাত থেকে বাঁচা গেল। চোখ বন্ধ করে মোনাজাত করছি। প্রথম দিকে কেমন একটা গোঁ গোঁ চাপা শব্দ হচ্ছিল। বোঝা যাচ্ছিল না শব্দটা কোথা থেকে আসছে।

হঠাৎ ঘটল ঘটনাটা। প্রচন্ড বৃষ্টির মাঝে আচমকা কবরের ভেতর থেকে কাঁচা মাটি ফুঁড়ে একটা কালো কুচকুচে হাত বের হয়ে এলো! বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা হাতটার গায়ে লেগে থাকা কাদা মাটি ভিজিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে। আমরা যারা ছিলাম ওখানে ব্যাপারটা অনেকেই প্রথমে খেয়াল করল না কারণ মোনাজাত করছিল সবাই নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে। সম্ভবত আমিই প্রথম দেখলাম ব্যাপারটা। জমে গেলাম বরফের মত।

আমার থেকে বড়জোড় দুই হাত সামনে কবরের ভেতর থেকে হাতটা কব্জি সহ আরো একটু বেরিয়ে এসেছে! কয়লার মত কালো হাত। দ্বিতীয় ধাক্কায় অন্য হাতটা বের হয়ে এলো কবর ফুঁড়ে! সেই হাতে একটা ত্রিশূ্ল ধরা! ত্রিশূলের চকচকে ফলা বজ্রপাতের আলোয় জ্বলজ্বল করছে! আমি শুনতে পেলাম বাকিরা ভয়ঙ্কর আতংকে চিৎকার দিয়ে দৌড়ে পালানো শুরু করেছে! আমিই কেবল নড়তে পারছিনা। আমার দুই পা যেন হাজার মণ ভারি হয়ে গেছে। মাটি থেকে তুলতেই পারছি না। বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে দেখলাম কবরের বাঁশ চাটাই সব ঠেলে নিচ থেকে কালো কুচকুচে একটা মানুষের মাথা বের হল কবরের মাটির ওপর! বজ্রপাতের সাদা আলোতে দেখতে পেলাম হলুদ রঙের দুটো চোখে মানুষটা সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে আছে! মানুষের চোখের মণি এরকম হলুদ হতে পারে না! লোকটার গলায় পেঁচানো কালো বিষধর একটা সাপ! ফণা তুলে হিস্ হিস্ করছে…… আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না।

বোধহীন জড়বস্তুর মত সেখানে দাঁড়িয়ে আছি। আমার চোখের সামনে মানুষটা কবর ভেঙে উঠে এল মাটির ওপর। কাদা মেখে আছে লোকটার গায়ে। সাদা কাফনটা দিয়ে কোমড়ের অংশটা পেঁচিয়ে রেখেছে। তাজল শেখ! এত কালো ছিল না দাফনের আগেও….. এখন দেখতে ওকে ঠিক সেই শিব মূর্তিটার মত লাগছে অবিকল….. তাজল আমার দিকে তাকিয়ে চিনতে পারার মত কোনো ভাব দেখালো না।

হলুদ রঙের জ্বলন্ত চোখে আমার দিকে দীর্ঘ একটা মুহূর্ত তাকিয়ে রইল। তারপর আস্তে আস্তে খুরওয়ালা পায়ে সাবলীল ভঙ্গিতে হেঁটে বৃষ্টির মাঝে জঙ্গলের ভেতর হারিয়ে গেল! ওর পিঠে আরো দুইজোড়া হাত টিউমারের মধ্য থেকে নড়ছে…. আমি নিজের পায়ের উপর ভর টিকিয়ে রাখতে পারছিলাম না। কেবল মনে হচ্ছিল ভয়ঙ্কর অশুভ-অশূচি কিছু একটা ঘটছে……. ঘটনাটা দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ল সারা গ্রাম জুড়ে। এমনকি শিব মন্দিরের পুরোহিতদের কান পর্যন্ত চলে গেল। সেই রাতেই মন্দিরের পুরোহিতরা চলে এলো গোরস্থানে।

তাদের কথা অনুযায়ী তাজল শেখ হল তাদের দেবতা- তার শরীরে শিব ভর করেছে। কবরটার ভেতরে তখন হাজার হাজার সাপ কিলবিল করছে যখন পুরোহিতরা যায় ওখানে। কিন্তু তাজল শেখকে পাওয়া যায়নি। বেমালুম গায়েব হয়ে গেছে। মশাল জ্বালিয়ে সারা জঙ্গল তন্ন তন্ন করে খুঁজল মন্দিরের সবাই।

বার বার বলতে থাকল তারা- তাদের দেবতা মন্দির ছেড়ে চলে এসেছে বলে মন্দিরটা ভেঙে গেছে। মাটির নিচে চলে গেছে মূর্তিগুলো। তাই তাদের দেবতাকে খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু চারপাশের দশ মাইল চষে ফেলার পরও তাজল শেখকে পাওয়া যায়নি। সে রাত থেকে আমার প্রচন্ড জ্বর শুরু হল।

এমন জ্বর বহুদিন হয়নি। কাউকেই চিনতে পারছিলাম না। কেবল বিছানায় শুয়ে কাথার নিচে কাঁপছিলাম থরথর করে আর পাগলের মত প্রলাপ বকছিলাম। ০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০ সুলতানার কোনো আত্বীয় স্বজন ছিল না। কারণ তাজল শেখ মারা যাবার সময় কেউ আসেনি।

থাকলে নিশ্চই আসতো। স্বামী মারা যাওয়ায় মেয়েটা পাগলের মত হয়ে গিয়েছিল। তোমার চাচী সুলতানাকে এবাড়িতে এনে রেখেছিল কিছুদিন। কারো সঙ্গে কোনো কথা বলত না। একা একটা ঘরে সারাক্ষণ দরজা বন্ধ করে বসে থাকত।

কিছু খেতেও চাইত না। ফেলে দিত সব। জয়গুন অনেক চেষ্টা করেও সুলতানাকে কিছু খাওয়াতে পারত না। দেখতে দেখতে হাসিখুশি মেয়েটা চোখের সামনে শেষ হয়ে যেতে লাগল। শুঁকিয়ে চোয়ালের হাড় বের হয়ে এল।

বড় মায়া লাগত মেয়েটাকে দেখে। আমার জ্বর থেকে সেরে উঠতে পাঁচদিন সময় লাগল। সুস্থ হবার পর প্রায়ই গিয়ে সুলতানাকে বোঝাতাম খাওয়া দাওয়া করার জন্য। মানুষ মারা যাবে এটাইতো স্বাভাবিক। এভাবে ভেঙে পরলে তো জীবন চলবে না।

ওর বয়স কম। সামনে ওর পুরো জীবনটা পরে আছে। কিন্তু এত কথা বলে কোনো লাভ হত না। মূর্তির মত যে মেয়েটা বসে থাকত তো থাকতই। কোনো কথাই বলত না।

প্রায় রাতেই মসজিদ থেকে এশার নামাজ পড়ে ফিরে আসলে সুলতানার ঘরের দিক থেকে শুনতে পেতাম একা একা কথা বলছে মেয়েটা। শুনে মনে হয় যেন কারো সঙ্গে কথা বলছে -কেবল অন্যজনের কথা শোনা যাচ্ছেনা। আমি পাগলের প্রলাপ ভেবে পাত্তা দিতাম না। তাজল শেখের কবর থেকে বেরিয়ে আসার ঘটনাটা সুলতানাকে কেউ বলেনি। বললে কি করত কে জানে।

এমনিতেই তাজলের শোকে পাথর হয়ে আছে। আমি শুক্রবার বিকেলে আমাদের বাড়িতে হুজুর এনে মিলাদ দেয়ালাম। কারণ তাজল শেখ মারা যাবার পর থেকেই এই বাড়িটা কেমন যেন হয়ে গেছে। যদিও এ বাড়িতে তাজল থাকত না। কিন্তু সুলতানা আসার পর থেকে এ বাড়িতে অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে।

খুব বেশি সাপ বের হচ্ছে বাড়ির নানান জায়গা থেকে। হাঁস মুরগি গুলো সব মরতে শুরু করেছে একে একে। আর বাড়ির চারপাশে কে যেন মাটি খুঁড়ে বড় গর্তের মত করে রাখে প্রতিরাতে। মিলাদের পরদিন কাজের চাপে সারাদিন বাসায় আসতে পারলাম না। গঞ্জে যেতে হয়েছিল মালপত্র নিয়ে আসতে।

সেসময় এখানে লোক এসে কোল্ড স্টোরেজ়ে বস্তা দিয়ে যেত না। গঞ্জে আমার মূল অফিসে দিয়ে যেত। আমাকে নিয়ে আসতে হত। ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল। নামাজের পর ফিরলাম।

রাতে আমি মসজিদ থেকে ফিরে সবে বাড়িতে পা রেখেছি অদ্ভুত একটা অনুভূতি হল। বাড়ির কোথাও কোনো আলো নেই। কারেন্ট না থাকতে পারে কিন্তু হারিকেন তো জ্বলবে-সেটাও জ্বলছে না। আমি হাতের টর্চ দিয়ে এদিক সেদিক দেখলাম। জয়গুন কিংবা আমার বড় মেয়ে কারো কোনো সাড়া শব্দ নেই।

অবাক হলাম ভীষণ। এমনকি চারপাশে অদ্ভুত একটা নিস্তব্ধতা, কোনো ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দও নেই। হাঁস মুরগির খোঁপ গুলোতেও কোনো আওয়াজ হচ্ছে না! সারা বাড়ি যেন কবর হয়ে আছে! আমি জয়গুনের নাম ধরে সবে ডাকতে যাবো- মুখ খুলেছি- হঠাৎ শুনতে পেলাম সুলতানা ওর ঘরটা থেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে, অস্পষ্ট গলায় কিছু বলছে। বোঝা যাচ্ছে না। আমি টর্চের আলো ফেললাম ওর ঘরটার দিকে, জানালা বন্ধ, দরজাও বন্ধ।

অন্ধকারে ভয় পেয়ে কাঁদছে নাকি? আমি এগিয়ে গেলাম তাড়াতাড়ি। ওর ঘরটার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দরজায় ধাক্কা দিতে যাবো-থমকে গেলাম আমি। স্পষ্ট শুনতে পেলাম একটা পুরুষ কন্ঠে কেউ বলছে, “মোর নগত কাহো আসিবা পারিবা নাহায় …….” কন্ঠটা শুনে জমে গেলাম। তাজল শেখের গলা! শুনতে পেলাম সুলতানা ভাঙা গলায় বলছে, “মুই যাম, মুই একলা রহিবা পারিবা নহু। ” আমি দরজার ফাঁক দিয়ে ভয়ার্ত চোখে তাকালাম ভেতরে কি হচ্ছে দেখার জন্য।

কিন্তু তার আগেই আমার হৃদপিন্ডটা ধরাস করে উঠল। আমি দরজার যে অংশে চোখ রেখে তাকাতে গেছি- ঠিক সেখানেই হলুদ একটা চোখ আমার দিকে ওপাশ থেকে চেয়ে আছে দরজার ওপাশ থেকে! গোরস্থানের সেই তাজলের চোখগুলো! আমি আতংকে পেছন দিকে ছিটকে এলাম। পায়ে পা বেঁধে হোচট খেয়ে পরে গেলাম উঠানে। টর্চটা হাত থেকে গড়িয়ে অন্যদিকে চলে গেল। আমি ভয়ার্ত চোখে দেখলাম সুলতানার ঘরের দরজা খুলে গেল।

চাঁদের ঘোলাটে আলোয় দেখা গেল তাজল শেখের সেই দেবতা রুপটা একহাতে ত্রিশূল নিয়ে, গলায় সাপ পেঁচানো- কালো কুচকুচে মুখে হলুদ দুটো চোখ। জ্বলন্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে! অন্য হাতে সুলতানার একটা হাত ধরে রেখেছে। আমি নড়তে পারছিলাম না ভয়ের চোটে। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তাজল সুলাতানার হাত ধরে নেমে এল উঠানে। আমার দিকে না তাকিয়ে দুজন সোজা হেঁটে যেতে লাগল ওদের মাটির বাড়িটার দিকে! পুরো দৃশ্যটায় ভয়ংকর একটা অশুভ আর অবাস্তব ব্যাপার রয়েছে।

আমার মনে হচ্ছে আমি খুব ভয়াবহ একটা দুঃস্বপ্ন দেখছি। কারণ আমি চাঁদের আলো আর পরে থাকা টর্চের আলোতে আবছা ভাবে দেখতে পাচ্ছি সুলতানার ঘরের খোলা দরজাটা দিয়ে-সিলিং থেকে সুলতানা ঝুলে রয়েছে ঘরের ভেতর! ওর শাড়িটা ফাঁস বানিয়ে গলায় দেয়া, ব্লাউজ আর পেটিকোট পরনে। দু’পা সোজা হয়ে রয়েছে, আঙ্গুল গুলো মাটির দিকে! বিস্ফোরিত চোখে অন্য দিকে তাকালাম। এখনো চাঁদের আলোয় দেখা যাচ্ছে সুলতানা ওর স্বামীর দেবতা মূর্তির হাত ধরে ওদের পুরনো ভিটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে জমির আল দিয়ে। সুলাতানা যদি ওখানে থাকে-তবে ফাঁস লাগিয়ে ঝুলছে কে? আমি হাঁচড়ে পাচড়ে উঠে টর্চ হাতে দৌড়ে ঘরটায় ঢুকলাম।

সুলাতানা ঘরে ফাঁস দিয়ে ঝুলে রয়েছে। এক নজর দেখেই বোঝা গেল ফাঁসটা এখন না, বেশ আগেই খেয়েছিল। ফুলে রয়েছে সারা শরীর! আমি খুব একটা সাহসী মানুষ তা বলব না। তবে সে সময় মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারলাম। জয়গুন আর বড় মেয়েকে না দেখতে পাওয়ার কারণটা বুঝতে পারলাম।

সম্ভবত লাশটা দেখে ভয়ের চোটে অন্য আধিয়ারদের বাড়িতে চলে গেছে। আমি নেই- ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক। হয়ত অন্যদের ডেকে আনার আগেই আমি চলে এসেছিলাম। সুলতানার লাশটা নামাতে গেলাম না আমি। পুলিশি ব্যাপার।

ওরা আসুক আগে। কতক্ষন আগে ফাঁস খেয়েছিল কে জানে। লাশটা দ্রুত ফুলে যাচ্ছে। আমি উঠানে বেরিয়ে এলাম টর্চ হাতে। দেখতে পেলাম চারপাশের জমিগুলোর আধিয়ারদের বাড়ি থেকে হারিকেন হাতে লোকজন ছুতে আসছে ক্ষেতের মাঝ দিয়ে।

আমি তাজলদের মাটির বাড়িটার দিকে তাকালাম। শিরশির করে উঠল গা। ভোররাতে পুলিশ যখন আসে তার একটু আগে সুলতানার লাশটা বেশি ফুলে গিয়ে শাড়ি ছিঁড়ে মেঝেতে পড়ে যায়। ঠিক একই সময়ে তাজলদের মাটির বাড়িটা অদ্ভুতভাবে হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ে। একেবারে মিশে যায় বাড়িটা……” থামলেন সাত্তার সাহেব।

আস্তে আস্তে বললাম, "সুলতানা এমন করল কেন?" হাসলেন তিনি, "সংসার। সংসার বড় আজব জিনিস। । বেধে রাখা যায় না, আবার ছেঁড়ার পরেও জোড়া দেয়ার বড় পাগল নেশায় টানে....... সুলতানাকে সংসারের নেশায় ধরেছিল, তাজলের সংসারের নেশা। কাটাতে পারেনি সেটা।

ফাঁসিতে ঝুলে নতুন করে ছেঁড়া সম্পর্কটা জুড়ে দিতে চেয়েছিল। " চুপ হয়ে গেলেন দীর্ঘ কয়েকটা মুহূর্তের জন্য। চারপাশে ঝিঁ ঝিঁ পোঁকার একঘেয়ে ডাক। আমি ঢোক গিললাম, “তারপর?” “তারপর অনেক ঘটনা ঘটেছিল, সব বলার মত না। তবে একটা ব্যাপার- ওরা মারা যাওয়ার পর আমার কোল্ড স্টোরেজে প্রায় রাতেই তাজল আর সুলতানাকে ঘুরে বেড়াতে দেখেছে অনেকে।

আমি নিজেও তালা বন্ধ করতে গিয়ে বেশ কয়েক রাতে দেখেছি। আবছা অন্ধকারের মাঝে কোল্ড স্টোরেজের ভেতরে বাঁশের তাকগুলোতে বস্তার উপর পা ঝুলিয়ে বসে রয়েছে তাজল শেখ। পায়ে ঘোড়ার খুর,গলায় সাপ। চুপচাপ বসে আছে প্রচন্ড ঠান্ডার মাঝে। কুয়াশার মত ধোঁয়া ওর চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে।

অদ্ভুত সুরে বিজাতীয় ভাষায় গুনগুণ করে গান গাওয়ার মত করে কিছু একটা বলে তাজল শেখ। কাকে বলে জানিনা। কিন্তু ঐ সময়টায় পুরো এলাকার সব ঝিঁ ঝিঁ পোকা, শিয়াল, খাটাস- একদম চুপ মেরে যায়। কোনো প্রাণের সাড়া পাওয়া যায় না। ” হুক্কা টানতে গিয়ে খেয়াল করলেন আগুন নিভে গেছে।

বিরক্ত হলেন যেন পাইপটার উপর। ফেলে দিলেন একপাশে পাইপটা। দীর্ঘ নীরবতা। “জামাই, অনেক রাত হয়েছে। ঘুমায় পরো বাবা।

” জয়গুন চাচী বললেন এক সময়। আমি মাথা কাত করে উঠে দাঁড়ালাম। চারপাশে কুয়াশার মত বৃষ্টি, তার মাঝেই মেঘ সরে গিয়ে চাঁদের ঘোলাটে আলো ছড়িয়ে পরেছে চারপাশের ক্ষেত গুলোতে। চাঁদের আলোতে মিহি বৃষ্টি। হঠাৎ খেয়াল করলাম চারপাশে ঝিঁ ঝিঁ পোকা, শিয়াল, কুকুর- কোনো কিছুর ডাক শোনা যাচ্ছে না! গায়ে কাঁটা দিল! কেন যেন মনে হল অন্ধকার জমির সেই জায়গাটায় আলের ওপর থেকে কেউ একজন জ্বলজ্বলে হলুদ চোখে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে এইদিকে।

চোখের ভূল কিনা বুঝতে পারলাম না। তবে হঠাৎ যেন লাগল সেখানে কম বয়সী একটা মেয়ের আবছা অবয়ব প্রকট হচ্ছে ধীরে ধীরে প্রথম জনের পাশে..... (সমাপ্ত) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।