আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আশ্বিন বোঝে মনের মাধুরী

আশ্বিন বোঝে মনের মাধুরী হঠাৎ করেই দেখা যায় নদীতে আর সেই থই থই পানি নেই। আগের সেই প্লাবনের রেশ তেমন নেই। ভাটার টানের মতো কমে যাচ্ছে নদীর পানি। শুকনো একটা পরিবেশ বিরাজ করছে প্রকৃতির মধ্যে। চোখে পড়ে পানিতে ভাসছে শাপলা।

মনটাও হঠাৎ করে যেন ভেসে ওঠে মনের মধ্যে। ওদিকে বৃষ্টি আসে হঠাৎ করে। সত্যিই তো আশ্বিনের টান বোঝা যাচ্ছে। চোখে পড়ছে শিউলি ফুল, কাশফুল। আকাশের সাদা মেঘের সাথে কাশের সাদার মিতালী মানুষের মনের মিতালীকেই যেন প্রগাঢ় করে।

আশ্বিন বোঝে প্রকৃত মনের মাধুরী। শরতের মধ্যে ডুবে থাকে আশ্বিন। ভাদ্র আর আশ্বিনের মধ্যেই শরতের বসবাস। ভাদ্র শরতের যেসব বিষয় সূচনা পর্বে এনে দেয় আশ্বিন নিজে তার নিজস্ব আগমনের সময় থেকে তাকে পূর্ণতা দেয়। আশ্বিন শরৎকে পরিপূর্ণ করে।

এই দিক দিয়ে আশ্বিন শরতের পরিপূর্ণতার সুহৃদ। আবার অন্যদিকে য়িত শরতের জন্যও আশ্বিন বিশেষ ভূমিকা রেখে থাকে। অর্থাৎ ভাদ্রের সাথে শরতের নিবষ্টতা প্রগাঢ় হওয়ার আগেই আশ্বিনের আগমন - বিচ্ছিন্ন করে দিতে চায় ভাদ্রের স্বপ্নকে আর নিজেকে নিবিড় করে তুলতে সদা সচেষ্ট থাকে আশ্বিন নিজেই। কিন্তু সেও খুব বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয় না। অল্প সময়ের আগমন, ণিক পরেই প্রস্থান।

কিন্তু তার এই প্রস্থান দ্রুত সত্ত্বেও সে নিজেকে শরতের সুরভিতে জড়িয়ে নিতে সম হয়। ধন্য হয় শরৎ। ভাদ্র-আশ্বিনের উদারতায় বিমুগ্ধ প্রকৃতি। শিউলি ফুলের ফোঁটা, সাদা মেঘ, শান্ত সরোবর নদী, কাশফুল, ভাদ্রের তালপাকা গরম সব মিলিয়ে শরতের অপরূপ শোভা সত্যি মুগ্ধকর। গরমের তীব্রতা আশ্বিনে আস্তে আস্তে কমে আসে।

কখনো কখনো প্রকৃতি আশ্বিনে কিছুটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ভাদ্রে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও আর্দ্রতা বেড়ে যায় এবং তা সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসে আশ্বিনে। ভ্যাপসা গরমের ভাব অনেকটা কমে আসে। একটি পরিবর্তন প্রকৃতির ভিতর যেমন ল্য করা যায়, আশ্বিন সেই পরিবর্তনে পূর্ণতা দান করে। নদীর পানি ধীরে ধীরে কমতে থাকে এ সময়।

মাটির সিক্ততাও কমতে থাকে। সেই বর্ষার অবিরাম বর্ষণের ধারা শরতে এসে আর তেমন দেখা যায় না। চারিদিকে ক্রমেই শুকনো অবস্থার রূপ পরীলতি হতে থাকে। একদিকে নদীর পানি কমে, বৃষ্টির পরিমাণ বেশ কমে আসে, অন্যদিকে আকাশের গুচ্ছ গুচ্ছ সাদা মেঘ আর শরতের পুরোদস্তুর নেমে পড়া প্রকৃতি আনন্দের সুর তোলে হৃদয়ে। এই পরিবেশকে যে যেভাবে উপভোগ করে নিতে পারে নিক।

শিউলি, গোলাপ, বকুল, মল্লিকা, কামিনী, মাধবী ফুলের সুরভিতে মুখরিত হয়ে ওঠে প্রকৃতি। বিলে ঝিলে শাপলা আর নদীর তীরে কাশফুল আশ্বিনের দুয়ারে প্রাণের বার্তা নিয়ে আসে। শরতের পরিবেশকে নির্মল চোখে দেখে সবাই। বাতাসে শীতের স্পর্শ যেন পাওয়া যায় আশ্বিনের ভোরে। শরতের এই নির্মল প্রকৃতি কারই না ভালো লাগে।

প্রমথনাথ বিশীর কবিতায় আমরা আশ্বিনের নির্মল রূপকে দেখি, আশ্বিনের নির্মল নদী দিগি¦জয়ী সম্রাটের কোষনির্মুক্ত তরবারির মত, পাশেই প'ড়ে আছে কাশের রূপালি কাজ করা তার খাপখানা। সে পদ্মা কবির। আশ্বিন মাসে মেঘ মোটামুটি কেটে যায়। ভাদ্রের থেকে সরে আরো কিছুটা। কাশফুলে ফোটে।

কবি বড়– চণ্ডীদাস তার কবিতায় আশ্বিনের চিত্র এঁকেছেন এভাবে - আশিন মাসের শেষে নিবিড় বারিষী মেঘ বহিআঁ গেলে ফুটিবেক কাশী। তবে কাহ্ন বিনী হইব নিফল জীবন গাইল বড়– চণ্ডীদাস বাসলীগণ। প্রকৃতির প্রৃতিটি পরিবর্তনই মানুষের কম বেশি চোখে পড়ে। যে যেভাবে পারে সে সেভাবে তা তার হৃদয়ে ধারণ করে। প্রকাশও করে সে সেভাবেই।

ছিন্ন মেঘের ছন্নছাড়া দল নিয়ে আকাশ চলছে। বিরহ বেদনা যাতনাও এসে হাজির হয়। অতীত স্মৃতি বর্তমানকেও মাঝে মধ্যে প্রশ্নের সম্মুখীন করে। বুদ্ধদেব বসু’র কবিতায় জীবন বাস্তবতার সুখ উঁকি দিতে দিতে আসে আর যায়। ঋণজর্জর জীর্ণ জীবনে শরতের উঁকিঝুঁকি পারে না করতে সুখী।

শ্রাবণের কালো এখনই আলোয় গলবে, বৃষ্টিশেষের নীল বন্যায় জ্বলবে ছিন্ন মেঘের ছন্নছাড়ার দল, আমি ব'সে ভাবি সংসার কিসে চলবে। শরতের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য শিউলি ফুল। এ সময় শিউলি ফোটে, শিউলি গন্ধ ছড়িয়ে দেয় প্রকৃতির ভিতর, প্রকৃতি মেতে ওঠে আনন্দে। শিউলির শরৎ নিয়ে কবিদের মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। সবার মনেই শিউলি কমবেশি নাড়া দিয়ে যায়।

আশ্বিনে শিউলি আরো প্রিয় হয়ে ওঠে। অসংখ্য উপমা উদ্ধৃতি পাওয়া যায় বাংলা সাহিত্যে। আশ্বিন যেন ব্যাকুল অস্থিরতায় শিউলিকে দিয়ে যায় চিত্তের সান্ত্বনায়। কাজী নজরুল ইসলাম শরতের শাপলা শালুক শিউলিকে রোমান্টিক করে তোলেন - শাপলা শালুকে সাজাইয়া সাজি শরতে শিশিরে নাহিয়া, শিউলি ছোপানো শাড়ী প'রে আগমনী-গীত গাহিয়া। আকাশের নির্মলতায় যে পাড়ে নিজেকে জড়িয়ে নেয়।

শিউলির সৌরভে উচ্ছল হয়ে কেউ। পাখির কলোরব উদাসী করে তোলে। কে আটকা থাকে ঘরের ভিতর। যত আলসেই হোক না কেন ঘরেও থাকা যায় না আবার কাজেও মন বসে না। এর মধ্যেই খুঁজে নেয় হারানো বন্ধু অথবা মনের প্রিয় সাথিকে।

অনেক স্মৃতিও এই সময়ে মনের কোনে উঁকি দেয়। আশ্বিন সম্পর্কে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘আশ্বিনে’ কবিতায় হৃদয়ের কথাই প্রকাশ করেন - আকাশ আজিকে নির্মলতম নীল, উজ্জ্বল আজি চাঁপার বরণ আলো; সবুজে সোনায় ভূলোকে দ্যুলোকে মিল দূরে-চাওয়া মোর নয়নে লেগেছে ভালো। ঘাসে ঝ'রে-পড়া শিউলির সৌরভে মন-কেমনের বেদনা বাতাসে লাগে। মালতী বিতানে শালিকের কলরবে কাছ-ছাড়া পাওয়া ছুটির আভাস আগে। হৃদয়ের কথা প্রকাশের পর রবীন্দ্রনাথ আশ্বিনের আহ্বানকে স্বাগত জানায় আজি আশ্বিনে প্রিয়-ইঙ্গিত-সম নেমে আসে বাণী করুণকিরণ-ঢালা Ñ চিরজীবনের হারানো বন্ধু মম, এবার এসেছে তোমারে খোঁজার পালা।

কেউ কেউ শরতের সাথে বিষাদ দেখেছেন। আর আনন্দও দেখেছেন কেউ কেউ। কিন্তু প্রকৃতি মানেই হলো কিছু দেয়ার কিছু নেয়ার। সে তার চিরন্তন নিয়মেই আসে আর যায়। বিলায়ে ভালোবাসা সৌরভ ধন্য করে যায় মন।

প্রকৃতির খেলা ভালোমন্দ মিলেই আসে। সব ঋতুই যে সবার কাছে সমান প্রিয়, সমান ভালোবাসার হবে তার কোনো মানে নেই। দেখা যাচ্ছে একই ব্যক্তি শরতের সাদা মেঘ দেখে পুলকিত হচ্ছেন, তিনিই আবার বিষাদ ভরা হৃদয় নিয়ে শরতের কাল কাটাচ্ছেন। এটাও তো মানুষের হৃদয় প্রকৃতিরই এক খেলা ভিন্ন আর কিছু না। কাজী নজরুল ইসলাম আশ্বিনে অতীতের বিরহকে স্মরণ করে স্মৃতিকে তুলে আনেন।

অতীত প্রণয়-স্মৃতি স্মরি’ কেঁদে যায় আশিন হাওয়া, উ'ড়ে বেড়ায় বর সে ভ্রমর কমল-পরাগ মাখিয়া। উদাসী ভাবকে সহজেই ধরে রাখা যায় না। শিউলির কথাও কমবেশি ঘুরে ফিরে আসে। উপমা শোভিত হয় শিউলি। আশ্বিনের আকাশকে নরম হিসেবে পরিচয় ঘটে আমাদের।

তার কোমল পেলবতা বারবার নাড়া দিয়ে যায়। কবি গোলাম মোহাম্মদ আশ্বিনের আকাশের সাথে মিশিয়ে দেখেছেন হৃদয়ের মমতাকে। মখমল চোখ তার মুখ তার শিউলীর ফুল হেমন্তের মাঠ যেন দেহ তার বিহ্বল শ্রাবণের মেঘের মুকুল। আশ্বিনের আকাশের নরম নীলের মমতায় ধীরে চলা মেঘেদের আঁচলের মতো আলুথালু ফিরে ফিরে চায়। প্রকৃতির ভারসাম্যহীনতায় ঋতুর পরিবর্তনকে আমরা সত্যি ঠিকমত ধরতে পারি না।

কখন আশ্বিন আসে আর কখন যায় শহরে বসে তা বোঝা আরো কঠিন। তবু শরৎ আসে, আশ্বিন আসে। প্রকৃতির সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে শরৎ উন্মুখর হয়ে থাকে। শরতের শোভা বৃদ্ধির সাথে সাথে মনের শোভাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। অবশ্য তার জন্য মন থাকা চাই।

দুই চোখ মেলে দেখার দৃষ্টি থাকা চাই। দুই ডানা মেলে উড়াল দেবার স্বপ্ন থাকা চাই। এর শোভা উপভোগ করতে হলে প্রকৃতির সাথেই আমাদের তাল মিলিয়ে চলতে হবে। আমরা যদি তা না করতে পারি তাহলে প্রকৃতির কোনো তি হবে না। কিন্তু তাকে যদি আমাদের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে বলি তাহলে প্রকৃতি বিপর্যস্ত হতে বাধ্য।

সেই বিপর্যয় পরিণামে আমাদের বিপর্যস্ত করে তুলবে। ১৬.০৯.২০০৮ ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।