আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সেনসর ছাড়া শফিক রেহমানের লেখা

শফিক রেহমানের এই লেখাটি সেনসর করে ছাপানো হয়েছিলো, আসলে তিনি এভাবেই লিখেছিলেন। শুধু ইংরেজী শব্দগুলো কপি করতে পারিনি। ১ মনমোহনের সফর কানেকটিভিটি ও রুটি নেড়িকুকুরের ইন্টারভিউ শফিক রেহমান এবার ভাদ্র মাসে হয়েছে ক্ষ্যাপা শ্রাবণের অঝোর বৃষ্টি। কবিতাপ্রেমী মনুষ্যকুল বৃষ্টি নিয়ে কবিতা বিলাস করে। তারা বোঝে না, বৃষ্টিতে সাধারণ কুকুরের কি দুরবস্থা হয়।

আমাদের কোনো পাকা দালান-কোঠা নেই। বেড়া বা টিনের বাড়িঘর নেই। এমনকি ফুটপাথে নীল পলিথিন শিটের তাবুও নেই। বৃষ্টিবিলাসী মানুষ জানে না বৃষ্টির সময় কুকুররা কোথায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। আমরা বৃষ্টির সময়ে আগে চেষ্টা করতাম কারো বাড়ির বারান্দায় গিয়ে দাড়াতে।

এখন ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্টে সিকিউরিটি গার্ডদের উপস্থিতির ফলে সেটা আর সম্ভব নয়। এখন বৃষ্টির সময়ে আমরা চেষ্টা করি কোনো বড় গাছের নিচে দাড়াতে। কিন্তু সেখানেও জায়গার জন্য প্রতিযোগিতা করতে হয় সাধারণ মানুষের সঙ্গে। তাদের অনেকেই ধুর ধুর বলে আমাদের তাড়িয়ে দেয়। তাই এখন বৃষ্টি হলে ভেজাই হয় আমাদের অনিবার্য পরিণতি।

ফলে জ্বর-নিউমোনিয়া প্রভৃতি রোগে আমাদের হয় অকাল মৃত্যু। এসব কথা কবিরা লেখে না। মানুষরা ছাপে না। সাম্প্রতিক কালে বৃষ্টিতে আরেকটি সমস্যায় পড়েছি আমরা। বিশেষত রাজধানী ঢাকায়।

বেশি বৃষ্টি হলে রাজধানীতে মাছ-মাংস ও শাকসবজির দাম বেড়ে যায়। গত ঈদুল ফিতরের পরে ব্যবসায়িক মন্থরতা, রাজধানীর সঙ্গে সংযোগকারী পথের দুর্দশা এবং দীর্ঘস্থায়ী বৃষ্টির ফলে, বিশেষত শাকসবজির দাম ধরাছোয়ার বাইরে চলে যায়। কাচামরিচের কেজি হয় চারশ থেকে পাচশ টাকার মধ্যে। এই অবস্থায় সাধারণ মানুষই যখন জীবন যুদ্ধে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে তখন ডাস্টবিনে উচ্ছিষ্টের পরিমাণ যায় কমে। ফলে সাধারণ কুকুরদের প্রায়ই অনাহার বা অর্ধাহারে থাকতে হয়।

রাষ্ট্রীয় সফরে মানুষের দুর্ভোগ এই পরিপ্রেক্ষিতে ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ২০১১-তে ইনডিয়ান প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা আগমন সাধারণ মানুষ ও সাধারণ কুকুরকে আরো বিপাকে ফেলে দিয়েছিল। ইনডিয়ান অতিথিদের জন্য শতাধিক টন চাদপুরের ইলিশ সাপ্লাই দিতে গিয়ে মাছের দাম আরো বেড়েছিল। ভাগ্যিস ইনডিয়ান অতিথিরা মাংসবিমুখ। তাই মাংসের দাম স্থিতিশীল ছিল। মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছিল আরেকটি কারণে।

মনমোহন সিং ও তার সহযাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের জন্য কয়েকটি রাস্তায় যানবাহন এবং জন চলাচল সীমিত করে ২ দেয়া হয়েছিল। ফলে বাস, সিএনজি ও রিকশাযাত্রী এবং সাধারণ পথচারী কয়েক ঘণ্টা ধরে নিজের শহরেই অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। যন্ত্রণাকাতর এসব মানুষ গালিগালাজ ও কটু কথা ছুড়ে দিয়েছে আগন্তুকদের প্রতি। বলা বাহুল্য, সেসব কিছুই শোনেননি জানালার কাচ ওঠানো এসি গাড়িতে ভ্রমণরত অতিথিরা। শুনেছি রাষ্ট্রীয় সফরে উনড়বত দেশের নাগরিকদের এমন বিড়ম্বনা পোহাতে হয় না।

মনমোহন সিংয়ের উপস্থিতির ফলে সাধারণ মানুষের মতোই কুকুরদেরও চলাচল হয়ে গিয়েছিল সীমিত। তবে সৌভাগ্যের বিষয় যে, কোনো কুকুরকে ধরে বেধে নেয়া হয়নি। ওই সময়ে যেসব মানুষের চলাচল অবাধ ও অসীম ছিল তাদের অন্যতম ছিলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডা. দীপু মনি। মনমোহন সিংয়ের সফরের দ্বিতীয় দিনের সকালে ডা. দীপু মনি নিজেই বিদেশ সফরে চলে গিয়েছিলেন। যেখানে মনমোহন সিংয়ের সফরটাই ছিল পররাষ্ট্র বিষয়ক সেখানে দ্বিতীয় দিনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর অনুপস্থিতিটা ছিল বিস্ময়কর ও দুঃখজনক।

হতে পারে, আরেকটি জরুরি রাষ্ট্রীয় কারণে ডা. দীপু মনিকে এই সফরে যেতে হয়েছে। কিন্তু মনমোহন সিংয়ের সফরসূচিকে বিবেচনায় রেখে আগেই ডা. দীপু মনির সফরের সময় নির্ধারণ করা উচিত ছিল। ডা. দীপু মনির নিজের সফরসূচির এই অসামঞ্জস্যতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তার নিজের অজ্ঞানতা। ৫ সেপ্টেম্বরে যখন ইনডিয়ান মিডিয়াতে সম্প্রচারিত হচ্ছিল তিস্তা চুক্তি হবে না তখনো তিনি জোর গলায় দাবি করছিলেন চুক্তিটি হবেই! বাগাড়ম্বর ও লেখাড়ম্বর মনমোহন সিংয়ের আসার আগে থেকেই তার সফরের সম্ভাব্য সুফল বিষয়ে টিভি টক শোতে অনেক বাগাড়ম্বর এবং পত্রিকায় অনেক লেখাড়ম্বর করা হয়েছিল। আওয়ামী সরকার, সরকার সমর্থক ও আওয়ামী মিডিয়ার এসব হাইপ (ঐুঢ়ব) শীর্ষে পৌছেছিল ৬ সেপ্টেম্বর ২০১১-র সকালে।

সেদিন সকালবেলায় আওয়ামী মিডিয়াতে এই সফরের সাফল্য বিষয়ে সর্বোচ্চ আশা প্রকাশিত হয়েছিল। যদিও তার আগের দিন ৫ সেপ্টেম্বরে দিল্লিতে ইনডিয়ান পররাষ্ট্র সচিব রঞ্জন মাথাই একটি প্রেস কনফারেন্সে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি সফর সঙ্গী হচ্ছেন না এবং তিস্তা বিষয়ে কোনো ঐকমত্য হয়নি। বিভ্রান্তিমূলক সংবাদ শিরোনাম বাংলাদেশের মানুষ কঠোর বাস্তবতার সঙ্গে পরিচিত হয় মনমোহন সিং দিল্লি ফিরে যাওয়ার পরদিন ৮ সেপ্টেম্বরে। এই দিন সকালে দৈনিক পত্রিকাগুলোর সংবাদ শিরোনাম ছিল : ৩ প্রত্যাশিত অর্জন নেই (বাংলাদেশ প্রতিদিন)। নতুন বার্তা পেল ভারত (প্রম আলো)।

অনিষ্পনড়ব অনেক ইস্যুই ঝুলে গেল (নয়া দিগন্ত)। তিস্তার পানি বণ্টন হবে সমতার ভিত্তিতে (ইত্তেফাক)। ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক নতুন মাত্রায় (আমার দেশ)। তীরে এসে ডুবল কেন তরী (সমকাল)। তিন উপদেষ্টাই ডোবালেন (কালের কণ্ঠ)।

দুঃখিত মনমোহন (জনকণ্ঠ)। ইতিহাস নয়, শেষ পর্যন্ত হতাশাই (মানবজমিন)। বাংলাদেশ-নেপাল রেল ট্রানজিটে ভারত সম্মত (সকালের খবর)। ৬৫ দফা ঢাকা ঘোষণা (আমাদের সময়)। বাংলাদেশ পানি পেল না।

ট্রানজিট নিল ভারত। মনমোহনের ঢাকা সফর ব্যর্থ (যুগান্তর)। ঞববংঃধ ভধরষঁৎব ঁহভড়ৎঃঁহধঃব (ডেইলি স্টার)। এসব শিরোনাম পড়ে সাধারণ মানুষের আশা ভঙ্গ হয় এবং তারা পড়ে যায় এক গভীর গোলকধাধায়। আসলেই বাংলাদেশ কি পেয়েছে এবং কি পায়নি, এ দুটি প্রশেড়বর যুগপৎ উত্তর একমাত্র যুগান্তর ছাড়া আর কেউ দেয়নি।

যুগান্তরই যথাযথ হেডলাইন দেয়, বাংলাদেশ পানি পেল না, ট্রানজিট পেল ভারত। কিন্তু যুগান্তরের সাবহেডিংটি ধাধার সৃষ্টি করে। যদি বাংলাদেশকে পানি না দিয়েও ইনডিয়া ট্রানজিট দিয়ে থাকে তাহলে ইনডিয়ান দৃষ্টিকোণ থেকে মনমোহনের ঢাকা সফরটি তো ছিল তাদের প্রত্যাশার চাইতেও বেশি সফল। পাঠকরা আচ করেন আসলে হয়তো পত্রিকাগুলোই বুঝতে পারেনি কি দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। তাই তাদের হেডলাইনগুলো ছিল নন-কমিটাল, অনির্দিষ্ট ও অস্বচ্ছ।

ট্রানজিট, করিডোর, ট্রানশিপমেন্ট, কানেকটিভিটি, টৃটি (ঞৎবধঃু), চুক্তি, প্যাকট (চধপঃ), ফ্রেমওয়ার্ক এগৃমেন্ট (ঋৎধসবড়িৎশ অমৎববসবহঃ), কাঠামোগত ঐকমত্য, জয়েন্ট কমিউনিকে (ঔড়রহঃ ঈড়সসঁহরয়ঁব), যৌথ ইশতেহার, জয়েন্ট স্টেটমেন্ট (ঔড়রহঃ ঝঃধঃবসবহঃ), যৌথ বিবৃতি, সম্মতিপত্র, স্মারক সমাঝোতা, প্রভৃতি কূটনৈতিক শব্দের বা উরঢ়ষড়সধঃরপ ঔধৎমড়হ (ডিপ্লম্যাটিক জার্গন)-এর বহুল প্রয়োগে চাপা পড়ে যায় প্রকৃত ঘটনাটি। সাধারণ মানুষ এসব শব্দের তুলনামুলক তাৎপর্য বোঝে না। তারা জানতে চায় সরল প্রশেড়বর একটি সরল উত্তর, ইনডিয়াকে ট্রানজিট দেয়া হয়েছে কি না? বাংলাদেশের পত্রিকা পড়ে ও টক শো দেখে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে যায়। কারো কারো মনে পড়ে যায় মোল্লা নসরুদ্দিনের একটি গল্প। ৪ রুটি কি? একবার রাজসভায় মোল্লা নসরুদ্দিনের বিচার করার জন্য সমবেত করা হয়েছিল দেশের শীর্ষ ফিলসফার, আইনবিদ ও যুক্তিবাদী ব্যক্তিদের।

কারণ এটা ছিল একটি সিরিয়াস ঘটনা। নসরুদ্দিন স্বীকার করেছিলেন, তিনি এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে ঘুরে বেড়ানোর সময়ে তার মতামত প্রচারে বলেছেন, তথাকথিত জ্ঞানী ব্যক্তিরা আসলে অজ্ঞ, বিভ্রান্ত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ়। নসরুদ্দিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছিল এ কথা প্রচার করে তিনি দেশের নিরাপত্তাহানি করেছেন। বাদশাহ তার সিংহাসন থেকে নসরুদ্দিনকে বললেন, তোমাকেই প্রমে বলার সুযোগ দিলাম। কিছু কাগজ ও কলম আনার নির্দেশ দিলে এই বান্দা বাধিত হবে।

নসরুদ্দিন অনুরোধ করলেন। কাগজ ও কলম আনা হলো। এখানে উপস্থিত সাত জ্ঞানী ব্যক্তিকে কাগজ-কলম দেয়া হোক। নসরুদ্দিন আর্জি করলেন। কাগজ ও কলম বিলি করা হলো।

আপনারা প্রত্যেকেই একটি প্রশেড়বর উত্তর লিখে দিন। প্রশড়বটি হলো, রুটি কি? সাত জ্ঞানী ব্যক্তি তাদের উত্তর লিখে বাদশাহর হাতে দিলেন। বাদশাহ উত্তরগুলো পড়ে শোনালেন। প্রম জ্ঞানী ব্যক্তির উত্তর : রুটি একটি খাদ্য। দ্বিতীয় উত্তর : রুটি হচ্ছে আটা ও পানি।

তৃতীয় : আল্লাহর নেয়ামত। চর্তু : মাখা আটার ভাজি। পঞ্চম : একটি পুষ্টিকর বস্তু। ষষ্ঠ : বিভিনড়ব সময়ে বিভিনড়ব মানে হতে পারে। সপ্তম : আসলেই কেউ জানে না।

উত্তরগুলো শোনার পরে নসরুদ্দিন বললেন, যখন তারা ঠিক করতে পারবেন রুটি কি, তখন তারা অন্য বিষয়গুলোও ঠিক করতে পারবেন। যেমন ধরুন, আমি ঠিক বলছি, নাকি বেঠিক বলছি। হুজুর, এই ধরনের ব্যক্তিদের ওপর কি রাষ্ট্রীয় বিবেচনা ও বিচারের ভার অর্পণ করা যায়? যে বস্তুটি তারা প্রতিদিনই খাচ্ছেন সেই বস্তুটির বিষয়ে তারা একমত ৫ হচ্ছেন না। এটা কি খুব আশ্চর্যের বিষয় নয়? অথচ তারা সবাই একমত হয়েছেন যে, আমি রাষ্ট্র বিরোধী কথা বলছি! পত্রিকার জ্ঞানী সম্পাদক-রিপোর্টার এবং টক শোর প-িত বক্তারা যখন সুস্পষ্ট ভাষায় সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারছিলেন না ইনডিয়াকে ট্রানজিট দেয়া হয়েছে কি না তখন দেশবাসী গভীর সমস্যায় পড়ে যায়। ইনডিয়ান মিডিয়ার নিউজ বুলেটিন এবং ইনডিয়ান প্রাইম মিনিস্টারের স্পষ্ট স্বীকারোক্তি “(তিস্তা চুক্তি না হওয়াটা দুর্ভাগ্যজনক)” থেকে বাংলাদেশের মানুষ বুঝতে পারে তিস্তা চুক্তি হয়নি।

অর্থাৎ, তিস্তার প্রত্যাশিত পানি বাংলাদেশ পাবে না। কিন্তু ইনডিয়া কি তাদের প্রত্যাশিত ট্রানজিট পেয়ে গিয়েছে? মানুষ এই প্রশেড়বর উত্তর উদগ্রীব ভাবে খুজতে থাকে। কারণ তারা জানে এরই ওপর নির্ভর করছে বাংলাদেশের প্রকৃত স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব। হন্যে হয়ে মানুষ জানতে চাইছিল বাংলাদেশ ট্রানজিট দিয়ে দিয়েছে কি না? কে দেবে এই জরুরি প্রশেড়বর উত্তর? মনমোহন সিং দিল্লি ফিরে যান ৭ সেপ্টেম্বর বিকেলে। পরদিন ৮ সেপ্টেম্বর সকালে একটি প্রেস কনফারেন্সে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ প্রশড়বটির উত্তর দেন।

তিনি বলেন, মূলত ট্রানজিটের চুক্তি আগেই হয়ে গিয়েছে। এখন শুধু যানবাহন চলাচলের ব্যাপারে একটি চুক্তি হওয়ার কথা ছিল। কেবল সেই সমঝোতায় স্বাক্ষর করা থেকে সরকার বিরত থেকেছে। মির্জা ফখরুল সংক্ষিপ্ত ভাবে তার রায় দেন এবং এটাই ঠিক। কিন্তু প্রেস কনফারেন্সের সীমিত সময়ে তিনি তার রায়ের পূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে পারেননি।

এখন বিবেচনা করা যাক মির্জা ফখরুলের ব্যাখ্যা কি হতে পারে? তাহলে আমাদের পড়তে হবে ইনডিয়া ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পাদিত তিনটি দলিল এবং ৫ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে ইনডিয়ান পররাষ্ট্র সচিবের দেয়া প্রেস কনফারেন্সের রিপোর্ট। এই তিনটি দলিল হচ্ছে, যথাμমে : এক. ইনডিয়া-বাংলাদেশ জয়েন্ট কমিউনিকে (নতুন দিল্লি, ১২ জানুয়ারি ২০১০)। দুই. ফ্রেমওয়ার্ক এগৃমেন্ট অন কোঅপারেশন ফর ডেভেলপমেন্ট বিটউইন ইনডিয়া অ্যান্ড বাংলাদেশ (ঢাকা, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১১)। তিন. ঢাকা-দিল্লি সিক্সটি-ফাইভ পয়েন্ট স্টেটমেন্ট (ঢাকা, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১১)। ইংরেজি ট্রটি ও এগৃমেন্ট, দুটি শব্দেরই একই বাংলা শব্দ হতে পারে, চুক্তি।

কিন্তু ইংরেজিতে ট্রটি ও এগৃমেন্ট শব্দ দুটির কূটনৈতিক ওজন এবং আইনগত তাৎপর্য ভিনড়ব। যেহেতু কূটনৈতিক ভাষার কিছু শব্দের যথার্থ বাংলা নেই সেহেতু সাম্প্রতিক কালে বহু ৬ শব্দের ফাদে পড়ে যাওয়া সাধারণ মানুষের উচিত হবে ইংরেজি শব্দের আলোকেই ট্রানজিট দেয়া হয়েছে কি না তা বিবেচনা করা। ১২ জানুয়ারি ২০১০-এ যা ঘটেছিল ক্ষমতাসীন হওয়ার বছরখানেক পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লিতে গিয়েছিলেন ইনডিয়ান প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের আমন্ত্রণে ১০ থেকে ১৩ জানুয়ারি ২০১০-এ একটি রাষ্ট্রীয় সফরে। শেখ হাসিনার সেই সফরের পর পঞ্চাশটি অনুচ্ছেদ সংবলিত উপরে উল্লিখিত প্রম দলিলটি ইনডিয়া-বাংলাদেশ জয়েন্ট কমিউনি-কে প্রকাশিত হয়েছিল ১২ জানুয়ারি ২০১০-এ। সেখানে ছিল ট্রানজিট সংশ্লিষ্ট আটটি অনুচ্ছেদ : অনুচ্ছেদ নং ২২. বৈঠকে বাংলাদেশের আশুগঞ্জ ও ইনডিয়ার শিলঘাটকে পোর্ট অফ কল ঘোষণার ব্যাপারে উভয় প্রধানমন্ত্রী একমত হন।

নোট বিনিময়ের মাধ্যমে এ সম্পর্কিত আইডাব্লিউটিটি প্রটোকল সংশোধন করা হবে। উভয়ে একমত হন যে, আশুগঞ্জ থেকে এককালীন বা দীর্ঘ মেয়াদি ওডিসির (ওভারসাইজ ডাইমেনশনাল কার্গো) পরিবহন ব্যবস্থা চালুর জন্য অবকাঠামোগত উনড়বয়ন এবং এ ব্যাপারে সম্ভাব্য ব্যয় নিরুপণের জন্য একটি যৌথ টিম কাজ করবে। এ জন্য ইনডিয়া প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করবে। উভয় দেশের ঠিকাদাররা কাজ পেতে প্রতিযোগিতা করতে পারবে। ২৩. চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার করে ইনডিয়ান পণ্য সড়ক ও রেলপথে আনা- নেয়ার জন্য বাংলাদেশ ইনডিয়াকে অনুমতি দেয়ার ব্যাপারে ঐকমত্য হয়েছে।

নেপাল ও ভুটানকেও ওই দুই বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দেয়ার ইচ্ছার কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ। ২৪. প্রস্তাবিত আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগ স্থাপনের ব্যয় ইনডিয়ান অনুমোদন করা হবে মর্মে উভয় প্রধানমন্ত্রী একমত হয়েছেন। এ ব্যাপারে উভয় দেশের রেল কর্তৃপক্ষের একটি টিম দুই দেশের সংযোগ রাস্তা চিহ্নিত করবে। ২৫. ঢাকা ও কলকাতার মধ্যে মৈত্রী এক্সপ্রেস চালু করার বিষয়টিকে উভয় প্রধানমন্ত্রী স্বাগত জানিয়েছেন। এর পাশাপাশি তারা দুই দেশের মধ্যে বন্ধ থাকা অন্যান্য সড়ক ও রেল যোগাযোগ আবার শুরু করার জন্য বলেছেন।

৩২. বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি উৎসাহিত করতে উভয় দেশ শুল্ক ও অশুল্কগত বাধা তুলে নেয়া, বন্দর সমস্যা দূর করা এবং রেল ও নৌপথে কনটেইনার কার্গো চলাচল ব্যবস্থার ব্যাপারে একমত হন। সার্কের স্বল্পোনড়বত দেশগুলোকে ইনডিয়ার বাজারে শুল্কমুক্ত পণ্য প্রবেশ সুবিধা প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণকে স্বাগত জানান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। ইনডিয়ায় নিষেধাজ্ঞা তালিকায় থাকা বাংলাদেশি পণ্যের সংখ্যা কমানোর জন্যও তিনি ৭ ইনডিয়ার প্রতি অভিনন্দন জানিয়েছেন এবং এ সংখ্যা আরো কমানোর অনুরোধও জানিয়েছেন তিনি। ৩৫. উভয় নেতা প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত উনড়বয়নের মাধ্যমে সাবরুম-রামগড় ও দেমাগিরি-থেগামুখ স্থল বন্দরকে সμিয় করার ব্যাপারে সম্মত হয়েছেন। এছাড়া বিদ্যমান অন্য স্থল বন্দরগুলোকে আরো কার্যকর করার ব্যাপারেও তারা একমত হয়েছেন।

৩৮. ইনডিয়ার প্রধানমন্ত্রী রেলওয়ের অবকাঠামোর উনড়বয়ন, রেলের লোকোমোটিভ ও যাত্রীবাহী কোচ সরবরাহ, সৈয়দপুর ওয়ার্কশপের পুনর্বাসন, বিশেষ বাস ও ড্রেজিংসহ বিভিনড়ব প্রকল্পের জন্য ১০০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। ৩৯. ফ্লাইওভার নির্মাণসহ ঢাকার সড়ক অবকাঠামো উনড়বয়নে সহায়তার জন্য বাংলাদেশ ইনডিয়ার প্রতি অনুরোধ জানায়। ইনডিয়া এ অনুরোধ বিবেচনার ব্যাপারে সম্মত হয়েছে। এই আটটি অনুচ্ছেদেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ১০ জানুয়ারি ২০১০-এ শেখ হাসিনা দিল্লিতে যে দলিলে সই করেছেন তাতে জল ও স্থলপথে ইনডিয়াকে করিডোর সুবিধা দেয়া হয়ে গিয়েছে। ইনডিয়া যে ১০০ কোটি ডলার বাংলাদেশকে ঋণ দেবে তার একটি অংশ এই করিডোর সুবিধাকে বাস্তবায়িত হওয়ার জন্য খরচ হবে।

অর্থাৎ, বাংলাদেশের খরচে ইনডিয়ার করিডোর হবে। এখানে জেনে নেয়া উচিত, বহুল আলোচিত দুটি ইংরেজি শব্দের মানে। করিডোর মানে নিজের দেশের মধ্যে চলাচলের সুবিধার্থে দ্বিতীয় আরেকটি দেশের মধ্য দিয়ে যাওয়ার পথ। ইনডিয়া এটাই চেয়েছে এবং পেয়েছে। এই করিডোর সুবিধা দেয়ার কোনো আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধ্যকতা বাংলাদেশের নেই।

ট্রানজিট মানে একটি দেশ থেকে দ্বিতীয় একটি দেশ হয়ে তৃতীয় আরেকটি দেশে যাওয়া। ভূবেষ্টিত বা ল্যান্ডলকড (খধহফষড়পশবফ) দেশগুলোকে (যেমন, নেপাল ও ভুটান) ট্রানজিট দেয়ার আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধ্যকতা আছে। নেপালকে ইনডিয়ার মধ্য দিয়ে ট্রানজিটের সুবিধা দিতে বাধ্য ইনডিয়ান সরকার। কিন্তু যেহেতু পশ্চিমবঙ্গ থেকে শিলিগুড়ি হয়ে ইনডিয়ার পূর্বাঞ্চলে চলাচল সম্ভব সেহেতু ইনডিয়াকে ট্রানজিট সুবিধা দিতে বাংলাদেশ বাধ্য নয়। লক্ষ্য করুন, বাংলাদেশের এই বাধ্যবাধকতা নেই বলেই হাসিনা-মনমোহন তাদের সম্পাদিত ১০ জানুয়ারি ২০১০-এর দলিলের এ আটটি অনুচ্ছেদে কোথাও ট্রানজিট শব্দটি ব্যবহার করেননি।

আর করিডোর শব্দটি ইনডিয়া কোনোদিনই ব্যবহার করবে না। কারণ তারা জানে, করিডোর দিতে বাংলাদেশ বাধ্য নয়। এবার লক্ষ্য করুন, এ আটটি অনুচ্ছেদে শব্দের মারপ্যাচ। যেমন, পরিবহন ব্যবস্থা চালুর জন্য অবকাঠামোগত উনড়বয়ন, ইনডিয়ান পণ্য সড়ক ও রেলপথে আনা-নেয়ার জন্য বাংলাদেশের অনুমতি, বন্দর সমস্যা দূর করা, অবকাঠানো উনড়বয়ন, ইত্যাদি। ৮ এসব শব্দের আড়ালে শেখ হাসিনা ১২ জানুয়ারি ২০১০-এ ইনডিয়াকে দিয়ে এসেছিলেন ট্রানজিট সুবিধা।

বাংলাদেশে ইতিহাসে এই তারিখটি কলংকিত হয়ে থাকবে শেখ হাসিনা কর্তৃক তার ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও দলীয় ঋণ পরিশোধের এবং ইনডিয়া কর্তৃক বাংলাদেশের ওপর ভূরাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সূচক দিন রূপে। এ জন্যই বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়া ও তার দলের বার বার দাবি সত্ত্বেও এই পঞ্চাশ অনুচ্ছেদের দলিল বা কমিউনিকে নিয়ে সংসদে সরকারি দল কোনো আলোচনা করেনি। জনগণের কাছেও এই কমিউনিকে পেশ করেনি। এই কলংকিত কমিউনিকের পরে বাংলাদেশ ও ইনডিয়া সরকার এগিয়ে যায় এটিকে বাস্তবায়িত করণে। ঢাকায় আসা-যাওয়া করতে থাকেন ইনডিয়ার মন্ত্রী, সচিব ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা।

দিল্লিতে আসা-যাওয়া করেন ঢাকার সরকারি কয়েক উপদেষ্টা ও কর্মকর্তা। ৫ সেপ্টেম্বর ২০১১-তে দিল্লিতে ইনডিয়ান পররাষ্ট্র সচিব কি বলেছিলেন? এই পরিপ্রেক্ষিতে এবার লক্ষ্য করুন বাংলাদেশ সফরের প্রাক্কালে ৫ সেপ্টেম্বর ২০১১-তে ইনডিয়ান পররাষ্ট্র সচিব রঞ্জন মাথাই যে প্রেস কনফারেন্স দিয়েছিলেন তার কিছু অংশ : এক. বারো বছর পরে ইনডিয়ার প্রধানমন্ত্রী দ্বিপক্ষীয় সফরে যাচ্ছেন। এর লক্ষ্য হলো, জানুয়ারি ২০১০-এ শেখ হাসিনা ইনডিয়াতে ঐতিহাসিক সফরে এসে আমাদের মধ্যে সম্পর্কের যে নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন তাকে সুসংহত করার সকল পদক্ষেপ নেয়া। আমরা চেষ্টা করছি কয়েকটি বিষয়ে সহযোগিতা চালু করতে। এসব বিষয়ের অন্যতম হচ্ছে, বাণিজ্য ও পুজি বিনিয়োগ, কাঠামো, বিদ্যুৎ ও পানি সম্পদ, বর্ডার ম্যানেজমেন্ট, শিক্ষা, সাংস্কৃতিক যোগাযোগ উনড়বততর বর্ডার এবং যানবাহন কাঠামো বা যেটাকে বলা হয় কানেকটিভিটি (... ঃৎধহংঢ়ড়ৎঃ ংঃৎঁপঃঁৎব বা যিধঃ রং পধষষবফ পড়হহবপঃরারঃু.)।

লক্ষ্য করুন, এখানে করিডোর বা ট্রানজিট শব্দটি নয়, কানেকটিভিটি শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। দুই. বাণিজ্য ও কানেকটিভিটি বিষয়ে ইনডিয়ান পররাষ্ট্র সচিব আরো বলেন : ক. আশুগঞ্জ ও ইনডিয়ার শিলঘাট-কে পোর্ট অফ কল রূপে ঘোষণা করা হয়েছে। কাস্টমস বা শুল্ক কাজ হবে শিলঘাটে। খ. আশুগঞ্জ রুটে ওভার সাইজ ডাইমেনশনাল কার্গো (সংক্ষেপে ওডিসি) বা অতিকায় যানবাহন চলা শুরু করেছে। এটা হচ্ছে ত্রিপুরার পালাটানা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য।

গ. আখাউড়া-আগরতলা রেল যোগযোগ এবং সাবরুম-রামগড় স্থল শুল্ক স্টেশনের কাজ চূড়ান্তকরণের প্রμিয়া চলছে। ৯ ঘ. ইনডিয়া ও বাংলাদেশ স্থল শুল্ক স্টেশনগুলোর মধ্য দিয়ে চলাচলের সুবিধার্থে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (সংক্ষেপে এসওপি) বা স্ট্যান্ডার্ড কর্মপদ্ধতি আমরা স্থির করেছি। ঙ. সকল ট্রানজিট ইসুতে, যেমন, আখাউড়া-আগরতলা রেল যোগাযোগ বিষয়ে আমরা কাজ করছি। রোহানপুর-সিঙ্গাবাদ বিষয়ে আমার সহকর্মী জয়েন্ট সেμেটারি বলবেন। চ. জয়েন্ট সেμেটারি বলেন, আখাউড়া-আগরতলা এবং রোহানপুর-সিঙ্গাবাদ, উভয় ক্ষেত্রেই ট্রায়াল বেসিসে কাজ চলছে।

বস্তুত হালকা কার্গো চলাচল ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। ... ছ. পররাষ্ট্র সচিব আরো বলেন, আমরা এই ট্রান্সপোর্ট কানেকটিভিটিসহ সমগ্র বিষয়টিকে এমনভাবে দেখছি তাতে যেন বাণিজ্যিক সুবুদ্ধি থাকে। ... ইনডিয়ান পররাষ্ট্র সচিবের এই প্রেস কনফারেন্সে স্পষ্ট হয়ে যায়, তিস্তার পানি অথবা বাংলাদেশ কর্তৃক অন্য যে কোনো সুবিধা পাওয়ার আগেই কানেকটিভিটির নামে ইনডিয়াকে করিডোর/ট্রানজিট দেয়া হয়ে গিয়েছে এবং সেটা বাস্তবায়নে বাংলাদেশের বিভিনড়ব স্থানে কাজ চলছে। ওই প্রেস কনফারেন্সেই ইনডিয়ান পররাষ্ট্র সচিব মাথাই জানিয়েছিলেন, তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। এর বেশি আমি কিছু বলতে চাই না।

বাংলাদেশ ও ইনডিয়ার মধ্যে যে চুক্তিই হোক না কেন, তাতে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যসরকারের সঙ্গে আলোচনা করেছি এবং সেই আলোচনা চালিয়ে যাবো। পররাষ্ট্র সচিব মাথাই-এর এই উক্তির তাৎপর্য ছিল যে তিস্তার পানি বণ্টন বিষয়ে কোনো চুক্তি ছাড়াই ইনডিয়া করিডোর/ট্রানজিট বা মি. মাথাইয়ের ভাষায় কানেকটিভিটির সুবিধা পেয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ, ইনডিয়ান দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে এ সিদ্ধান্তে আসতেই হয় যে, শুরু হওয়ার আগেই মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফর শতকরা একশ ভাগেরও বেশি সফল হয়ে গিয়েছিল। ৭ সেপ্টেম্বর ২০১১-র যৌথ ইশতেহারে কি বলা হয়েছে? ১২ জানুয়ারি ২০১০-এ দিল্লিতে মনমোহন-হাসিনা চুক্তি এবং ৫ সেপ্টেম্বর ২০১১-তে দিল্লিতে পররাষ্ট্র সচিব মাথাইয়ের প্রেস কনফারেন্সের পর বাকি ছিল দুই দেশের সরকারের মধ্যে কিছু আনুষ্ঠানিকতা সম্পনড়ব করা। ১০ সফরের আগেই মনমোহন সিং জানতেন তিস্তার পানি বণ্টন বিষয়ে বাংলাদেশের আশা পূরণ হবে না।

মনমোহন সিং তার পদে পূর্ণ শক্তিমান থাকলে অথবা পারফেক্ট জেন্টলম্যান রূপে তার প্রতিষ্ঠিত ভাবমূর্তি বজায় রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকলে তিনি হয়তো ঢাকা সফর বাতিল করতে পারতেন। তিনি তা করেননি। কারণ ইনডিয়াতে টেলিকমিউনিকেশন সেক্টরে বিশাল দুর্নীতি এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে আনড়বা হাজারে-র অনশন ধর্মঘট প্রভৃতিতে মনমোহন সিং কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছেন অথবা হয়তো তিনি ইমপারফেক্ট জেন্টলম্যান। ঢাকা সফরের শেষে মনমোহন সিং তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি না হওয়ার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। এটা ছিল নিছক সৌজন্যতা প্রকাশ।

কারণ ইনডিয়ার স্বার্থ রক্ষায় যা তার করণীয় ছিল, বাংলাদেশের কাছ থেকে যা আদায় করার ছিল তার সবই তিনি সফলভাবে করেন। ৭ সেপ্টেম্বর ২০১১-র যৌথ ইশতেহারের কয়েকটি অনুচ্ছেদ ৩৩. বাণিজ্য ও লোকজনের চলাচলের সুবিধার্থে উভয় পক্ষ নতুন নতুন বন্দর,এলসিএস, ইমিগ্রেশন পয়েন্ট প্রতিষ্ঠান বিষয়টি খতিয়ে দেখতে সম্মত হয়েছে। ৩৪. দুই প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন যে, উভয় পক্ষ ইতিমধ্যে বাংলাদেশের ল্যান্ড কাস্টমস মুভমেন্টে নেপাল ও ভুটান থেকে ট্রাকবাহিত পণ্যের চলাচলের জন্য স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) স্বাক্ষর করেছে। যাত্রী ও কার্গো চলাচলের বিধি-বিধানের জন্য মোটর ভেহিকল এগৃমেন্ট নিয়ে কাজ করতে সম্মত হয়েছে। ৩৫. ত্রিপুরার পালাটানা বিদ্যুৎ প্রকল্পের ওডিসি কার্গো যাতায়াতের অনুমতি দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।

৩৬. দুই প্রধানমন্ত্রী দ্বিপক্ষীয় অভ্যন্তরীণ নৌ ট্রানজিট ও বাণিজ্য প্রটোকলের আওতায় অতিরিক্ত ডাক বন্দর হিসেবে আশুগঞ্জ এবং শিলঘাটকে অন্তর্ভুক্ত করায় সন্তোষ প্রকাশ করেন। আশুগঞ্জ বন্দরে বহুমাত্রিক স্থাপনা ব্যবহার করে ত্রিপুরাগামী বাল্ক কার্গোর সফল পরীক্ষামূলক পরিচালনার জন্য তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেন। আশুগঞ্জে অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ কাজ ত্বরান্বিত এবং ব্যবহার উপযোগী হওয়া মাত্র বাল্ক কার্গোর জন্য ব্যবহারের বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে। ৩৭. উভয় পক্ষ প্রটৌকল রুটগুলোতে নৈশকালীন নৌযান চলাচল উপযোগীকরণের কাজ ত্বরান্বিত করতে উভয় পক্ষ একমত হয়েছে। তারা রেল ও নৌপথে কনটেইনার চলাচলের ব্যাপারে দুই পক্ষ একমত হয়েছে।

৩৮. দুই পক্ষের মধ্যকার আগেকার সমঝোতা অনুযায়ী ফেনী নদীর ওপর সেতু নির্মাণ কাজ ত্বরান্বিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে উভয় প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিচ্ছেন। ১১ ৩৯. আগরতলা ও আখাউড়ার মধ্যবর্তী সীমান্তে রেলওয়ে অবকাঠামো সংμান্ত সমঝোতা স্মারকের আলোকে কাজ করা এবং যতো দ্রুত সম্ভব রেললাইনের কাজ শেষ করার জন্য দুই প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন। ৪০. বাংলাদেশ ও ইনডিয়ান রেলওয়ের মধ্যকার সমঝোতা স্মারক সংশোধন করে রোহনপুর-সিঙ্গাবাদকে বাল্ক এবং কনটেননার, উভয় ধরনের কার্গোর অতিরিক্ত রুট হিসেবে নেপালি রেল ট্রানজিটের সুযোগ প্রদান করায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ইনডিয়ান প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। রেল রুটের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে নেপালে সার পরিবহনের সুযোগ দেয়ার জন্যও ইনডিয়ার প্রশংসা করে বাংলাদেশ। দুই দেশের মধ্যকার পুরনো লিংকেজ ও ট্রান্সপোর্ট রুটগুলো নতুন করে চালু উৎসাহিত করার লক্ষ্যে চিলাহাটিহলদি বাড়ি এবং কুলাউড়া-মহিশাসনের মধ্যকার রেল সংযোগ আবার প্রতিষ্ঠায়ও তারা একমত হন।

৪১. দুই প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে নৌ, রেল ও সড়কপথে ইনডিয়ান পণ্য আনা-নেয়ার সুযোগ সৃষ্টির প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা দ্রুত সম্পনড়ব করার নির্দেশ দেন। (৪১. ঞযব চৎরসব গরহংঃবৎং ফরৎবপঃবফ ঃযধঃ হবপপবংংধৎু ভড়ৎসধষরঃরবং ভড়ৎ ঃযব ঁংব ড়ভ ঈযরঃঃধমড়হম ধহফ গড়হমষধ ংবধঢ়ড়ৎঃং ভড়ৎ সড়াবসবহঃ ড়ভ মড়ড়ফং ঃড় ধহফ ভৎড়স ওহফরধ ঃযৎড়ঁময ধিঃবৎ, ৎধরষ ধহফ ৎড়ধফ ংযড়ঁষফ নব পড়সঢ়ষবঃবফ ঁৎমবহঃষু.) ৪২. উভয় প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন যে, এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যকার পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও কল্যাণমূলক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সড়ক, রেল ও নৌপথগুলো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। ভৌত অবকাঠামো নির্মাণের ফলে পণ্য বিনিময় ও যানবাহন চলাচল প্রসারিত হবে এবং সেটা সেবা, অথ্য, চিন্তা, সংস্কৃতি ও জনগণের মধ্যে কানেকটিভিটির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। (৪২. ইড়ঃয ঃযব চৎরসব গরহরংঃবৎং হড়ঃবফ ঃযধঃ ৎড়ধফ, ৎধরষ ধহফ ধিঃবৎধিুং বিৎব নঁরষফরহম নষড়পশং ঃড় ধহ রহঃবৎ-ফবঢ়বহফবহঃ ধহফ সঁঃঁধষষু নবহবভরপরধষ ৎবষধঃরড়হংযরঢ় ধসড়হম ঃযব পড়ঁহঃৎরবং ড়ভ ঃযব ৎবমরড়হ. ঞযব বংঃধনষরংযসবহঃ ড়ভ ঢ়যুংরপধষ রহভৎধংঃৎঁপঃঁৎব ড়িঁষফ ঢ়ৎড়সড়ঃব বীযধহমব ড়ভ মড়ড়ফং ধহফ ঃৎধভভরপ, ধহফ ষবধফ ঃড় ঃযব পড়হহবপঃরারঃু ড়ভ ংবৎারপবং, রহভড়ৎসধঃরড়হ, রফবধং, পঁষঃঁৎব ধহফ ঢ়বড়ঢ়ষব.) করিডোর বা ট্রানজিট নয়, কানেকটিভিটি লক্ষ্য করুন, ৫ সেপ্টেম্বর ২০১১ থেকে যে কালেকটিভিটির কথা বলা হয়েছে সেটা ৭ সেপ্টেম্বর ২০১১-এ ৬৫ দফা যৌথ ইশতেহারের ৪২ অনুচ্ছেদেও বলা হয়েছে। শুধু তাই নয়, এ অনুচ্ছেদের প্র ম লাইনটিও কৌতূহল উদ্দীপক।

এই লাইনে উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রী ১২ দুঃখ, বিরক্তি বা আফসোস যাই বলুন না কেন, প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যকার পারস্পরিক নির্ভরশীলতা এবং সম্পর্কের ক্ষেত্রে সড়ক, রেল ও নৌপথগুলো প্রতিবন্ধকতার (ইষড়পশং) সৃষ্টি করছে। তবে কি উভয় প্রধানমন্ত্রী চান এই ধরনের সব “প্রতিবন্ধকতা” সরিয়ে ফেলতে? অনেকেরই হয়তো মনে পড়বে, ৩০ জুলাই ২০১১-তে লন্ডনের দি ইকনমিস্ট ম্যাগাজিনে ইনডিয়া-বাংলাদেশের বর্তমান সম্পর্ক বিষয়ে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট যার শিরোনাম ছিল আলিঙ্গনে একাকার (ঊসনৎধপবধনষব ণড়ঁ)। মনুষ্যকুল তাদের চূড়ান্ত সুখের সময়ে পোশাক-আশাকের প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে ফেলে আলিঙ্গনে একাকার হয়। আর এখন আলিঙ্গনাবদ্ধ দুই দেশের মধ্যে সব প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে ফেলতে যাত্রা শুরু হয়েছে।

কিন্তু এই যাত্রার শেষে এ ধরনের আলিঙ্গন কি দৃষ্টিকটু ও অশালীন হবে না? বাংলাদেশের সাধারণ শালীন মানুষ কি সেটা সহ্য করবে? আলিঙ্গনের বাসরঘর হানিমুন ও সংসার এরপর ৬ সেপ্টেম্বর ২০১১-র ফ্রেমওয়ার্ক এগৃমেন্টের প্রম অনুচ্ছেদটি উল্লেখ করতে হবে : বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোরদার করতে হবে যা ভারসাম্যপূর্ণ, টেকটসই এবং উভয় দেশের জন্য সমৃদ্ধিকে নিশ্চিত করবে। উভয় পক্ষ বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস, ট্যারিফ ও নন-ট্যারিফ বাধা দূরীকরণ এবং সড়ক, রেল, নৌপথ, বিমান ও জাহাজযোগে বাণিজ্য ত্বরান্বিত করবে। উভয় পক্ষ যথাযথ অবকাঠামো উনড়বয়ন, সমুদ্র বন্দরগুলোর ব্যবহার, বহুমুখী পরিবহন ব্যবস্থা এবং দ্বিপক্ষীয় ও উপ-আঞ্চলিক ভিত্তিতে ব্যবহারের জন্য পরিবহন ব্যবস্থার মানোনড়বয়নকে উৎসাহিত করবে। লক্ষ্য করুন, এখানেও সড়ক, রেল, নৌপথ, বিমান ও জাহাজযোগে বাণিজ্য ত্বরান্বিত করার জন্য অবকাঠামো উনড়বয়ন, সমুদ্র বন্দরের ব্যবহার, বহুমুখী পরিবহন ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। এরপর ৭ সেপ্টেম্বর ২০১১-র যৌথ ইশতেহারের ৪১ ও ৪২ অনুচ্ছেদ পড়লেই বোঝা যায় করিডোর বা ট্রানজিট কিংবা ইনডিয়ানদের ভাষায় কানেকটিভিটি দেয়া হয়ে গিয়েছে।

এখন শুধু প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা দ্রুত শেষ করতে হবে। তবে ধারণা করা যেতে পারে, এই আনুষ্ঠানিকতা ধাপে ধাপে শেষ হবে। প্রমে আশুগঞ্জে, তারপর মংলায় এবং সবশেষে চট্টগ্রামে। যৌথ ইশতেহারের ৩৩ থেকে ৪০ অনুচ্ছেদ পড়লে বোঝা যায় করিডোর বা ট্রানজিট পয়েন্ট রূপে ইতিমধ্যেই আশুগঞ্জ রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছে। ত্রিপুরায় পালাটানাতে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য আশুগঞ্জ দিয়ে ইনডিয়ান অতিকায় যানবাহন (ওভারসাইজ ডাইমেনশনাল কার্গো) চলাচল করছে।

শোনা যাচ্ছে, আসামে একটি বড় এয়ারপোর্ট নির্মাণের কাজে যন্ত্রপাতিও শিগগিরই আশুগঞ্জ পয়েন্ট দিয়ে নেয়া শুরু হবে। ১৩ আশুগঞ্জ পয়েন্ট ফুললি অপারেশনাল বা পূর্ণভাবে চালু হওয়ার পাশাপাশি ইনডিয়া চাইছে মংলা সমুদ্র বন্দরকে তাদের উপযোগী করে তুলতে। কলকাতা থেকে কাছে মংলা এবং এই বন্দর এলাকা খুলনা শহরের বাইরে। প্রাথমিক ভাবে খুলনাবাসীর দৃষ্টি এড়িয়ে মংলার আনুষ্ঠানিকতা সম্পনড়ব করা সম্ভব হবে। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দর সহজেই চট্টগ্রাম শহরবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করবে।

বৃটিশ আমলে সূর্য সেনের চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন এবং পাকিস্তানি আমলে জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার ক্ষেত্র চট্টগ্রাম ঐতিহাসিক ভাবে বিদ্রোহের নার্সারি। এখানে ইনডিয়ান উপস্থিতি হবে সবচেয়ে শেষে আশুগঞ্জ ও মংলাকে পুরোপুরি কব্জায় নেয়ার পরে। বলা যায়, আশুগঞ্জে হয়েছে আলিঙ্গনে একাকার হওয়ার বাসরঘর। তারপর হানিমুন হবে মংলায়। সংসার হবে চট্টগ্রামে।

পানি ও ট্রানজিট ইসু এক নয় ৭ সেপ্টেম্বর ২০১১-তে ধরা যাওয়া আওয়ামী মিডিয়া পরদিন ৮ সেপ্টেম্বর হতবুদ্ধি থাকার পর থেকে তারা বিরূপ পরিস্থিতি সামাল দেয়ার লক্ষ্যে দ্বিমুখী ক্যামপেইন শুরু করে। এক. তারা বলতে থাকে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি না হওয়াতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইনডিয়ার ট্রানজিট অভিপ্রায়কে রুখে দিয়েছেন। প্রম আলোর এক স্টাফ-কলামিস্ট মনমোহন সফর বিষয়ে তার দীর্ঘ লেখাটি শেষ করেছেন শাবাশ জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রশংসা বাক্য দিয়ে। দুই. তিস্তার কাক্সিক্ষত পানি পেলেই ট্রানজিট দেয়া হবে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতসহ আরো কেউ কেউ বলেন, তিন মাস বা তার কাছাকাছি সময়ের মধ্যে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সম্পাদিত হবে।

উপরোক্ত দুটি ক্যামপেইনের ফলে মানুষের মনে হয় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির ঢাকায় না আসা এবং তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তিতে গররাজি হও।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।