আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্বোপার্জিত সমাপ্তি...

কিছুটা আমার কিছুটা তোমার.. মেলেনা তো কিছু এখন আর! অনেক দিন পর মায়ের ঘরের বারান্দায় আসলেন,শিহাব সাহেব,বাড়ী আসা হয় প্রতি বছরই কিন্তু মায়ের ঘরটা তেমন ঘুরে দেখা হয় না অনেক বছর। বারান্দায় কিছু্ক্ষন দাড়িয়ে থেকে অনেকটা স্মৃতি কাঁতর হয়ে পড়লেন যেন,কত শত ছুটাছুটি ছিল একসময় এখানে,হঠাৎ দৃষ্টি আটকে গেল কোনার গোলাপ গাছটা দিকে,ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন,ছোট একটা গোলাপ ফুটে আছে গাছটায় মনে হয় মা এখনো গাছটায় পানি দেন,আর দেবেনই বা না কেন শত হলেও শিখার খুব শখ ছিল গোলাপ গাছটার প্রতি,সারা বাড়ি সাজিয়ে রাখতে চাইত গোলাপ গাছ দিয়ে,মা আর ভাইরা যত বিরক্তই হোক না কেন,তাকে দমাতে পারত না কেউ । আর কেউ যদি একবার তার গোলাপ গাছের গোলাপ ছিড়েছে তবেই সেরেছে,পুরো বাড়ি চিৎকার করে গরম করে ফেলত। সেসব কথা মনে করে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল শিহাব সাহেবের। বড্ড জেদি আর অভিমানি ছিল শিখা,এখনো আছে,কিন্তু মনটা খুব নরম ওর।

ভাবতে ভাবতে আনমনে হয়ে গেলেন যেন...কত দিন হয়ে গেল শিখার কন্ঠে ছোট'দা ডাক শুনেন না,কত দিন হবে?উ্মম...প্রায় সাত বছরের বেশি হবে,শেষ বার কানাডা থেকে যখন ওর ছেলে-মেয়েকে নিয়ে বাবার সাথে দেখা করতে এসেছিল,বিদায়ের সময় শিহাব সামনেই ছিল ভেবেছিল শিখা তার দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে বলবে,'আসি ছোট'দা,নিজের দিকে খেয়াল রাখিস,আর আমার জন্য দোয়া করিস''কিন্তু না,ওর দিকে যাবার বেলা একবারও তাকায়নি শিখা,শুধু শিহাবের কোলে থাকা বোবা ভাতিজার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গিয়েছিল,একবারও ''ছোট'দা'' বলে ডেকে যায়নি ওকে। বারান্দায় রাখা টু্লটাতে বসে পড়েন শিহাব। বোধহয় স্মৃতির প্রহর তাকে বসতে বাধ্য করেছে। মনে হচ্ছে এইতো সেদিনের কথা বড় ভাইয়া সিলেটা চলে যাবেন পড়তে সবার খুব মন খারাপ,বিদায়ের বেলা সবাই মুখ কালো করে ভাইয়াকে বিদায় দিলেন,কিন্তু শিখার কোন দেখা নেই,হঠাৎ কোথাথেকে ছুটে এসে ভাইয়ার গলা জড়িয়ে ধরে সেকি কান্না ,কান্নার বেগের জন্য কথাই বলতে পারছেনা। ওর কান্নার জন্যই শেষ পর্যন্ত সেদিন ভাইয়া যেতে পারেননি,শেষে বিকেলে যখন ও ঘুমিয়ে ছিল তখন রাতের ট্রেনে ভাইয়া সিলেট রওনা হন।

ফোনের যুগেও প্রতি সপ্তাহে সপ্তাহে ভাইয়াকে চিঠি লিখতো শিখা,ভাইয়া কত না করত কিন্তু কে শুনতো কার কথা। প্রতিদিন বাসায় কি হচ্ছে,্তাদের বিড়া্লটা কি করেছে,গোলাপ গাছে কয়টা গোলাপ ফুটেছে সব কিছু ফোনে ভাইয়াকে বলার পরেও আবার ইয়া লম্বা করে এসব নিয়ে চিঠি দিতে হত ভাইয়াকে। পাগলীও ছিল বটে শিখা...বলে আবার হাসলেন। বড় ভাইয়া চলে যাবার পর তার দায়িত্ব একটু না অনেকখানি বেড়েছিল,তার মধ্যে বেশি দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে শিখার। সারাক্ষন ছায়ার মতো লেগেই থাকতো শিহাবের সাথে,ওকে নিয়ে মায়ের যতটা না চিন্তা ছিল তার থেকে মনে হয় শিখারই বেশি চিন্তা ছিল,যতক্ষন বাইরে থাকতো কত বার যে ফোন করত হিসেব নেই।

তবে যেদিন থেকে শিহাবের জীবনে নীলা আসল শিখার পাগলামী কিছুটা কমতে লাগল যেন। তখন তার যত কথা সব নীলার সাথে। নীলাও খুব খুশি ছিল শিখাকে পেয়ে,দু'জনই একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কারনে আন্তরিকতা বেশি ছিল। ছাত্র জীবন থেকেই শিহাব বিভিন্ন সামাজিক সংঠনের সাথে কাজ করত,প্রতিবন্ধি মানুষ,পথ শিশু এদের নিয়ে কাজ করত,সেখানেই পরিচয় হয় নীলার সাথে। বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠার পর তাদের সাথে যোগ দেয় শিখা।

তিন জন এক সাথে কত দিন যে রোদে হেটে ফান্ড কালেকশন করেছে,গ্রামে গ্রামে যেয়ে বিনামুল্যে ওষধ দিয়েছে,সেমিনার করেছে হিসেব নেই। এসব কাজের পাশাপাশি শিখা ভাল লিখতে পারত। রাত জেগে জেগে এসব নিয়ে অনেক লেখা-লেখি করত শিখা,সে গুলো শুধুমাত্র দেশেই না,বিদেশি ম্যাগাজিনেও প্রকাশ পেত। অনেক স্বপ্ন দেখত এই সব পথ শিশু আর প্রতিবন্ধিদের নিয়ে তারা তিনজন। দেখতে দেখতে বড় ভাইয়া পাশ করে চাকরী নিলেন,বিয়ে করে ওদের সাথে ঢাকাতেই স্যাটেল হলেন।

শিহাবের ও পড়াশুনা প্রায় শেষের দিকে, সেই সাথে সে এখন কয়েকটা সংঠনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করছে,নীলা আর শিখাও পিছিয়ে নেই,শিখা তো দেশের বাইরে সোস্যাল ওয়ার্কের উপর পড়াশুনা করতে যাওয়ার চেষ্টা করছে। একমাস পর শিহাব আর নীলার বিয়ের তারিখ ঠিক হয়,বলতে গেলে সব কিছুই শিখা ব্যাবস্থা করছে,দুই পরিবারকে রাজী করানো,দিন তারিখ ঠিক করা সব কিছু,শিখাকে দেখেই বুঝা যায় সে প্রচন্ড খুশি। বিয়ের শপিং করতে একদিন বের হয় ওরা তিনজন। কেনাকাটা শেষ করে গাড়ীর জন্য অ্পেক্ষা করে ওরা,শিহাব ওদের দাড়াতে বলে রাস্তা পাড় হয়ে ওপাড়ে যেয়ে সিএনজি ঠিক করে ওদেরকে এপাড়ে আসতে বলে আর ঠিক তখনই ঘটে যায়,সব ভালোবাসার সমাপ্তি। বুকের ভেতরে আবারো চিনচিনে ব্যাথা উঠে শিহাব সাহেবের।

অনেক বছর পরেও তা অনুভব করেন তিনি... ডাক্তার বলে দিয়েছেন,নীলার দু'টি চোখ আর কখনোই ঠিক হবেনা,এ কথা শুনার পর থেকেই সবার মুখের ভাব কেমন জানি বদলে গেল। থেমে গেল বিয়ের আয়োজন। দু'বাড়ির কারোরই কোন কথা নেই। কিন্তু কথা বলে উঠল শিহাবের বাবা-মা। নীলাকে তারা তাদের ছেলের বউ হিসেবে গ্রহন করবেন না,যদি শিহাব তাদের অমতে যায়,তাহলে সে তার বাবা-মা কে হারাবে।

অন্যদিকে শিহাবের নীরবতা নীলাকেও আঘাত করে বুঝতে পারে যে শিহাবকে সে ভালোবেসেছিল দুটি চোখের সাথে তাকেও সে হারিয়েছে। নীলা এই অসহ্য যন্ত্রনা এড়াতে শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যায় কাউকে কিছু না বলেই। কিছুই করতে পারেননি শিহাব,হয়তো মেনে নিতে পারেন নি... দিন চলে যায়,সব কিছু আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হতে থাকে,শিহাবের বাবা-মা দ্রুত ভাবে শিহাবের জন্য পাত্রী খুঁজতে থাকেন,শিহাবও চাকরী নিয়ে ব্যাস্ত হতে থাকে,প্রায় একমাস পর শিখা একদিন খাবার টেবিলে ঘোষনা দিয়ে বসল,সামনের সপ্তাহে সে কানাডা যাচ্ছে,তার স্কলারশীপ হয়ে গেছে। বোমা ফুটলেও মনে হয় এতটা অবাক হতোনা কেউ,খাবার ফেলে সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে শিখার দিকে,কিন্তু সেদিকে লক্ষ্য নেই শিখার চুপচাপ নিজের খাওয়া শেষ করে উঠে চলে যায়। শিহাবের মনে পড়ে বিয়ে ভাঙ্গার পর থেকে নিয়ে এই পর্যন্ত শিখা তার সাথে একটি কথাও বলেনি!কেন বলেনি?!! খাওয়া শেষ করে শিখার ঘরে গেলেন শিহাব,যেয়ে দেখে বই-পত্র প্রায় সব কিছুই গুছানো হয়ে গেছে ,বোনের কাজে অবাক হলেন তিনি!এমন কেন করছে শিখা?!তার দিকে একবারও ফিরে তাকাচ্ছে না,মনে হয় ঘরে যে কেউ এসেছে তা সে দেখেই নি...অনেকক্ষন পর তার দিকে না তাকিয়েই একটা সাদা কাগজ বাড়িয়ে দিল,অবাক হয়ে হাতে নিলেন কাগজটা,শিখা বলল,'নিজের ঘরে যেয়ে পড়'।

তাড়াতাড়ি রুমে এসে খুললেন... ''প্রিয় ছোট'দা, ভালো থাকিস। আজ আর আমার কাছে তোকে দেবার মতো ভালোবাসা নেই,অনেক গর্ব ছিল আমার তোকে নিয়ে,মানুষকে ভালোবাসতে তুই আমাকে শিখিয়েছিলি। অসহায়ের পাশে দাড়াতে,অন্ধকে আলো দেখাতে,অক্ষমকে সক্ষম বানাতে তোর কাছ থেকে শিখেছিলাম। তোর কাছ থেকেই স্বপ্ন দেখেছিলাম এ সমাজ এই দেশ কে বদলে দেবার,শিখেছিলাম দেশকে ভালোবাসতে,সমাজের দরিদ্র আর অক্ষম মানুষ গুলোকে ভালোবাসতে,তাদের মুখে একটু হাসি ফুটাতে,তাদের সুখের মাঝে নিজের সুখ খুঁজে নিতে। মনের ভেতর তোকে নিয়ে অনেক শ্রদ্ধা ছিল আমার।

আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর জুটি ছিল শিহাব-নীলা জুটি। সত্যিকারের চলার পথের সাথী ছিলি তোরা,তোদের দেখে মনে হতো ভালোবাসা এমনই হয়,একে অন্যের জন্য কাঁদতে শিখায় হাসতে শিখায়। কিন্তু এক ধাক্কায় সব শেষ। সত্যি কি এত দুর্বল ছিল তোদের ভালোবাসার বন্ধন?এতই নড়েবড়ে ছিল তোদের বিশ্বাস?নাকি তোরা কখনোই কেউ কাউকে ভালোবাসিসইনি?আমি কিছুতেই হিসাব মেলাতে পারিনা! এই তুই কি সেই তুই?যে কিনা নিজের পকেটের টাকা খরচ করে অন্ধদের জন্য সাদা ছড়ি কিনে দিয়েছিলি?তুই কি আমার সেই ছোট'দা যে কিনা নিজের ঈদের টাকা দিয়ে মানুষকে হুইল চেয়ার কিনে দিয়েছিল?আমার সব এখন রুপ কথার গল্প মনে হয়রে...বিশ্বাস করতে পারিনা আমি। নীলা যেদিন চলে যায়,আমি অনেক্ষন ওর চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম,কি যে মায়া আর ভালোবাসা ছিল সেই চোখে তা এখন আর তুই বুঝবিনা।

অনেক ভালোবাসত নীলা তোকে। কিন্তু তুই স্বার্থপরের মতো কোন মুল্যই দেসনি। আসলে তোদের মত ভন্ড সমাজ সেবকরা এই দেশে আছে বলেই এদেশের কোন উন্নতি হয় না। আমি আমার ছোট'দা কে হারিয়ে ফেলেছি,একেবারেই। আমার দুই ভাই আছে ঠিকই কিন্তু আমার ছোট'দা আর নেই।

আমার পরিবার আছে ঠিকই তবে শুধু পরিচয় দেবার জন্যে। আর সে জন্যই আমার এভাবে চলে যাওয়া। মনে হয় না আর কোনদিন তোদের সেই শিখা হয়ে আর ফেরা হবে। ভাল থাকিস তোরা,মান-সম্মান নিয়ে,বাস্তবতা নিয়ে তোদের এই সমাজে এই পরিবারে। ''শিখা '' বুকের ভেতরের ব্যথাটা মনে হয় বাড়তে থাকে শিহাব সাহেবের।

শিখা ঠিকই বলেছিল,আর ফেরেনি সে। শিখা বিয়ে করেছিল এক প্রতিবন্ধি ছেলেকে। প্রতিবন্ধি হলেও অ্নেক মেধাবী একটা ছেলে। স্বামী-সন্তান নিয়ে অনেক সুখেই আছে শিখা। আর নীলা...নাহ,পিছিয়ে নেই সেও।

শুধু পিছিয়ে আছেন শিহাব নিজে। সারা জীবনের জন্য। আযানের শব্দের ধ্যান ভাঙ্গে শিহাব সাহেবের,চোখ মুছে উঠে দাড়ালেন। আযাবার আগে আর একবার ফিরে তাকিয়ে দেখলেন শিখার গোলাপ গাছটাকে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।