আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

১৩ই সেপ্টেম্বর.....

Dream Today,Create Tomorrow........ হসপিটাল কিংবা হাসপাতাল যে যেই নামেই ডাকুন না কেন.. ..এই স্থানটিকে সবসময় এড়িয়ে চলার চেষ্টা থাকতো আমার। এই কান্না-হাসির দালানটার কাছ থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকার চেষ্টা করতাম। নিয়তি বলে একটা কথা আছে। যা নাকি কখনই খন্ডানো যায় না। খালার বাসায় বেড়াতে যাওয়া,খালুর বাসার বাহিরে থাকা এবং খালার হঠাৎ অসুস্থ হয়ে যাওয়াটা মনে হয় তাঁরই একটা অংশ।

কথায় আছে না-"যেখানে বাঘের ভয়,সেখানেই রাত হয়"..... বিনা নোটিশে প্রচন্ড অসুস্থ খালাকে নিয়ে ছুটলাম হসপিটালে। সু্স্থ খালা সন্ধ্যার একটু পরই এমনই অসুস্থ হলেন তাঁকে হসপিটালে ভর্তি করানো ছাড়া আর কোন উপায়ই থাকলো না। উনার অবস্থা খুব একটা ভালো ছিলো না। দৌড়াদৌড়ি করে ভর্তি করালাম। কেবিন মিললো পঞ্চম তলায়।

রুম নাম্বার ৫১৪। উনাকে নিয়ে এতটাই ব্যস্ত ছিলাম যে অপছন্দের স্থানটিকে নিয়ে ভাবনার কোন অবকাশও ছিলো না। তখন মাথায় একটাই চিন্তা....খালা তুমি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠো। যখন উনার অবস্থা আগের চেয়ে একটু ভালো দেখলাম তখন শত ক্লান্তি এবং অস্বস্তি ঝেরে শান্তি বোধ করছিলাম। সর্ম্পকগুলো বুঝি এমনই হয়..!!! প্রিয় মানুষগুলোকে হাসি-খুশী দেখার মতো সুন্দর দৃশ্য মনে হয় পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি হয় না........... ভর্তির প্রাথমিক কার্য্যাবলী ও প্রয়োজনীয় ঔষধগুলো সংগ্রহ করে কেবিনে ঢুকলাম।

খালা ঘুমাচ্ছে। স্যালাইন চলছে। খালার ঘুমন্ত মুখটি দেখে মনে হলো আগের চেয়েও ভালো বোধ করছে। মা,নানু আর খালাতো বোন তুলিন খালার পাশেই বসা। আস্তে আস্তে রাতও বেড়ে চলছে।

নানু আর মা কথা বলছে রাতে কে থাকবে তা নিয়ে। এমনিতেই হাসপাতাল চোখের বিষ তার উপর রাত্রিযাপন। গোদের উপর বিষ ফোঁড়া আর কি!! মা-মেয়ের যুক্তিতর্ক শেষে সিদ্ধান্ত হলো নানু রাতে থাকবে আর মা,তুলিন বাসায় চলে যাবে। আর কখন কি লাগে না লাগে তার তো ঠিক নেই তাই নানু,খালার পাহারাদার হিসেবে আমি। ভিতরে একরাশ বিরক্তি আর মুখে মধু নিয়ে মা'কে বললাম-ভেবো না তোমরা।

আমি আছি তো। তোমরা শুধু দোয়া করো। তুলিন আর মা'কে রিকশায় তুলে দিলাম। তারপর একরাশ বিষাদভরা মনটা নিয়ে আবার কেবিনে গেলাম। নানুর সাথে কিছুক্ষন কথাবার্তা বলে সময় কাটানোর চেষ্টা করলাম।

হসপিটালে রাতে ঘুমানো আমার হবে না..তাই সে চিন্তা বাদ দিয়ে কিভাবে রাতটা কাটানো যায় তাই ভাবছিলাম। ঘড়ির দিকে তাকালাম। সাড়ে বারোটা বাজছে। খালাকে নিয়ে এতটাই ছোটাছুটি করছিলাম ঘড়ি দেখার সময়ই পাইনি। নানুকে আশ্বস্ত করে বললাম চিন্তা না করে ঘুমিয়ে যেতে,আমি সারারাত জেগে আছি।

যদি কোন সমস্যা হয় আমি তো আছিই। নিজেই থাকে বারো মাসের মধ্যে আট মাসই অসুস্থ তার উপর আবার এই বয়সে রাত্রি জাগতে চায়। মা'গুলো বুঝি এমনই হয়। নানুকে ঘুমানোর ব্যবস্থা করে কেবিনের বাহিরে করিডোরে হাঁটতে বের হলাম। হাসপিটালটা অন্যান হসপিটালগুলোর তুলনায় বেশ পরিস্কার-ই আছে।

ভালো লাগলছিলো পরিছন্ন পরিবেশটা। করিডোরের সামনের দিকের শেষ প্রান্তে বারান্দা। নিচে মূল রাস্তার পরে বিশাল একটা লেক। আকাশ জুড়ে থালার মতো চাঁদ। জোছনার আলোয় টলমল করছে জোছনাসিক্ত জল।

দারুন একটা পরিবেশ কিন্তু যখনই মনে পড়লো হসপিটালে আজ একা একা সারাটা রাত থাকতে হবে সব কেমন জানি ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। ইশ!! কথা বলার মতো একটা সঙ্গী পেতাম? করিডোরে পায়চারী করছি আর কর্তব্যরত নার্সদের ছোটাছুটি দেখছি। কোন কোন কেবন থেকে মৃদু আর্তনাদ ভেসে আসছে। সব মিলিয়ে একটা অস্থির ভালো মন্দ সংমিশ্রিত সময় পার করার চেষ্টা করছি আর নিজকে সান্তনা দিচ্ছি-আরে মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যপার। দেখতে দেখতেই কেটে যাবে।

বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে রাতের স্তব্দতা উপভোগ করছিলাম। হঠাৎ করেই লক্ষ্য করলাম সব কিছু কেমন জানি আরও নিঝুম হয়ে গেছে। ভাবলাম হয়তো মেলা রাত হয়ে গেছে। হাত ঘড়িটায় তাকিয়ে রেডিয়ামের নিয়ন আলোতে দেখলাম ছোট্ট কাঁটা টা দুই আর বড়টা তিনের ঘরে। চিকনটা আমার মতই অস্থিরভাবে এ ঘর থেকে ওঘরে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে।

বেশকিছুক্ষন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে নীরবে মূল্যবান সময়ের প্রস্থান উপভোগ করলাম। অপেক্ষা জিনিসটাই বড্ড বাজে। আর একাকী,অপ্রিয় জায়গায় অপেক্ষা...সে অনুভূতির প্রকাশ নাইবা করলাম। এত রোগী কারো সাথে কি কোন রাতজাগা আত্নীয়-স্বজন নাই? একটা সঙ্গী হলে মন্দ হতো না!! এমাথা ওমাথায় হাঁটছি করিডোরের। মাঝে মাঝে রুমের দরজার ফাঁক দিয়ে দেখছি নানু,খালামনিকে।

স্যালাইনের টপ টপ ফোঁটার শব্দ। রাতের স্তব্দতা ভাঙ্গা শব্দটা অদ্ভুত। পায়চারী করছি আর নিচের টাইলসের সংখ্যা গুনছি। টাইলস গুনায় বিরক্ত ধরে যাওয়ায় করিডোরে দু'পাশের কেবিনগুলো গুনছি। ১,২,৩.....১৩ তারপর রেলিং,এরপর বারান্দা।

সামনে বিশাল লেক। এই ছেলেমানুষী কাজে নিজের অজান্তেই হেসে ফেলালাম। মানুষ একাকীত্ব কাটানোর জন্য কত অদ্ভুত কিছুই না করে!! বারান্দায় এসে আকাশের বিশাল চাঁদটাকে দেখতে লাগলাম। তার ভালোবাসার জোছনায় মিলেমিশে একাকার হচ্ছে লেকের জলে। মায়া ধরিয়ে দেয়।

জোছনা ভেজে টলমল জল। নাহ!! রাত জাগাটা একেবারে বৃথা নাহ। যদি রাতটা না জাগতাম এতো সুন্দর একটা দৃশ্য হয়তো এই নশ্বর জীবনে আর দেখা হতো না। হঠাৎ খট করে একটা শব্দ হলো। মনে হলো কেউ দরজা খুলছে।

জোছনা প্রেমের মোহ ভেঙ্গে উৎসুক চোখে পিছনে ফিরলাম। নাহ,কেউ নেই। মনে পড়লো আমার কেবিনের কথা। তাড়াতাড়ি কেবিনের সামনে গিয়ে দরজাটা অলতো ফাঁক করে দেখলাম। সব ঠিকই আছে।

দু'জনেই অঘোর ঘুমে। দরজাটা বন্ধ করতে করতে ভাবছিলাম শব্দটা কোথায় হলো? ভাবনার জগত থেকে মাথাটা তুলে সামনে বারন্দার দিকে তাকাতেই চমকে গেলাম। ঠিক দেখছি তো!! নাহ!! ঠিকই আছে। একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে জোছনাসিক্ত লেকের জল দেখছিলাম ঠিক সেখানেই।

মনটা অজানা এক ভালো লাগায় নেচে উঠলো। যাক বাবা!!এতোক্ষন পর হলেও তো একজনকে পেলাম। মেয়েটির উদ্দেশ্য করে হাঁটছি তখন নজর পড়লো ৫০৭ নাম্বার কেবিনের দরজাটা হালকা ফাঁকা,পর্দা ঝুলছে। এইবার বুঝলাম শব্দটা কোথা থেকে আসছে। শব্দ ভাবনা ঝেড়ে ভাবলাম মেয়েটার সাথে কিছুক্ষন গল্প করি।

আল্লাহ জানে কি টাইপের মেয়ে!! হঠাৎ প্রশ্ন জাগলো মেয়েটা কখন ঐখানে গেলো? আমি তো আমাদের দরজার সামনেই দাঁড়ানো ছিলাম? ভাবছি আর সামনে এগুচ্ছি। একটু দূরত্ব রেখে মেয়েটিকে দেখতে লাগলাম। হালকা রংএর একটা জামা পড়া, মাথার চুলগুলো কোঁকড়ানো কেমন যেনো। পিছনে করিডোরের ঐ মাথায় দেখলাম নার্সদের রুমের দরজা আধো খোলা। হয়তো গল্প করছে নয়তো ঝিমুচ্ছে।

মনে মনে সাহস সঞ্চার করলাম কিছু একটা দিয়ে আলাপ শুরু করবো ভেবে অমনি শুনতে পেলাম মেয়েটার কান্নার শব্দ। এলোমেলো চুলে মুখটা ঢাকা। মেয়েটা কাঁদছে তো কাঁদছেই। মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। আর একটু কাছে গিয়ে মুখটা দেখার বৃথা চেষ্টা করলাম।

চুলের জন্য কিছুই দেখা যাচ্ছে না। প্রচন্ড কৌতূহলে সব দ্বিধা ভেঙ্গে জিজ্ঞাস করলাম-কি হয়েছে আপনার? আপনি কাঁদছেন কেন? রোগী আপনার কি হয়? উনি কি খুব অসুস্থ? প্লীজ কাঁদবেন না,ইনশাল্লাহ ভালো হয়ে যাবে। কি রে বাবা!!! এতো কাথা বললাম তাও কান্না থামার কোন লক্ষন-ই দেখলাম না বরং আমি যে একটা জ্বলজ্যান্ত মানুষ তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে এতো কথা জিজ্ঞাসা করছি তারও কোন ভ্রুক্ষেপ নেই!! ছেলে হলে না গায়ে হাতে দিয়ে কিছু বলতে পারতাম। মেয়ে হওয়াতে তাও পারছি নাহ। আর একটু কাছে গিয়ে ভাবলাম মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলবো।

একটু এগুতেই কেমন যেনো পোড়া একটা গন্ধ নাকে এসে লাগলো। হসপিটালে যে কত গন্ধ পাওয়া যায়!! নানান চিন্তায় আর প্রবল কৌতূহলী অস্থিরতায় আরও কাছে যেতেই মেয়েটি আমার দিকে ফিরলো। আতংকিত হয়ে,ভীষন চমকে কয়েক হাত পিছনে চলে আসলাম। এ আমি কি দেখছি? এমন কুৎসিত কারও মুখ হয়!! সারা মুখমন্ডল পোড়া,ঝলসানো। চোখগুলো হিমশীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

ভয়ে কিংবা অজানা এক অনুভূতিতে স্তব্দ হয়ে গেলাম। কোন কিছু সামলে উঠার আগেই দেখলাম মেয়েটা রেলিং থেকে ঝাপিয়ে পড়লো নিচে। আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে পিছনে না তাকিয়ে সোজা দৌড় দিলাম নার্সদের রুমের দিকে। ঠিক মতো কথা বলতে পারছিলাম না। শুধু বললাম-৫০৭।

নার্সরা আমার এ অবস্থা দেখে বললো আপনি শান্ত হন। ৫০৭ এ কি আমরা দেখছি। একজন ছুটে গেলো ঐ রুমের দিকে। আমি হতবিহবল হয়ে বসে রইলাম। এক গ্লাস পানি খেতে চাইলাম।

উনি পানি দেওয়ার সাথে সাথে শত বছরের তৃষ্ণাত্বের মতো ঢক ঢক করে পান করলাম। ঐ নার্সটি ফিরে এসে বললো-কই ৫০৭-তে তো সব ঠিক আছে। সাবাই ঘুমাচ্ছে। নিজকে একটু ধাতস্ত করে যা দেখেছিলাম উনাদের সব বললাম। সব শুনে এক নার্স বললো- আপনিও দেখেছেন তাহলে? বেশ কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলাম ঘটনাটা কি? নার্সটা যা বললো তা ছিলো-"বছর তিনেক আগে এসিডে ঝলাসানো এক মেয়ে ভর্তি হয়েছিলো ৫০৭ নাম্বার রুমে।

ভর্তি হওয়ার পরের রাতে আনুমানিক এই মধ্যরাতের দিকে ওর সব আত্নীয় স্বজনরা যখন ঘুমে ছিলো ঐ রেলিং থেকে ঝাঁপিয়ে নিচে পড়ে আত্নহত্যা করে। ঘুমে থাকায় ওর লোকজন কিছু বলতে পারেনি। নিচের দারোয়ান রাস্তায় ওর লাশ আবিস্কার করে। পরে মেয়েটির আত্নীয়রা তাঁর লাশ সনাক্ত করে। মেয়েটি হসপিটালে ভর্তি হয়েছিলো ১২ই সেপ্টেম্বর।

" নার্সদের রুম থেকে বের হয়ে এলোমেলো পায়ে আবার রেলিং-এর দিকে হাঁটতে লাগলাম। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলাম ৩.১৫মিনিট আর এক কোনায় ১৩ই সেপ্টেম্বর। রেলিং-এর পাশে এসে নিচে তাকলাম। সব ফাঁকা। আকাশের পানে তাকালাম ঘোর লাগা চোখে।

নিজের মনে অনেক প্রশ্ন এসে ভিড় করছিলো। মারা যাবার আগে মেয়েটি সত্যিই কি এমন করে কেঁদেছিলো? কেনো কেঁদেছিলো? পৃথিবীর মায়ায় নাকি কিছু মানুষরূপী শয়তানদের অভিশাপ স্বরূপ? সেদিনও কি এমন করেই জোছনা হাসছিলো?? নাহ!! সত্যিই হসপিটাল একটা জঘন্য জায়গা........................................... ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।