আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ব্রেন ড্রেন

একটি বানানভুলসর্বস্ব ব্লগ শেষ পর্যন্ত মানিকের এই উপলব্ধি হয় যে তার পক্ষে এই পোড়া দেশে বাস করা আর সম্ভব নয়। পদ্মা তীরের বাসিন্দা মানিক সিদ্ধান্ত নেয় যে সে জার্মানীর রাইন নদীর পাড়ে তার স্থায়ী বসতি গাড়বে। মানিকের নতুন করে জন্মানো পুরনো এই উপলব্ধি আমাদেরকে তেমন একটা বিচলিত করে না। গত ছয় বছর থেকেই আমরা একই গীত শুনে আসছি, কিন্তু এখনো মানিকের রাইনের তীরে পাইনের নীচে বসে এক কাপ কড়া ধোঁয়া ওঠা কালো কফি খাওয়া হয়ে ওঠেনি। সত্যি কথা বলতে কি, মানিক যদি আসলেই জার্মানী পাড়ি দেয় তাহলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হব আমরা।

মানিকই আমাদের ছুটির আড্ডার মধ্যমণি। পৃথিবীর তাবৎ বিষয়ে মানিকের জ্ঞান রীতিমত ঈর্ষনীয়। সুতরাং আমাদের আড্ডাতে গল্প করার জন্য বিষয়ের অভাব হয় না। শুধু মানিক যখন কোন বিষয়ে তার মুখ খুলে তখন সাধারণত আমরা বিষয়টি খুব সূক্ষ্ণভাবে এড়িয়ে যাই। আমরা যখন আমাদের দুনিয়াবি বিষয় নিয়ে মশগুল থাকি মানিক তখন হারিয়ে যায় নিৎসে,কান্ট আর হেগেলের দুনিয়ায়।

পদ্মা পাড়ের এক কোণার মামার চায়ের দোকান তখন তার জন্য হয়ে ওঠে সাহিত্যিকদের আড্ডার জন্য বিখ্যাত প্যারিসের শেক্সপিয়ার এন্ড কোম্পানী লাইব্রেরী। তবে একটা কথা মানতেই হবে যে গল্প বলাতে মানিকের কোন জুড়ি নেই। যে কোন ইতিহাস, গল্প, রূপকথা, লোক কাহিনী বলার মানিকের একটি বিশেষ গুণ আছে। ‘জানি না’- কথাটি মানিক আসলেই জানে না। সে জানুক বা না জানুক, পাঁচমিশালী গল্প তৈরীতে মানিক তার মিতা মানিক বন্দোপধ্যায়কেও হার মানাবে।

মুখে মুখে গল্প বানানোর ক্ষমতা হোমারেরও ছিল, কিন্তু তাতে বাস্তবতার ফিনিশিং টাচের অভাব ছিল প্রবল। আমাদের মানিক এসব ভুলত্রুটির উর্ধ্বে। তার গল্পগুলো বাস্তবমুখী, সেটা আলেকজান্ডারের বিশ্বজয়ই হোক আর ইবনে বতুতার বিশ্ব ভ্রমণই হোক। রোমের আগুনের গল্প মানিক এমনভাবে বলে যেন নিরো বাঁশি বাজানোর সময় মানিক তার পাশে বসে তা শুনতে শুনতে রাতের কালো রোম কমলা হতে দেখছিলো। কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার যেন কলম্বাসের জাহাজ সান্তা মারিয়া-এর মাস্তুল থেকে সে নিজের চোখে দেখেছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গল্প মানিকের কাছে দাদী-নানীর কাছ থেকে শোনা রাক্ষস-খোক্ষস আর ডাইনীর গল্পের মত। জার্মানীর “পিতৃভূমি”-তে চরণ না ফেললেও তার জর্মন জ্ঞান যে কোন জার্মানের চেয়েও গভীর। জার্মানীর কোন শহরের কোন চার রাস্তার মোড়ে কতগুলো সিগন্যাল লাইট আছে বা কোন খামারবাড়ির কোন মুরগীটার স্বাদ সবচেয়ে ভাল এসবই মানিকের নখদর্পনে। মার্ক্সপ্রেমিক মানিক তার এসব জ্ঞান বস্তুবাদীদের মত কুক্ষিগত করে রাখে না। জ্ঞানের সুষম প্রবাহকে বজায় রাখতে সে তার জার্মান জ্ঞানকে আমাদের মত প্রোলেতারিয়েতদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চায়।

কিন্তু আমরা প্রোলেতারিয়েতরা বিলিয়ে দেয়া এই আলোকে বিনা পয়সায় পাওয়া কৃমির ওষুধের মত উগরে ফেলে দেই। মানিকের অনেক দিনের স্বপ্ন শহর থেকে দূরে রাইন নদীর পাড়ে কোন এক খামারবাড়ির ফায়ারপ্লেসের পাশে বসে হিটলারের মত কড়া কফি খেতে খেতে জানালা দিয়ে তুষারপাত দেখা। আর তার পাশে বসে উল দিয়ে সোয়েটার বুনবে এলম্‌গাছের মত ছিপছিপে ছয় ফুট দুই ইঞ্চি লম্বা জার্মান অর্ধাঙ্গিনী। কেনই বা সে কোন শহরে থাকবে না আর কেনই বা তার জায়াকে ছয় ফুট দুই ইঞ্চি লম্বা ফ্রলাইন হতে হবে জিজ্ঞেস করলে মানিক রোমান্টিক হয়ে যায়। শহুরে জীবন তার পছন্দ নয়।

এতে না আছে আত্মার শান্তি, না শরীরের। শহরের যান্ত্রিক জীবন তার সাথে খাপ খাওয়াতে পারে না। মানিকও শহরের এই অক্ষমতা মার্জনা করতে রাজি নয়। সে বরং প্রতিদিন দু’বার করে তার সেকেন্ড হ্যান্ড ভোক্সওয়াগনে করে মাইলের পর মাইল পাড়ি দিতে রাজি আছে। ভোরবেলা মোরগের ডাকে ঘুম ভেঙ্গে, বাড়ি থেকে বের হয়ে তার পুরনো গাড়িতে চড়ে দু’পাশে পাইনের সারিকে বিদায় দিতে দিতে অফিস যাত্রা।

ঠিক একইভাবে বিকেল বেলা রাস্তায় পড়ে থাকা পাইনের মরা পাতা মাড়িয়ে গৃহে প্রবেশ। কোন কোন দিন একগুচ্ছ লিলি, কোনদিন রাইনের অপর প্রান্ত থেকে আমদানিকৃত সুইস্‌ওয়াইন নিয়ে ফ্রলাইনের কানে কানে খটমটে জার্মানে “ইখ লিবে ডিখ” বলে তাকে চমকে দেয়া, কাপড় ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে পোর্চে বসে ফ্রলাইনকে সারাদিনের খতিয়ান দেয়া, সন্ধ্যায় একসাথে ‘ডিনার’ তৈরী করা (যদিও মানিক এক নুডুলস্‌ছাড়া আর কিছুই বানাতে পারে না), রাতে ফায়ারপ্লেসের পাশে বসে ‘ডিনার’ সারা, তারপর তার খামারের মুরগীর পালক দিয়ে বানানো বালিশে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে যাওয়া। এর চেয়ে রোমান্টিক জীবন আর কি হতে পারে! জার্মান জায়ার কারণ জিজ্ঞেস করলে মানিক বলে জার্মান মেয়েরা রোমান্স জানে। তারা বাঙ্গালী মেয়েদের মত দেহ আর মন নিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলে না। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা- মন্ত্রে দীক্ষিত জার্মান রমণীরা ভালো করেই জানে দাম্পত্য জীবন কিভাবে সামাল দিতে হয়।

কিন্তু কেন তাকে মানিকের চেয়ে অর্ধ ফুট লম্বা হতে হবে তার কোন সদুত্তর মানিক আমাদের কখনো দেয়নি। মানিক যে এবার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তা বোঝানোর জন্য বারবার জার্মান এ্যাম্বাসীতে ধর্না দেয়া শুরু করলো। প্রতিদিন এ্যাম্বাসী থেকে ঘুরে এসে সেখানে শেখা নতুন নতুন জার্মান শব্দগুলো আমাদেরও শেখাতে লাগল। কয়েকদিনের মধ্যেই গুটেনটাখ, গুটেন মর্গেন, বিটে সাথে আরো ছোট ছোট কিছু জার্মান শব্দ আমাদের ডিকশনারীতেও যোগ হল। সেই সাথে সামনা-সামনি দেখা হয়ে গেলো জার্মান আদব-কায়দা।

ছোট বাচ্চারা নতুন কথা বলতে শিখলে বারবার জানা শব্দগুলো ব্যবহার করে। পানি হোক বা খাবার সব কিছুর নামই ‘মাম’। আর হাটতে শিখলে তো দড়ি দিয়েও বেঁধে রাখা সম্ভব না। তখন মাকে নতুন হাটতে শেখা বাচ্চার পিছে সারাদিন দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। মানিককে কখনোই আমরা ‘পাংচুয়াল’ বলে গালি দেইনি।

কখনো আশা করিনি কাজ না থাকলে সে বেলা তিনটার আগে ঘুম থেকে উঠবে। খোদ ‘জার্মান’ শব্দটাই বোধহয় ছোঁয়াচে, নাহলে ঝাঁকে ঝাঁকে জার্মান হিটলারের পাগলামিতে যোগ দিত না। মানিকের এরূপ আকস্মিক পরিবর্তনে আমরা একটু অবাক হই। আমাদের মনে একটু একটু করে মেঘ জমতে শুরু করে। তাহলে কি মানিক সত্যি সত্যিই দেশান্তরী হবে? আমাদের উৎকন্ঠা আর সবার মধ্যেও ছড়াতে শুরু করে।

মানিকের বস (বন্ধুদের সবার মধ্যে একমাত্র মানিকের বসই বিপরীত লিঙ্গের) মানিককে তার অফিসে ডেকে অনেকক্ষণ ধরে তার সাথে আলাপ করেন। এখানে একটু, ওখানে একটু জিজ্ঞেস করে যতটুকু জানতে পারি তা হল বস মানিকের এই সিদ্ধান্তের সাথে একমত হতে পারেননি। তিনি মানিককে বিদেশে থাকার অসুবিধা ও দেশের থাকার সুবিধা নিয়ে বিস্তর জ্ঞান বিতরণ করেন। কোম্পানীতে মানিকের বর্তমান ও ভবিষ্যত অবস্থান নিয়েও যথেষ্ট আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তারপরও মানিকের মন টলাতে না পেরে শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়ে বলেন, “তোমার জন্য আমার দরজা সবসময় খোলা থাকবে।

তুমি যদি কখনো দেশে ফিরে আসো তাহলে আবার এই কোম্পানীতেই জয়েন কোরো”। অফিসের সহকর্মীদের মধ্যেও এ নিয়ে হাহাকার পড়ে যায়। বিনয়ী ও পরোপকারী এই সহকর্মীকে অফিসের মহিলা সহকর্মীরা হাতছাড়া করতে নারাজ। শরৎচন্দ্রের দিদিরা যেমন তাদের বাউন্ডুলে ভাইদের সন্ন্যাস যাত্রা রহিত করতে নাকের জলে, চোখের জলে আঁচল ভাসিয়ে দিতেন, মানিকের আধুনিককালের দিদিরাও টিস্যুর পর টিস্যু সিক্ত করে সেয়ানে সেয়ানে লড়াই দিতে পিছপা হননি। একটু প্রবীণ যারা তারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “ব্রিটিশরা সেই একবার নিয়ে গেছিল আমাদের কোহিনূর।

শেষ পর্যন্ত জার্মানরাও ছাড় দিলো না”। পুরো অফিসে শোকের মাতম শুরু হয়ে যায়। অশ্রুর আড়ালে মানিকের অবর্তমানে কে তার অফিস দখল করবে এ নিয়েও চলতে থাকে হিসাব কষাকষি। মানিকের বিদেশ গমনের সিদ্ধান্তে যে মানুষটি একেবারের জন্যও বিচলিত হননি তিনি হলেন মানিকের মা। আন্টির মতে, “দিল্লী এখনো অনেক দূর”।

মানিক আদৌ স্বদেশ ত্যাগ করবে কিনা তা নির্ভর করছে তার সিদ্ধান্তের উপর। আগেই বলেছি যে মানিক অনেক দিন থেকেই যাবো যাবো বলছে। আন্টি এতদিন সম্মতি দেননি বলেই তার এখনো যাওয়া হয়ে ওঠেনি। কিন্তু এটাও সত্য যে মানিক এবার বদ্ধপরিকর। স্বপ্নের দেশে যাওয়ার জন্য সে যে কোন কিছু করতে রাজি আছে।

পারিবারিক বৈঠকে মানিক আনুষ্ঠানিকভাবে তার প্রস্তাব পেশ করলে আন্টি সঙ্গে সঙ্গেই তা নাকচ করে দেন। কিন্তু মানিক বরাবরই জেদী। লেবুর রস তিতা না হওয়া পর্যন্ত সেই লেবুর জীবন দফারফা না করা পর্যন্ত সে ছাড় দেয় না। দিন-রাত ঘ্যানর ঘ্যানর ও প্যানর প্যানরের পর আন্টি শেষ পর্যন্ত তা বক্তব্য শুনতে রাজি হন। জার্মান জায়ার অংশটুকু বাদ দিয়ে মানিক তার পরিকল্পনা তার মা কে জানায়।

আন্টিও উপলব্ধি করেন যে ছেলে বড় হয়েছে। ছোট ডাল অনেক দূর পর্যন্ত বাঁকানো যায়, কিন্তু বড়ো ডাল বেশী বাঁকাতে গেলে ভেঙ্গে যাবার সম্ভাবনাই বেশী। কিন্তু তাই বলে তো আর বাগানের গাছগুলোকে ইচ্ছামত বাড়তে দেয়া যায়না। ডালগুলো, পাতাগুলো একটু-আধটু ছাঁটাই করে বাগানের সৌন্দর্য্য ঠিক রাখতে হয়। সুতরাং, শুরু হয় দর কষাকষি।

জার্মানীতে মানিকের থিতু হবার পরিকল্পনা তিনি প্রথমেই খারিজ করে দেন। জার্মানী তো আর পাশের পাড়া না যে যখন ইচ্ছা হবে তিনি খোঁজ খবর নিবেন, বা মানিক মাঝে মাঝে এসে সবার সাথে সারাদিন কাটিয়ে যাবে। তিনি শর্ত দেন যে পড়াশোনা করেই হোক আর কয়েক বছর বিদেশে চাকুরি করে অভিজ্ঞতা নিয়েই হোক, তিন বছরের মধ্যে মানিককে দেশে ফিরতে হবে। আন্টির দ্বিতীয় শর্ত হল, যাবার আগে মানিককে বিয়ে করে যেতে হবে, এবং বৌকে সাথে বেঁধে নিয়ে যেতে হবে। ব্যাচেলর মানিক বিদেশে গিয়ে কি কি করতে পারে এ নিয়ে তিনি কোন প্রকার ঝুঁকি নিতে চান না।

তার ভয় হয়ত মানিক কোন এক বিদেশিনী ধরে নিয়ে আসবে যার সাথে তিনি ভাল করে কথাই বলতে পারবেন না, শ্বাশুড়ি সেবা তো অনেক দূরের ব্যাপার। তৃতীয় শর্ত, বছরে অন্তত একটা ঈদে মানিকের দেশে আসা আবশ্যক। বাড়ির বড়ো ছেলে আর বৌকে টানা তিন বছর না দেখে থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মিত্রবাহিনী জার্মানীর উপর কি কি শর্ত আরোপ করেছিল জানি না, কিন্তু সেগুলোর কোনটাই যে জার্মানীর পক্ষে ছিল না তা বেশ বোঝা যায়। যুদ্ধবিধ্বস্ত জার্মানী শর্তের চাপে নিজেদের গৌরব প্রায় হারিয়ে বসতে চলেছিল।

সেই সময় হিটলার এসে জার্মানীর গৌরবকে পুনর্জীবিত করে দেশকে আবার যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়। মায়ের শর্তগুলো শোনার পর মানিকের দশাও হয় সেরূপ। শর্তগুলোর কোনটাই তার স্বার্থসাপেক্ষ না হওয়ায় মানিক প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। হিটলারের মত সে “ভার্সেই চুক্তি” ভঙ্গ করে বসে। আন্টির কোন শর্তই পূরণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে মানিক গোলটেবিল বৈঠক থেকে উঠে আসে।

শুরু হয় মা-ছেলের ঠান্ডা যুদ্ধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে মিত্রবাহিনীর নিষেধাজ্ঞা স্বত্বেও হিটলার একটু একটু করে তার সৈন্যবাহিনী বাড়াতে থাকে। তার কর্মকান্ডে মিত্রবাহিনীর মৌনতাকে সম্মতি মনে করে সে তার গন্ডি বড় করতে থাকে। মানিকও তার মায়ের ঠান্ডা আচরণকে মৌনতা ধরে নিয়ে তার বিদেশ যাত্রার জন্য একটু একটূ করে প্রস্তুতি নেয়া শুরু করে। বাসায় সবাই রাজি কিনা জিজ্ঞেস করলে মানিক বলে সব ঠিক হয়ে গেছে, কোন দিকেই কোন সমস্যা নেই।

কয়েক মাসের মধ্যেই তার সব রকম আয়োজন শেষ হয়ে যায়। এবার যাবার পালা। এর মধ্যে আমরা মানিকের পকেট ফেঁড়ে নেই। খাওয়ার সময় মনে হয়েছিল যথেষ্ট হয়েছে, কিন্তু পরে বুঝেছি খুব অল্পের উপর দিয়ে হয়ে গেছে। যদি পুরো ব্যাপারটা জানতাম তাহলে হয়ত আরো ভাল করে খাওয়া যেত।

যাবার আগে নানাবিধ ব্যস্ততার কারণে মানিক কারো সাথে সেভাবে দেখা করতে পারে নি। আমরাও ওর পরিস্থিতি বুঝে আর বিড়ম্বনা বাড়াইনি। ফ্লাইট ছিল ভোরবেলা। তাই অনেক ইচ্ছা থাকা স্বত্বেও আমরা কেউই ওকে বিদায় জানানোর জন্য এয়ারপোর্ট যেতে পারিনি। যদি জানতাম যে জার্মানী যাওয়ার পর কারো সাথেই ওর আর কোনো যোগাযোগ হবে না তাহলে যত কষ্টই হোক বিদায় জানাতে যেতাম।

যেহেতু জানতাম না তাই তখন আক্ষেপ করিনি, করেছি পরে। প্রায় দেড় বছর পর এক পরিচিত নম্বর থেকে ফোন আসলে চমকে উঠি। মোবাইলের স্ক্রিনে মানিক লেখা। তাড়াতাড়ি ফোন ধরে বলি, “তুই কি জার্মানীতে জেলে ছিলি? ইমিগ্রেশনে ঢুকেই কি তোকে জাল পাসপোর্ট সন্দেহে জেলে দিছিলো না কি শালা? এতদিন যোগাযোগ করিস নি কেন?” “কালকে বিকালে বাসায় আয়। তোদের জন্য কয়েক প্যাকেট সিগারেট আনছি নিয়ে যা”।

আসন্ন কিছু প্রাপ্তির কথা শুনে বেশ ভাল লাগে। মানিক বরাবরই উদার ও বিনয়ী। সেই সাথে এক ধরণের অপরাধবোধও কাজ করতে থাকে। ভোরবেলা একটূ কষ্ট করে বিদায় জানাতে গেলেই হত। তাহলে প্রাপ্তিটা একটূ হালাল করে নেওয়া যেত।

অনুতাপ খুবই ক্ষণস্থায়ী অনুভূতি। তা না হলে জন্মপাপী মানব সম্প্রদায় কখনো আগামীতে অগ্রসর হতে পারতো না। বাকি বন্ধুদের ফোন করে পরের দিন মানিকের বাসায় যাওয়ার প্রোগ্রামটা ঠিক করে নিলাম। মানিকের বাসার দরজা খোলার পর আমরা ছয়জন একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকাই। আমরা কি ভুল বাসায় এসেছি? মানিকরা কি এর মধ্যে বাসা বদল করেছে? রাজু মানিকের বাসার ঠিকানা কনফার্ম হবার জন্য মোবাইল বের করে মানিককে ফোন দিলে ভেতর থেকে রিংটোন ভেসে আসে।

আমরা আরো অবাক হই। দরজায় দাঁড়ানো অপরিচিত রমণীকে জিজ্ঞেস করি, “এটা কি মানিকের বাসা?” ঠিক তখনই মানিক ভেতর থেকে বের হয়ে আসে, “শালা, আমার আসল নাম মানিক নাকি? মানিক বললে ও চিনবে?” “ও কে?” “তোদের ভাবী”। সবাই একসাথে জিজ্ঞেস করি, “কবে?” আমাদের কালো মানিক একটু লাল হয়ে বলে, “যাওয়ার আগে। সেরকম অনুষ্ঠান করিনি তো তাই তোদের বলা হয়নি। ঘরোয়া ভাবেই সব হয়েছে”।

ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলি, “দোস্ত, আমাদেরকে এই অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে মুক্তি দে”। “আর বলিস না। আম্মা যেতেই দিচ্ছিলো না। শেষ পর্যন্ত আম্মার কথা মানতেই হল। ওখানে যেয়ে যে তোদেরকে জানাবো সেই সময়টা পর্যন্ত পাইনি।

অফিস আর ঘর নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম। শহরে যে ট্র্যাফিক, যেতে আসতেই যে সময় লাগে। এসেই আগে তোদের ফোন দিছি”। “আবার যাবি কবে?” “আর যাবো না। আম্মা বলছিল দুই বছরের বেশী থাকা যাবে না।

ওখানে একটা কোম্পানীতে দেড় বছরের চুক্তিতে কাজ করছি। এখন এখানেই”। “এখানে এখন কি করবি?” “কেন? বলছিলাম মনে নাই? আগের কোম্পানীতে জয়েন করবো”। পুনশ্চ: ১৯৪৫ সালের ৭ মে জার্মানী নিঃশর্তভাবে মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     বুকমার্ক হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।