আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঝ্যাং ইয়াইমৌর চলচ্চিত্র ‘দা রোড হোম’ : স্বপ্ন রংয়ে আঁকা প্রেম

সাধারণ একজন ঝ্যাং ইয়াইমৌর ‘দা রোড হোম’ : স্বপ্ন রংয়ে আঁকা প্রেম তা রি ক আ ল আ জি জ উৎসর্গ: আমার এসএসসি’র বন্ধুদের। গেট টুগেদার-ইফতার পরবর্তী আড্ডায় সবার চোখে ফ্ল্যাশব্যাকের রঙ্গিন ছবি দেখেছি। আমরা সাধারণত ফ্ল্যাশব্যাকে সাদা-কালো দেখি। অনেক হালকা রং ব্যবহার করেন। দা রোড হোমে ঘটনাটা ঠিক উল্টো।

এখানে বর্তমান সাদা-কালো হলেও অতীতের প্রেম চারণটা রঙ্গিন। চলচ্চিত্রে বর্ণনাকারী ছেলে বাবা-মা’র অমর প্রেম তুলে ধরছে। রং প্রেমিক ও বিলাসী চলচ্চিত্রকার ঝ্যাং ইয়াইমৌ প্রয়াস পেয়েছেন একটি ছন্দ ধরে রেখে প্রেমকে রং দিয়ে মেশাতে। তিনি স্বার্থক। চমৎকার সব কম্পোজিশন হৃদয়ে গেঁথে আছে।

বারবার মুভিটা টেনে টেনে দেখি। স্বপ্ন রংয়ে আঁকা একটি নিটোল-সুন্দর প্রেমকাহিনী। পরিচালকের মুন্সিয়ানায় ছবিটি সুউচ্চে উঠেছে। চলচ্চিত্রটি বাউ শি’র ‘রিমেমব্রেন্স’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত। গ্রামের উঁচু-নীচু রাস্তা ধরে একটি গাড়ি যাওয়ার সাধারণ দৃশ্য দিয়েই চলচ্চিত্রের শুরু।

শহরে চাকরী করা গাড়ীর আরোহী ছেলের বর্ণনাতে পাওয়া যায় তার স্কুল শিক্ষক বাবার সদ্য মারা যাওয়ার কথা। গ্রামের মেয়র তাকে জানিয়েছে। ছেলে চিন্তিত তার মা’কে নিয়ে। একমাত্র সন্তান সে। বাবার মৃত্যু মা কিভাবে নিবে, সেটাই তার ভাবনা।

বাড়িতে পৌছে ছেলে মা’কে পায়না। মেয়রের সাথে দেখা হয়। মেয়র তাকে তার বাবার মৃত্যুর কারণ ও উ™ভুত পরিস্থিতির কথা তুলে ধরে। ঠান্ডর মধ্যেই বড় একটি স্কুল গড়তে ফান্ড তৈরির জন্যে পাশের এক এলাকায় গিয়েছিল তার বাবা। তুষার ঝড়ে অবস্থা নাজুক হলে গ্রামের লোকেরা প্রাদেশিক হাসপাতালে ভর্তি করলেও তাকে বাঁচানো যায়নি।

ছেলেটির মা তার স্বামীর মৃতদেহ গ্রাম্য প্রথা অনুযায়ী হাসপাতাল থেকে রাস্তা দিয়ে পায়ে হেটে বহন করে নিয়ে আসতে চাইছে। মেয়র গ্রামের যুবকদের কাজের জন্য বাইরে থাকার কথা বলে এই ঠান্ডায় মৃতদেহ ট্রাকে করে নিয়ে আসার কথা বলে। ছেলে মাকে বুঝালেও মা সিদ্ধান্তে অটল থাকে। সারা রাত তার মৃত স্বামীর কাফনের কাপড় নিজ হাতে তৈরি করতে থাকে। ছেলে ঘুমাতে যায় বাবার স্টাডি রুমে।

সেখানে বিবাহকালীন সময়ে ফ্রেমবন্দী বাবা-মা’র যুগল ছবিটা দেখতে পায়। হাতে নেয়। একবার পেছনে তাকায়। পাশের ঘরে কাজরত মার দিকে অর্থবহ চাউনি। মিউজিক বেজে উঠে।

টেনে নিয়ে যায় পেছনে। ক্যামেরা ছবিতে জুম ইন করতে থাকে। ছেলে বলতে থাকে বাবা-মা’র প্রেম কথা। ‘বাবা গ্রামে আসে শিক্ষক হিসেবে। বাবার বয়স ছিল ২০, মা’র ১৮।

গ্রামের সবাই এই প্রেমকাহীন ভালভাবে জানে। ’ ডিজলভ হয়ে ছবির রাস্তা হয়ে উঠে রঙ্গিন। তেরো মিনিট জুড়ে একটা সূচনার পর শুরু হয় খেলা। লং শটে একটা ঘোড়ার গাড়ীতে রঙ্গিন হয়ে উঠা পর্দায় আসতে দেখা যায় স্কুল শিক্ষককে। একটু পরে সামনে দিয়ে চলে যাওয়া ভেড়ার পাল সমন্বয়ে কম্পোজিশনটা সুদৃশ্য ও গ্রামীণ একটা আবহ পায়।

গ্রামবাসী অপেক্ষায় ছিল নতুন শিক্ষককে দেখতে, বরণ করতে। এর মাঝেই উৎসুক চেয়ে থাকা অভিনেত্রী ঝ্যাং জিয়িকে ক্লোজ আপে দেখা যায়। এ ছবির মুল কাহিনী যাকে ঘিরে আবর্তিত। প্রথম দর্শনে প্রেমের মতই শিক্ষককে দেখেই প্রেমে পরে কিশোরী কিশোরি ঝাও ডি। দৌড়ে সে বাড়ি ফিরে।

মিডশটে নেয়া দৌড়ের দৃশ্য সত্যিই মনরোম। বাড়িতে ঝাও ডির অন্ধ মা শিক্ষকের খোঁজ নেয়। ঝাও ডি নতুন পোষাক পরে। লাল কাপড় বুনে। গ্রামে থাকা দুটি কুপের নতুনটির বদলে পুরাতনটিতে সে পানি নিতে যায়।

শিক্ষককে সেখান থেকে দেখা যায়। খাবার বানায়, নতুন শিক্ষক এ খাবার খাবে এই তার আশা। কাহিনী এগিয়ে চলে। প্রতিদিন ঝাও ডি শিক্ষককে দেখতে পাথে বসে থাকে। ছাত্রদের নিয়ে পথে বেরুলে সে তাদের অনুসরণ করে।

শিক্ষকের সাথে তার দেখাও হয়। পানি নিতে যাওয়ার ছলে দেখতে চায় প্রেমিক পুরুষকে। সে বাড়িতে নিমন্ত্রণ জানায় শিক্ষককে। শিক্ষক পরদিন আসে। কিশোরি ঝাও ডি আগ্রহ নিয়ে খাবার বানায়।

শিক্ষক আসবার মুহুর্তে সে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে। বর্ণনাকারী ছেলের কণ্ঠে ভাসে, ‘আমার বাবা আমাকে বলেছেন, তিনি প্রথম মা’র বাড়িতে গেলেন। সে (ঝাও ডি) দরজায় পাশের ফ্রেমে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। তাকে পেইন্টিংয়ের মত দেখাচ্ছিল। এই দৃশ্য তিনি কখনোই ভুলতে পারেননি।

’ গ্রামে নতুন আসা শিক্ষকের মজে যাওয়ার সাথে সাথে দর্শকও মজে যায়। ঝাও ডির অন্ধ মাও বুঝতে পারে তার কিশোরি মেয়ের মনের অবস্থা। সে মেয়েকে শিক্ষককে ভুলে যেতে বলে। ঝাও ডির মন তবু বাঁধন মানেনা। এরই মাঝে একদিন শিক্ষক এসে শহরে যাওয়ার কথা বলে বিদায় চায়।

ঝাও ডি জিজ্ঞেস করে কবে আসবে? শিক্ষককে খাবার খেয়ে যেত অনুরোধ করে। শিক্ষক তাকে লাল একটি ক্লিপ দিয়ে বলে, এটা তোমার লাল জ্যাকেটের সাথে খুব মানাবে। শিক্ষকের জন্য প্রতিক্ষায় থাকে কিশোরি। মাথায় পরে শিক্ষকের দেয়া ক্লিপ। এমতাবস্থায় সে শুনে শিক্ষক চলে গেছে।

সে তাড়াতাড়ি খাবার নিয়ে দৌড় দেয়। দৌড়ে শিক্ষকের ঘোড়ার গাড়ি ধরতে চায়। পাহাড়ের এ পাশ থেকে ও পাশ অনেক দৌড়ায়। শেষে তাল সামলাতে না পেরে তার খাবারের পাত্র হাত থেকে পরে যায়। ঘরের সেরা পাত্রটি, যেটা দিয়ে সে শিক্ষককে খাবার দিত তা ভেঙ্গে যায়।

শিক্ষকের ঘোড়ার গাড়ি অনেক দুরে চলে গেছে। কিশোরি কাঁদে। হারানোর বেদনা তাকে গ্রাস করে। হারিয়ে ফেলে সে মাথার ক্লিপটিও। খুঁজতে থাকে, পায়না।

অবশেষে একদিন বাড়ির সামনেই খুঁজে পায় ক্লিপটি। শীত এসে যায়। অন্ধ মা একদিন খাবারের পাত্রটি ঠিক করায়। তার মেয়ের স্মৃতি ধরে রাখতেই সে এটা করে। ঝাও ডি’র অপেক্ষা শেষ হয় না।

একদিন সে শুনে শিক্ষক স্কুলে নামতা পড়াচ্ছে। দৌড়ে সে স্কুলে গিয়ে বুঝতে পারে ভুল শুনেছে। বিবর্ণ স্কুলটা সাজাতে ব্যস্ত হয় সে। সুন্দর সাজিয়ে স্কুলটার রং ফেরায়। সেদিন গ্রামের মেয়র তাকে স্কুলে দেখে ফেলে বুঝে ফেলে ঘটনা কি।

পুরো গ্রামে ঝাও ডি’র প্রেম কাহিনী জানাজানি হয়ে যায়। বর্ণনাকারীর বর্ণনায় ভেসে আসে, ‘এটা এমন এক সময়- যখন অ্যারেঞ্জড ম্যারেজই প্রথা ছিল। মা’ই প্রথম কিশোরি যে তার প্রেমের প্রকাশ ঘটিয়েছিল। ’ ২৭ তারিখ এসে যায়। এদিন শিক্ষকের ফেরার কথা।

প্রচন্ড ঠান্ডা উপেক্ষা করে ঝাও ডি পথে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু শিক্ষক আসে না। ঠান্ডায় অসুস্থ হয়ে পরে ঝাও ডি। অসুস্থাবস্থায়ই একদিন সে বেরিয়ে পরে শহরে যাবার উদ্দেশ্যে। শিক্ষককে খুঁজে বের করবে।

পথেই সে পরে রয়। মেয়র তাকে বাড়িতে নিয়ে আসে। বৃদ্ধা মা মেয়রকে বলে, শিক্ষককে চিঠি লিখে জানাতে। একদিন শিক্ষক আসার খবর পায় ঝাও ডি। তার চোখ বেয়ে গড়ায় আনন্দাশ্রু।

দুর্বল শরীরেই সে দৌড়ে যায় স্কুলে। প্রতিবারের মত বেজে উঠে চেনা মিউজিক। মনকে সত্যিই দোলা দেয়। শিক্ষককে আবার ফিরতে হয় শহরে। আবার সে গ্রামে আসে।

কিশোরি ঝাও ডি সবসময় দাঁড়িয়ে থাকে পথের পাড়ে। প্রতিক্ষায় থাকে। বর্ণনাকারী ছেলের কণ্ঠে ভাসে, এটাই আমার বাবা-মা’র গল্প। এই পথ তাদের প্রেমের একটি অংশ। পথটি নোংরা, শহর থেকে এই পথ বেয়েই গ্রামে আসতে হয়।

আমার মা ভালবাসা ও বিশ্বাস নিয়ে বছরের পর বছর এই পথে দাঁড়িয়ে থাকতো। তাই সে শেষবারের জন্য বাবার সাথে এই পথ দিয়ে হাঁটতে চায়। ’ ছেলের কথার সাথে সাথে আবারো সাদা-কালো অর্থাৎ ফ্ল্যাশব্যাক থেকে বর্তমানে প্রত্যাবর্তন ঘটে। ছেলে মেয়রের কাছে গিয়ে মায়ের ইচ্ছা পূরণে পাশের গ্রাম থেকে লোক ভাড়া করতে বলে। মেয়র জানায় ৩৫-৩৬জন লোক লাগবে।

ছেলে মেয়রকে টাকা দেয়। মৃত দেহ নিয়ে আসতে তারা প্রাদেশিক হাসপাতালে যায়। স্ত্রীর বোনা সাদা কাপড়ে ঢাকা হয় মি. লুয়োর কফিন। ঠান্ডা উপেক্ষা করেই সেই পথ দিয়ে ফিরছে সবাই। মা, ছেলে; একশো মানুষ হয়ে যায়।

সবাই মি. লুয়োর ছাত্র। তারা শিক্ষকের মৃত্যুর কথা শুনে এসেছে। অনেক দুরের গুয়াংঝু থেকেও এসেছে কেউ কেউ। অনেকে আসতে চেয়েও পারেনি তুষার ঝড়ের কারণে। মেয়র ছেলেকে টাকা ফেরত দেয় এই বলে যে, একজনও টাকা নিতে রাজী হয়নি।

তুষার ঝড় অতিক্রম করেই পথ পাড়ি দেয় সবাই। আবারো ফিরে আসে সেই মিউজিক। মি. লুয়োর ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে সেই পানির কুপের পাশে দাফন করা হয়। যদিও কুপটি এখন আর ব্যবহৃত হয়না। মেয়র এরপরে বাড়িতে আসে স্কুলটা ঠিক করার কথা বলতে।

মিসেস লুয়ো, সেই কিশোরি ঝাও ডি, জমানো অর্থ বের করে, ছেলের টাকাও নেয় সাথে। মেয়রকে দেয়। মেয়র প্রথমে নিতে না চাইলেও বৃদ্ধার অনুরোধে নেয়। মা-ছেলে স্কুলে যায়। মা স্মৃতিচারণ করে।

মৃত স্বামীর উদ্দেশ্যে বলে, স্কুল ঠিক করা হচ্ছে, তোমার স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে, তুমি এবারে নিশ্চিন্ত। ছেলেকে জানায় তার বাবার আশা ছিল সেও বাবার মত শিক্ষক হবে। ছেলে মা’কে শহরে নিয়ে যেতে চাইলেও বৃদ্ধা রাজি হয়না। স্বামীর স্মৃতি নিয়েই সে বাঁচতে চায়। আবেগ জড়িত কণ্ঠে মা জানায় বাবা তাকে কত ভালবাসতো।

পরদিন ছেলে বাবা-মার ইচ্ছা পূরণে কিছু ছেলেকে স্কুলে একত্র করে পড়ায়। মা পড়ানোর শব্দ পেয়ে আসে। ছেলে বাবার দাঁড়ানোর জায়গায় দাঁড়ায়। কোন একাডেমিক টেক্সট নয়, বাবার লেখা একটি বই পড়ায়। পরিচালক এখানে আবারো পেছনে ফিরে দেখান কিশোরির সেই উৎসুক মুখ, ছেলেদের নিয়ে শিক্ষকের পথ চলা এবং সেই দৌড়।

সেই পথেই দৌড়ানো ঝাও ডি ফ্রিজ হয়ে শেষ হয় ‘দা রোড হোম’। হংকংয়ের পরিচালক ঝ্যাং ইয়াইমৌর এ চলচ্চিত্রের কাহিনী গতানুগতিক হয়েও গতানুগতিক নয়। পথ, শিক্ষালয় বিস্তিৃতি দিয়েছে কাহিনীকে। ছবির প্রাণ অভিনেত্রী অর্থাৎ ঝাও ডি চরিত্রাভিনেত্রী ঝ্যাং জিয়ি অসাধারণ অভিনয় করেছেন। তাকে পর্দায় সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলতে স্বার্থক হয়েছেন পরিচালক ঝ্যাং ইয়াইমৌ, যেমনিভাবে পুরো ছবিকেই তিনি সাজিয়েছেন।

অতি রোমান্টিক হয়েও ছবিটি কখনোই বিতৃষ্ণা জন্মায়নি। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।