আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সরেজমিন মেহেরপুর ঃ জয়নালের আলোয় অন্ধকার মেহেরপুর (সরকারী দলের সাংসদ বলে কথা)

দেশের সীমান্তবর্তী জেলা শহর মেহেরপুর। ছোট ছিমছাম এ শহরে কোনো কলকারখানা নেই। চারদিকে শুধুই ইটের ভাটা। শহরের ঢুকতেই চোখে পড়ে ‘অয়ন’ পেট্রলপাম্প। হাজারো বাতি দিয়ে আলোকিত করা হয়েছে পাম্পটি।

এ পাম্পের মালিক মেহেরপুর-১ (সদর) আসনের সাংসদ জয়নাল আবেদীনের ছেলে। উজ্জ্বল আলোর দিকে তাকিয়ে পাম্পের অদূরে দাঁড়ানো মহিউদ্দিন শেখ বললেন, পাম্পের মতো সাংসদ শুধু নিজের পরিবারকেই আলোকিত করেছেন, আর অন্ধকার করেছেন পুরো মেহেরপুর। তাঁর অভিযোগ, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে নিয়োগ, বদলি, টেন্ডার, জমি নিবন্ধন, মামলা, হাটবাজার ও বিল ইজারা, প্রকল্প গ্রহণ, অফিস-আদালত—কোনো কিছুই সাংসদকে খুশি না করে করা সম্ভব হয়নি। সাংসদের হয়ে তাঁর স্বজন ও ঘনিষ্ঠজনেরা এসব নিয়ন্ত্রণ করেন। মেহেরপুরের আওয়ামী লীগের নেতারা প্রথম আলোর কাছে অভিযোগ করেছেন, নির্বাচিত হওয়ার পর সাংসদ জয়নাল আবেদীনের সঙ্গে দলের নেতা-কর্মীদের দূরত্ব বেড়েছে।

সাংসদের ছেলে, ভাগনে, জামাতা, শ্যালক, স্ত্রী ও আত্মীয়স্বজনই এখন সবকিছুর মালিক। টিআর, কাবিখার প্রকল্পও তাঁদের হাত থেকে বাদ পড়েনি। অভিযোগ আছে, ভুয়া ও বেনামি প্রকল্প দেখিয়ে তছরুপ করা হয়েছে এসব প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ দেওয়া খাদ্য ও অর্থ। তবে সাংসদ জয়নাল আবেদীন এসব অভিযোগের তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি চ্যালেঞ্জ করে বলছি, আমার এলাকায় সরকারি বরাদ্দ নিয়ে কোনো অনিয়ম হয়নি।

আমি বা আমার ছেলেও কোনো দুর্নীতি-অনিয়মের সঙ্গে জড়িত নয়। কেউ প্রমাণ করতে পারলে আমি সব দায়িত্ব মাথা পেতে নেব। ’ উন্নয়ন বরাদ্দ: অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত দুই অর্থবছরে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার (টেস্ট রিলিফ-টিআর) এবং গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (কাজের বিনিময়ে খাদ্য—কাবিখা) কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন প্রকল্পই নেওয়া হয়েছে বেনামে ও ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে। এক নামে একাধিক প্রকল্প নেওয়ার নজির রয়েছে। এসব প্রকল্পের বরাদ্দ করা শস্য ক্ষমতাসীন দলের লোকজন কম দামে কিনে নিয়েছেন, এমন অভিযোগও আছে।

মেহেরপুর থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের সংগঠনের কোনো কার্যালয় নেই। একটা ঘর ভাড়া নেওয়ার ইচ্ছা আছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ প্রতিষ্ঠানের নামে ২০০৯-১০ অর্থবছরে টিআর প্রকল্পের দুই মেট্রিক টন এবং ২০১০-১১ অর্থবছরে এক মেট্রিক টন গম বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সাইদুর রহমানের অভিযোগ, কে বা কারা তাঁর নাম ব্যবহার করে এসব প্রকল্প নিয়েছেন। তিনি এসবের কিছুই জানেন না।

শুধু তাই নয়, তাঁর নামে আমঝুপি কোলা বাবুপাড়া কবরস্থানের সীমানাপ্রাচীর নির্মাণের নামে আরও দুই মেট্রিক টন গম ও ৫০ হাজার টাকার দুটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। অথচ বাস্তবে এসব প্রকল্পের কোনো অস্তিত্বই নেই। সাইদুর নিজেও এসবের কিছুই জানেন না। সূত্র জানায়, ২০০৯-১০ অর্থবছরে মেহেরপুর জেলা আইনজীবী সমিতির উন্নয়নের নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে পাঁচ মেট্রিক টন গম। মেহেরপুর জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আসাদুল আযম প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের প্রকল্পের কথা তিনি লোকমুখে শুনেছেন।

কিন্তু কোনো কিছুই পাননি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মেহেরপুরের যাদবপুর ঘাট এলাকায় সাংসদের শ্যালকের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কাছে একটি ছোট্ট ঘরে লেখা আছে এলাহীদাদ ফাউন্ডেশন। সাংসদের শ্বশুরের নামে এ প্রতিষ্ঠানটি। এর উন্নয়নের নামে এ পর্যন্ত ১০ মেট্রিক টন গম বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া কম্পিউটার ও আসবাব কেনার নামে টিআর ও এডিবির খাত থেকে এক লাখ টাকা বরাদ্দ দেখানো হয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক সাংসদের শ্যালক ইসলাম আলী। তবে সাইনবোর্ডের পাশে ফাঁকা দোকানঘর ছাড়া আর কিছুই নেই। এ ব্যাপারে সাংসদের শ্যালক ইসলাম আলী প্রথম আলোকে বলেন, এ প্রতিষ্ঠানটি এখন পর্যন্ত ১০ টন গম আর নগদ ৪০ হাজার টাকা ছাড়া আর কিছুই পায়নি। এসব টাকা দিয়ে তাঁরা সামাজিক কিছু কাজ করার চেষ্টা করছেন। তিনি জানান, মেহেরপুরের আওয়ামী লীগের প্রকাশ্য দুটি অংশ রয়েছে।

তাঁদের প্রতিপক্ষ অংশটি এ টাকার পরিমাণকে বহুগুণে বাড়িয়ে অপপ্রচার করছে। মেহেরপুর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম রসুলের অভিযোগ, সাংসদের শ্বশুরের নামের প্রতিষ্ঠানটিকে নামে-বেনামে লাখ লাখ টাকার অনুদান দিয়ে আওয়ামী লীগের আদর্শের রাজনীতিকে কলুষিত ও প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। তিনি জানান, সাংসদের শ্বশুর এলাহীদাদ ভিকু মিয়া একাত্তর সালে শান্তি কমিটির সভাপতি ছিলেন। মেহেরপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবুল কাশেম জানান, সাংসদের শ্বশুর এলাহীদাদ একজন স্বীকৃত রাজাকার। মেহেরপুর শহরের পেয়াদাপাড়ায় সাংসদের বাড়ির পাশে বাইতুল আমান জামে মসজিদ।

এলাকাবাসী জানেন, স্থানীয়দের অনুদান এবং সাংসদের অর্থসাহায্যে মসজিদটির উন্নতি হয়েছে। কিন্তু খোঁজ করে দেখা গেছে, এ মসজিদের নামে টিআর ও এডিবির খাত থেকে পাঁচ লাখ টাকা এবং ১৫ মেট্রিক টন গম বরাদ্দ নেওয়া হয়েছে। মেহেরপুর শহরের অবনি থিয়েটার ও যুব সংঘের উন্নয়ন ও আসবাব ক্রয়ের নামে গত অর্থবছরে ১৫ মেট্রিক টন গম বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সংগঠন দুটি কোনো কিছুই পায়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এ সংগঠনের একাধিক সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের নামে প্রকল্প নিয়ে সাংসদের ঘনিষ্ঠরা এই অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।

একইভাবে জাগ্রত তরুণ সংঘের নামেও নেওয়া হয়েছে লাখ লাখ টাকার একাধিক ভুয়া প্রকল্প। এসব প্রকল্পের ব্যাপারে জানতে চাইলে সদর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা দিলীপচন্দ্র সেন বলেন, অর্থবছর শেষ হওয়ার মাত্র দুই দিন আগে প্রকল্প বরাদ্দের জন্য চিঠি আসে। এ কারণে তিনি একটি প্রকল্পও যাচাই-বাছাই করতে পারেননি বলে জানান। তবে ওই কর্মকর্তা স্বীকার করেন, যাচাই-বাছাই করে প্রকল্প তালিকা তৈরির নিয়ম থাকলেও স্থানীয় সাংসদের মতামতের বাইরে তিনি কিছুই করতে পারেননি। গত দুই অর্থবছরে বিভিন্ন মসজিদ ও প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের নামে মেহেরপুর-১ আসনের জন্য টিআরের প্রায় ২৫০ মেট্রিক টন এবং কাবিখার প্রায় ২০০ মেট্রিক টন চাল-গম বরাদ্দ আসে বলে জানা গেছে।

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ: সরকার ক্ষমতায় আসার পর মেহেরপুরে সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের যাবতীয় কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করেন সাংসদের ভাগনে মাহফুজুর রহমান রিটন। রিটন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি ও বদলির তদবিরও করেন। তবে রিটন এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। মেহেরপুর আওয়ামী লীগের একাংশের নেতারা অভিযোগ করেন, সাংসদ দলীয় অফিসে বসেন না, শ্যালকের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বসেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁর বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় দলের জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মিয়া জান আলী এবং মেহেরপুর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম রসুল খুনের মামলার আসামি হয়েছেন।

খুনের ব্যাপারে সাংসদ জয়নাল আবেদীন প্রথম আলোকে বলেন, মেহেরপুর পৌর মেয়র মোতাসিম বিল্লাহ শহরের একটি পুরোনো হাসপাতাল ভেঙে সেখানে একটি বিপণিবিতান করতে চেয়েছিলেন। এ জন্য তিনি ৩৬ কোটি টাকার দরপত্র আহ্বান করেছিলেন। মন্ত্রণালয়ের আদেশ উপেক্ষা করে ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানকে মার্কেট নির্মাণের কার্যাদেশও তিনি দেন। এর সঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের দুজন নেতাও জড়িত ছিলেন। বিপণিবিতান নির্মাণ বাবদ মেয়র কমিশন নেন।

মেহেরপুর পৌরসভার প্যানেল মেয়র মিজানুর রহমান রিপন এর প্রতিবাদ করায় মেয়র ও তাঁর লোকজন তাঁকে খুন করেন বলে সাংসদ অভিযোগ করেন। আরও অভিযোগ: জানা গেছে, গত মার্চ মাসে জেলা আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিকবিষয়ক সম্পাদক আবদুল মান্নানের ইজারা নেওয়া রুয়াকালির বিলটি সাংসদের সমর্থকেরা জোর করে দখল করে নেন। এর প্রতিবাদ জানাতে তিনি প্রেসক্লাবের সামনে অনশন শুরু করেন। এ সময় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের অনেক নেতা সাংসদের দুর্নীতির বিবরণ তুলে ধরেন। তাঁরা বলেন, সাংসদ জয়নাল আবেদীন নিজের জমি বিক্রি করে ব্যাংকের ঋণ শোধ করে নিঃস্ব অবস্থায় নির্বাচন করেন।

দলের নেতা-কর্মীদের চাঁদার অর্থে তিনি নির্বাচিত। কিন্তু নির্বাচনের পর তাঁর ও তাঁর পরিবারের বিপুল পরিমাণ অর্থ নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। মেহেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা ও দায়রা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি মিয়া জান আলী জানান, সাংসদের দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার কথা প্রধানমন্ত্রীকে জানানো হয়েছে। যেকোনো সময় দলের নেতা-কর্মীরা সাংসদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়ে রাস্তায় নামবেন। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সাংসদ জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘মেহেরপুর আওয়ামী লীগের তিন নেতা আমার বিরুদ্ধে যেভাবে বলে বেড়াচ্ছেন, আমি সাংসদ হয়ে সেভাবে বলতে পারি না।

এটা সাংসদের মানায় না। তারা আমার সুনাম নষ্ট করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে, সাংবাদিকদের কাছেও মিথ্যে তথ্য সরবরাহ করে বেড়াচ্ছে। ’ সূত্র ঃ প্রথম আলো ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।