আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বৃষ্টিস্নাত কাতলাবাবা এবং একটি মেয়ে

দুনিয়াতে শুধু দুই প্রকার মানুষ আছে। একদল ভাল, একদল খারাপ। এর বাইরে আর কোন বিভেদ নাই। জানালার কাচ ভাঙা। আমাকে ভেজাতে হলে বৃষ্টিকে ভাঙা জায়গা পেরিয়ে আসতে হবে।

সেটা অনেক কষ্ট ! তাই পুরো জানালাটাই খুলে রেখেছি আমি। বৃষ্টি আমাকে আলিঙ্গন করছে। "ভাইয়া, আপনার প্যান্ট ভিজে গেলো" পাশের সিট থেকে এক অচেনা যাত্রী বলল। "নিজেই ভিজাচ্ছি" বলে কৃত্রিম হাসি দিলাম। ছেলেটা কিছু বলল না।

অপ্রতিভ মনে হলো। এই ছেলে কখন এসে বসেছে খেয়াল করিনি । বয়স আঠারো উনিশ হবে হয়তো। হলুদ র‌্ঙের একটা রেইনকোট পরে আছে। "আপনাকে কি কোথাও দেখেছি আমি ?" ছেলেটা কৌতুহলীচোখে তাকায়।

"হতে পারে । " "আমি বুয়েটে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। আপনাকে বুয়েটে দেখেছি মনে হচ্ছে। " "আপনি রশিদ হলে থাকেন ?" "হ্যা,আপনি ?" "আমি শামীম ভাইয়ের কাছে পড়তে যেতাম, সেই সুবাদে হয়তো দেখা হতে পারে। " "ওহ,আমি উনার পাশের রুমে থাকি" "১০১০?" "না,১০০৮ ।

" "ওহ। " সিগনাল পড়েছে। বাস থেমে দাড়ায়। জ্যামে পড়েছি । বাইরে তাকায় ।

গাড়ি এখন বিজয় সরনীতে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। আজ তিনদিন থেকে আকাশের এই অবস্থা । কাঁদছে তো কাঁদছেই । ইংরেজিতে যাকে বলে ক্যাটস এন্ড ডগস।

কুকুর-বিড়ালের সাথে বৃষ্টির কি সম্পর্ক আমার বোধগম্য হয় না। গাড়িতে একটা পত্রিকার হকার ওঠে। "নেন ভাই, পেপার, পেপার। খবর পড়েন, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দু'কোটি টাকার মামলা! আমাদের সময় দু'টাকা, বাংলাদেশ প্রতিদিন দু'টাকা" । আমার কোন আগ্রহ হয়না পত্রিকা কেনার।

হকারের দিকে তাকায়, বয়স খুব জোর দশ এগারো হবে হয়তো। এতটুকু বয়সেই রোজগারে নেমেছে। পকেট থেকে পাঁচটাকা বের করি। পত্রিকাসহ দু'টাকা ফেরত দিয়ে বলে "একটাকা নাই যে !" "লাগবে না,যা। " ছেলেটা হাসে ।

এক টাকার হাসি ! কিন্তু আমি ওর মুখে কোটি টাকার হাসি কল্পনা করি। কল্পনা করতে ভাল লাগে। ভাবতে ভাল লাগে, দেশের সব মানুষ ধনী হয়ে গেছে। সবাই কোটি কোটি টাকার মালিক। বাংলাদেশ বিশ্বের একটা পরাশক্তি।

কোন দেশ চোখ তুলে তাকালেই "ঢাইচা ঢাইচা" শব্দ করে গুলি করে। কিন্তু পরক্ষনেই ভাবি, আচ্ছা, এই টোকাই-হকারগুলো যদি না থাকতো তবে এই পত্রিকাটা কি আমি এত সহজে বাসে বসে বসে পেতাম ? এই আওয়ামী লীগ-বিএনপির মিছিলে এতলোক আসতো ? টাকার জন্যেই তো এরা আসে । জনগন ধনী হয়ে গেলে, হাসিনা-খলেদা বেকার হয়ে যাবে! খালেদা-হাসিনার জন্য মায়া হয়। আমি কল্পনা করা বন্ধ করি। বাস ধানমন্ডি সাতাশে চলে এসেছে।

আমি নামার প্রস্তুতি নিই । শার্টের বাম পাশ পুরোটাই ভিজে গেছে। মোবাইল ডান পকেটে আছে, ভিজেনি। বাসের ধীর গতি আর সামনে পেছনে অনেক গাড়ি দেখে প্রিন্স প্লাজার সামনেই নেমে যায়। জোরে জোরে বৃষ্টি পড়ছে ।

আমি তোয়াক্কা করিনা। হাটতে থাকি। "কাতলা" ক্ষীন একটা আওয়াজ শুনে বা দিকে ঘুরে তাকায়। পেট্রোল পাম্পের সামনেই দাড়িয়ে মেয়েটা। হাতে ছাতা।

কাধে ব্যাগ। "নিশি। " আমি চিনতে পারি। "কিরে তুই ঢাকায় ! নাকি আমি স্বপ্ন দেখছি!" আমি পেট্রোল পাম্পের ছাউনির নিচে যায়। "কাতলাবাবা যে দিবাস্বপ্ন দেখে, এটা আগে জানতাম না।

" "কেউ যদি দেখায়, আমার দোষ কি ! " আমি হাসি। নিশি হাসে। আমাদের হাসি দেখে বৃষ্টি কাঁদে! "কোথায় এসেছিলি?" "এইতো মার্কেটে এসেছিলাম। তুই?" "রাস্তা থেকে। " "সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি।

তার আগে কোথায় ছিলি?" "বাসে " "ফাজলামু পকেটে রাখ। "ধমক দেয় নিশি। "এতদিন পর দেখা ,খারাপ আছি নাকি ভাল আছি প্রশ্ন না করে ফাজলামু করতেসিস। " "ওহ,সরি অ্যান্টি। " "কি কইলি !!! থাপ্পর খাওনের ইচ্ছা থাকলে আবার কইতে পারস।

" "তওবা, তওবা। রোজার দিনে খাওনের কথা কইলি আল্লাহ কি পরিমান গুনাহ দিবে, জানিস?" "কি পরিমান ?" "তুই জানিস না?" "না" "আমিও জানি না রে ! " তেড়ে আসার ভান করে করে নিশি। আমরা দুজনেই হাসি। "চল, আমাকে কিছু খাওয়াবি । " "পকেটে, পয়সা নাই।

" "তোরে পয়সা দিতে কই নাই। খাওয়াইতে কইসি খালি। " "পয়সা কি তোর বাপজানে দিব?" "পয়সা আমার হাজবেন্ডের। " "তুই বিয়ে করসিস !" আমি বিস্মিত হয়। আমরা প্রাইমারি স্কুলে একসাথে পড়তাম।

আমি রাজশাহী ছাড়ার পর আমাদের দীর্ঘদিন যোগাযোগ ছিল না। কাকতালীয়ভাবে পরে আবার দেখা হয় রাজশাহীতে গনিত অলিম্পিয়াডের অনুষ্ঠানে। এরপর কিছুদিন কুটুর কুটুর আলাপ। তারপর রাগ আভিমান। তবে সেটা প্রেম ছিল না ! চাঁপাইনবাবগঞ্জ সরকারি কলেজে পড়ার সময়ও মাখে মাঝে ফোনে কথা হতো।

শেষ দু'বছর আর যোগাযোগ নেই। সম্পর্কগুলো সম্ভবত এইভাবেই চলে যায়। ভাঙে আবার গড়ে। একসময় বুড়োবুড়ি হয়ে যায় আমরা। তারপর মৃত্যুর দিনক্ষন গুনতে বাকি থাকে।

"না করলে আমার বাপে আমারে ঢাকায় থাকতে দিবো ?" "শেষ পর্যন্ত ঢাকায় থাকনের লাইগ্যা বিয়া করলি। ছিঃ ছিঃ ! তুই এত নিচ!" আমি ফোড়ন কাটি। "বেশি প্যাক প্যাক করবি তো ধাক্কা দিয়া বাসের নিচে ফেলাই দিব। " আমি হাসি। চল, আমারে একটু পৌছায় দিবি।

"কোথায়?" "কলাবাগান। " ওখানে কে আছে? "তোর দুলাভাই। " আজকাল দুলাভাইয়ের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। আমি আতঙ্কিত হয়। "আমি গেলে তোরে সন্দেহ করবো !" "করলে করুক।

ওরে কেয়ার করি না। " আমি ও'র দম্ভোক্তি দেখে অবাক হয়। কিছু জিগেস করি না। ছাতা খুলছিল নিশি। আমি নিষেধ করলাম ।

মাথা ঝাকায় ও। আমরা দু'জন ভিজতে ভিজতে হাটতে থাকি। পুরোনো দিনের মত। বৃষ্টি একটু দম নিয়েছে। আকাশে মেঘ দৌড়া দৌড়ি করছে।

আমরা হাটতে থাকি। সিয়াম সারোয়ার জামিল এর "কাতলা বাবার দিনলিপি-২" ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।