আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মরন্তের বিপন্নতা

রেশমার মুখটা কেমন তেতো হয়ে আছে, খিচড়ে আছে মেজাজ আর কেমন ভাঙচুর একটা রাগ হচ্ছে। মনে হচ্ছে এক্ষুণি কিছু ভেঙে একাকার করে ফেলে। ভীষণ নিশপিশ করছে হাত। দাঁতে ঠোঁট কামড়ে সারা ঘরে আতি পাতি করে খোঁজে রেশমা, যদি কিছু পাওয়া যায়। চোখ বন্ধ করে শোনে কিছু আছড়ে ভেঙে পড়ার ঝনঝন শব্দ।

কিন্তু ওই পর্যন্তই। বেচারী অসহায়, অক্ষম রাগে ছটফট করে, থরথর করে কাঁপে, দাঁত কিড়মিড় করে উঠে আর তারপরে শুরু হয় চোখ জ্বালা করা। জ্বালা ধরানো আগুন গরম তরল ওর চোখ ছাপিয়ে উপচে পড়ে, সহ্যের বাধ ভেঙে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। রেশমার বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে ভেঙেচুড়ে যায়। বিছানায় উপুড় রেশমার দেহটা কান্নার দমকে ফুলে ফুলে উঠে।

আম্মাকে বহুদিন বলেছে রেশমা, লোকটাকে সে সহ্যই করতে পারে না। আম্মা খুব সুন্দর করে বোঝান ওকে, 'তুই তোর মত থাকবি, সামনে যাবি না...তাইলেই তো হয়'। রেশমার তো যেতে হয় না, সে নিজেই এসে হাজির হয়। কি ভয়ংকর একটা লোক। দেখলেই কেমন গিরগিটির মতন লাগে।

মণি দুটো ঠিকড়ে আসা কেমন ঢুলু ঢুলু চোখ, কোলে আস্ত বালিশের মত শুয়ে আছে মাংস পিন্ড; ভারী, কুচকুচে কাল, ভেজা ভেজা দুটো ঠোঁট; তেল চকচকে চুল চাঁদিতে পাট করে শোয়ানো; আর থলথলে দৈত্যের মত লোমশ একটা দেহ; দুটো হাততো বটেই, শার্টের ভিতরে বুক কিংবা ঘাড়ের যতটুকু দেখা যায় তাতেও বনমানুষের মত ঘন কুচকুচে কাল লোম। রেশমা সামনে এলেই লোকটা কেমন জুলজুলে চোখে চেয়ে থাকে, ঠোঁট ঝুলে পড়ে, ভেজা ভেজা হয়ে যায়...যেন এখনি গড়িয়ে পড়বে লালা। আর রেশমা ভীষণ আতংকে কুকড়ে যায়। ওর মনে হতে থাকে একটা গিরগিটি খুব সন্তর্পণে ওঁত পেতেছে, এগুচ্ছে গুড়ি মেরে। আর একটু...আর একটু... শিউড়ে ওঠে রেশমা, চমকে তাকায় দরজার দিকে।

নাহ, দরজা বন্ধই আছে। তারপরও তার ভয় কাটে না। যেন ঘরের কোন না কোন ফাঁক ফোকড় থেকে উকি মেরে আছে একটা গিরগিটি। ভীষণ গা গুলায় ওর। লোকটাকে যে এতখানি অবহেলা বা অগ্রাহ্য করা যায় না, তা রেশমা বোঝে।

অঢেল টাকা তার, পুরান ঢাকায় দুটো বিশাল বনেদী বাড়ি, তিন তিনটা গ্যারাজ, কম করে হলেও দশটা ট্রাক, আর আরো কি কি সব কারবার। তবে কুৎসাও কম নেই তার নামে। সে নাকি বিয়েও করেছিল দুইবার; একটা বউ মরে গেছে, লোকে বলে খুন করেছে; আর আরেকটা পালিয়েছে। এইসব কানকথায় আম্মার কিছু আসে যায় না। এমন একটা মক্কেল হাতছাড়া করার মত বোকাতো আর জুলেখা বেগম নয়।

স্বামী পরিত্যাক্ত যে মহিলাকে এই চল্লিশের ঘরে এসেও এখনও পুরুষমানুষের লোলুপ দৃষ্টি সইতে আর সামলে চলতে হয়; রেশমার মত সোমত্ত, সুন্দরী একটা মেয়ে তার জন্য কি বিশাল একটা বোঝা তাতো সহজেই অনুমেয়। সরাসরি কিছু বলে নি আম্মা, নিজেদের এতটা সহজলোভ্য করতে নেই তা তিনি ভালই জানেন। তবে পরোক্ষে তার কাছ থেকে আশকারাই পেয়ে যাচ্ছে লোকটা। রেশমার কিছুতেই সহ্য হয় না এমন বেহায়াপনা। তার মাঝে মাঝে খুব বেপরোয়া কিছু করে ফেলতে ইচ্ছা হয়।

মাংসলোভী কুকুরটা বহুদিন ধরেই ছোঁক ছোঁক করে যাচ্ছে এ এলাকায়, এ বাড়ির আশেপাশে, রেশমার কাছাকাছি। রাস্তায়, কি কলেজের সামনে লোকটার অত্যাচার সয়েছে রেশমা। একা পেলেই লোকটা বিচ্ছিরি আর নোংরা সব কথা বলে। সাপের মত জিভ বের করে ঘন ঘন চাটতে থাকে থলথলে ঠোঁটজোড়া। মোটা ঘড়ঘড়ে অশ্লীল কন্ঠটা যেন তার কানে গরম সীসা ঢেলে দেয়।

রেশমা শুধু কুকড়ে যায়, পিছাতে পিছাতে আর যখন জায়গা থাকে না তখন কাঁপতে থাকে একটা ভীরু খরগোশের মতন। ভীষণ অপমানে চোখে শ্রাবণ নামে। কতদিন রেশমার ভেতরটা বিদ্রোহ করে উঠেছে। ওই ভয়ংকর দৃষ্টি থেকে নিজেকে বাঁচানোর কত উপায়ই না সে মনে মনে ভেবেছে। কখনো কখনো সেটা তার কল্পনাতেই এত ভীষণ রকম হিংস্র আর ভয়ংকরও হয়ে উঠেছে যে সে নিজেই আঁতকে উঠেছে ভয়ে।

কিন্তু তার কিছুই করা হয়ে উঠেনি। শুধু আম্মাকে বলেছে, যদিও বলে কোন লাভ নেই। উল্টে বকাই শুনতে হয়, রেশমার মত বোকা মেয়ে পৃথিবীতে দুটো নেই, কত সুখেই না রাখবে এই লোক রেশমাকে, এমন সুযোগ হেলায় হারাতে নেই। আবার সন্তর্পণে এ খেয়ালও তার থাকে রেশমার রাগ যেন মাত্রা না ছাড়ায়। চিরকাল চুপচাপ, নরম সরম মেয়েটা যে ভিতরে ভিতরে প্রচন্ড জেদী আর গোয়ার, মাতো তা ভাল করেই জানেন।

ধমক দিয়ে, আদর দিয়ে কতভাবে তিনি ওকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, তবু রেশমা বোঝে না। ওর সমস্ত শরীর জুড়ে থাকে ভয়ানক এক ঘৃণা, আর অস্বস্তির এক চাদর। লোকটা সামনে এলেই গা গুলায় রেশমার। মনে হয় যদি গেলে দেয়া যেতো ওই ড্যাবড্যাবে চোখ দুটো, চিরদিনের মত শেষ করে দেয়া যেতো ওই চোখের দৃষ্টি! আজকাল লোকটার সাহস বেড়েছে বেশ। সে এখন রাস্তা, গলি পেরিয়ে বাড়ির উঠান অবধি এসে হাজির হয়।

পাশের ঘরের পিচ্চিটার সাথে উঠানে বসেই গল্প করছিল রেশমা। হঠাৎ চেয়ে দেখে লোকটা, একদম সামনেই দাঁড়ানো, সেই গা ঘিনঘিনে চোখে চেয়ে থাকা আর লকলকে জিভের ভিতর বাহির নিয়ে। রেশমা বিপন্নের মত এদিক ওদিক চায়। কিন্তু খুঁজে পায় না কোন মানুষ বা প্রাণী তাকে বাঁচানোর মত। গুড়ি মেরে এগুতে থাকে গিরগিটিটা; লালসা ভরা জুলজুলে চোখে, ঝুলে পড়া ভেজা থ্যাবড়া ঠোঁটে অশ্লীল হাসি নিয়ে।

ভয়ে, আতংকে, ঘৃণায় অবশ হয়ে আসে রেশমার দেহ। এক পা এক পা করে সে পিছায়, পিছায়......কিন্তু একসময় পিঠ ঠেকে যায় ঘরের নড়বড়ে বেড়াটায়। মরিয়া হয়ে রেশমা ঘুরে দাঁড়ায়, এক ছুটে ঢুকে যায় ঘরের ভিতর। তেতো হয়ে উঠে মুখ, ভয়ংকর একটা ভাঙচুর রাগে থরথর করে কাঁপতে থাকে রেশমা। উদভ্রান্ত দৃষ্টি মেলে আঁতিপাতি খোঁজে ঘরের চারদিক।

কিছু একটা ভাঙতে হবে, ধ্বংস করতে হবে কিছু একটা....... রেশমার দৃষ্টি আটকে যায় ওর ছোট্ট পড়ার টেবিলটার ওপর। কি উপলক্ষে পড়শী এক ঘর থেকে মিষ্টি দিয়েছিল, খাওয়া শেষে প্লেটটা সরানো হয়নি, রয়ে গেছে কাঁটাচামচটাও। চোখে আগুন নিয়ে রেশমা চেয়ে থাকে চামচটার দিকে। বাইরে আম্মার গলা পাওয়া যায়। কোথা থেকে ফিরলেন তিনি কে জানে! খুব বিগলিত ভঙ্গিতে হাসছেন গিরগিটিটার সাথে, ওই ভয়ংকর প্রাণীটার ঘড়ঘড়ে গলার হাসিও শুনতে পাচ্ছে রেশমা।

ওর খুব গা গুলায়। শুনতে পায় আম্মা খুব মিষ্টি করে ডাকছেন ওকে। আজ আর কোন রাখঢাক নেই। ওর চোখে জ্বালা আরো বাড়ে, ঠিকরে বেরোয় আগুন। সেই উত্তাপে শুকিয়ে যায় চোখের পানি।

ধকধকে চোখে রেশমা এগিয়ে যায় টেবিলের দিকে। সর্বশক্তিতে চেপে ধরে কাঁটাচামচটা। তার ভেতরে যেন কি এক প্রলয় ঘটে গেছে। আজ সে আর সহ্য করবে না এই নোংরা, ভয়ংকর লোকটার স্বেচ্ছাচার। তার হাতে ধরা চামচটা যেন গলে যাবে দৃষ্টির ভীষণ উত্তাপে।

ভেতরে থেকেই টের পায় লোকটাকে সামনের ঘরে বসিয়ে আম্মা সরে গেছে কোথাও। কাঁটাচামচ ধরা হাতটা দেহের পিছনে আড়াল করে, ভীষণ এক হাসির ভঙ্গিতে ঠোঁট বাঁকিয়ে রেশমা দরজার আগল সরায়। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.