আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছিন্নস্মৃতি: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় (১৯৮৯-৯৫)

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ আমরা যে সময়টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম সে সময়টায় আমারদের কারও মোবাইল ফোন কিংবা এমপি থ্রি প্লেয়ার কিংবা ল্যাপটপ ছিল না। ক্লাসের ফাঁকে আমরা ডাকসু ক্যাফেটেরিয়ায় বসে খুব তাস খেলতাম। মনটি রহমান (বর্তমানে প্রথম আলোর মিজানুর রহমান খান) আসত ডাকসু ক্যাফেটেরিয়ায় ।

মনটির জন্মতারিখ ছিল ৫ মে। ওই দিনেই কার্ল মার্কসেরও জন্ম; কথাটা ওকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার পর আমার সঙ্গে মনটির বেশ ভাব হয়ে যায়। মনটির টাইপ ছিল বেশ সিরিয়াস। আমার মত চপল-চঞ্চল না। আমার মতন ডাকসু ক্যাফেটেরিয়ায় ক্লাসের ফাঁকে তাস খেলতে বসে যেত না।

... মনটি পড়ত সাংবাদিকতা বিভাগে। আমি ইতিহাসে। তখই বিচিত্রায় দূর্দান্ত সব ফিচার লিখে হইচই ফেলে দিয়েছিল মনটি। চমৎকার কবিতা লিখত। হাতের লেখা সুন্দর ছিল ওর।

নীলক্ষেত থেকে শক্তি চট্টোপাধ্যায় অনুদিত কালিদাস-এর ‘মেঘদূত’ কিনে ডাকসু ক্যাফেটেরিয়ায় এসে বসেছি। মনটি সে বইয়ের পিছনে একটা কবিতা লিখে দিল। ...অথচ একদিন দুম করে কবিতা লেখা ছেড়ে দেয় মনটি । কারণটি আমি জানি। বলব না।

সব কথা বলা যায় না। লেখা যায় না। শুধু এটুকুই বলব যে আমার এই ক্ষুদ্র জীবনে সংকীর্ণচেতা কবিদের ঈর্ষা অনেক দেখেছি আমি। দেখে অত্যন্ত ক্ষুব্দ এবং মর্মাহত হয়েছি। কবিদের ওই রকম সংকীর্ণতায় আমার ঘেন্না ধরে যেত।

আমি অনেক কাল আগেই জেনেছি: গুণী শিল্পী হলেই মন মহৎ হয় না ... অনেক সময় দুপুরের খাওয়াটা সেরে নিতাম ডাকসু ক্যাফেটেরিয়ায়। ১০/১২ টাকার একপ্লেট পোলাও আর অল্পখানি গোশত দিত। কখনও জগন্নাথ হলের ক্যান্টিনে যেতাম খেতে । শেষ ক্লাস দুপুর ২টা ৩০ এ। কলাভবন থেকে আসা-যাওয়ার সময় পাওয়া যেত।

এখন তো বাজারে ইলিশ মাছ আক্রা, সেই সময়ে অর্থাৎ ১৯৯০/৯১ সালে ওই মাছটার দরটর নিয়ে মধ্যবিত্ত বড় একটা উদ্বিগ্ন ছিল না। জগন্নাথ হলের ক্যান্টিনটা আমার কাছে বরাবরই আলাদা মনে হয়েছে। রান্নার স্বাদ ছিল তো ছিলই আর ছিল ভারি পরিচ্ছন। আমরা যে মুসলিম সেটি হলের হিন্দু ছাত্ররা ঠিকই জানত। তা সত্ত্বেও আমরা এক ধরনের নীরব সম্ভাষণ টের পেতাম।

যেন প্রত্যন্ত গাঁয়ের কোনও দেবী মন্দিরে গিয়েছি। ভিন জাতের পর্যটকের চোখে দেখছি পুরাতন স্থাপত্য। তবে অদৃশ্য থেকে মা যেন ভারি আনন্দিত , আমরা গেছি বলে ... আমার সিজোফ্রেনিক মনে এমনই মনে হত। তখনকার দিনগুলি ছিল এমনই গভীর । অন্তত আমার কাছে।

গায়ে রোদ মেখে সিগারেট টানতে-টানতে আমরা কলাভবনে ফিরে আসতাম। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ নতুন করে স্বাধীন হয়েছে। নব্বুয়ের আন্দোলনের পর স্বৈরাচারী এরশাদের পতন হয়েছে। দেশে তখন গনতন্ত্রের তুমুল জোয়ার, সর্বত্রই নতুন আশাবাদ । সেই আশাবাদ ঝরে ঝরে পড়ত শ্রাবণের রোদে, রাস্তার পাশের কৃষ্ণচূড়া গাছে কিংবা হা-ক্লান্ত রিকশাওয়ালার মুখেচোখে ।

আমারও গনতান্ত্রিক পরিবেশে ঢিলেঢালা ভাবে হাঁটতাম । তার কারণ আছে। ২টা ৩০- এ যে ম্যাডামের ক্লাস ছিল তার পড়ানোর স্টাইল ছিল ভারি বিরক্তিকর। আর ইতিহাস সাবজেক্টটা এম্নিতেই অ-রসালো! ওই ম্যাডাম কখনোই বোঝার চেষ্টা করেন নি যে অধ্যাপক হওয়া সহজ কিন্তু প্রকৃত শিক্ষক হওয়া কঠিন! ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আবদুল মোমিন চৌধুরী প্রকৃত শিক্ষক ছিলেন। মোমিন স্যার যা পড়াতেন তাই পড়াতেন।

কখনও পাঠের কেন্দ্র থেকে চ্যূত হতেন না। মানে ‘সাব লিঙ্কে’ ঢুকতেন না। তদুপরি স্যারের বাচন ভঙ্গি ছিল চমৎকার । জলদ মধুর। ১৯৮৯ সালের ১৭ অগস্ট কলা ভবনের চারতলার একটি কক্ষে (কক্ষ ন! ৪০০০ কত যেন!) আমাদের প্রথম ক্লাস শুরু হয়।

প্রথম ক্লাসটিই ছিল মোমিন স্যারের। ক্লাসে স্যার কুড়ি মিনিটির মতো ছিলেন। নাঃ, সেদিন স্যার ইতিহাস নিয়ে কিছু বলেননি। কেবল তিনটে কথা বলেছিলেন। (১) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ মুড়ির চেয়েও সস্তা।

কাজেই মনোযোগী হও (২) ইতিহাসের খুঁটিনাটি তথ্য বাস্তবজীবনে তত কাজে নাও লাগতে পারে! কাজেই যদ্দিন এখানে আছো, ইংরেজি ভাষাটা ভালো করে শিখ। আর (৩) রিকশায় কখনও তিনজন উঠবে না! ক্লাস শেষ করে বাড়ি ফিরে এলাম। মা কে বললাম, মানুষ যে কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যায়। সেটি আজ প্রথম ক্লাসেই পূর্ণ হল। মায়ের চোখে কৌতূহল ঝিকিয়ে উঠল।

মাকে বললাম মোমিন স্যারের কথাগুলি। বিশেষ করে ৩নং পয়েন্ট। মায়ের মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। আমার মা ছিলেন ইতিহাসের ছাত্রী। শখ ছিল ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে পড়বে।

এই শখের পিছনে আমার মায়ের যে গূঢ়তম ইচ্ছে ছিল, সে ইচ্ছে প্রথম ক্লাসেই পূর্ণ করে দিলেন এক মহৎপ্রাণ প্রকৃত শিক্ষক! ইতিহাস বিভাগের আরেক জন অধ্যাপক আমায় গভীরভাবে আলোড়িত করেছিলেন । অধ্যাপক আহমেদ কামাল। আহমেদ কামাল স্যার আমাদের ‘এনসিয়েন্ট ইন্ডিয়া’ পড়াতেন । প্রথমতঃ তার কাছেই প্রথম বেদের শ্লোক শুনি। স্যার মৌলিক বৈদিক টেক্সট পাঠ করে ব্যাখ্যা করতেন ক্লাসে।

এই অভিজ্ঞতা আমার কাছে ছিল অভূতপূর্ব। আরেকবার। আহমেদ কামাল স্যারকে অনুরোধ করলাম আমাদের সঙ্গে পিকনিকে যাওয়ার জন্য। স্যার যেতে রাজি হলেন না। মেয়েরা ‘প্লিজ স্যার’, ‘প্লিজ স্যার’ করতে লাগল।

অবশেষে স্যার বললেন, দেখ আমি খোলা মাঠে অসংখ্য ক্ষুধার্ত শিশুর সামনে বসে বিরিয়ানি খেতে পারব না। আমরা মনক্ষুন্ন হয়ে চলে এলাম। আমি অবশ্য স্যারের কথার তাৎপর্য অনেক পরে বুঝতে পেরেছিলাম। ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বর মাস। প্রথম বর্ষের প্রায় ৪/৫ মাস কেটে গেছে।

আমরা সবাই সর্বদাই খানিকটা উত্তেজিত হয়েই থাকি। পিকনিক যাওয়ার প্ল্যান করছি। স্যারদের কাছ থেকে সহযোগিতা পাওয়া গেল না। নিজেরই গোপনে - গোপনে উদ্যেগ নিয়ে একটা মিনিবাস ভাড়া করে গাজীপুরের কুয়াশা ঘেরা এক শালবনের সকালে পৌঁছে যাই। মিনি বাস থেকে নেমে আমরা সবাই যে যার মতন চতুর্দিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়লাম।

আমাদের সঙ্গে মেয়েরাও ছিল। আমাদের ক্লাসের মেয়েদের সঙ্গে ছেলেদের পরিচয় হওয়ার ঘটনাটি ছিল কিন্তু বেশ মজার । প্রথম ক্লাসেই দু-এক জন ছাত্রের সঙ্গে আমার পরিচয় হল। তাদের একজন ছিল মঞ্জু। খুলনার ছেলে।

বেশ সপ্রতিভ বলে মনে হল। লম্বা। চশমা পরা। কাঁধ অবধি দীর্ঘচুল। দেখেই মনে হয়েছিল সাহিত্য-তাহিত্য করে।

ক্লাসের পর মঞ্জুকে বললাম, শুধু পড়াশোনা করে কী লাভ বল? সাহিত্যও তো করতে হয়। মঞ্জু আমার কথায় সায় দিল। বললাম, একটা সাহিত্য পত্রিকা বার করলে কেমন হয়? মঞ্জু সায় দেয়। বললাম, এই কথাটা মেয়েদেরও বল না কেন। মঞ্জু লম্বা ফর্সা মতন একটা মেয়ের কাছে গিয়ে কথা বলতে লাগল।

(পরে জেনেছিলাম ওই মেয়েটির নাম বীণা। ) মঞ্জু ফিরে এসে আমাকে বলল, মেয়েরাও নাকি সাহিত্য নিয়ে ভীষণ আগ্রহী। সাহিত্য পত্রিকা বার করার কথা ভাবছে। ঠিক হল, এ নিয়ে আগামীকার টিএসসি তে জরুরি বৈঠক। পরের দিন সাহিত্যবিষয়ক জরুরি বৈঠকে আমাদের ক্লাসের প্রায় কুড়িজন ছেলেমেয়ে উপস্থিত দেখলাম।

প্রথমেই যে যার নাম ও সংক্ষিপ্ত পরিচয় জানাল। এরপর কথা নানা দিকে গড়াল। কেবল ওই সাহিত্য পত্রিকা বাদে ... যা হোক। ডিসেম্বরের রোদ ও কুয়াশায় মাখামাখি নির্জন শালবনে আমি হাঁটছিলাম। আমার পাশে নীপা আর শুভ।

শুভ কবিতা লিখত। ওর লেখা দু-লাইন কবিতা আজও মনে আছে আমার: (১) আত্মার পথে উড়ে যায় এক অনির্বাণ কাক। (২) দুর্নিবার এই দিন ও রাত্রির খেলা ... । শুভ ছবিও আঁকত। পরাবাস্তব সব ছবি।

যেমন, অ্যাকুয়ারিমামে এ্যাঞ্জেল মাছ। সে মাছের চোখে বড় করে পাপড়ি এঁকে দিত। শুভ ছিল খানিকটা অস্থির। অপরদিকে নীপা ছিল বেশ স্মার্ট । আর ছিল ভীষণ স্বপ্নপ্রবণ।

নীপা আমাকে আর শুভকে ওর স্বপ্নের কথা বলল। স্বপ্ন মানে বিয়ে। হবু স্বামী যেন আমেরিকায় থাকে, আমেরিকার পুবে নয়, পশ্চিমে। সে যেন খুব সৌখিন হয়। তার যেন হাজার জোরা টিশার্ট আর হাজার জোরা জুতা থাকে।

পরবর্তীকালে অনেকটা কাকতালীয় ভাবেই নীপার সঙ্গে আমার এক দূর সম্পর্কের খালাতো ভাইয়ের বিয়ে হয়েছিল। রানা ভাই আমেরিকার ডালাস থাকতেন । বেশ সৌখিন। সংগ্রহে হাজার জোরা টিশার্ট আর হাজার জোরা জুতা! ... নীপার স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল! আমাদের ফাস্ট ইয়ারটা কেটেছিল টিএসটি তে । ফাস্ট ইয়ারে ক্লাস ছিল কম।

১২টা ১টার মধ্যেই ফ্রি হয়ে যেতাম। আমরা বসতাম ফোয়ারার কাছে। তারপর বিকেল পর্যন্ত আড্ডা চলত। মাঝখানে ক্যাফেটেরিয়ায় খেয়ে নিতাম। আমার মনে হয়েছিল টিএসটির ভিতরটাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সবচে সুন্দর জায়গা।

লনে সবুজ মসৃন ঘাস। কাঁচে ঘেরা বারান্দা। বালক বয়েসে মেজো মামার সঙ্গে একবার টিএসসি এসেছিলাম । মেজো মামা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগে পড়াতেন। গোলমতন অডিটোরিয়ামে কী নিয়ে যেন সেমিনার ছিল ।

আমার খালি মনে আছে মামা আমার হাতে একটা ঠোঙা দিয়েছিলেন। ঠোঙার ভিতরে কালোজাম আর সিঙাড়া। শ্যামলা রঙের মেয়েটাকে প্রথম দেখি লেকচার থিয়েটারে। সাবসিডিয়ারি ক্লাসে। আমাদের তখন অনার্স কোর্স ছাড়াও দুটো সাবসিপিয়ারি সাবজেক্ট নিতে হত।

আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান নিয়েছিলাম। রাষ্ট্রবিজ্ঞান ক্লাসে সামনের বেঞ্চে বসেছিল মেয়েটি । পাশ থেকে অপরূপ মুখটা দেখে বুক ধরাস করে উঠেছিল । কে এ! ভারি মিষ্টি চেহারা। অনেকটা আশির দশকের সাড়া জাগানো সংগীতশিল্পী মিতালী মুখার্জীর মতন দেখতে ... পান পাতার মতো মুখে গড়ন।

তাতে বিধাতা ডাগর-ডাগর দুখানি চোখ বসিয়ে দিয়েছেন। পরে জানতে পারলাম মেয়েটি সমাজবিজ্ঞানে অনার্স পড়ছে । নাম? ধরা যাক: রূপসী বাংলা। রূপসী বাংলাকে দেখার পর থেকে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম। রাত কাটতে লাগল নির্ঘুম।

রূপসী বাংলাকে দেখার আগে আমি ছিলাম অজ্ঞেয়বাদী বা এগনোস্টিক! কিংবা বলা ভালো সংশয়বাদী। ঈশ্বরে অস্তিত্ব নেই, কিংবা ঈশ্বরের অস্তিত্ব থাকলেও সীমাবদ্ধ মানবমন তাকে জানতে পারে না-এমন একটা বদ্ধ বিশ্বাস আমার ভিতরে গড়ে উঠেছিল। এখন সে বিশ্বাসে ফাটল ধরল। সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে বাংলা-ইংরেজি বিজ্ঞানভিত্তিক অনেক বই পড়েছি। এতকাল জীবন আকস্মিক লাগছিল।

কিন্তু এখন ভাবতে লাগলাম জীবন আকস্মিক নয়। নইলে ওই অপরূপ মুখশ্রী কে গড়ল? ও মুখ তো আর মিছে নয়। কাজেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই, এ কথা বললে আমার মন আর সাড়া দেয় না। ক্লাসের আগে কিংবা ক্লাসের ফাঁকে কলাভবনের সামনের মাঠে রোদের ভিতর গোল হয়ে বসে আড্ডা দিতাম । রূপসী বাংলাও বসত, খানিকটা দূরে, গোল হয়ে সহপাঠীদের সঙ্গে।

আমি এমন ভাবে বসতাম যেন ঈশ্বরনির্মিত প্রতিমাটিরে দেখতে পাই। নীপা ছিল বেশ অর্ন্তজ্ঞানের অধিকারিনী। কী ভাবে যেন সব টের পেয়েছিল। নীপা আমাকে বলল, ইমন, দশটা টাকা দে না। দিলাম।

নীপা উঠে ঝাড়মুড়ি কিনল। তারপর, কী আশ্চর্য, রূপসী বাংলার পাশে গিয়ে বসল। একটু পর দেখি রূপসী বাংলা ঝালমুড়ি খাচ্ছে আর ডাগর-ডাগর চোখে আমাকে দেখছে। বাংলাদেশের মেয়েরা আসলেই ভীষণ ইনটিউটিভ! কদিন পর নীপাই আমার সঙ্গে রূপসী বাংলার পরিচয় করিয়ে দিল। আমাদের ইতিহাস বিভাগের করিডোরে এসেছিল রূপসী বাংলা ।

(আমি সিজোফ্রেনিয়ার ঘোরে ভাবছিলাম আমার খোঁজেই বুঝি এসেছিল!) আমাদের মৃদু পরিচয় হল বটে, তবে আমি রূপসী বাংলার কাছে ঘেঁষার চেষ্টা করিনি। ওরে দূর থেকেই দেখতাম। তার কারণ ছিল। আমার অতল অমীমাংশিত আচরণে প্রতি আমার ক্যাম্পাসের বন্ধুরা গভীর আকর্ষন বোধ করত। সর্বদা আমার আশপাশে ঘুরঘুর করত।

তাছাড়া আমি ছিলাম খানিকটা সহজ-সরল । বন্ধুদের বিশাল সার্কেল-এর চোখে ধুলো দিয়ে রূপসী বাংলার সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ার পদ্ধতি সম্পর্কে ছিলাম অজ্ঞাত । জানতাম যে একদিন অন্য কেউ এসে ছোঁ মেরে রূপসী বাংলাকে নিয়ে যাবে। নিয়ে যাক। তারপরও তো সব ফুরিয়ে যাবে না।

ততদিনে কবি ও ঔপন্যাসিক আনিসুল হকের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেছে আমার। সেই ৯২/৯৩ সালে সন্ধ্যের পর আমার ঘরেই বসত জমজমাট আড্ডা। সেই আড্ডায় ব্রাত্য রাইসু, আদিত্য কবির, হুমায়ূন রেজা, সাজ্জাদ কবির এরাও আসতেন। সেই সময় আনিসুল হক একটি হৃদয় বিদারক কবিতা লিখেছিলেন - বুকের মধ্যে অই মেয়েটির ছায়া/ ছায়ার মধ্যে অই মেয়েটি নেই! ... কবিদের এসব অর্ন্তজ্ঞানের কারণে আজও আমি প্রজ্ঞাবান কবিদের আশেপাশে ঘুরঘুর করি। কলাভবনের চারতলায় ছিল আর্ন্তজাতিক সম্পর্ক বিভাগ।

ও বিভাগে প্রায়ই যেতাম কবি আরমান আনোয়ার- এর আকর্ষনে । কেননা, কবি আরমান আনোয়ার লিখেছিল: ভরা নদী মরে গেছে / ক্যাকটাসে ভরে গেছে বন/ এইসব কেমন জীবন/ বিপরীত আশার মতো ভুল ট্রেন সিটি দিয়ে যায় ... কবি হুমায়ূন রেজা, ইশতিয়াক (আমার বাল্যবন্ধু) এরা সব আর্ন্তজাতিক সম্পর্ক বিভাগে পড়ত। হুমায়ূন রেজা “অর্জুন” নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করত। কবি আরমান আনোয়ারের বেদনালিপ্ত কবিতাটি ওই অর্জুন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। নাঃ, অর্জুনে আমার কোনও লেখা কখনও বের হয়নি।

আমার লেখা তখনও ঠিক সেভাবে জমাট বাধেনি। তবে আমার ভালো লাগত শিল্পের আশেপাশে থাকতে । যে কারণে আমার ঘরই হয়ে উঠেছিল হুমায়ূন রেজার অর্জুন পত্রিকার অফিস। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমার একটা মাত্র কবিতাই ছাপা হয়েছিল। সেই পত্রিকাটি কারা বের করেছিল আজ আমার আর মনে নেই ।

তবে প্রচ্ছদ শিল্পীর নাম দেখে যে চমকে উঠেছিলাম তা মনে আছে। মুসবা আমীন। আমার মেজোমামার (এ লেখার প্রারম্ভে যাঁর কথা উল্লেখ রয়েছে ...) বড় কন্যা। আর্ট কলেজে পড়ত। আশ্চর্য! জীবনে প্রথম একটা লেখা বেরুল আমার, যার প্রচ্ছদ কিনা আমারই এক বোনের।

কিন্তু এই কথাটা আমি আজও মুসবাকে বলেনি। কলাভবনের চারতলায় আর্ন্তজাতিক সম্পর্ক বিভাগের পাশে মেয়েদের ক্যান্টিন । রিফ্রেশ রুম। করিডোরে ছেলেরা দাঁড়িয়ে থাকত। চা খেত, সিগারেট টানত।

ওই করিডোরের আমি নাম দিয়েছিলাম ‘লোফারস কর্নার। ’ যাই হোক। মেয়েদের অনুরোধ করলে ভিতর থেকে চা সিঙাড়া এনে দিত। তারপর মুচকি হাসত। তো একদিন লোফারস কর্নারে আমি আর হুমায়ূন রেজা দাঁড়িয়ে আছি।

ভিতর থেকে রূপসী বাংলা বেরিয়ে এল। ডাগর ডাগর চোখে আমাকে দেখল । হাসল। ঘাড় সামান্য কাত করে জিগ্যেস করল, ভালো আছেন? উত্তরে শীতে- জমে-যাওয়া আমি কী বলেছিলাম আজ আর মনে নেই। খালি মনে আছে, আমি বরফের কুচির মতো গলে গলে ছড়িয়ে পড়ছিলাম।

হুমায়ূন রেজা ব্যাপরটা জানত। মিটমিট করে হাসছিল ও। ঘোরে র মধ্যে আমি বোধ হয় ভাবছিলাম, আমি খুঁজি আলটিমেট রিয়ালিটি। তার খোঁজ কি রূপসী বাংলার কাছে আছে? তাহলে? ও কেন প্রগাঢ়ভাবে পূজিত হবে? আমি খুঁজি আলটিমেট রিয়ালিটি। আমি তো ওর সামনে এভাবে নত হতে পারি না।

আমি অনাবাসিক ছাদ্র হলেও ছিলাম কবি জসীমউদ্দীন হলে অ্যাটাচ। ওই হলেই আবাসিক ছাত্র ছিল রঞ্জু । রঞ্জু রাজবাড়ির ছেলে। কতবার যে ওর সঙ্গে রাজবাড়ি গিয়েছি গ্রামীণ নির্জনতার টানে, নদী পদ্মার টানে। শীতকালে পদ্মার চরে বালির ওপর বহুক্ষণ শুয়ে থেকেছি, হেঁটেছি হিমহিম সন্ধ্যায়... কোনও কোনও দিন ক্লাসের পর সোজা জসীমউদ্দীন হলে চলে যেতাম।

ঢাকার কিছু ছেলে মফঃস্বলের ছেলেদের অবজ্ঞা করত। অথচ আমার মনে হত এই মফঃস্বলের ছেলেরা এক একজন এক একটা বই । নটছিটির কবির, রাজবাড়ির রঞ্জু, হবিগঞ্জের বকুল, কুমিল্লার তৈয়ব। রঞ্জুর রুমে বসেই আড্ডা মরাতাম। তাস খেলতাম।

রঞ্জু খিচুড়ি চাপিয়ে দিত। তখনকার দিনে গরুর গোশতের কেজি ছিল পঞ্চাশ টাকার মতো! (১৯৯১/৯২)। হল থেকে বাড়ি ফিরতে ফিরতে কখনও রাত নটাদশটা বেজে যেত। রাতে আমি আমার জগতে ডুবে যেতাম। সে জগতে ছিল বই আর গিটার।

রাত ১টা ২টা পর্যন্ত বই পড়তাম। যাদের সঙ্গে সারাদিন কাটাতাম তাদের সঙ্গে আমার এই একান্ত জগতের কোনও সম্পর্ক ছিল না । আমি যে নিজেকে বদলে ফেলছিলাম ধীরে ধীরে তা কিন্তু কারও চোখেই পড়ত না। আমি তখনই জানতাম যে আমি একদিন খুব নিঃসঙ্গ হয়ে যাব। কারণ আমি অন্বেষন করি আলটিমেট রিয়েলিটি ... আমার আতীব্র জ্ঞানতৃষ্ণার জন্যই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থগারটি ছিল আমার জ্ঞানপীঠ।

তবে লাইব্রেরিতে বসে নির্জনে জুতমতো পড়তে পারতাম না। তার কারণ, আমি লাইব্রেরিতে গেলেও আমার ক্যাম্পাসের বন্ধুরা আমায় ঘিরে ভিড় জমাত। তারা অনেকেই আমার আশেপাশের টেবিলে বসে থাকত। তখন আমি হয়তো মায়া কিংবা অ্যাজটেক সভ্যতা উপর ঢাউশ একখানি বই খুলে কনসেনট্রেট করার চেষ্টা করছি। আমার টেবিলের আশেপাশে অ-পড়ুয়ারা সব উশখুশ করত।

আমারও সে সময় সিগারেট খাওয়ার প্রবল নেশা ছিল। নীচেই লাইব্রেরি সামনে বিখ্যাত হাকিম চত্তর। হয়তো চা খেতে নেমেছি। রেজিষ্টার বিল্ডিংয়ের দিক থেকে ধুম ধুম বোমার আওয়াজ শোনা গেল। গা বাঁচাতে আমরা যে যেদিকে পারি দৌড় ... সেসব দিনে ক্যাম্পাসে বিনা নোটিশে গোলাগুলি শুরু হয়ে যেত ।

১৯৯০ সালের আগে যারা একসঙ্গে স্বৈরাচার বিরোধী সফল আন্দোলন করেছিল, সংঘাত চলত তাদের মধ্যেই । প্রচন্ড শব্দে আতঙ্কিত ছাত্রছাত্রীরা এদিক-সেদিক দৌড়াত। পুলিশও অ্যাকশন নিত। একবার ইতিহাস বিভাগের করিডোরে টিয়ার গ্যাসের শেল এসে পড়েছিল। প্রচন্ড ধোঁয়ার মধ্যে আমার চৈতন্য লোপ পেয়ে যায় আর কী।

প্রচন্ড শ্বাসকষ্ঠ হচ্ছিল। কোনওমতে চেয়ারম্যানের ঘরে ঢুকে রক্ষা পাই। ইতিহাস বিভাগের চেয়ারম্যান তখন সৈয়দ আনোয়ার হোসেন। ( বর্তমানে ইংরেজি দৈনিক সান পত্রিকার সম্পাদক) ... আনোয়ার স্যার মেঝের ওপর উবু হয়ে বসে আছেন। আমরাও।

আনোয়ার স্যার চমৎকার করে কথা বলতে-বলতে মিটমিট করে হাসেন। বাইরে প্রচন্ড গোলাগুলি । তা সত্ত্বেও স্যারের হাসিটি ম্লান হয়নি। আসলে আমি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ক্লাসের চেয়ে ক্লাসের বাইরে শিখছিলাম বেশি। ও, হ্যাঁ।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বিপদেও কম পড়িনি। একবার। পিকনিকের তারিখ নির্ধারণ নিয়ে গন্ডগোল বেঁধে গেল। যারা তারিখ নির্ধারণ করেছিল তারা ছিল সরকারি দলের সমর্থক। ওদের চোটপাট ছিল বেশি।

কিন্তু ওই নির্ধারিত তারিখে পিকনিকে যেতে অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীই আপত্তি করেছিল। আমিও অনেকটা বেপরোয়া হয়েই ছাত্রছাত্রীদের পক্ষ নিলাম। কাজেই সরকারপক্ষীয়রা আমার বিরুদ্ধে ক্ষেপে উঠল। তখন সরকারী দলের ক্যাডার ছিল হেমায়েৎ (নামটা গোপন রাখলাম) । বিশ্ববিদ্যালয়ের মূর্তিমান ত্রাস ।

ওই বেপরোয়া তরুণটির চারপাশে অস্রের ঝনঝনানি। আমার ক্লাসমেটরা হেমায়েৎ-এর কাছে আমার নামে রিপোর্ট করে। আমি এত কিছু জানতাম না। ক্লাস শেষে সোজা বাসায় চলে গিয়েছিলাম। ভাগ্যিস! পরের দিন সকালে ইতিহাস বিভাগের করিডোরের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।

আমায় দেখেই জড়িয়ে ধরল বাবু । বাবু আমার ক্লাসমেট; সূর্যসেন হলে থাকে । পলিটিক্স করলেও সব দলের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো। আমাকে জড়িয়ে ধরে বাবু অবরুদ্ধ কন্ঠস্বরে বলল, আরে হেমায়েৎ তোরে গুলি করত জুবায়ের। সূর্যসেন হলে বইসা রাত দুইটা পর্যন্ত কত বুঝাইলাম ।

পরে হেমায়েৎ কয়, ইমনের পায়ে গুলি করব। তারপরও কত বুঝাইলাম। শেষে হে কইল, আচ্ছা যা গুলি করুম না ... আমি ক্রোধ টের পাই! সামান্য ঘটনা। তুচ্ছ পিকনিকের ডেট। এতেই সশন্ত্র ক্যাডার ডেকে এনেছে।

এই দেশের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে ঘোর সন্দিহান হয়ে উঠি! আর এটাও বলা জরুরি যে- আমার জীবনে বারবার বাবুদের মতো পরোপকারী মানুষ আমার পাশে এসে যথা সময়ে দাঁড়িয়েছে। এই ঘটনার তিন দিন পর সকাল বেলায় গোলাগুলির সময় ভাষা ইনসটিটিউট-এর সামনে হেমায়েৎ প্রতিপক্ষের গুলিতে মারা যায়! হেমায়েৎ যে আমায় গুলি করতে চেয়েছিল সেটা ক্যাম্পাসের অনেকেই জানত। যে কারণে হেমায়েৎ নিহত হওয়ার পর পরই আমাকে ঘিরে ক্যাম্পাসে এক ধরণের অলৌকিক গুঞ্জন ছড়ায়। আমাকে জড়িয়ে এক ধরণের দিব্য মাহাত্ম্য ছড়ায়। তবে আমি একে দৈব ঘটনাই বলতে চাই।

তবে এর চেয়েও গভীর এক দৈব ঘটনা ঘটেছিল। যার ব্যাখ্যা আমি আজও পাইনি। ...আমার এক ক্লাসমেট। নাম আবির (ছদ্মনাম) । ফাস্ট ইয়ারে আবিরের সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক ছিল।

পরে নানা কারণে সেটি ছিন্ন হয়ে যায়। আবির ওর জন্মদিনে সহপাঠীদের নীরব হোটেলে খাওয়াবে। আমাকে এড়িয়ে গেল। আমি কলাভবনের সিঁড়িতে বসে আছি। বিপর্যস্ত বোধ করছি।

সহপাঠিরা একে-একে রিকশায় উঠছে। আমি সিঁড়িতে বসে সিগারেট টানছি। অপমান বোধ করছি। এরপর আর আবিরের সঙ্গে আমার সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়নি। ... ১৯৯৫ সাল।

১৭ জানুয়ারি। ক্লাসমেট বীথির জন্মদিন। দুপুরে নীরবে খাওয়ার পর বুড়িগঙ্গায় নৌকা ভ্রমন। নৌকায় আবির আমার সামনে বসেছিল। হঠাৎ আবিরের হাতের করতলে আমার চোখ আটকে গেল।

আয়ূ রেখা অর্ধেক। অনেক শাস্ত্রের মতো হস্তরেখা সর্ম্পকেও আমার প্রাথমিক ধারণা ছিল। আয়ূ রেখা অর্ধেক মানে তো ... আবির কি অচিরেই মারা যাবে? না, তা কি করে হয়? আমি আর যাই বিশ্বাস করি, হস্তরেখায় তো বিশ্বাস করি না! এর ঠিক ৫ বছর পর, অর্থাৎ, ২০০০ সালে এক ভয়াবহ দূর্ঘটনায় আবিরের মৃত্যুর সংবাদ পেলাম। গভীর বিস্ময়ে স্তব্দ হয়ে গিয়েছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আনন্দ আর উত্তেজনাময় দিনগুলি কী ভাবে যেন কেটে গেল ... কখন যে ফুরুৎ করে স্বপ্নময় সোনালি দিনগুলি শেষ হয়ে গেল! ১৯৯৫ সালের মাঝামাঝি এম. এ পরীক্ষা শেষ হল।

মৌখিক পরীক্ষার দিন ঘামছিলাম খুব। পরীক্ষক এসেছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তিনি আমাকে সস্নেহে জিগ্যেস করলেন: শরীর খারাপ লাগছে কি? উত্তরে ম্লান হেসেছিলাম শুধু ... এই লেখার জন্য আমি এই মুহূর্তে ঠিক মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম না। ব্লগার নিদাল- এর অনুরোধেই লিখলাম । কারও কারও অনুরোধ তো উপেক্ষা করা যায় না।

নিদাল তাদেরই একজন। নিদাল নব্বুয়ের দশকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। লেখাটা সেরকম হল না মোটেও। খালি খালি নিজের ঢোলই পিটালাম ...আমার মনের এই বক্রগতির স্বভাবের জন্য আমি না হতে পারলাম লেখক, না হতে পারলাম ঐতিহাসিক ... ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।