আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আল্লামা শফীর ভিডিও বিতর্ক : নর্তকীর আস্ফালনে দোলে বাঙলার মসনদ

একদিন তুমি ডাক দেবে, আমি প্রতীক্ষায় আছি এক. ‘শফী সাহেব হুজুরের এই ওয়াজটি আমি দুই-তিন বছর আগে চট্টগ্রামের কোথাও রেকর্ড করেছিলাম। কোথায় করেছিলাম, সেটি এখন আর মনে নেই। কারণ প্রতিবছর হুজুর শত শত স্থানে ওয়াজ করেন। আমি চেষ্টা করি হুজুরের সব বক্তব্য রেকর্ড করতে। আমি হুজুরের প্রায় প্রতিটি ওয়াজেই উপস্থিত থাকি।

কিন্তু বিগত দুই-এক বছরে যে এ বক্তব্য রেকর্ড করিনি, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। করলে আমার মনে থাকতো। ’ ‘হুজুরের বক্তব্য নিয়ে সম্প্রতি যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, এটা সুপরিকল্পিত একটি অপপ্রচার। হুজুর আমাদের চট্টগ্রামের সব মানুষের মুরব্বি, সবার অভিভাবকের মতো। তিনি সাধারণ মানুষকে ধর্ম সম্পর্কে বুঝাতে গিয়ে নানা সময় নানা আঙ্গিকে কথা বলেন।

আমরাই দেখেছি, তিনি ৬০-৭০ বছরের বৃদ্ধমানুষকে সবার সামনে গালমন্দ করেন। সমাজের অনেক বড় বড় ব্যক্তি, ব্যবসায়ী, শিক্ষিত মানুষকেও তিনি এভাবে বকাঝকা করেন- আপনার বাড়িতে গান-বাজনা চলে কেনো? আপনার ছেলে নাকি নেশা করে? আপনার ঘরে নাকি পর্দা নাই? এমন বিষয়ে তিনি সবসময়ই সবাইকে সতর্ক করেন, উপদেশ দেন। তারা হুজুরের সামনে তার কথার প্রতিবাদ করা তো দূরের কথা বরং মাথা নিচু করে বসে থাকেন, নিচুস্বরে হাসেন। এলাকার মানুষের প্রতি ভালোবাসা থেকেই তিনি এমনটা করেন। এলাকার মানুষও বিনা বাক্যব্যয়ে হুজুরের কথা মেনে নেন।

’ ‘এই ওয়াজটি তিনি কোনো একটি গ্রাম্য মাহফিলে দিয়েছিলেন সম্ভবত। গ্রামের মানুষের জন্য হুজুর সাধারণত চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় ওয়াজ করেন এবং এমন সব উপমা দিয়ে তাদের বুঝাতে চেষ্টা করেন যেগুলো দিয়ে গ্রামের সাধারণ মানুষ সহজেই বুঝতে পারেন। আমার মনে হয়, তিনি যা বলেছেন তাতে নারীদের মোটেও অসম্মান করা হয়নি, বরং নারীদের সম্মানকে আরো বাড়ানো হয়েছে। এতোদিন আগের একটি ওয়াজকে এখন মানুষের সামনে উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রচার করে ফায়দা ওঠানো নাস্তিকদের কারসাজি ছাড়া আর কিছু নয়। ’ ইয়ার আহমদ, স্বত্বাধিকারী আল আরব এন্টারপ্রাইজ, হাটহাজারী মাদরাসা মার্কেট, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

আল্লামা আহমদ শফীর বক্তব্য বা ওয়াজগুলো সাধারণত আল আরব এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী ইয়ার আহমদ রেকর্ড করে থাকেন এবং আলোচিত ওয়াজটিও আল আরব এন্টারপ্রাইজ কর্তৃক রেকর্ডকৃত ও বাজারজাতকৃত। উপর্যুক্ত বক্তব্যটি আল আরব এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী ইয়ার আহমদের। দুই. ইয়ার আহমদের বক্তব্যের রেশ ধরে আমরা কয়েকটি বিষয়কে আলোচনার টেবিলে টেনে আনতে পারি। প্রথম কথা হলো, আল আরব এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী ইয়ার আহমদের বক্তব্য অনুযায়ী বক্তব্যটি কম হলেও দুই বছর আগের কোনো এক ওয়াজ মাহফিলের। দুই বছর আগের একটি বক্তব্যকে কেনো আমাদের চতুর মিডিয়া হঠাৎ করেই সামনে নিয়ে এলো? দ্বিতীয় কথা হলো, বিশেষ অপপ্রচারের জন্য আমাদের মিডিয়া যখন এই ইস্যুটি সামনে নিয়েই এলো, কেনো তারা এটিকে আল্লামা আহমদ শফীর সাম্প্রতিক বক্তব্য বলে চালিয়ে দিলো? দুই বছর সময়কে কি কেউ সাম্প্রতিক বলে? কোনো কোনো সংবাদমাধ্যমে এই বক্তব্যকে ‘কয়েকদিন’ আগের বলে চালিয়ে দেয়া হয়েছে।

একটি জনপ্রিয় অনলাইন সংবাদমাধ্যম বক্তব্যটিকে ৮ জুলাই হাটহাজারীতে দেয়া আল্লামা শফীর বক্তব্য বলে প্রচার করেছে। অথচ আল্লামা শফী জুলাইয়ের প্রথম থেকেই উমরার উদ্দেশে সৌদি আরব অবস্থান করছেন। তবে কেনো মিডিয়ার এই নির্জলা মিথ্যাচার? তৃতীয় কথা হলো, আল্লামা শফী বক্তব্য দিলেন অথচ তার সামনে উপস্থিত শ্রোতারা কেউ প্রতিবাদ করলো না। এক বছর গেলো, দুই বছর গেলো কিন্তু কোথাও কোনো প্রতিবাদ হলো না; একজন নারীও সরব হলেন না তার ‘অপমানের’ প্রতিশোধ নিতে। অথচ দুই বছর পর তার সেই বক্তব্য নিয়ে হঠাৎ করেই আমাদের মিডিয়া সরব হয়ে ওঠলো।

কতিপয় নারীনেত্রী আর ধাপ্পাবাজ রাজনৈতিক নেতার শরীরে আগুন ধরে গেলো- জাত গেলো জাত গেলো বলে। অথচ সরাসরি যাদের সামনে বললেন তাদের গায়ে আগুন লাগলো না, তাদের মা-বোনের ইজ্জত গেলো না; ইজ্জত গেলো আমাদের প্রধানমন্ত্রীর। তাও তিন বছর পর! বাঙালি নারীর ইজ্জত কি এতোই সস্তা? তিন বছর পর তার ইজ্জত ঢাকার জন্য আমাদের প্রধানমন্ত্রী আর তার হায়ার করা নারীনেত্রীদের টনক নড়লো! তবে কি বাঙালি নারীরা এতোদিন আব্রুহীন হয়ে পথেঘাটে পড়ে ছিলেন? আল্লামা শফী যেসব বক্তব্য দিয়েছেন, তার বক্তব্যের ফলে কোনো নারী কি ধর্ষণের স্বীকার হবেন? কোনো নারী কি স্বামীর দ্বারা নির্যাতিত হবেন? কোনো নারী কি যৌতুকের মতো অভিশাপের স্বীকার হবেন? কোনো নারী কি কর্মস্থলে তার সহকর্মীর হাতে যৌনাক্রান্ত হবেন? স্কুল-কলেজে কি এর দ্বারা ইভটিজিং বেড়ে যাবে? এর প্রত্যেকটার উত্তরই হবে ‘না’। তাহলে তার বক্তব্যে যদি এতোসব উপকারিতা থেকে থাকে তবে কোন অমৃত সুধার তালাশে আমাদের তথাকথিত নারীনেত্রীরা ১৮ জনের মানববন্ধন নিয়ে প্রেসক্লাবের সামনে দাঁড়ান? আর আমাদের বেহায়া মিডিয়াগুলো কীভাবে সেই ১৮জনের মানববন্ধনের ছবি প্রথম পাতায় ছাপতে পারে? ১৮জনের জনসমর্থনই কি দেশের ১৭ কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে? তিন. কী কারণে দোষ ধরা হয় আল্লামা আহমদ শফীর? তিনি নারীকে ঘরে সুরক্ষিত থাকতে বলেছেন, তাকে অনর্থক বাইরে বেরুতে নিষেধ করেছেন, তাকে ভিন্নপুরুষের সঙ্গে চলতে নিষেধ করেছেন, চাকরিতে, স্কুল-কলেজে, ছেলেদের সঙ্গে উন্মুক্তভাবে মিশতে নিষেধ করেছেন। একজন মেয়ের জন্য এটা কি অপমানসূচক উপদেশ? তিনি মেয়ের বাবাকে বলেছেন মেয়ের খোঁজ নিতে, মেয়ে চাকরির নামে অন্য ছেলের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে কী-না, স্কুলের নামে পার্কে বসে আড্ডা দিচ্ছে কী-না, সে যা উপার্জন করছে সেগুলো হালাল কী-না এসব বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলেছেন।

এগুলো একজন অভিভাবককে পরামর্শ দেয়াটা কি মানবতাবিরোধী কাজ? বরং এটা কুরআনের সরাসরি নির্দেশ। কুরআনে এসেছে- ‘(নারীরা!) তোমরা গৃহাভ্যন্তরে অবস্থান করবে এবং মূর্খতা যুগের (আইয়্যামে জাহিলিয়ার) অনুরূপ নিজেদেরকে প্রদর্শন করবে না। ’ (৩৩:৩৩) এর আগের আয়াতে বলা হয়েছে- ‘যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, তবে পরপুরুষের সঙ্গে কোমল ও আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে কথা বলো না। ফলে সেই ব্যক্তি কুবাসনা করে, যার অন্তরে ব্যধি রয়েছে। তোমরা সংযত কথাবার্তা বলবে।

’ (৩৩:৩২) বাংলাদেশে গ্রামে-গঞ্জে ওয়াজ-মাহফিল একটি অতি সাধারণ বিষয়। সেসব ওয়াজে নারী-পুরুষের পরস্পরে সম্পর্ক, স্বামী-স্ত্রীর অধিকার, ছেলে-মেয়ের প্রতি আচরণ, পিতা-মাতার মর্যাদা বিষয়ে খুব সাধারণ ভাষায় বক্তব্য রাখেন ধর্মীয় বক্তারা। সেখানে শুধু তেঁতুল নয়, আগ্রহী শ্রোতাদের বুঝাতে মুরগি-ডিম, চোর-ডাকাত, স্বামী-স্ত্রী, ঢাকা-বাগদাদ এমন নানা ধরনের উপমার অবতারণা করেন বক্তারা। এটা গ্রামীণ ওয়াজে খুবই প্রচলিত একটি টার্ম। এমনকি গ্রামের মাহফিলে সেই বক্তাকেই বেশি তোয়াজ করা হয়, যে যতো বেশি বিভিন্ন ধরনের উপমা ব্যবহার করতে পারেন।

সেখানে তেঁতুল উপমা অতি সাধারণ গোছের একটি উপমা ছাড়া আর কিছুই নয়। সুতরাং শহরের ওয়াজ না শোনা সুশীলব্যক্তিরা যখন এইসব গ্রাম্য উপমা আর গ্রামীণ দরদমাখা কথাবার্তা শুনেন তখন মনে করেন, এটা গালিবিশেষ, অতি করুচিপূর্ণ বক্তব্য। আল্লামা শফীও সমাজে নারীর অবমূল্যায়ন এবং অবমাননা রুখতে সাধারণ গ্রাম্য ভাষায় বিষয়টি প্রতিহত করতে সবার প্রতি আহবান জানিয়েছেন মাত্র। এখন শহরের আধুনিক মানুষরা যদি গ্রাম্য ভাষাকে গালি মনে করে আল্লামা শফীকে অপরাধী ঠাওরান, তাহলে দোষটা আসলে কার, সেটা বিবেচনার দাবি রাখে। আবার আল্লামা শফীর বক্তব্য আমাদের মিডিয়ায় আংশিকভাবে বিবৃত হয়েছে।

তিনি নারীদের ঘরের বাইরে না যাওয়ার ব্যাপারে বলার আগে বলেছেন, নারীরা ঘরের রাণী। আপানারা কেনো বাইরে যাবেন? আপনার বাবা, স্বামী, ছেলেকে বলুন আপনার কী দরকার। তারা আপনাকে এনে দেবে। আপনি শুধু ঘরে বসে আরাম-আয়েশ করবেন। সুতরাং আল্লামা শফী দোষটা করলেন কোথায়? আমাদের সমাজব্যবস্থাটা তো তার বক্তব্যের চেয়ে খুব বেশি ভিন্ন নয়।

কিছুদিন আগে আইসিডিডিআরবি একটি জরিপ করেছে, যাতে বলা হয়েছে, দেশে ১৮ বছরের আগেই অন্তত ৫০ ভাগ শহুরে তরুণ-তরুণী যৌন অভিজ্ঞতা নিচ্ছে। এরা পরোক্ষভাবে প্ররোচিত হয়ে এমনটা করছে। এদের এক-তৃতীয়াংশ আবার গ্রুপ সেক্সে (দলগত যৌনকর্ম) জড়িয়ে পড়ছে। আইসিডিডিআরবি তাদের প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করেছে, ১১ থেকে ১৪ বছর বয়সী তরুণেরা যৌনকর্মে লিপ্ত হচ্ছে পর্নোগ্রাফি দেখে। গত বছর সময় টিভি থেকে করা এক জরিপে ওঠে এসেছে আরও ভয়াবহ তথ্য।

তারা রাজধানী ঢাকার বেশ কয়েকটি স্কুল ঘুরে জানতে পারেন, স্কুলের ৮২% ছাত্র-ছাত্রী সুযোগ পেলেই মোবাইলে পর্নোগ্রাফি দেখে। ঢাকা শহরের ৬২% স্কুলপড়–য়া ক্লাসে বসেই পর্নোছবি দেখে। ৪৪% প্রেম করার জন্য মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। আর স্কুলপড়–য়া মেয়েরা মনে করে, তার একটা বয়ফ্রেন্ড থাকতেই হবে, না হলে সে স্মার্ট না। একাধিক বয়ফ্রেন্ড থাকাটাও একটা ক্রেডিটের ব্যাপার মনে করে তারা।

মনে রাখতে হবে, এটা কিন্তু কলেজ-ভার্সিটি বা সাধারণ নারীদের ওপর জরিপ নয়, এটা স্কুলের মেয়েদের ওপর করা জরিপ। যারা এখন এসএসসির নিচে অধ্যয়নরত এবং তাদের কারোরই বয়স ১৬-১৭-এর ওপরে নয়। তো আমাদের সুশীল নারীনেত্রী আর সংসদ সদস্যরা এই বাস্তবতায় নিজেদের অবস্থান কোথায় তুলবেন? সমাজ যেখানে চাক্ষুষ পাপাচারে লিপ্ত হচ্ছে, মেয়েরা যখন ইচ্ছা-অনিচ্ছায় সর্বক্ষেত্রে যৌনতার মতো ভয়াবহ ব্যধিতে আক্রান্ত, সেখানে আল্লামা শফীর এই সহজকথন কেনো তাদের গায়ে কাঁটা দেয়? তিনি বিষয়গুলো সহজ আর সরলভাষায় বলেছেন বলেই কি তিনি এতোটা প্রশ্নবাণের স্বীকার হয়েছেন? নাকি এসব কথা বলে মানুষকে সচেতন করলে অনেকেরই ভোগবাদী চরিত্র খসে পড়ার ভয় আছে? চার. নারীকে দেখলে পুরুষের কামভাব জাগবে, এতে অবাক হওয়ার কী আছে? এটার মধ্যে রুচি-কুরুচির কী আছে? এটা আদম থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ের প্রতিটি পুরুষের বেলায়ই প্রযোজ্য। বিগত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েড ব্যাপারটি অত্যন্ত সহজ সাবলীল ভাষায় বলেছেন, ‘কামভাবটা নারী-পুরুষের একটা স্বাভাবিক প্রবৃত্তি (ন্যাচারাল টেনডেন্সি) এবং এর অনুপস্থিতি ঘটলে কোনো নারী কিংবা পুরুষ স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে না। ’ -Three contributions to the theory of sex নারীদের ব্যাপারেও ফ্রয়েড অত্যন্ত চমৎকার কথা বলেছেন- The great question that has never been answered, and which I have not yet been able to answer, despite my thirty years of research into the feminine soul, is 'What does a woman want? -From Sigmund Freud: Life and Work by Ernest Jones, 1953 সিগমুন্ড ফ্রয়েডকে বলা হয় আধুনিক মনোবীক্ষণের জনক।

তিনিই নারী-পুরুষের যৌনতার ব্যাপারে এভাবে খোলাখুলি মন্তব্য করেছেন এবং মোটাদাগে বলে দিয়েছেন, নারীর প্রতি পুরুষের আকর্ষণ থাকবেই- এটা সতঃসিদ্ধ বিষয়। সেটা স্কুল হোক, কলেজ হোক, চাকরি কিংবা পথেঘাটে হোক; নারীর প্রতি পুরুষের আকর্ষণ অনস্বীকার্য। সেই হিসেবে আল্লামা আহমদ শফী কুরআন-হাদিসের আদেশ-নিষেধকে উপমার ভঙ্গিমায় বলেছেন। তার উপমা এবং সোজা-সাপ্টা কথা যদি কারো আঁতে ঘা লাগে তাহলে সেটা যার যার ব্যক্তিগত বিষয়। সেটা নিয়ে রাজনৈতিক ইস্যু তৈরি করা মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ নয়।

কারণ প্রধানমন্ত্রীর স্মরণ রাখা উচিত, হেফাজতে ইসলামের ক্ষত এতো তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যাবে না। আমাদের প্রধানমন্ত্রীও বড় গুণী মানুষ। কুরআন-হাদিসের উদ্ধৃতি দিতে তার জুড়ি মেলা ভার। এই কারণেই তার কাছের নেতাকর্মীরা প্রায়ই ভয়ে থাকেনÑ কখন নেত্রীর জবান খুলে যায়! আল্লামা শফীকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মন্তব্য করেছেন, ‘নবীজির স্ত্রী ব্যবসা করতেন। তিনি তার স্ত্রীকে ব্যবসা করতে বারণ করেননি।

তাছাড়া নবীজি জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রয়োজনে সুদূর চীন দেশেও যেতে বলেছেন। সেখানে তিনি নারী বা পুরুষ আলাদা করে বলেননি। ’ আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে কে বুঝাবে, রাসুলের স্ত্রী খাদিজা যখন ব্যবসা করতেন তখন আমাদের নবী নবীই হননি। তিনি নবী হওয়ার পর যখন খাদিজা মুসলমান হন, তৎপরবর্তী সময়ে তিনি ইসলামের কোন আদেশ-নিষেধটা অমান্য করেছেন, এটা প্রধানমন্ত্রীকে কে জানাবে? তাছাড়া তিনি চীন দেশে জ্ঞানার্জনে যাওয়ার যে বাণী দিলেন সেটা আদতে কোনো হাদিসই নয়, এটা জাল হাদিস বা সাধারণ আরবি প্রবাদ। আরও অবাক করার মতো বিষয় হলো, আল্লামা শফীর ব্যাপারে রোকেয়া প্রাচীসহ কতিপয় নট-নটী অভিযোগ করেছেন, তিনি নাকি ধর্মের অপব্যাখ্যা করছেন।

কি আজিব কথা! তিনি ৭০ বছর বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ মাদরাসায় শিক্ষাদান করে কুরআন-হাদিসের অপব্যাখ্যা করেন, আর রোকেয়া প্রাচী এবং তার মতো সুবিধাভোগী নারীনেত্রীরা দেশবাসীকে ইসলামের বিধি-বিধান শিক্ষা দেন! এর চেয়ে বড় কৌতুক আর কী হতে পারে!! দেশবাসী সবচেয়ে অবাক হয়েছে রোকেয়া প্রাচীর আস্ফালিত বক্তব্য শুনে। যাকে নাটক-সিনেমায় সাধারণত পতিতার চরিত্রে নির্বাচন করা হয়, কারণ তিনি এই রোলে সবচেয়ে বেশি মানানসই। তিনি ৭০ বছর হাদিস শিক্ষাদানকারী আলেমকে বললেন, আপনি তওবা করুন। লও ঠ্যালা! একজন পতিতা চরিত্রের অভিনেত্রী, যার দুই স্বামী বিগত হয়েছেন, তিনি নব্বুইঊর্ধ্ব দেশবরেণ্য এক আলেমকে বলছেন, আপনি তওবা করুন! দেশবাসী তো শঙ্কায় আছে, কবে যেনো তারা বলবেন- পতিতালয় ছাড়া নামাজ সহিহ হবে না। আল্লামা শফীর বক্তব্য যদি ধর্মের অপব্যাখ্যাই হতো তাহলে একজন ধর্মবেত্তা, আলেম, পীর-মাশায়েখ অন্তত তার এই বক্তব্যের প্রতিবাদ করতেন।

কিন্তু তার এই পুরনো ভিডিও প্রকাশ পাওয়ার পর একজন আলেম বা মাদরাসাশিক্ষকও প্রতিবাদ করেননি। পাঁচ. ‘পুরুষ প্রভু, নারী দাসী। ’ -এ্যারিস্টটল ‘পুরুষ হচ্ছে অনিবার্য, অপরিহার্য, অবধারিত; আর নারী হচ্ছে আকস্মিক, অপ্রয়োজনীয়, অতিরিক্ত। ’ -মিশেল ‘নারী ভূমি, নারী উর্বর, তবে ওই উর্বরতা সৃষ্টিশীল নয়, তাকে সৃষ্টশীল করে পুরুষ। -হিপক্রিটাস ‘রয়েছে এক শুভ নীতি যা সৃষ্টি করেছে শৃঙ্খলা, আলোক ও পুরুষ, রয়েছে এক অশুভ নীতি যা সৃষ্টি করেছে বিশৃঙ্খলা, অন্ধকার ও নারী।

’ -পিথাগোরাস ‘নারী এমন এক রাজ্য যাকে শুধু জয় করলেই হবে না, সম্পূর্ণরূপে পরাভূত, পর্যদুস্ত আর পদদলিত করতে হবে, যেনো সে ল-ভ- হয়ে যায়। ’ -নেপোলিয়ন ‘নারীর জন্মই হয়েছে পুরুষাধীন থাকার জন্য, তাকে চিরকাল তাই থাকতে দাও। ’ -রুশো ‘পুরুষ প্রভু, নারী তার সেবিকা; গৃহে থাকা, সংসার করা, পুরুষের সেবা করাই নারীর প্রকৃত স্থান ও শক্তি। ’ -রাসকিন নারী ভালোবাসার জন্য, জানার জন্য নয়। -অস্কার ওয়াইল্ড নারী একই সঙ্গে একটি আপেল ও সাপ।

-হেনরিক হাইনে কোলে থাকিলেও নারী, রেখো সাবধানে শাস্ত্র, নৃপ, নারী কভু বশ নাহি মানে। -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নারী কভু নাহি চায় একা হতে কারো এরা দেবী এরা লোভী যত পূজা পায় এরা চায় তত আরো ইহাদের অতিলোভী মন একজনে তৃপ্ত নয়, এক পেয়ে সুখী নয় যাচে বহুজন। -কাজী নজরুল ইসলাম আমরা জানি, এ্যারিস্টটল, পিথাগোরাস, রুশো, রবি ঠাকুর যা বলে গেছেন নারী সম্বন্ধে- তা মিথ্যে। অন্তত আমাদের তাই মানতে হবে। তারা তাদের গভীর জীবনবোধ এবং দৃষ্টির তীক্ষ্মতা দিয়ে নারীকে যতোটুকু মাপতে পেরেছেন, আল্লামা শফী সমাজে নারীদের কার্যকারিতা মাপতে জীবনবোধের গভীরতা ততোটা বুঝতে পারেননি।

আর তাতেই গোল বেঁধেছে সংসদ থেকে চায়ের দোকানে। জার্মান বিজ্ঞজন হেনরিক হাইনে নারীকে সাপ বললে সেটি হয়ে যায় ‘বাণী চিরন্তন’, আর আল্লামা শফী নারীকে ‘তেঁতুল’-এর সঙ্গে সাযুজ্য দিলে সেটি হয়ে যায় অশ্লীল-কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য। ব্রিটিশ চিত্রশিল্পী রাসকিন নারীকে পুরুষের সেবিকা বললে, তাকে গৃহকোণের আলোকবর্তিকা বললেও তিনি পূজনীয়, পক্ষান্তরে আল্লামা শফী তাকে গৃহের রাণী বললে তিনি হয়ে যান নারীবিদ্বেষী। কাজী নজরুল নারীকে অতিলোভী বলতে পারলেন, আর আল্লামা শফী হয়ে গেলেন নারী অবমাননাকারী। কথাসাহিত্যিক হাসানাত আবদুল হাই শাহবাগের কোনো এক নারীর দেহদানের ফিরিস্তি লিখলেই সেটি হয়ে যায় নারীর অবমাননা, কিন্তু সৈয়দ শামছুল হক, আল মাহমুদ, নির্মলেন্দু গুণ, হুমায়ুন আজাদ, হেলাল হাফিজরা যখন নারীর বিভিন্ন অঙ্গসৌষ্ঠবের আকার, ধরন, বর্ণ, উপকারিতা নিয়ে সাহিত্যের তুবড়ি ছোটান তখন সেটি তারানা হালিমদের কাছে হয়ে যায় উপাসনার বিষয়।

যদি নিদেনপক্ষে বাংলা সাহিত্যের দিকেও দেখা হয় তবে সেখানে নারীকে নিয়ে নামী আর বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিকদের এমনসব পঙক্তি আর লেখা পাওয়া যাবে যেগুলো সাধারণ ভদ্রসমাজে পাঠের উপযোগী নয়। তবুও যতোটুকু ভদ্র জিনিস উপস্থিত করা যায় ঠিক ততোখানিই আমাদের কুলীন সুশীল সমাজের সুরচিকর সাহিত্যপ্রতিভা তুলে ধরা হলো। ব্যথাতুর প্রেমের কবি নির্মলেন্দু গুণ তার ‘স্ত্রী’ কবিতায় স্ত্রীকে ভালোবাসা শিখিয়েছেন এই ভাষায়- রান্নাঘর থেকে টেনে এনে স্তনগুচ্ছে চুমু খাও তাকে/বাথরুমে ভেজানো দরোজা ঠেলে অনায়াসে ঢুকে যাও-/সে যেখানে নগ্ন দেহে স্নানার্থেই তৈরি হয়ে আছে আল মাহমুদের ‘সোনালী কাবিনে’ তিনি উদারহস্তে ঢেলেছেন নারীর প্রতি তার ‘সুরুচি’র বাহাদুরি- ‘তারপর তুলতে চাও কামের প্রসঙ্গ যদি নারী/খেতের আড়ালে এসে নগ্ন করো যৌবন জরদ/শস্যের সপক্ষে থেকে যতটুকু অনুরাগ পারি/তারো বেশী ঢেলে দেবো আন্তরিক রতির দরদ। (সনেট ১০ : সোনালি কাবিন) কবি ও লেখক সৈয়দ শামছুল হক আল্লামা শফীর সমালোচনায় বিবৃতি দেয়া ১৭জন বিশিষ্টজনের মধ্যে একজন। তার লেখাজোখা নিয়ে কথা বলতেও বিবাহিত হতে হয়।

অবিবাহিতদের জন্য সাধারণত তার রচনা পড়া নিষিদ্ধ। তিনি প্রাপ্তবয়স্কদের লেখক। দেখুন তার অ্যাডাল্ট কবিতা- শত বাধা সত্ত্বেও থামতে পারে না কামুক পুরুষ/দুজনের দেহ ছিঁড়ে বের হয় দুধ-পূর্ণিমা/আর তা নেমে আসে স্তনের চূঁড়ায়/বাড়তে থাকে কামনার জ্বর/আর জ্বরতপ্ত হাত কুড়ায় কামনার ফুল। (‘ভালোবাসার রাতে-২৯’) হুমায়ুন আজাদের কবিতা এখানে উল্লেখ করা গেলো না অতিরিক্ত ‘রুচিবোধে’র কারণে। তবে তার একটি বচন অমৃত পড়তে পারেন পাঠকসকল- ‘চোখের সামনে আমার মেয়ে বড় হচ্ছে।

কিন্তু সামাজিক নিয়মের বেড়াজালে আমার হাত-পা বাঁধা। ’ এই হলো আমাদের সুশীল আর সভ্য সমাজের রুচিভেদ। আল্লামা শফী গ্রামের সহজ সরল ভাষায় বললেই সেটা হয়ে যায় কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য আর সমাজের ভোগবাদী পুরুষরা বললে সেটা হয়ে যায় রমণীবান্ধব শ্লোকমালা। এখানেই আল্লামা শফীর পরাজয়। এ কারণেই সাংবাদিক ফারুক ওয়াসিফ লিখেছিলেন, বার্বি ডল আর সেক্সি গ্রেনেডের যুগে পারবে না হেফাজত...।

কারণ ইসলামপন্থীরা জানে না, কী করে নকল স্ক্যান্ডাল তৈরি করতে হয়। তাদের কাছে কোনো ব্যক্তির দোষ ধরা কুরআনের পক্ষ থেকে নিষিদ্ধ। হাদিস বলে, অন্যের দোষ তুমি গোপন রাখো, আল্লাহ তোমার দোষ গোপন রাখবেন। এই নির্দেশের পর কিভাবে তারা প্রতিপক্ষের দোষ খুঁজতে যাবে? এই জন্যই হয়তো ফারুক ওয়াসিফরা আক্ষেপ করে বলতে পারেন, সেক্সি গ্রেনেড আর বার্বি ডলের যুগে আপনাদের (হেফাজতের) বেইল নাই...। সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর সৌজন্যে : সাপ্তাহিক লিখনী ১৬ জুলাই ২০১৩ ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.