আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

উজানে পানি আটকে রেখে তিস্তাচুক্তি হবে বড় রকম কূটনৈতিক প্রতারণা

বিবেকিন্দ্রিয়-লোচন কাট কপি পেস্ট করা পোস্টঃ তিস্তাচুক্তি নিয়ে একটি মহল অতি উৎসাহ দেখালেও বাস্তব পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই চুক্তি হলে বাংলাদেশের সাড়ে ১৩ লাখ হেক্টর জমি চাষের আওতায় আসার কল্পকাহিনী মহলটি প্রচার করছে। তারা বলছে, তিস্তা নদীর পানি সমান ভাগ হলে বাংলাদেশই বেশি লাভবান হবে। কৃষি ও নৌ যোগাযোগে ঘটবে যুগান্তকারী উন্নয়ন। কিন্তু পর্যবেক্ষকরা বলছেন, উজানে অনেক ক'টি প্রকল্পের মাধ্যমে পানি আটকে রেখে তিস্তাচুক্তি হলে তা হবে বড় রকম কূটনৈতিক প্রতারণা।

এ পর্যন্ত প্রকাশিত তথ্যে জানা গেছে, তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত করেছে বাংলাদেশ ও ভারত। নদীর স্বাভাবিক প্রবাহের জন্য ১০ শতাংশ রেখে অবশিষ্ট পানি সমান ভাগে ভাগ করে নেবে দুই দেশ। তিস্তায় ঐতিহাসিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনার জন্য উভয় দেশের মিলিত পদক্ষেপ নেয়ার কথা চুক্তিতে উল্লেখ থাকবে। আগামী সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় এ চুক্তি স্বাক্ষর হবে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সফরকারী ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসএম কৃষ্ণা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

তবে বলা হয়েছে, এখনই স্থায়ী চুক্তি হচ্ছে না, ১৫ বছরের জন্য অন্তবর্তীকালীন চুক্তি হবে। তিস্তার পানিপ্রবাহ নিয়মিত পর্যবেক্ষণের পর স্থায়ী পানি বণ্টন চুক্তি হবে। অপরপক্ষে, বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দুই দেশের সমঝোতা মোতাবেক যদি নদীর স্বাভাবিক প্রবাহের জন্য ১০ ভাগ রেখে অবশিষ্ট পানি সমানভাগে ভাগ করে নেবার কথা বলা হয়। তবে তা হবে এক শুভঙ্করের ফাঁকিমাত্র। কারণ ভারতের অসংখ্য প্রকল্পের চাহিদা মেটাতে গিয়ে তিস্তার ভাটিতে এসে মোট পানির পরিমাণই ১০ ভাগ থাকবে কিনা সে সন্দেহও রয়েছে।

আর এই প্রবাহের হিসাব হবে কিসের ভিত্তিতে তাও নির্দিষ্ট নয়। পানির প্রবাহ ভারত নিয়ন্ত্রণ করবে, তারাই পানি ছাড়বে এবং হিসাবও রাখবে তারাই। ফলে এ নিয়ে যে প্রবল কূটচালের শিকার হবে বাংলাদেশ- এটা অভিজ্ঞতাই বলে দিচ্ছে। ভারত ইতোমধ্যে তিস্তার উজানে গজলডোবায় বিশাল বাঁধ দিয়ে একতরফা পানি প্রত্যাহার করে চলেছে। আর তিস্তা নদীকে কেন্দ্র করে ভারত অন্তত ৩৫টি সেচ ও পানি-বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের মাধ্যমে বেশিরভাগ পানিই টেনে নেয়ার পরিকল্পনা করছে।

সেখানে পানির কথিত ‘স্বাভাবিক প্রবাহ' কতটুকু থাকবে তারও কোন নিশ্চয়তা নেই। ফলে ভারত কতটুকু পানি বাংলাদেশকে দিতে পারবে সে প্রশ্নও ওঠছে। ভাটির দেশ বাংলাদেশ যখন উজানে পানি আটকে রাখা কিংবা প্রত্যাহার করার বিষয়ে চিৎকার করে ফিরছে তখন ভারত না শোনার ভান করে থাকার নীতি গ্রহণ করে চলেছে। অথচ তার আরেক প্রতিবেশী চীন আগের পরিকল্পনা মতোই ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর বাঁধ তৈরির কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। এতে ভাটির দেশ ভারতে মারাত্মক প্রভাব পড়বে এবং ব্রহ্মপুত্রের পানিপ্রবাহ প্রায় বন্ধ হয়ে যাবে বলে আহাজারি শুরু করেছে।

সম্প্রতি এক রিপোর্টে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং বা ‘র'-এর বেইজিং শাখা বলেছে, চীন এ বাঁধের উচ্চতা কমানোর কোনো পরিকল্পনা করছে না। অথচ ভারত বহুবার এ দাবি জানিয়ে এসেছে। বর্তমান নকশা অনুযায়ী জাংমু বাঁধের উচ্চতা হবে তিন হাজার ৩৭০ ফুট। এ বিষয়ে জরুরি ভিত্তিতে চীনের সঙ্গে আলোচনার জন্য পরামর্শ দিয়েছে ‘র'। ভারতের বার্তা সংস্থা পিটিআই এই সংবাদ পরিবেশন করে।

ভারত এর আগে পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ি থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে গজলডোবা নামক স্থানে তিস্তা নদীর ওপর যথারীতি একটি ব্যারাজ নির্মাণ করেছে যা বৃহৎ একটি সেচ প্রকল্প হিসেবে কাজ করছে। এবার ভারত তার অংশের তিস্তার পুরো অংশকে কাজে লাগিয়ে আগামী ১০ বছরের মধ্যে ৫০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিশাল প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এই প্রকল্পের আওতায় পানির বৃহৎ বৃহৎ রিজার্ভার গড়ে তোলা হবে এবং এগুলোর শক্তিশালী প্রবাহ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। তিস্তা নদীর ওপরে ভারতের প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলো হলো, ভাসমি, বিমকং, চাকুং, চুজাচেন, ডিক চু, জোরথাং লোপ, লাচিন, লিংজা, পানান, রালাং, রামমাম-১, রামমাম-৪, রণজিৎ-২, রনজিৎ-৪, রাংইয়ং, রাতিচু-বাকচা চু, রিংপি, রংনি, রুকেল, সাদা মাংদের, সুনতালি তার, তালিম, তাশিডিং, তিস্তা-১, তিস্তা-২, তিস্তা-৩, তিস্তা-৪, তিস্তা-৬, থাংচি, টিং টিং, প্রভৃতি। এছাড়াও বর্তমানে চলমান প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে, লোয়ার লাগিয়াপ, রামমাম-২, রণজিৎ-৩, তিস্তা-৫ এবং রঙ্গিচু।

এগুলো সবই পানি-বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। এগুলোর জন্য অবশ্যই তিস্তার পানি প্রত্যাহার ও সংরক্ষণ করা প্রয়োজন হবে। সেক্ষেত্রে তিস্তার বাংলাদেশ অংশে কীভাবে প্রার্থীত পরিমাণ পানি আসবে তার কোন হিসেব মেলাতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা। উল্লেখ করা যেতে পারে, ৩১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ও খরস্রোতা তিস্তা নদী ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং-জলপাইগুড়ি হয়ে বাংলাদেশের লালমনিরহাট দিয়ে কুড়িগ্রামের চিলমারীতে প্রবেশ করে ব্রহ্মপুত্রে মিলিত হয়েছে। বাংলাদেশে এর দৈর্ঘ ১শ' ১২ কিলোমিটার।

ফলে এটি শুধু স্বাধীন একটি নদীমাত্র নয়, তিস্তা বাংলাদেশেরও নদী এবং তা ব্রহ্মপুত্রের পানিপ্রবাহেরও অন্যতম উৎস। তিস্তার প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়া মানেই ভাটিতে বাংলাদেশের তিস্তার অপমৃত্য এবং সেই সঙ্গে ব্রহ্মপুত্র তথা যমুনার প্রবাহ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। এই নদীর অস্তিত্বের সঙ্গে বিস্তীর্ণ এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ নির্ভরশীল। খোদ সিকিমের সাধারণ মানুষ এসব বাঁধ-ব্যারাজের বিরোধিতা করছে। এ নিয়ে আদালতে মামলাও হয়েছে।

কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করছে না বলে জানা গেছে। বাংলাদেশের লালমনিরহাট জেলার দোয়ানিতে যে তিস্তা ব্যারাজ নির্মিত হয়েছে তা-ও এসব প্রকল্পের ফলে অকার্যকর হয়ে পড়বে। এখান থেকে একশো কিলোমিটার উজানে জলপাইগুড়ির গজলডোবার তিস্তা ব্যারাজ দিয়ে ভারত ইতোমধ্যে শুকনো মওসুমে দেড় হাজার কিউসেক করে পানি তার অংশের মহানন্দায় প্রত্যাহার করে নিয়ে যাচ্ছে। তার প্রতিক্রিয়াই ভয়াবহ হয়ে ওঠেছে। বাংলাদেশের তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পের অধীন সাড়ে ৭ লাখ হেক্টর জমিতে সেচ দেয়ার কার্যক্রমও শিকেয় ওঠবে বলে আশংকা করা হচ্ছে।

এখন আবার ৩৫ প্রকল্পের মাধ্যমে পানি সংরক্ষণ করা শুরু হলে বাংলাদেশের তিস্তার অপমৃত্যুই ঘটবে না- বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহও ব্যাপক হ্রাস পাবে। ফলে এক বিরাট অববাহিকা জুড়ে প্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতির কবলে পড়বে বাংলাদেশ। উৎসাহী মহলটি প্রচার করছে, শুষ্ক মৌসুমে ভারত উজানে বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহার না করলে উত্তরাঞ্চলের ছয় জেলার ৩৫ উপজেলার প্রায় ১৩ লাখ ৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে ফসল উৎপাদন হবে পুরোদমে। চাঙ্গা হবে উত্তরের কৃষি অর্থনীতি। দেশের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের সেচ কার্যক্রমও ফিরে পাবে গতি।

সচল হবে উত্তরাঞ্চলের ছোটবড় ১২টি নদী ও নালা। মরুকরণের হাত থেকে রক্ষা পাবে উত্তরের জীববৈচিত্র্য, বাড়বে মাছের উৎপাদন। বর্ষা মৌসুমে বন্যার প্রকোপ কমবে বৃহত্তর রংপুরে। কিন্তু এই পানিপ্রাপ্তি কীভাবে নিশ্চিত হবে তার কোন হদিস দেয়া হচ্ছে না। পানির মোট পরিমাণ গজলডোবা বাঁধের ভেতর থেকে হিসাব করা হবে, নাকি বাংলাদেশের তিস্তা ব্যারেজের মুখে হিসাব করা হবে, তা ও নিশ্চিত নয়।

ফলে এক গোলক ধাঁ ধাঁর চক্করে ঘুরপাক খাচ্ছে পুরো বিষয়টি। তিস্তা সেচ প্রকল্পের একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, ৩৮ বছর আগের ভরা তিস্তা আজ মরা নদীতে পরিণত হয়েছে। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুরের জীববৈচিত্র্যের ওপর। দেশের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের সেচ কার্যক্রম চালিয়ে নেয়ার মতো পানিও মিলছে না। চর পড়েছে নদীতে।

চারপাশে ধু-ধু বালু। অনুসন্ধান ও সরেজমিনে দেখা গেছে, তিস্তার প্রবাহ পথে বিশাল বালুচর ও উভয় তীরে ভাঙনের তান্ডবে তিস্তার বাংলাদেশ অংশে এর প্রস্থ কোন কোন জায়গায় ৫ কিলোমিটারেরও বেশী। আবার কোন জায়গায় মাত্র ২শ' থেকে ৫শ' গজে সংকীর্ণ হয়ে গেছে। বর্ষাকালে এই নদীর গভীরতা ৫ দশমিক ৫০ মিটার হলেও শুষ্ক মৌসুমে তা কোথাও কোথাও মাত্র এক মিটার থেকে এক মিটারে এসে দাঁড়ায়। সরেজমিনে দেখা গেছে, তিস্তার তলদেশে অজস্র পাথর, নুড়ি, বালি আর পলি পড়ে তিস্তার ১২৫ বর্গকিলোমিটার বুকে এখন বালির উত্তাপ।

দেখে বোঝার উপায় নেই-এটি একদা খরস্রোতা নদী ছিলো। পরিবেশবিদরা বলেছেন, তিস্তাসহ এই অঞ্চলের ধরলা, ঘাঘট, যমুনেশ্বরী, আখিরা, দুধকুমার, বুড়ি তিস্তাসহ প্রায় ৩৩টি ছোট-বড় নদ-নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ব্যাপকভাবে নেমে গেছে। পাউবো সূত্রে প্রকাশ, এবার শুষ্ক মওসুমের শুরুতেই ভারত গজলডোবার সব ক'টি গেট বন্ধ করে দেয়ায় তিস্তায় পানির প্রবাহমাত্রা এখন বিগত ১শ' বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে কম। ১৯৬১ থেকে ১৯৬৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিস্তায় পানির প্রবাহমাত্রা ছিলো ৪ হাজার ৬৭০ কিউসেক। কিন্তু এবার মওসুমের শুরুতে তিস্তার পানি প্রবাহমাত্রা মাত্র ৪০০ থেকে ৪৫০ কিউসেকের মধ্যে ওঠানামা করে।

তিস্তার ‘ঐতিহাসিক রূপ ফিরিয়ে আনার' কল্পকাহিনী প্রচারকারীদের তিস্তার এই চিত্র কোন বোধদয়ের সম্ভাবনা তৈরি করবে বলে আশা করেন বিশ্লেষকরা। তিস্তাচুক্তি নিয়ে একটি মহল অতি উৎসাহ দেখালেও বাস্তব পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই চুক্তি হলে বাংলাদেশের সাড়ে ১৩ লাখ হেক্টর জমি চাষের আওতায় আসার কল্পকাহিনী মহলটি প্রচার করছে। তারা বলছে, তিস্তা নদীর পানি সমান ভাগ হলে বাংলাদেশই বেশি লাভবান হবে। কৃষি ও নৌ যোগাযোগে ঘটবে যুগান্তকারী উন্নয়ন।

কিন্তু পর্যবেক্ষকরা বলছেন, উজানে অনেক ক'টি প্রকল্পের মাধ্যমে পানি আটকে রেখে তিস্তাচুক্তি হলে তা হবে বড় রকম কূটনৈতিক প্রতারণা। এ পর্যন্ত প্রকাশিত তথ্যে জানা গেছে, তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত করেছে বাংলাদেশ ও ভারত। নদীর স্বাভাবিক প্রবাহের জন্য ১০ শতাংশ রেখে অবশিষ্ট পানি সমান ভাগে ভাগ করে নেবে দুই দেশ। তিস্তায় ঐতিহাসিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনার জন্য উভয় দেশের মিলিত পদক্ষেপ নেয়ার কথা চুক্তিতে উল্লেখ থাকবে। আগামী সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় এ চুক্তি স্বাক্ষর হবে।

ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সফরকারী ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসএম কৃষ্ণা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তবে বলা হয়েছে, এখনই স্থায়ী চুক্তি হচ্ছে না, ১৫ বছরের জন্য অন্তবর্তীকালীন চুক্তি হবে। তিস্তার পানিপ্রবাহ নিয়মিত পর্যবেক্ষণের পর স্থায়ী পানি বণ্টন চুক্তি হবে। অপরপক্ষে, বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দুই দেশের সমঝোতা মোতাবেক যদি নদীর স্বাভাবিক প্রবাহের জন্য ১০ ভাগ রেখে অবশিষ্ট পানি সমানভাগে ভাগ করে নেবার কথা বলা হয়। তবে তা হবে এক শুভঙ্করের ফাঁকিমাত্র।

কারণ ভারতের অসংখ্য প্রকল্পের চাহিদা মেটাতে গিয়ে তিস্তার ভাটিতে এসে মোট পানির পরিমাণই ১০ ভাগ থাকবে কিনা সে সন্দেহও রয়েছে। আর এই প্রবাহের হিসাব হবে কিসের ভিত্তিতে তাও নির্দিষ্ট নয়। পানির প্রবাহ ভারত নিয়ন্ত্রণ করবে, তারাই পানি ছাড়বে এবং হিসাবও রাখবে তারাই। ফলে এ নিয়ে যে প্রবল কূটচালের শিকার হবে বাংলাদেশ- এটা অভিজ্ঞতাই বলে দিচ্ছে। ভারত ইতোমধ্যে তিস্তার উজানে গজলডোবায় বিশাল বাঁধ দিয়ে একতরফা পানি প্রত্যাহার করে চলেছে।

আর তিস্তা নদীকে কেন্দ্র করে ভারত অন্তত ৩৫টি সেচ ও পানি-বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের মাধ্যমে বেশিরভাগ পানিই টেনে নেয়ার পরিকল্পনা করছে। সেখানে পানির কথিত ‘স্বাভাবিক প্রবাহ' কতটুকু থাকবে তারও কোন নিশ্চয়তা নেই। ফলে ভারত কতটুকু পানি বাংলাদেশকে দিতে পারবে সে প্রশ্নও ওঠছে। ভাটির দেশ বাংলাদেশ যখন উজানে পানি আটকে রাখা কিংবা প্রত্যাহার করার বিষয়ে চিৎকার করে ফিরছে তখন ভারত না শোনার ভান করে থাকার নীতি গ্রহণ করে চলেছে। অথচ তার আরেক প্রতিবেশী চীন আগের পরিকল্পনা মতোই ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর বাঁধ তৈরির কাজ এগিয়ে নিচ্ছে।

এতে ভাটির দেশ ভারতে মারাত্মক প্রভাব পড়বে এবং ব্রহ্মপুত্রের পানিপ্রবাহ প্রায় বন্ধ হয়ে যাবে বলে আহাজারি শুরু করেছে। সম্প্রতি এক রিপোর্টে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং বা ‘র'-এর বেইজিং শাখা বলেছে, চীন এ বাঁধের উচ্চতা কমানোর কোনো পরিকল্পনা করছে না। অথচ ভারত বহুবার এ দাবি জানিয়ে এসেছে। বর্তমান নকশা অনুযায়ী জাংমু বাঁধের উচ্চতা হবে তিন হাজার ৩৭০ ফুট। এ বিষয়ে জরুরি ভিত্তিতে চীনের সঙ্গে আলোচনার জন্য পরামর্শ দিয়েছে ‘র'।

ভারতের বার্তা সংস্থা পিটিআই এই সংবাদ পরিবেশন করে। ভারত এর আগে পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ি থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে গজলডোবা নামক স্থানে তিস্তা নদীর ওপর যথারীতি একটি ব্যারাজ নির্মাণ করেছে যা বৃহৎ একটি সেচ প্রকল্প হিসেবে কাজ করছে। এবার ভারত তার অংশের তিস্তার পুরো অংশকে কাজে লাগিয়ে আগামী ১০ বছরের মধ্যে ৫০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিশাল প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এই প্রকল্পের আওতায় পানির বৃহৎ বৃহৎ রিজার্ভার গড়ে তোলা হবে এবং এগুলোর শক্তিশালী প্রবাহ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। তিস্তা নদীর ওপরে ভারতের প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলো হলো, ভাসমি, বিমকং, চাকুং, চুজাচেন, ডিক চু, জোরথাং লোপ, লাচিন, লিংজা, পানান, রালাং, রামমাম-১, রামমাম-৪, রণজিৎ-২, রনজিৎ-৪, রাংইয়ং, রাতিচু-বাকচা চু, রিংপি, রংনি, রুকেল, সাদা মাংদের, সুনতালি তার, তালিম, তাশিডিং, তিস্তা-১, তিস্তা-২, তিস্তা-৩, তিস্তা-৪, তিস্তা-৬, থাংচি, টিং টিং, প্রভৃতি।

এছাড়াও বর্তমানে চলমান প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে, লোয়ার লাগিয়াপ, রামমাম-২, রণজিৎ-৩, তিস্তা-৫ এবং রঙ্গিচু। এগুলো সবই পানি-বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। এগুলোর জন্য অবশ্যই তিস্তার পানি প্রত্যাহার ও সংরক্ষণ করা প্রয়োজন হবে। সেক্ষেত্রে তিস্তার বাংলাদেশ অংশে কীভাবে প্রার্থীত পরিমাণ পানি আসবে তার কোন হিসেব মেলাতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা। উল্লেখ করা যেতে পারে, ৩১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ও খরস্রোতা তিস্তা নদী ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং-জলপাইগুড়ি হয়ে বাংলাদেশের লালমনিরহাট দিয়ে কুড়িগ্রামের চিলমারীতে প্রবেশ করে ব্রহ্মপুত্রে মিলিত হয়েছে।

বাংলাদেশে এর দৈর্ঘ ১শ' ১২ কিলোমিটার। ফলে এটি শুধু স্বাধীন একটি নদীমাত্র নয়, তিস্তা বাংলাদেশেরও নদী এবং তা ব্রহ্মপুত্রের পানিপ্রবাহেরও অন্যতম উৎস। তিস্তার প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়া মানেই ভাটিতে বাংলাদেশের তিস্তার অপমৃত্য এবং সেই সঙ্গে ব্রহ্মপুত্র তথা যমুনার প্রবাহ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। এই নদীর অস্তিত্বের সঙ্গে বিস্তীর্ণ এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ নির্ভরশীল। খোদ সিকিমের সাধারণ মানুষ এসব বাঁধ-ব্যারাজের বিরোধিতা করছে।

এ নিয়ে আদালতে মামলাও হয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করছে না বলে জানা গেছে। বাংলাদেশের লালমনিরহাট জেলার দোয়ানিতে যে তিস্তা ব্যারাজ নির্মিত হয়েছে তা-ও এসব প্রকল্পের ফলে অকার্যকর হয়ে পড়বে। এখান থেকে একশো কিলোমিটার উজানে জলপাইগুড়ির গজলডোবার তিস্তা ব্যারাজ দিয়ে ভারত ইতোমধ্যে শুকনো মওসুমে দেড় হাজার কিউসেক করে পানি তার অংশের মহানন্দায় প্রত্যাহার করে নিয়ে যাচ্ছে। তার প্রতিক্রিয়াই ভয়াবহ হয়ে ওঠেছে।

বাংলাদেশের তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পের অধীন সাড়ে ৭ লাখ হেক্টর জমিতে সেচ দেয়ার কার্যক্রমও শিকেয় ওঠবে বলে আশংকা করা হচ্ছে। এখন আবার ৩৫ প্রকল্পের মাধ্যমে পানি সংরক্ষণ করা শুরু হলে বাংলাদেশের তিস্তার অপমৃত্যুই ঘটবে না- বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহও ব্যাপক হ্রাস পাবে। ফলে এক বিরাট অববাহিকা জুড়ে প্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতির কবলে পড়বে বাংলাদেশ। উৎসাহী মহলটি প্রচার করছে, শুষ্ক মৌসুমে ভারত উজানে বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহার না করলে উত্তরাঞ্চলের ছয় জেলার ৩৫ উপজেলার প্রায় ১৩ লাখ ৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে ফসল উৎপাদন হবে পুরোদমে। চাঙ্গা হবে উত্তরের কৃষি অর্থনীতি।

দেশের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের সেচ কার্যক্রমও ফিরে পাবে গতি। সচল হবে উত্তরাঞ্চলের ছোটবড় ১২টি নদী ও নালা। মরুকরণের হাত থেকে রক্ষা পাবে উত্তরের জীববৈচিত্র্য, বাড়বে মাছের উৎপাদন। বর্ষা মৌসুমে বন্যার প্রকোপ কমবে বৃহত্তর রংপুরে। কিন্তু এই পানিপ্রাপ্তি কীভাবে নিশ্চিত হবে তার কোন হদিস দেয়া হচ্ছে না।

পানির মোট পরিমাণ গজলডোবা বাঁধের ভেতর থেকে হিসাব করা হবে, নাকি বাংলাদেশের তিস্তা ব্যারেজের মুখে হিসাব করা হবে, তা ও নিশ্চিত নয়। ফলে এক গোলক ধাঁ ধাঁর চক্করে ঘুরপাক খাচ্ছে পুরো বিষয়টি। তিস্তা সেচ প্রকল্পের একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, ৩৮ বছর আগের ভরা তিস্তা আজ মরা নদীতে পরিণত হয়েছে। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুরের জীববৈচিত্র্যের ওপর। দেশের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের সেচ কার্যক্রম চালিয়ে নেয়ার মতো পানিও মিলছে না।

চর পড়েছে নদীতে। চারপাশে ধু-ধু বালু। অনুসন্ধান ও সরেজমিনে দেখা গেছে, তিস্তার প্রবাহ পথে বিশাল বালুচর ও উভয় তীরে ভাঙনের তান্ডবে তিস্তার বাংলাদেশ অংশে এর প্রস্থ কোন কোন জায়গায় ৫ কিলোমিটারেরও বেশী। আবার কোন জায়গায় মাত্র ২শ' থেকে ৫শ' গজে সংকীর্ণ হয়ে গেছে। বর্ষাকালে এই নদীর গভীরতা ৫ দশমিক ৫০ মিটার হলেও শুষ্ক মৌসুমে তা কোথাও কোথাও মাত্র এক মিটার থেকে এক মিটারে এসে দাঁড়ায়।

সরেজমিনে দেখা গেছে, তিস্তার তলদেশে অজস্র পাথর, নুড়ি, বালি আর পলি পড়ে তিস্তার ১২৫ বর্গকিলোমিটার বুকে এখন বালির উত্তাপ। দেখে বোঝার উপায় নেই-এটি একদা খরস্রোতা নদী ছিলো। পরিবেশবিদরা বলেছেন, তিস্তাসহ এই অঞ্চলের ধরলা, ঘাঘট, যমুনেশ্বরী, আখিরা, দুধকুমার, বুড়ি তিস্তাসহ প্রায় ৩৩টি ছোট-বড় নদ-নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ব্যাপকভাবে নেমে গেছে। পাউবো সূত্রে প্রকাশ, এবার শুষ্ক মওসুমের শুরুতেই ভারত গজলডোবার সব ক'টি গেট বন্ধ করে দেয়ায় তিস্তায় পানির প্রবাহমাত্রা এখন বিগত ১শ' বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে কম। ১৯৬১ থেকে ১৯৬৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিস্তায় পানির প্রবাহমাত্রা ছিলো ৪ হাজার ৬৭০ কিউসেক।

কিন্তু এবার মওসুমের শুরুতে তিস্তার পানি প্রবাহমাত্রা মাত্র ৪০০ থেকে ৪৫০ কিউসেকের মধ্যে ওঠানামা করে। তিস্তার ‘ঐতিহাসিক রূপ ফিরিয়ে আনার' কল্পকাহিনী প্রচারকারীদের তিস্তার এই চিত্র কোন বোধদয়ের সম্ভাবনা তৈরি করবে বলে আশা করেন বিশ্লেষকরা। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।