বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইসতেহারের সবচেয়ে বড় প্রতিশ্রতি ছিল ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন। এ দেশের সাধারণ জনগন আজও জানেনা ডিজিটাল কি জিনিস। ডিজিটাল হলে কি হবে? কেন এই ডিজিটাল? কিভাবে হবে ডিজিটাল? তারা শুধু জানে ডিজিটাল হলে দেশে পরিবর্তন আসবে। পরিবর্তন কোথায় হবে? কিভাবে হবে? তার কিছুই জানেনা দু-মুঠো ভাতের জন্য অনবরত সংগ্রাম করতে থাকা খেটে খাওয়া মানুষ জন।
যদি সরাসরি প্রশ্ন করা হয় ডিজিটাল কি? তাহলে উত্তর হবে, ডিজিটাল সিস্টেমকে এমন একটা প্রযুক্তি যেটা বিচ্ছিন্ন অথবা বিযুক্ত মান ব্যবহার করে।
দু-একটা উদাহরণ দিলে ব্যপারটা আরও সহজ হবে। যেমন: কাটাওয়ালা ঘড়ি এনালগ কিন্তু যেসব ঘড়ি ডিজিট দিয়ে সময় প্রকাশ করে সেগুলো আবার ডিজিটাল ঘড়ি। আমাদের কম্পিউটার ডিজিটাল যন্ত্র কিন্তু কম্পিউটারের সাথে যুক্ত স্পিকার এনালগ।
এসব তো গেল সাধারণ কথা। প্রশ্ন হতে পারে ডিজিটাল বাংলাদেশের সাথে এসবের সম্পর্ক কি? সম্পর্ক আছে।
এখন সে কথাই বলব। উপরের সংজ্ঞা এবং উদাহরণ থেকে বুঝা যাচ্ছে ডিজিটাল শব্দটা প্রযুক্তি নির্ভর শব্দ। আসলে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি পরস্পর সম্পর্কিত। বিজ্ঞান সরাসরি মানুষকে কিছু দিতে পারেনা। এটা পঠ করা অথবা অধ্যয়ন করার বিষয়।
এটি একটি বিমুর্ত ধারণা। বিজ্ঞানকে অথবা বিজ্ঞানের জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে মানুষ পযুক্তির উদ্ভাবন করেছে, করছে। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, প্রযুক্তিই আজকের পৃথিবীকে এই অবস্থায় নিয়ে এসছে। সুতরাং ডিজিটাল বাংলাদেশ মানে হচ্ছে একটা প্রযুক্তি নির্ভর বাংলাদেশ। অর্থাৎ ডিজিটাল বাংলাদেশ তখনই সম্ভব হবে যখন ডিজিটাল প্রযুক্তিকে সর্বত্র সফল এবং সার্থকভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হবে।
প্রযুক্তি উদ্ভাবনের দ্বার উন্মোচিত হয় প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে। কিন্তু দূর্ভাগ্যবসত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই এখন চক্রান্তের শিকার । দেশের প্রধাণ চারটি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়(বুয়েট), চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়(চুয়েট), খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়(কুয়েট), রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়(রুয়েট)। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে যেখানে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি আর প্রকৌশল চর্চা হওয়াই মূল লক্ষ্য সেখানে বাসা বাঁধছে দূর্নীর্তি এবং কলুষিত ছাত্র রাজনীতি। বুয়েট সহ সবকটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের বিরেদ্ধে দলীয়করণের অভিযোগ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
শিক্ষক-কর্মচারীদের রাজনীতি করার অনুমোদন না থাকা সত্তেও তারা নির্ভিঘ্নে রাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছেন এবং রাজনীতিকে প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছেন যা ছড়িয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীদের মাঝে। বুয়েট ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ প্রায়ই পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। চুয়েট প্রশাসনের বিরোদ্ধেও রয়েছে দলীয়করণের অভিযোগ। রয়েছে দক্ষ ও অভিজ্ঞ শিক্ষকের অভাব। পিএইচডি ডিগ্রীধারী শিক্ষকের সল্পতার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে সি-গ্রেডে নামিয়ে দেয়া হয়েছে।
এসব ছাড়াও বিভিন্ন কারণে অনাকাঙ্খিত বন্ধের শিকার হচ্ছে প্রকৗশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। শহীদ মিনারের বেদিতে বসাকে কেন্দ্র করে রুয়েট শিক্ষার্থীদের সাথে সেখানকার কলেজ শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের ঘটনায় অর্নির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ছিল রুয়েট। এর আগে চলতি বছরের জানুয়ারী মাসের ২৯ তারিখে চুয়েটে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দু’গ্রুপের সংঘর্ষে বন্ধ হয়ে যায় চুয়েট। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায় বিভিন্ন কারণে গত দুই বছরে শুধুমাত্র চুয়েট বন্ধ হয়েছে ৮ বার। এসব কারণে ব্যপকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে দেশের প্রকৌশল শিক্ষা।
শুধু তাই নয় শিক্ষার মান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। যে প্রকৌশলীরা হবেন ডিজিটাল স্বপ্ন বুননের কারিগর তারাই এখন দ্বিধাগ্রস্থ।
লেখার শুরুতে বলছিলাম ডিজিটাল শব্দের অর্থ। আক্ষরিক অর্থ ছাড়া আরও একধরণের অর্থ থাকে। আমাদের মনে রাখতে হবে ডিজিটাল মানে কথায় না কাজে প্রমাণ করা।
ডিজিটাল মানে স্বপ্ন নয় বাস্তবে রূপ দেয়া। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর দুই বছর পার হয়ে গেছে। এ সময়ে সরকরের নিরন্তর প্রচেষ্টা স্বত্তেও সেই স্বপ্নের কিয়দংশও পূরণ করতে সক্ষম হয়নি। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বোঝার জন্য শিক্ষার পর-পরই থাকে সে দেশের Economy-এর অবস্থান। এ দেশের জিডিপির ৪৫ ভাগেরও বেশি নির্ভর করে শেয়ার বাজারের উপর ।
বিনিয়োগের অন্যতম ক্ষেত্র হল শেয়ার বাজার। যা এখনও রয়ে গেছে ডিজিটাল প্রযুক্তির ধরা ছোঁয়ার বাইরে। অনলাইনে লেনদেন শুরু হওয়ার কথা থাকলেও অজানা কারণে তা বিলম্বিত হচ্ছে। এর পরিবর্তে অপরিকল্পিতভাবে বাড়ানো হয়েছে ব্রোকারেজ হাউজ। ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠা ব্রোকারেজ হাউজগুলোতে অনিয়ন্ত্রিত লেনদেনের পরিণতি আজ জাতি দেখতে পাচ্ছে।
সার্কিট ব্রেকারের পাঁচ-ছয় মিনিটের খেলা সমগ্র দেশ দেখেছে। অথচ লেনদেন অনলাইনে হলে ব্রোকারেজ হাউজের অতিরিক্ত ঝামেলা অনেক আংশেই কমে যেত। লেনদেন হত স্বচ্ছ এবং দ্রুত। সার্কিট ব্রেকারের ঝামেলা এড়ানো সহজ হত উন্নত সফটওয়ার টেকনোলজির মাধ্যমে। দেশের Economy-কে উন্নত করতে হলে প্রয়োজন জ্ঞান ভিত্তিক শিল্পের বিকাশ।
আমাদের পার্শবর্তী দেশ ভারত অনেক দ্রুত তাদের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে তুলছে। এর সবচেয়ে বড় প্রেরণা ছিল জ্ঞান ভিত্তিক শিল্পের সঠিক বিকাশ। আমাদের পিছিয়ে থাকার আরও একটি কারণ জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার অভাব। একটি দেশের সমগ্র জনগোষ্ঠীকে সে দেশের সম্পদে পরিণত করতে গেলে জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার কোন বিকল্প নেই।
একটা ধারণার প্রচলন হয়ে গেছে ডিজিটাল বাংলাদেশের সম্পর্কে।
আর সেটা হচ্ছে বেশি বেশি কম্পিউটার ব্যবহার করলেই দেশ ডিজিটাল হয়ে যাবে। তাই দ্রুত হারে সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ে কিছু কম্পিউটার টেনিং সেন্টার ও ইনস্টিটিউট ইতোমধ্যেই খোলা হয়েছে। কম্পিউটার ও কম্পিউটারাইজড প্রযুক্তি অবশ্যই ডিজিটাল। সেই মত সরকার শুধু কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টার খুলে নামে মাত্র কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশের সাফাই গাইলে গাইতে পারে, কিন্তু অতি শিঘ্রই সে গান বেসুরা লাগবে, এটা নিশ্চিত। কারণ, এখনও দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতেই ম্যানুয়েলি হচ্ছে সব কাজ।
ভূগান্তির শিকার হচ্ছে সাধারণ জনগন। বাংলাদেশ ব্যাংকের অধিকাংশ শাখাতে এখনও প্রায় সবকাজ হচ্ছে ম্যানুয়েলি।
একজন দরিদ্র মানুষের কথা যদি চিন্তা করি যার জন্য দু-বেলা অন্ন যোগান করাই কষ্টসাধ্য তার কাছে ডিজিটাল বাংলাদেশের অর্থ কি হতে পারে?
চিন্তা করুন বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষার্থী হলে থাকে, টিউশনি করে জীবন চালায় অথচ সেশন জটের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে আটকে আছে বছরের পর বছর। রাজনৈতিক কোন্দলের কারণে যার প্রতিটি দিন হয়ে উঠেছে দূর্বিষহ ,তার জন্য ডিজিটাল বাংলাদেশ অর্থ কি হতে পারে?
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে হলে দেশের সকল পেশাজিবী মানুষের কথা মাথায় রাখতে হবে। চিন্তা করতে হবে সমাজের সকল স্তরের মানুষের কথা।
আমাদের মনে রাখতে হবে শুধু প্রতিস্রুতি আর স্বপ্ন দিয়ে খুব বেশিদূর যাওয়া যায়না। অনেক সময় পেরিয়ে গেছে, এখনই যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায় এ দেশের সাধারণ জনগন যারা ডিজিটাল অর্থ জানেনা তারা কিন্তু ডিজিটাল পথ ঠিক খুঁজে বের করবে।
## ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।