আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

।। আমার হাইস্কুল।। পর্ব-২।।

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা... আমাদের স্কুলে কোনো টয়লেট ছিল না। প্রায় ৫০০ ছাত্রছাত্রীদের জন্য এটা নিয়ে তখন কেউ মাথাও ঘামাতো না। স্কুলের পেছনেই হেডস্যারের বাড়ি। হেডস্যারের বাড়ির ঠিক উত্তর পাশে কাটা খাল সোজা পশ্চিমে চলে গেছে। কাটাখালের দু'পার দিয়েই রাস্তা।

এই রাস্তা সোজা চলে গেছে বানিয়ারীর দিকে। হেডস্যারের বাড়ির পেছনের দিকে বিশাল জঙ্গল। শিয়ালও বসবাস করতো সেই জঙ্গলে। এছাড়া স্কুলের পেছনে দক্ষিণ পাশে সুজিতদাদের বাড়ি। সুজিতদাদের বাড়ি'র সামনে থেকে সোজা দক্ষিণে চলে গেছে আরেকটি রাস্তা।

ওটা দিঘীরজান ও কুমারখালীর দিকে গেছে। আর দীঘিরজান বাজারের একেবারে উত্তর-পূর্ব কোনে বাজারের শেষ মাথায় হল মসজিদ। মসজিদের পাশেই ব্রিজ। ব্রিজ পারালে উত্তর পাশে আবার পূর্ব বানিয়ারী। মরা বলেশ্বরের পার ঘেঁষে সেই রাস্তা একেবেঁকে চলে গেছে বানিয়ারী'র দিকে।

একেবারে খাসেরহাট-চিতলমারী পর্যন্ত। আর স্কুলের পূর্ব পাশের মাঠের একেবারে পূর্ব পাশের মরা বলেশ্বর নদী ঘেঁষে ডিস্ট্রিক বোর্ডের রাস্তা রুহিতলা পর্যন্ত গিয়ে দু'ভাগ হয়েছে। একটি নদী বরাবর চলে গেছে পূর্ব দিকে বাইনকাঠির দিকে। আর ডিস্ট্রিক বোর্ডের রাস্তা সোজা দক্ষিণ-পূর্ব কোনে চলে গেছে নাজিরপুর থানা ও পিরোজপুর মহাকুমার দিকে। তো ছেলেদের হিসি পেলে হেডস্যারের জঙ্গল বা সুজিতদাদের বাগানে যাবার নিয়ম।

আর স্যারদের জন্য জীবেস স্যারের বাসার পেছনে একটা অর্ধপাকা টয়লেট ছিল। সেখানে যেতেন তারা। ফাফরে ছিল স্কুলের মেয়েরা। দু'একজন সাহস করে জীবেস স্যারের বাসার টয়লেটে যেতো। আর বাকীরা? সুজিতদাদের বাগানে ঠিক রাস্তার পাশে পাশপাশি দুইটি খ্যাড়ের পালা।

সেখানে ছেলেরাও যেতো। মেয়েরাও যেতো। যখন মেয়েরা যেতো তখন ছেলেদের যাওয়ায় অঘোষিত নিশেধাজ্ঞা থাকতো। মেয়েরা যেতো দলবেঁধে। ছেলেরাও দলবেঁধে।

ছেলেরা আগে গেলে মেয়েরা খ্যাড়ের পালার দিকে না এসে সুজিতদাদের বাড়িতে ঢুকে পড়তো। সুজিতদাদের বাড়ির পেছনে পুকুরের সাইডেও জঙ্গল। সেই জঙ্গলে বা কাঁচা টয়লেটেও তখন মেয়েরা প্রাকৃতিক কাজটি সারতো। এছাড়া স্কুলের উত্তর পাশে বাজারের স্থায়ী দোকানগুলো যে গুলো কাটা খালের সঙ্গে সমান্তরাল সেগুলো প্রায়ই ছিল পারিবার কাম দোকান। সামনের রুমে হয়তো টেইলার, মুদি দোকান বা ফার্মেসি বা রেডিও ঠিক করার দোকান।

আর পেছনে তাদের পরিবার থাকতো। স্কুলের মেয়েরা সেই সব পরিবারের সঙ্গে খাতির পাতাতো। তারা প্রাকৃতিক কাজ সারতে একটি গ্রুপ তখন বাজারের দিকেও যেতো। সবচেয়ে বেশি হিসি দেবার ভিড় পড়তো টিফিন পিরিয়ডে। তখন প্রায়ই ছেলেমেয়রা কখনো কখনো অনাকাঙ্খিত মুখোমুখি হয়ে যেতো।

আর সেটা প্রায়ই ঘটতো সুজিতদাদের খ্যাড়ের পালার আড়ালে। মেয়েরা সেখানে গেলে একজন অন্তঃত রাস্তায় পাহারা দিতো। কিন্তু কোনো পাহারা না থাকলে ছেলেরা অনায়াসে খ্যাড়ের পালার পেছনে ঢুকে পড়তো। আর তখনই মাঝে মাঝে বিপত্তি ঘটতো। এই ঘটনা যদি একই ক্লাশের ছেলেমেয়ের মধ্যে ঘটতো, তখন সেই ঘটনার রেশ ক্লাশরুমেও চলে আসতো।

দেখা যেতো সুবোধের দিকে তাকিয়ে পুতুল আর মিনতী খুব মিটমিট করছে। আবার কখনো জীবনের দিকে তাকিয়ে শাহনাজ আর হেনা মিটমিট ফুসফাস করছে। একদিন নির্মল স্যারের বাংলা ক্লাশ চলছে। মেয়েদের কলামে একেবারে পেছনের দিকে ঝর্ণা আর মাহফুজা খুব মিটমিট করছে। আর এদিক ছেলেদের দুই কলামের একেবারে দ্বিতীয় কলামের সেকেন্ড রো'তে মোস্তফা আর স্বপন খুব মিটমিট করছে।

ফুসফুাস করছে। ছেলেদের দুই কলামের কেবল প্রথম কলামের ফার্স্ট রো ছাড়া সবাই ঘটনা বুঝে ফেলেছে। শুধু নির্মল স্যার, ছেলেদের ফার্স্ট বেঞ্চ আর মেয়েদের সামনের দিকের কয়েক বেঞ্চ ঘটনার আগামাধা কিছুই বুঝতে পারছে না। তো এক পর্যায়ে নির্মল স্যার মোস্তফাকে দাঁড় করালেন। এতো খুশি'র হেতু কি গোলাম মোস্তফা ছাহাব? মোস্তফা দুরুদুরু বুকে উঠে দাঁড়ালো।

কিন্তু মুখের হাসি আরেকটু বাড়লো। আর কোন ফাঁকে চোখ টেরা করে একবার মেয়েদের দিকের পেছনের বেঞ্চে বসা ঝর্না আর মাহফুজাকে দেখলো। মোস্তফা'র চাহনিটি নির্মল স্যার ধরে ফেলেছিলেন। এবার স্যার ঝর্নাকেও দাঁড় করালেন। কি নিয়া এতো গুজুর গুজুর? জবাবে ঝর্না বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে প্রসঙ্গ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিল।

বললো, স্যার আমরা একটা সেলাই নিয়া হাসতেছিলাম। আমাদের ক্লাশের পুতুল একটা রুমালে একটা ফুলের ছবি সেলাই করছে। তার পাশে কে যেনো কলম দিয়ে লিখে রেখেছে- 'আই লাভ ইউ'। ঝর্না বলতে চাইছে, ওটাই তাদের হাসির রহস্য। নির্মল স্যার এবার মোস্তফা'র উপর নহর দিলেন।

তুমি কি জন্য হাসছো? জবাবে মোস্তফা বললো, হেইডা কইতে পারমু না, স্যার। স্যার তখন আরো কঠোর হয়ে ধমক মারলেন, কইতে পারবা না মানে? গোপন কিছু? হ' স্যার, এক্কেরে গোপন। নির্মল স্যার ঝর্না আর মোস্তফাকে দাঁড় করিয়ে রেখে ক্লাশ চালিয়ে গেলেন। আমি নিশ্চিত সেদিনের ক্লাশের বাকি সময়টায় কারো আর পড়ায় মনযোগ ছিল না। আমরা সবাই তখন সেই হাসির রহস্য নিয়ে ব্যস্ত।

আর তাপসের নের্তৃত্বে একদল লেগে গেল পুতুলের রুমালে কে লিখেছিল তা নিয়ে গোয়েন্দাগিরি করতে। তালেব আলী নানা ঘণ্টা পিটিয়ে দিলেন। দুই মিনিট পর নির্মল স্যার ক্লাশ থেকে বের হলেন। এর মধ্যেই মাহফুজা মোস্তফাকে বলে বসলো- শয়তান। তাই নিয়ে মোস্তফা আর মাহফুজা-ঝর্না বাকবিতণ্ডা।

ওদিকে পুতুলের থেকে সেই রুমাল চেয়ে নিয়ে আমাদের তাপস আর হারুন হাতের লেখা দেখে ঘোষণা করলো- এটা জীবনের হাতের লেখা। ঠিক সেই মুহূর্তে আমাদের বিজ্ঞানের ক্লাশ নিতে আসলেন অনন্ত স্যার। অনন্ত স্যার খুবই বদমেজাজী। এসেই চেয়ারে না বসে টেবিলের চক ফু দিয়ে উড়িয়ে একটু হাতের খাতা দিয়ে ঝেড়েঝুড়ে টেবিলেই আরাম করে বসতেন। উচুতে বসায় অনন্ত স্যারের ক্লাশে টু শব্দ করার কোনো জো ছিল না।

করলেই সে ধরা পড়া যেতো। তো স্যার টেবিল ঝাড়তে ঝাড়তে জিজ্ঞেস করলেন, হৈ চৈ কি নিয়ে? মেয়েদের মধ্য থেকে শাহনাজ আবার ফিক করে একটু হেসে ফেললো। শাহনাজকে সকল স্যাররা একটু বাড়তি স্নেহ করতেন। কারণ শাহনাজের বাবা দীঘিরজান প্রাইমারি স্কুলের সেকেন্ড স্যার। অনন্ত স্যার শাহনাজকে জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে? শাজনাজ বললো, স্যার পুতুলের রুমাল।

আবার সেই হাসি। এবার একটু উচ্চস্বরে। এবার অনন্ত স্যার সেই রুমাল উদ্ধার করে নিজের কাছে নিলেন। গোটা ক্লাশ তখন ধমধমে। অনন্ত স্যার কয়েকবার 'নারায়ন, নারায়ন' বলে চিৎকার করলেন।

মানে আমাদের দপ্তরি নারায়ন দা এবার লাইব্রেরি থেকে বেত নিয়ে আসবেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে নারায়ন দা বেত নিয়ে হাজির। অনন্ত স্যার ঘোষণা করলেন, জোড়া বেত লাগবে। নারায়ন দা আবার লাইব্রেরিতে গিয়ে জোড়া বেত নিয়ে আসলেন। ইতোমধ্যে তাপস, হারুন, শাজনাজ, হেনা, মিনতী এরা এই মর্মে সাক্ষ্য দিলেন যে, পুতুলের ফুলতোলা রুমালে কে বা কারা যেনো ওটা লিখেছে।

কে লিখেছে, ওরা দেখেনি। তাপসরা কেউ কেউ স্বাক্ষ্য দিল ওই হাতের লেখার সঙ্গে জীবনের হাতের লেখায় মিল আছে। তো আর কই যায়! অনন্ত স্যার প্রথমে শুরু করলেন শাহনাজকে দিয়ে। দুই হাতে চারটা। বামহাতের গোড়ার দদিকে দুইটা।

তারপর পুতুলকে ছয়টা। তারপর হেনাকে চারটা। তারপর মিনতীকে আটটা। মেয়েদের বেতানোর পর এবার ছেলেদের পালা। তাপসকে চারটা হাতে পিঠে দুইটা।

হারুনকে ছয়টা হাতে দুইটা পিঠে। সবশেষে জীবনের পালা। জীবনকে সেদিন অনন্ত স্যার ঠিক গরুর মতোই পিটিয়েছিলেন। কয়টি তার হিসেব নেই। শুরু করেছিলেন দুই হাত দিয়ে।

জীবন যখন আর হাতে সইতে পারছিল না তখন আর হাত পাতলো না। তখন পিঠে। পিঠে যখন আর সয় না তখন পাছায়। জীবন ততোক্ষণে হাইবেঞ্চের ফাঁক গলিয়ে স্যারের একেবারে সামনে চলে এসে স্যারে পায়ে পরেছে। স্যার তখনো পেটালেন।

তারপর অনন্ত স্যার বেত জানালা দিয়ে ছুড়ে মারলেন। আমাদের রোলকল খাতা আর চক ডাস্টার ক্লাশরুমে ছুড়ে দিলেন। আর ঘোঁদঘোঁদ করতে করতে ক্লাশরুম থেকে বেড়িয়ে গেলেন। ......................চলবে........................... ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।