আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্বভাবধর্ম + ধর্মবিশ্বাস = মানুষের ধর্ম

বাংলা আমার দেশ বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী এই লেখাটির শিরোনামে যে শব্দগুলি আছে তাদের পৃথক ও যুক্ত অবস্থায় কী অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে তার কৈফিয়ৎ প্রথমেই দিতে হয় এবং এদের আভিধানিক অর্থগুলো দিয়ে কৈফিয়ৎটি শুরু করা যাক। স্বভাব শব্দটির অর্থ প্রকৃতি। তাপে পানি বাষ্প হয় কিংবা হিমে বরফ হয়। আমরা বলি পানির এটাই ধর্ম, কিন্তু এই ধর্ম উৎকৃষ্ট পানির, নিকৃষ্ট পানির নয়। অর্থাৎ পানি যখন নির্ভেজাল থাকে তখন তার নিশ্চিত স্বভাবধর্ম এটা-ই।

ধর্মবিশ্বাস যুক্ত শব্দের ধর্ম শব্দটির অর্থ যদি ইংরেজি শব্দ রিলিজন বলা হয়, সেক্ষেত্রে ধর্মবিশ্বাস যুগ্মশব্দের অর্থ দাঁড়ায় এমন একটি নির্দিষ্ট নীতিজাতীয় বিশ্বাস যেগুলোতে যারা বিশ্বাসী তাদের কাছে সেগুলো উচিত-অনুচিতের কষ্ঠিপাথর। মানুষের প্রতিশব্দ মানব এবং সেক্ষেত্রে মানবতা গুণটি যার নেই তিনি মানুষের সংজ্ঞায় আসতে পারেন না। যে চুরি করে সে মানুষ নয় এটা তর্কাতীত। অর্থাৎ মানুষের ধর্ম আর মানবতার ধর্ম একই কথা। ছোটবেলার কথা মনে পড়ল।

ইংরেজ শাসনকাল। আব্বার কর্মস্থল পিরোজপুর শহরে বাস করি। আমি চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ি। সিরাজ নামে মাঝবয়সী একজন মধুবিক্রেতা মাঝে-মধ্যে আমাদের বাসায় আসত। সে মধু বেচার পরেও বারান্দায় বসে আমার সঙ্গে বিস্তর গল্প করত।

পিরোজপুর ছাড়িয়ে বহুদূর দক্ষিণে সুন্দরবনের গভীর জঙ্গলে উঁচু গাছের ডালে মৌমাছিদের মস্ত বড় বড় চাকে মধু পাওয়া যায়। সিরাজের গল্পের বিষয় ছিল সে কী কৌশলে কী সাহসে কখনো একাকী চাক ভেঙে মধু সংগ্রহ করত। বোধ করি সে আমাকে তার গল্পের এমন শ্রোতা পেয়েছিল যে তার বর্ণনার সবটুকু বিশ্বাস করত। সেবার সিরাজ একা মধু সংগ্রহে সুন্দরবনে গিয়েছিল। মৌচাকের খোঁজ বেখেয়ালে সে বনের এক গভীর অংশে চলে যায়।

হঠাৎ সে দেখতে পেল গাছের উঁচু ডালে মস্ত বড় মৌচাক। লোভের বশে সে চাকটি ভাঙতে শুরু করল। তারপর মধুভর্তি চাকের টুকরোগুলো পাত্রে ভরে সেটা পিঠে বেঁধে ফিরতি পথ ধরল। এদিকে দুপুর গড়িয়ে তখন বিকেল হয়ে গিয়েছে। মরা রোদ গাছের মাথায়।

চারিদিকে গা ছমছম করা নিস্তব্ধতা। নিচে ঘাসগুল্মঢাকা মাটিতে আবছা আঁধার। সিরাজের মনে হলো একটা অজানা-অচেনা পরিবেশ তাকে গ্রাস করে ফেলেছে। আচমকা একটা কণ্ঠস্বর শুনে সে একটা গাছের আড়ালে থমকে দাঁড়াল। অবাক কাণ্ড! কয়েক হাত দূরে আর একটি গাছের তলায় এক বাঘিনী তার বাচ্চার গালে চড় মারছে আর বলছে, আর কখনো চুরি করে খাবি? মানুষ কোথাকার! বাঘিনী তার বাচ্চাকে চুরি করে খাওয়ার জন্য যখন বকাবকি করছিল তখন চোর শব্দটির সমার্থক তার অভিজ্ঞতায় মানুষ শব্দটি এসেছিল।

সে দেখেছে মানুষ বনজঙ্গল থেকে কাঠ চুরি করে, মধু চুরি করে, জন্তুদের হত্যা করে তাদের মাংস কিংবা চামড়া কিংবা সবকিছু চুরি করে। কিন্তু বাঘিনীর জানা নেই এটা মানুষের স্বভাবধর্ম নয়, সুতরাং এটা তার ধর্মবিশ্বাসের কোনো নীতি হতে পারে না এবং সেজন্য এটা মানুষের ধর্মও নয়। এই প্রসঙ্গে মানুষের স্বভাবধর্ম কী এই প্রশ্নটি হাজির হচ্ছে। উত্তরটি আমি নিশ্চিত সব ধর্মবিশ্বাসেই পাওয়া যাবে। প্রশ্নটির উত্তরে কোরআন বলে, “একনিষ্ঠভাবে নিজেকে ধর্মের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাখ।

এটাই আল্লাহর প্রকৃতি, যার ওপর তিনি মানব সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টির কোনো পরিবর্ত নেই। এটাই সরল ধর্ম কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না”। (৩০ঃ৩০) একজন মানুষকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, আপনি কি একজনকে অযথা গালিগালাজ করতে পারবেন? আপনি কি অযথা একজনকে মারধর করতে পারবেন? আপনি কি চুরি করতে পারবেন? আপনি একজন ক্ষুধার্ত দুঃস্থ মানুষের সামনে পার্কে বসে কিছু খেতে পারবেন? আপনি কি উলঙ্গ হয়ে পথেঘাটে হাঁটতে পারবেন? নিশ্চয়ই প্রতিটি প্রশ্নের আপনার বিবেকের উত্তর হবে না, না, কখনই না। এই উত্তরগুলো কে আপনাকে শিখিয়েছে? কেউ না।

এটাই আপনার প্রকৃতি বা স্বভাবধর্ম যার ভিত্তিতে আপনাকে সৃষ্টি করা হয়েছে যে ভিত্তির কোনো পরিবর্তন নেই। আবার সুন্দরবনের ওই বাঘিনীর কাছে ফিরে যাওয়া যাক। সে বাঘিনী কিংবা তার সহধর্মী ব্যাঘ্রকুল প্রয়োজনের অধিক প্রাণীহত্যা করে না। আপনারা অনেকে টিভিতে ‘ডিসকভারী’ চ্যানেলে দেখেছেন। সেখানে দেখা একটি ‘লাইভ’ দৃশ্যের কথা বলছি।

একটি গভীর জঙ্গলের মাঝে দেখা যাচ্ছে এক পাল হরিণ চরে বেড়াচ্ছে, ঘাসগুল্ম খাচ্ছে। হঠাৎ জঙ্গলের গহীন অংশ থেকে একটা বাঘ বের হয়ে হরিণের পালে হামলা করল। হরিণেরা প্রাণপণে দৌড় দিল। বাঘটি তাদের পিছুপিছু দৌড় দিয়ে একটি হরিণকে মেরে ফেলে তার রক্ত চাটতে লাগল। যে মাত্র হরিণটি নিহত হলো ও বাঘটি তার শিকার নিয়ে ব্যস্ত হলো হরিণদের দৌড়ানো থেমে গেল ও তারা বাঘটির আশেপাশে নির্ভয়ে চরতে লাগল।

কারণ তারা জানে বাঘ তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত আদৌ কোনো প্রাণীহত্যা করবে না। এই প্রসঙ্গে কোরআন বলে, (হে মুহাম্মদ) “আর তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে, কী তারা ব্যায় করবে? বলে দাও, নিজেদের প্রয়োজনীয় ব্যয়ের পর যা বাঁচে তাই খরচ করবে”। (২ ঃ ২১৯) ‘প্রয়োজন’-এর সংজ্ঞা একেজনের কাছে একেক রকম মনে হলেও যখন একজন তার স্বভাবধর্মে বা আপন প্রকৃতিতে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে তখন তার প্রয়োজনীয়তা ক্রমাগত কমতে থাকবে যেমন জাতীয় কবি বলেছেন ঃ “ইসলাম বলে, সকলের তরে মোর সবাই, সুখ-দুঃখ সম-ভাগ করে নেব সকলে ভাই নাই অধিকার সঞ্চয়ের! * * * * ওগো সঞ্চয়ী, উদ্বৃত্ত যা করিবে দান, ক্ষুধার অন্ন হোক তোমার। ” (কাজী নজরুল ইসলাম, ঈদ-মোবারক) আমি নিশ্চিত খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, হিন্দু ও যেকোনো ধর্মবিশ্বাসে উপরোক্ত একই সুর পাওয়া যাবে। সুতরাং ব্যক্তিগত পর্যায়ে ধর্মবিশ্বাসে আবদ্ধ থাকলে এবং সেটা মানুষের স্বভাবধর্মও বিধায় তখন সেগুলো মানুষের ধর্ম হয়ে যায়।

কিন্তু ধর্মীয় সংগঠন গড়ে উঠলে, ধর্ম রাজনীতির উপর ভর করলে তখন তার কাজ দেখা যাচ্ছে কেবলমাত্র প্রচারেই আবদ্ধ থাকে না। যে সব বিশ্বাস ও তাদের সঙ্গে কাহিনী ধর্মসংগঠনটির আদিম মূলধন তাদের বিষয়ে কেউ সংশয়ী হলে তার প্রতি বলপ্রয়োগের উদাহরণ অতীতে ও বর্তমানে অসংখ্য পাওয়া যাবে। এই অসহিষ্ণুতা বন্ধ করার উপায় যারা মানুষের ধর্মে বিশ্বাসী তাদেরকে ভাবতে হয়। ধর্মের বিরুদ্ধে নাস্তিকদের যারা মানুষের ধর্মকে অস্বীকার করেন না তাদের অভিযোগ একটাই। সেটা হচ্ছে সব সমাজেই অসাম্য, অত্যাচার ও শোষণ বর্তমান যার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ বিদ্রোহ করা মানুষেরই ধর্ম।

ক্ষমতাশালীরা এই বিক্ষোভ বিদ্রোহ দমনের জন্য, অসাম্যভিত্তিক সামাজিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য, ধর্মপ্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজে লাগায়। এটা আমার কোনো নিজস্ব মতামত নয়। অতীত ও চলতি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এটা দৃঢ়তা পেয়েছে। কিন্তু যদি দয়া দাক্ষিণ্য সেবা সততা দায়িত্ববোধ ইত্যাদি স্বভাবধর্ম এবং ধর্ম বিশ্বাস উভয়েরই একত্র যোগফলে মানুষের ধর্ম হয়, তবে ধামির্কতার রূপ কখনও হিংস্র কিংবা অত্যাচারী হতে পারবে না। ২৩ জুলাই ২০০৮ ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.