আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পতনের পর পর

ভ্যাপসা গরমে যখন সবাই হাঁস-ফাঁস করে একে একে লাইন থেকে বেড়িয়ে চলে যাচ্ছিল কাউন্টারে টিকিট জমা দিয়ে- তখনই বাসটা চলে এলো। ভিতরটা ফাঁকা দেখে সদ্যভাঙ্গা যাত্রী-লাইনের সামনের অংশটুকু প্রায় লাফিয়ে বাসে চড়ে বসল মধ্যবয়স্ক মহিলাটি। সব গুলো খোলা জানালা দিয়ে যে সামান্য কিঞ্চিত বাতাস ঢুকতে পারছে তাতে শরীরের ঘাম শুকোচ্ছে না। ঘামে ভেজা শরীরের যতটুকু সম্ভব শাড়ী টেনে একদম শেষ মাথায় একটা সিট খালি পেয়ে টালমাটাল হয়ে চলন্ত বাসের মধ্যে দিয়ে এগোতে থাকলো। ঘামে বুকের খোলা অংশ চিক চিক করছে হালকা উজ্বলতায়, ভারী নিতম্বের দিকে আড়চোখে ঘুরে আসে অনেকগুলো চোখ।

কোন প্রসাধনী ব্যবহার করেন নি মহিলা- ভুরু দুটো কোন কিছু দেখে আশ্চর্য হয়েছেন এমন ভঙ্গিমায় বাঁকিয়ে রেখেছেন। সিঁদুর বরাবর একটা ঘামের রেখা আস্তে করে গড়িয়ে পড়ল মুখের মধ্যক বরাবর, এক হাত ঝাঁপটা উঠিয়ে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ঘষে সরিয়ে দিতে চাইলো মহিলা রেখাটা- আর স্পীড ব্রেকারের প্রবল ঝাঁকুনিতে ভাঁজ হয়ে এলো দু-পা। শূন্যের মাঝে দুই হাত এলোমেলো করে ছুঁড়ে ধরতে চাইলো কোন কিছু- চলন্ত বাসে এ ধরনের কান্ড খুব সাধারন। কিন্তু তারপরও যাত্রীদের আগ্রহের কোন ঘাটতি তৈরী হয় না কখনো এ ধরনের কোন ঘটনা সামনাসামনি ঘটে গেলে উপস্থিতিতে আগ্রহী দর্শক হয়ে বসে থাকতে। চুড়ি ওয়ালা কোন হাতকে সাহায্য করতে আরেকটা হাত এগিয়ে আসলে সাহায্যপ্রার্থীও দেখে নেয় বাড়িয়ে দেওয়া হাতে চুড়ি আছে কিনা।

অশ্লেষে কোন সাহায্যকারীও তখন নিবৃত্ত হয় ক্ষণিক উপলব্ধিজাত অপরের অপমানটুকুর সামনে দাড়িয়ে নিজে অপমান হয়ে। শরীরের পুরো ভর ভীড়ে অন্য কারো পায়ের উপর চাপিয়ে নিশ্চিন্ত মনে রাস্তাটুকু পাড় করে দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন শহরের মানুষ। অর্ধেক ভাড়ার দাবীতে বাস পুড়িয়ে হাসতে হাসতে পরের বাসের হ্যান্ডল পাকড়ে ধরেন অর্ধেক ভাড়া চুরি করে, কন্ডাকটরকে বলা জায়গার চেয়েও অতিরিক্ত চড়ে। জানালার ফাঁক গলে আসা চৈতালি রোদের ঝাপটায় আবছা কেউ কেউ লক্ষ্য করে রক্তিম মুখটা ইষৎ লজ্জিত ও ঘটনার আকস্মিকতায় স্তব্ধ। কয়েক জোড়া হাত এগিয়ে যায় মহিলার দিকে- তাকে সোজা দাড় করিয়ে দিতে।

মহিলাটি কোন হাতের দিকে তাকায় না। কেয়ারই করলো না যেন- ঐ হাতগুলোতে কোন চুড়ি নেই। অঙ্গে-উপাঙ্গে তখন ব্যাথ্যা আর অপমান-লজ্জার মিশেল কোন তরল বইছে। এরই ফাঁকে একটা হাত বুকে এসে আলতো ছুঁয়ে যায়। কেউ খেয়াল করে না, বাসের সবগুলো চোখ ব্যস্ত হয়ে ঘুরে রাস্তার দৃশ্য আর মহিলাটির শরীরের দৃশ্যমান অঞ্চলে।

ভদ্রলোক একটা দেঁতো হাসি দিয়ে ফিরে চলে যান নিজের সিটে- অন্য কেউ বসে পড়তে পারে সেই ভয়ে। তাৎক্ষনিক বিমূঢ়তার ভাব কাটিয়ে উঠতে পারে না যেন মহিলা। আস্তে করে একটা কিশোর এগিয়ে এসে বলে, আপা আপনি আমার সিটটাতে বসেন। এদিকে আরেকটি তরুণ সামনের সিট থেকে লাফিয়ে সামনে এগিয়ে গিয়ে সেই মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোকের কলার চেপে ধরে গেটের দিকে টেনে নিয়ে যায়। এরা খুব সামান্য সময়ে অসামান্য প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে, অগ্রপশ্চাদ বিবেচনা কিছুটা কম- সেই রমনী সুলভ চেহারার তরুণটির প্রচন্ড অগ্নিমূর্তির সামনে সেই ভদ্রলোক যেন কেঁচো হয়ে যান সহসাই।

মুহূর্তে এক প্রচন্ড কোলাহল তৈরী হয়ে যায়- আশেপাশের লোকজনের হই হই রই রই এড়িয়ে শোনা যায় তরুণটির চিৎকার, ‘শাউয়্যার পোলা তগো বাসায় মা-বোন নাই, বানচোত....’ মহিলাটিকে আর শেষের দিকের সিটের দিকে হেঁটে যেতে হয় না। সামনের দিকেই একটা সিট পেয়ে যান। প্রত্যভিজ্ঞায় এই ধরনের ঘটনার সাথে পরিচিত হওয়ায় দ্রুত সামলে উঠেন তিনি-কিছুক্ষন আগে সেই মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোকের আচরণ। আলতো করে আঁচল দিয়ে পেঁচিয়ে রাখা হাত থেকে সেই ভদ্রলোকের মানিব্যাগটি পাশের যাত্রীর চোখ এড়িয়ে ভ্যানিটি ব্যাগের মধ্যে চালান করে দিয়ে কপাল ঠেসে ধরেন জানালার কাঁচে। চাতক বহুড়ীর মতো উপরে তাকান মহিলা- আজ প্রচন্ড গরম পড়েছে- বৃষ্টি পড়তে পারে ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।