আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চক্র

আমি কিছু বলতে চাই। বিকেলের ঘুমটা হঠাৎ করেই ভেঙে যায় মিলির। চোখদুটো মেলে চারপাশটা দেখতে থাকে সে। কোথায় আছে বুঝতে কিছুটা সময় লাগে তার। এত সুন্দর একটা স্বপ্নের মাঝখানে ঘুমটা ভেঙে গেল! একটু আগেও তার পাশে একজন মানুষ ছিল।

বৃষ্টিভেজা একটা রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল তারা দুজন। নির্জন,নিস্তব্ধ আর অনন্ত বিস্তৃত সেই রাস্তাটার কোন শেষ ছিল না। অথচ এতটুকু ক্লান্তিও ছিল না কোথাও। মিলির মনটা খারাপ হয়ে যায় ভীষন। বিকেলের স্বপ্নগুলো যদি সত্যি হত! ভেতরের রুম থেকে শোরগোলের শব্দ শুনতে পায় সে।

আস্তে আস্তে বিছানার উপর উঠে বসে। এলোমেলো চুলগুলো বেধে নেয় খুব যত্ন করে। মিলিকে উঠতে দেখে টুনি দৌড়ে আসে ভেতর থেকে। "আপা তোর বিয়ে হয়ে যাবে"- টুনির মুখটা শুকিয়ে এতটুকুন হয়ে গেছে। "তোকে কে বলল এসব?" "আমি সব জানি আপা,তোর বিয়ে হয়ে যাবে"।

মিলির বিশ্বাস হয় না একদম। আবার অবিশ্বাসও করতে পারে না। এইরকম বয়সে তার বড় আপারও বিয়ে হয়ে গিয়েছিল, বাবার এক বন্ধুর ছেলের সাথে। বাবা বেশ কিছু টাকা ধার নিয়েছিলেন তার কাছ থেকে। কিন্তু সেই টাকা দেয়ার মতন সামর্থ্য বাবার ছিল না।

আপাকে একরকম জোর করেই বিয়ে দেয়া হয়েছিল। আপাও টু শব্দটি করে নি। মুখ বুঝে মেনে নিয়েছিল সবকিছু। "আমি না থাকলে তোর কি অনেক কষ্ট হবে?"-মিলি জিজ্ঞেস করে। টুনি এই প্রশ্নের কোন উত্তর দেয় না।

চুপচাপ দাড়িয়ে থাকে কিছুক্ষন। তারপর মুখটা নিচু করে চলে যায়। মিলি অবাক হয় ভীষন। এতটুকু একটা মেয়ে। মায়া,মমতা আর ভালবাসার মত জটিল বিষয়গুলো যার বুঝার কথা না, সেও কত সহজে মায়ার জালে বন্দী হয়ে গেছে! কত সহজে মান অভিমান করা শিখতে শুরু করেছে! একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে আপনাআপনি।

মায়া বড় কঠিন জিনিস, অস্বীকার করা যায় না তাকে। আকাশ দেখা হয় না আজ অনেকদিন। বারান্দায় দাড়িয়ে শরতের আকাশটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মিলি। অসাধারন একটা অনুভূতি হয় তার। অল্প কিছু মুহুর্তের জন্য বেঁচে থাকাটা সার্থক মনে হয়, জীবনটাকে আর অর্থহীন মনে হয় না।

বাসার সামনের রাস্তাটার দিকে চোখ পড়তেই মনির ভাইকে দেখতে পায় মিলি। মনির ভাই হা করে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। চোখে চোখ পড়তেই চোখ সরিয়ে নিলেন। হন্তদন্ত করে সামনের দিকে যাওয়া শুরু করলেন। কিছুদূর গিয়েই আবার ফেরত আসলেন।

-"এই দিক দিয়েই যাচ্ছিলাম মিলি,কেমন আছ?" মিলির হাসি পায় ভীষন। প্রতিদিন এই রাস্তাটায় দাড়িয়ে থাকেন মনির ভাই। দেখা হলে প্রতিদিন একই কথা বলেন। তারপর খুব ব্যস্ত ভঙিতে চলে যান সামনের দিকে। "জ্বি মনির ভাই, ভালো আছি"- মিলি উত্তর দেয়।

হাতের ঘড়িটার দিকে বারবার তাকাতে থাকেন মনির ভাই। কয়েকবার আকাশের দিকেও তাকান। বৃষ্টি আসবে কিনা সেটা পরখ করে নিচ্ছন যেন। "আজ যাই মিলি, অন্য একদিন কথা হবে"। কথাটা বলেই আর দাড়ান না মনির ভাই, খুব ব্যস্ত ভঙিতে চলে যান সামনের দিকে।

মানুষটা আসলেই ভীষন বোকা। দিনের পর দিন এভাবে দাড়িয়ে থাকেন কেন কে জানে? মা পাশে এসে দাড়িয়েছেন অনেক্ষন হলো। "মিলি,কাল বাসায় কিছু মেহমান আসবে,একটু সেজেগুজে থাকিস মা"। এই প্রথম অজানা আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে উঠে মিলির। চোখের কোনে পানি জমতে শুরু করে।

বাবা আবার কি করে বসেছেন কে জানে? মা বুঝতে পারেন সব। সাহস জোগানোর চেষ্টা করেন শুধু। "ছেলেটা অনেক ভালো, তুই অনেক ভালো থাকবি মা"। মা'র চোখদুটোও ছলছল করে উঠে পানিতে। আর কিছু বুঝতে বাকি থাকে না মিলির।

বড় আপার পর এবার তাকেও বলির পাঠা বানানো হচ্ছে। দু'চোখের পানি ধরে রাখতে পারে না সে। মায়ের সামনে থেকে চলে যায়। বাথরুমের দরজাটা লাগিয়ে অঝোরে কাঁদতে থাকে। রাতে টুনিকে নিয়ে ছাদে উঠে মিলি।

বাগানটা ঠিক আগের মতই আছে। গোলাপগুলোর রংও বদলায়নি এতটুকু। কিংবা আকাশের পূর্নিমার চাঁদের আলো, সেটাও ম্লান হয় নি একরত্তি। শুধু চারপাশটা অদ্ভুত রকমের নির্জন,নির্জীব। কোথাও প্রানের ছোঁয়া নেই।

আপার কথা মনে পড়ে মিলির। একসময় আপার সাথে এই ছাদে উঠতো। ছাদের এপাশ থেকে ওপাশ চষে বেড়াতো দু'জন। সারারাত গল্পের আসর বসাতো। সবচেয়ে বেশি মজা হতো ভূতের গল্পগুলোর দিন, রাতে আর ঘুমাতে পারত না মিলি, আপাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতো শুধু।

সেই আপাকে গত পাঁচ বছরে একবারের জন্যও দেখল না মিলি। একটাবারের জন্যও কথা হল না তার সাথে। তার দুঃখিনী আপাটা কোথায় আছে, কেমন আছে, কিচ্ছু জানে না মিলি। আপার বিয়ের দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ে মিলির। বিয়ের আগের দিন সারাটা রাত কেঁদেছিল আপা।

কিন্তু কি আশ্চর্য্য, বিয়ের দিন তার দু'চোখে এক ফোটা অশ্রুও ছিল না। বুকে পাথর বেধে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিল আপা। নিজের কষ্টগুলোর কথা কাউকে বুঝতে দেয় নি, মুখ ফুটে কাউকে বলেওনি কোনদিন। অথচ সৃষ্টিকর্তার কি প্রহসন,ভদ্রগোছের একটা লম্পটকে গছিয়ে দিলেন তিনি। টুনিটা চুপচাপ বসে আছে, হাঁসিখুশি মেয়েটা হঠাৎ করেই নিশ্চুপ হয়ে গেছে।

কি ভাবছে কে জানে? হয়ত নিজের কথাই ভাবছে। একদিন তো সেও বড় হবে। স্বপ্ন দেখা শুরু করবে। তারপর সেই স্বপ্নগুলিকে জলান্জলি দিয়ে মুখ বুঝে সব সহ্য করে নেবে। পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষ শুধু প্রতারিত হতে আসে, তাদের স্বপ্ন দেখতে হয় না।

পরদিন সকাল থেকেই মিলিদের বাড়িভর্তি মানুষ। মিলিকে পছন্দ হলো তাদের। খুব দামী একটা আংটি পরানো হল, আর খুব কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নেয়া হল। আজ রাতেই মিলিকে নিয়ে যাবে তারা। ছেলে দেশের বাইরে থাকে।

খুব বেশিদিন দেশে থাকবে না,এই জন্যই এত তাড়াহুড়ো। বুকের ভেতরটা শূন্য হয়ে যায় মিলির। এতদিনের পরিচিত ঘর,পরিচিত মানুষজন, সবকিছু ছেড়ে চলে যেতে হবে। টুনিটার জন্য অনেক খারাপ লাগবে তার। মেয়েটা বড্ড একা হয়ে গেল।

সন্ধ্যার পর প্রচন্ড বৃষ্টি নামে। শেষবারের মতন বৃষ্টিটাকে আপন করে দেখতে ইচ্ছে হয় তার। বারান্দায় গিয়ে দাড়ায় মিলি। খুব অপ্রত্যাশিত ভাবে মনির ভাইকে দেখতে পায় রাস্তায়। বৃষ্টিতে ভিজছেন মনির ভাই।

মিলির চোখে চোখ পড়তেই চোখদু'টো নামিয়ে নিলেন। কিন্তু আজ আর চলে গেলেন না। অপরাধীর মতন দাড়িয়ে রইলেন শুধু। জীবনে এই প্রথমবারের মত কোন মানুষকে ভালোবাসতে ইচ্ছে হয় মিলির,ভীষন ইচ্ছে হয়। বোকা এই মানুষটা তাকে একটাবার দেখার জন্য এই বৃষ্টির মধ্যে দাড়িয়ে আছে, কতক্ষন দাড়িয়ে আছে কে জানে? মিলির খুব বলতে ইচ্ছে করে,"আপনি এভাবে বৃষ্টিতে ভিজবেন না,জ্বর হবে তো"।

কিন্তু ততক্ষনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। কথাটা হয়ত আর কোনদিন বলা হবে না। নিজের রুমে এসে চুপচাপ শুয়ে থাকে মিলি। আচ্ছা,ওই স্বপ্নটা যদি আরেকবার দেখা যেত!! বৃষ্টিভেজা আর দিগন্তবিস্তৃত একটা রাস্তা। দু'পাশে কোন মানুষজন নেই তার।

শুধু একজন অপরিচিত মানুষের হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছ মিলি। মুহুর্তে চমকে উঠে মিলি। সেই অপরিচিত মানুষটা আর কেউ না-মনির ভাই। মিলি বুঝতে পারে, বিকেলের স্বপ্নগুলো সত্যি হয় না। (অনেক তাড়াহুড়ো করে লেখা,খুব একটা ভালো হয় নি,ক্ষমাপ্রার্থী।

) contact: ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।