আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঢাকা মহানগরীর স্থাপত্য মহাকাব্য রচয়িতা লুই আই কান

শুচি সৈয়দ শুচি সৈয়দ ১৯৮৪ সালের ১৪ অক্টোবর ঢাকার জাতীয় সংসদকে ঘিরে মানিক মিয়া এভিনিউয়ের প্রশস্ত চত্বরে সারা বাংলাদেশ থেকে এসে জমায়েত হয়েছিল গণতন্ত্রকামী লক্ষ মানুষ। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সেই মাহেন্দ্রক্ষণে যথার্থই সার্থক হয়ে উঠেছিল স্থাপত্যের কবি, দার্শনিক, ধ্যানী-যোগী লুই আই কানের হাতে নির্মিত গণতন্ত্রের জীবন্ত সৌধ বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ভবন। একই সঙ্গে অন্য একমাত্রায় উত্তীর্ণ হয়েছিল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মহান চেতনা ও আকাক্সক্ষাÑ ধারাবাহিকতায় যা পতন ঘটিয়েছিল সামরিক স্বৈরাচারের। উপরের উপলব্ধিটি মনে এলো লুই আই কান বইটি পাঠের পর। বিশ্ব বিখ্যাত স্থপতি, আমাদের জাতীয় সংসদ ভবনের নির্মাতা লুই আই কানকে নিয়ে লিখেছেন আহমেদ খালেদ।

বাঙালির একটি অন্যতম গৌরবের নির্মাতা এই অমর স্থপতিকে আমরা তার যথার্থ প্রাপ্য সম্মাননা আজও দিতে পারিনি। লুই আই কান সম্পর্কে আমাদের বাংলা ভাষায় লেখালেখির যে প্রায়-শূন্যতা রয়েছে তার সামান্য ক্ষতিপূরণ আহমেদ খালেদের এই বইটি। যে কোনও পাঠক বইটি পাঠান্তে তৃষ্ণার্ত বোধ করবেনÑ এই অসাধারণ মহৎ মানুষটির জীবন সম্পর্কে আরও জানার জন্য। লেখক আহমদ খালেদের মুন্সীয়ানা এখানে যে, পাতার পর পাতা উল্টে যেতে পাঠককে বাধ্য করেনÑ লুই আই কানের বহুমাত্রিক কর্ম, সাধনা এবং জীবন সম্পর্কে আলোকপাত করে। স্থাপত্যিক বোধ বাঙালি জাতির জন্য সাম্প্রতিক উপলব্ধির বিষয়।

সেটাও ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভাগীয় শহরের কিছু মানুষের ভাবনা বলয়ে সীমিত। লুই আই কান যখন আমাদের জাতীয় অহংকারে পরিগণিত সংসদ ভবনের পরিকল্পনা করেন তখন সেই ১৯৬৪-৬৫ সালে প্রাদেশিক রাজধানী শহর ঢাকাও এক অজ মফস্বলই ছিল। বলা যায়, এক উষর মরুভূমিতে মরুদ্যান রচনার কর্মযজ্ঞে নেমেছিলেন স্থাপত্যের এই ধ্যানী-যোগী-দার্শনিক ও কবি। কান সম্পর্কে যে কথা ক’টি বলা হল সে বিশেষণগুলো নিতান্তই যথার্থ। কোনও অতিশয়োক্তি নেই তাতে।

যার প্রমাণ মিলবে তাঁর বহুমাত্রিক কর্মযজ্ঞে। পৃথিবীব্যাপী তাঁর কৃত স্থাপত্যের শরীর ও আÍায়। লুই আই কানকে দেয়া হয়েছিল বাংলাদেশের দ্বিতীয় রাজধানী নির্মাণের কাজ। আর সেই কাজে তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন যে কোনও বাঙালির চেয়ে বেশি বাঙালি সত্তায় অভিষিক্ত করে। ১৯৬২ সালে ২৭ আগস্ট বন্ধুর একটি ছোট্ট টেলিগ্রাম পেয়েই কাজ করার সম্মতি জানিয়েছিলেন কান।

আর ১৯৬৩ সালের জানুয়ারিতে এ দেশের মাটিতে পা রেখেÑ “সাইটের জলাকীর্ণ বিস্তীর্ণ নিচু জমির সামনে দাঁড়িয়ে বলে উঠেছিলেনÑ‘এখানে দরকার মাটির জন্য করা স্থাপত্য’ অর্থাৎ জলের সহযোগে মাটিকে প্রস্তুত করে যে স্থাপত্য, তাই। গ্রাম বাংলায় মানুষ বাড়ি তৈরি করতে গেলে প্রথমেই মাটি খুঁড়ে ভিটা প্রস্তুত করে। এই নির্মাণ রীতির প্রত্যক্ষ কোন জ্ঞান ছিল না কানের, তখন পর্যন্ত; তা সত্ত্বেও নিজস্ববোধ নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে এ রীতিই অনুসরণের সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ’’ (লুই আই কান, পৃ. ৭১) যেন এ মাটির এক সন্তান তিনি! জšে§ছেন এই বঙ্গে! এই বোধ প্রকৃতপক্ষে ঐশ্বরিক। মহৎ কর্মে, মহৎ কর্মীর জন্য স্বভাবজাত সর্বজনীনও বোধ করি! ‘মানুষ যেখানে এসে মিলিত হয়Ñ এমন সব জায়গার বিশিষ্ট এক মর্যাদা ছিল লুই কানের কাছে।

মানুষে মানুষে একত্র হওয়ার প্রেরণাকে কান বলতেন, ‘সম্মেলন’। আর তার কাছে, এ ছিল ধর্মীয় বা আধ্যাÍিক অনুভূতির মতোই পবিত্র এক বোধ। প্রেরণা থেকে মানুষ সৃষ্টি করে প্রতিষ্ঠানের, এমনটাই বিশ্বাস করতেন কান, তার সে বিশ্বাসের রূপায়নে তাই, উপসনালয় আর আইনসভার বাস্তবরূপ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। ’ (লুই আই কান, পৃ. ৮২) দার্শনিক, কবি এবং ধ্যানী-যোগী হিসেবে লুই আই কানের জীবনবেদ দাঁড়ায়Ñ ‘‘জীবনের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে, মানুষের মূল প্রেরণাগুলোকে মোটের উপর তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করতে চাইলেন লুই কান। এ ভাগগুলো হচ্ছেÑ লেখার প্রেরণা, সম্মেলনের প্রেরণা আর প্রকাশের প্রেরণা।

আর এই তিন প্রেরণা থেকেই গড়ে উঠেছে মানবেতিহাসের ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠানÑ এমনটাই ভাবতে চাইতেন তিনি। কানের কাজগুলোর মধ্যে, সম্মেলনের ধারণার সবচেয়ে চমৎকার প্রকাশ ঘটেছে, নিঃসন্দেহে ঢাকার জাতীয় সংসদ ভবনে। ’’ (লুই আই কান, পৃ. ১২৩) শুধু সম্মেলনের ধারণা নয়, আমার বিশ্বাস কানের পূর্ণাঙ্গ জীবনবেদই ফুটে উঠেছে আমাদের এই ভবনটিতে। কান সম্পর্কে সবচেয়ে সুন্দর মূল্যায়ন তার বন্ধু বালকৃষ্ণ দোশির। তিনি বলেছেন, ‘‘আমার তো লু-কে একজন যোগী বলে মনে হত; সবসময়ই ধ্যানে মগ্নÑ অনিত্যের ব্যঞ্জনাকেÑ সত্য আÍা ও সত্তাকে ধরবার সাধনায় মগ্ন।

’’ (লুই আই কান, পৃ. ১৩০) আবার ‘‘কানের কাজ সম্পর্কে ভিনসেন্ট স্কালির করা মন্তব্যই যেন শেষ কথা, ‘তার কাজগুলো নিঃশব্দ। সেগুলোর নৈঃশব্দ্যই আমাদের কাছে জীবন্ত হয়ে ওঠে। কিছু ধ্বনি, ড্রামের গম্ভীর বাদন, অর্গ্যানের তীক্ষè চিৎকার, আমাদের শ্র“তির বাইরে বেজেই চলে। নৈঃশব্দ্যের মাঝেই সেগুলো কাঁপতে থাকেÑ যেন ঈশ্বরের উপস্থিতি। ’’ (লুই আই কান, পৃ. ১৫২) লুই আই কান কেবল আমাদের দ্বিতীয় মহানগর নির্মাণের সূচনাই করেননিÑ বাঙালি প্রথম নাগরিক চেতনারও সূচনা করেছেন।

যদিও ঊনবিংশ শতাব্দীর শ্যামল জলাকীর্ণ বিস্তীর্ণ নিচু জমিতে পা রেখে সূচনা করেছিলেন এক স্বপ্নের মহানগরেরÑ আজ একুশ শতকে কংক্রিটের জঙ্গল এই নগরে, তার সেই আÍিক অভিযাত্রাকে খুঁজে পাওয়া দুষ্করÑ তা সত্ত্বেও কানকে আমাদের জাতির নির্মাণ পর্বে স্মরণ করতে হবে এক বিশিষ্ট বাঙালি হিসেবেও। লুই কানকে নিয়ে এই সুন্দর ও মূল্যবান বইটি লেখার জন্য আহমদ খালেদকে ধন্যবাদ। ধন্যবাদ প্রকাশক পড়–য়াকেও। লুই আই কান। আহমদ খালেদ।

প্রকাশক পড়–য়া, আজিজ মার্কেট, ঢাকা। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.