আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে মানুষের ভালোবাসা

শুচি সৈয়দ শুচি সৈয়দ আজ এ কথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি ‘আমার বাবা, আমার হিরো। ’ যতটা সহজে এই বাক্যটি লেখা গেল এই বোধটি অর্জনের যে অভিযাত্রা তা কিন্তু ততটা সহজ নয়। এই বোধটি অর্জনের জন্য অনেক রক্ত-ঘাম আর অশ্রু পেরিয়ে আসতে হয়েছে। শিল্পী শাহজাহান মাহমুদ ; রঙ তুলিতে সাইবোর্ড লিখেছেন, গ্রামের স্কুলে মাস্টারি করেছেন, ভাষা আন্দোলনের সময় ব্যানার-পোস্টার লিখেছেন, সক্রিয় রাজনীতি করেছেন, রাজনীতির জন্য জেলে গেছেন, নিগৃহীত হয়েছেন। সমাজ বিপ্লবের স্বপ্নে তারা তাদের বর্তমানকে উৎসর্গ করেছিলেন।

এ রকম বাবার বন্ধুরা? তাঁরাও আমার ‘হিরো’। আর এরকম একজন হিরো রণেশ কাকা। শ্রীরণেশ মৈত্র। আমার বাবা ছিলেন একজন সাধারণ কর্মী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)-এর। রণেশ কাকা ছিলেন নেতা।

আমার এখনো মনে পড়ে ন্যাপের জনসভা। ঢাকা থেকে কেন্দ্রীয় নেতারা এসেছেন। পাবনা টাউন হল ময়দানে লুঙ্গিপরা বাবার পাশে বসে আমি বক্তৃতা শুনছি। ন্যাপের একটি মুখপত্র ছিল সম্ভবত নাম সাপ্তাহিক নতুন বাংলা নামে। বাবা ছিলেন তার গ্রাহক।

সেই সাপ্তাহিকে প্রতি সপ্তাহে কলাম লিখতেন অধ্যাপক কমরেড মোজাফফর আহমেদ। ‘এ সপ্তাহের খেদির মা’। সে কলামে অনেক হাস্যকৌতুক সহযোগে নানা সমস্যার রাজনৈতিক ভাষ্য তুলে ধরতেন ন্যাপের সভাপতি। এবং যতদূর মনে পড়ে বেশ জনপ্রিয় ছিল সেই কলাম। আমি সেটি পড়ে মজা পেতে চেষ্টা করতাম কিন্তু মজা পেতাম না।

টাউন হলের মাঠে নেতাদের বক্তৃতার মতোই দুর্বোধ্য মনে হত তা। শুধু এটুকু খুব ভালোভাবে বুঝতাম তারা মানুষের জন্য ভালো কিছু চান। মানুষের, মানব সভ্যতার জন্য যা কিছু মঙ্গলকর তারা সেটারই পক্ষে। সেই অবুঝ শৈশবে আমার বাবা এবং বাবার বন্ধুদেরকে আমি কোনো বিশেষ দৃষ্টিতে দেখতে বা ভাবতে পারিনি। মানুষ ভালোর পক্ষে থাকবে সেটাই তো স্বাভাবিকÑতো সেই স্বাভাবিক মানুষের আলাদা বিশেষত্ব আর কি? তবু কেন যে তাঁরা জেলে যানÑ পুলিশের ধাওয়া খান এসব আমার মাথায় ঢুকত না।

ভালো এবং মন্দ। ব্যক্তি এবং সমষ্টিÑ এগুলো বোঝার সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে শিখলাম আমার ‘হিরোদের’। সময় বড় বলবান, প্রজš§ পর¤পরায় সময় এত দ্রুত ধাবমান যে, আমার হিরোদের কথা লিখতে গিয়ে আমি নিজেই সংশয়াকুল হচিছ আমার সšতান কি আমার এই লেখাটি বুঝবে? আমি কি তাকে যথার্থভাবে কম্যুনিকেট করতে পারবো—তাকে কি একথা সঠিকভাবে উপলব্ধি করাতে পারবো। রণেশ কাকার সফেদ চুলের ব্যক্তিত্ব স¤মন্ন অভিব্যক্তির দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করে এই যে, সাদা চুলের বুড়ো দাদুটিকে দেখছ ওঁরা তাদের জীবনবাজী ধরেছিল বলে এই দেশটি আজ স্বাধীনÑতোমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। ওঁরা চেয়েছিলেন এমন একটি দেশ, এমন একটি সমাজ যেখানে মানুষ বাঁচবে পরিপূর্ণ আÍমর্যাদায় বলীয়ান হয়ে।

স্বাধীন দেশটি আমরা পেয়েছি, পেয়েছি মাতৃভাষার অধিকার কেবল স্বপ্নের সমাজটি পাইনি। ওঁর সঙ্গে তোমার দাদাও ছিলেন। ’ এই গর্ব আর গৌরবের কি স্ফীত হবে আমার সšতানের বুক? হয়তো, বোধকরি, জানি না!! কেমন অসংলগ্ন তিনটি শব্দÑপ্রজš§ পর¤পরায় যে অসংলগ্নতা বিরাজমান বলে আমার কাছে প্রতিভাত হয়েছে আমি তাকে সরল সত্যতায় বর্ণনা করছি মাত্র। প্রজš§ থেকে প্রজšে§র মধ্যে ধারাবাহিকতা প্রবাহিত করার যে সাধনা কিম্বা কাজ সেই কর্মের সেতুটি ভেঙে পড়েছে বলে আমার মনে হয়। আর সে দায় সর্বাংশে আমাদেরই—জানি না দীর্ঘায়ু পেলে আমার বাবাও রণেশ কাকার মত গণফোরাম দলটিতে নাম লেখাতেন কি না।

আবারও শব্দ তিনটি এসে হাজির হচেছ হয়তো, বোধকরি, জানি না!!! আমার বাবা এবং তাঁর বন্ধুরা আমার হিরোÑ তাঁদের সামান্যতা এবং অসামান্যতাÑ দুটি দিকেই আমার দৃষ্টি আছেÑসচেতন আমি নিজের সামান্যতার বিষয়েও। কমরেড প্রসাদ রায়, কমরেড আমিনুল ইসলাম বাদশা, কামাল লোহানী, রণেশ মৈত্র ; শুনেছি কমরেড আলাউদ্দিনের সঙ্গেও সখ্য ছিল আমার বাবার। এ লেখার শুরু এবং বাবার প্রসঙ্গে পাঠক হয়তো বিরক্ত হবেন কিন্তু বাবা প্রসঙ্গ অপ্রাসঙ্গিক নয় সেটা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন। মূলত পিতৃপ্রতিমতার মধ্য দিয়ে আমি আমার অনুভূতির যথার্থ আদলটি ফুটিয়ে তুলতে চাইছিÑবলা চলে যথাযথভাবে কম্যুনিকেট করতে চাইছি। আমি আমার হিরোদের কথা বলতে চাইছি কারণ আমার হিরোরা আমার কাছে যতটা না ব্যক্তি কার চাইতে বেশি সমষ্টি।

রণেশ কাকার কথা লিখতে চাইলে কেবল রণেশ কাকা নয় লিখতে হবে আমাকে পুরো পরিবারটিকে নিয়েÑপূরবী কাকীমা, বাবলা দা, প্রলয়, কাজল... সবার কথা কারণ আমার হিরো আমার বাবা—তাঁকে এরা সবাই ভালোবাসতেনÑমোটা অক্ষরে আবারও শব্দটি লিখি আমার হিরো আমার বাবাকে এঁরা ভালোবাসতেনÑআমি নিজেও এঁদের ভালোবাসা এবং øেহ পেয়েছি। মনে আছে একবার আমার বাবা কিভাবে যেন আঘাত পেয়ে আহত হয়েছিলেন সম্ভবত হাত-টাত কেটে গিয়েছিল—Ñপূরবী কাকীমা এতো যতœ করে, এমন গভীর মমতায় তাঁর ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছিলেনÑ সেই কৃতজ্ঞতার শোধ কোনোদিনই দেয়া যাবে না। বাবলা দা অস্ট্রেলিয়ায় পারমিতা সিটি কাউন্সিলের নির্বাচিত প্রথম বাঙালি কাউন্সিলর এই সংবাদ আমাকে এতো অভিভূত করে যে সেটা লিখে বোঝাতে পারব না। সম্ভবত কাকার ৭৫তম জš§দিনে সদ্য হাসপাতাল থেকে কাজলের বাসায় দিয়েছেন। প্রলয়ের সঙ্গে আমরা ক’জন গেলাম তাঁকে দেখাতে—কাকা এসে বললেন, আজ আমার পঁচাত্তরতম জš§দিনÑ ভীষণ তড়িতাহত হলাম আমরা সবাই।

প্রলয়ও ভুলে গেছেÑ কাকীমা বোধ হয় স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। জš§দিনে তাঁকে তাঁর পা ছুঁয়ে সালাম করলাম মাথায় তাঁর হাতের ¯পর্শে আমার চোখ এবং বুক আর্দ্র হয়ে গেল। রণেশ কাকাকে তাঁর আÍজীবনীটি লিখতে অনুরোধ জানিয়ে এলাম সেদিন। টুকরো টুকরো করে শুরু করেছিলেন—জানি না পুরো অবয়ব দাঁড়াচেছ কিনা সেটার। আমি মানুষ হয়েছি আমার ’হিরোর’ কাঁধে কাঁধে।

চার মাস যখন আমার বয়েস তখন বাবার সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় মা চলে গিয়েছিলেন নানাবাড়ি। বেচারি! আমার হিরোকে বুঝতেই পারেননি; উল্টো আমাকে ‘রাম বেচারা’ বানিয়ে দিয়ে গেছেন। ছোট বেলায় যেখানেই গেছি সবাই মা না থাকার বেদনায় আমার চেয়ে বেশি ব্যথিত হয়েছেÑ তাদের আহারে-উহুরের যšত্রণায় আমার দমবন্ধ হয়ে যেত। তারা করুণার সমুদ্রে আমাকে পারলে ডুবিয়ে মেরে ফেলত—ভাগ্যিস কিছু ব্যতিক্রম ছিল—যা জীবনদায়িনী। রণেশ কাকার বাসায় পূরবী কাকীমা, বাবলা দা, প্রলয় এদের কাছে ছিল স্বাভাবিকতা, ছিল, অপরিমেয় আপনতা—ভালোবাসা।

এখনো আমার বুকের নিভৃতে এদের জন্য অজস্র তারার মতো ভালোবাসার ফুল ফুটে আছে—দিনের আলোয় সে ভালোবাসার সীমাহীন সৌন্দর্য কারোরই গোচরে আসে না—এঁরাও জানেন না—আর একটা সত্যি কথা, সত্য অনুভূতি বা সত্য বিশ্বাস ন্ডিভালোবাসার আসলে কোনো বিনিময় হয় না। অšতত আমি তা পারিনি—এ বিষয়ে বাইবেলে একটি চমৎকার বাণী আছে। সেটির শরণ নিইÑ “ভালোবাসা ধৈর্য ধরে, হিংসা করে না, গর্ব করে না, অহংকার করে না। ভালোবাসা সম¯ত কিছু সহ্য করে, সম¯ত কিছুতে আশা রাখে আর সকল অবস্থায় স্থির থাকে। বিশ্বাস আশা এবং ভালোবাসা শেষ পর্যšত টিকে থাকে।

এইগুলির মধ্যে আবার ভালোবাসা বড়। ‘‘ ‘ভালোবাসার’ এই অমোঘ শক্তিটা আমার ভেতরে সঞ্চারিত করে দিয়ে গিয়েছেন আমার বাবা শিল্পী শাহজাহান মাহমুদ। তাঁর সতীর্থ, সহযোদ্ধা এবং কমরেডদের প্রতি আমার যে ভালোবাসা সেটি হয়তো তাদের কাছ থেকেই পাওয়া পর¤পরায়। রণেশ কাকার কাজ, তাঁর ব্যক্তিসত্তা তাঁর সাফল্য ব্যর্থতা নিয়ে লেখার জন্য তাঁর সতীর্থ সহযোদ্ধারা রয়েছেন—আমি কেবল তাঁকে, পূরবী কাকীমাকে ঘিরে আমার ব্যক্তি অনুভূতিকেই ব্যক্ত করলাম। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।