আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

উটপাখির জীবনযাপন : কোলাজ

শুচি সৈয়দ । । । । ।

। । । । ।

। । । । ।

। । । । ।

। । । । ।

। । । । ।

। । । । ।

। । । । ।

। । । । উটপাখি সম্পর্কে প্রচলিত উপাখ্যান- উটপাখি নাকি লুকোবার চেষ্টা করলে মাটির ভেতর মাথা গুঁজে দিয়ে ভাবে, সে নিরাপদ।

তাকে কেউ খুঁজে পাবে না কিংবা দেখছে না। উটপাখির এই চরিত্রের মতোই আমাদের জাতীয় চরিত্র। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনীতি- সব অঙ্গনেই চলছে এইরূপ পলায়নপরতার অব্যাহত হাস্যকর মহড়া। রাজনীতিকরা ভাবছে তাদের কেউ দ্যাখেনি- তাদের স্খলনপতন কেউ মনে রাখবে না। একই ভাবনা কাজ করছে সর্বত্র-সবক্ষেত্রে।

ফলে এক অনিঃশেষ কালোমেঘ ছেয়ে ফেলছে আশার দিগšত। ক্রমশই এক অতল নৈরাশ্যে নিমজ্জিত হয়ে পড়ছি আমরা। আমরা জানি না, এই নৈরাশ্যের প্রতিকার কি- আমরা এরকম ভেবে আÍতৃপ্তি পেতে চেষ্টা করছি যে, ‘রাতের আঁধার যত গভীর হয়, দিনের আলো তত এগিয়ে আসে। ’ সাšত্বনার এই আফিম ছাড়া অন্য কোনও আফিম নেই। সবাই বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো যে যার অবস্থানটিকে নিরাপদ ভেবেই আÍপ্রসাদ উপভোগ করছি।

ফলে রাজনীতি হয়ে উঠছে ‘নীতিহীন’ রাজত্বের খোয়াব। অর্থনীতি হয়ে উঠছে, ‘অর্থহীন’ নীতির ছেঁড়া শৃঙ্খল আর সংস্কৃতি হয়ে উঠছে সঙের কীর্তি। ফলাফল সীমাহীন আÍপ্রবঞ্চনার অনিবার্য অন্ধকার। এই দেশের একজন কবি আর একজন কবি কথা বলতে গিয়ে বলছেন ‘আল মাহমুদ শয়তানের ভাই। ’ আর একজন ‘কবি’ (?) সেটা আবার ছাপছে তার পত্রিকার কাভারে।

সেই একই কবি আবার বলছেন, ‘এদেশে রাজনীতি করে মূর্খেরা। ’ তা উত্তম কথা, কিন্তু কবিতা যে লেখে শিক্ষিতরা তারইবা পরিচয় কোথায়? ষাট দশকের একজন খ্যাতিমান কবি উচ্চারণ করেছিলেন, ‘আলস্যে নেশায় বুঁদ/ আমি এক বেশ্যার বেড়াল। ’ এই আÍোপলব্ধি ছিল হয়তো জনৈকের সাহসী ঘোষণা কিন্তু আশির দশকে কবিরা যেভাবে স্বৈরাচারের গাছের এবং গোড়ার সমঝদার হয়ে উঠেছিল, তা কি মানুষ উটপাখির মতোই ভুলে যাবে! কবিতাকে নিয়ে হোটেলের জলসাঘর আর লিচুতলার টানাটানির আড়ালেও আখের গোছাতে কি বাকি রেখেছে কেউ- কবিতা রাজপথে নেমে এসেছে, তাকে ঠেলে ঠেলে ভাগাড়ে গড়িয়ে নেবার চেষ্টাও কম হয়নি- হচ্ছে না। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে তরুণ কথাশিল্পী মঈনুল আহসান সাবের প্রণিধানযোগ্য উক্তি করেছেন- ‘আমাদের এখানে ভালো পত্রিকা নেই, ভালো সম্পাদক নেই। সহজেই ছাপা হচ্ছে বলে ভালো কবিতা লেখার ইচ্ছেও বোধহয় নেই।

আর দু’চারজন বাদে অধিকাংশ ‘কবি’ অশিক্ষিত, কথা-সাহিত্যিকদের মধ্যেও অনেকে তাই। তবে এদেশে কবির সংখ্যা যেমন বেশি, তেমন কবিদের মধ্যে অশিক্ষিতের সংখ্যাও বেশি। ’ সংখ্যাগরিষ্ঠের দায়ভাগ শেষ পর্যšত কিনা কবিদের কপালেই মোহরাঙ্কিত কথাশিল্পীর বিবেচনায়! পাঠক, কথাশিল্পীর এই মূল্যায়নে কুছপরোয়া করার কারণ নেই। কারণ কবিরা কিন্তু মনে মনে কানে কানে এগিয়ে আছে এক শ’ বছর ঐ বাংলার তুলনায়। এটা কবি মহলের কথা- কীভাবে তারা এগিয়ে আছে তার কোনও ব্যাখ্যা নেই।

ভাবখানা এরকম- সেটার আবার দরকার আছে নাকি? খোয়াবে নাকি খেতে হয় পোলাও-কোরমা, এও হয়তো সে জাতীয় খাওয়াই। কবিরা নাকি খুব অগ্রসর- এরকম দাবি কবিদেরই। তাই ‘মিথ্যাবাদী রাখাল’ সাজা সর্বশেষ সাজ। মিথ্যাবাদী রাখাল নাকি ছিল ‘কবি’- যে অশুভকে আগেভাগেই আঁচ করতে পারত- ভবিষ্যৎকে দেখতে পারত (জনাšিতকে বলি ‘জ্যোতিষ সম্রাট’ ... ইত্যাদি ইত্যাদি)। ফলে যে কবি ‘কবির আÍবিশ্বাস’ নামে ‘কবির আÍপ্রতারণাকে’ ফেরি করছেন, তিনি ‘ভবিষ্যৎকে আঁচ করতে পারি’ যুক্তি দিয়ে জায়েজ করতে চাইছেন বর্তমানের শূন্যতাকে- বর্তমানের গোঁজামিলকে।

ভাবছেন পাঠকের দেবতা তো তিনিই- তার বাণী ঐশী বাণীর মতো ভাববে ‘বোকা’ সত্যবাদীরা। ঘুণে শেকড় কাটছে, তাতে কারও কোনও কষ্ট নেইÑ গাছের মাথায় পানি ঢেলে ঢেলে কালযাপন করছি আমরা সবাই। দেশের শিক্ষাঙ্গনগুলো হয়ে উঠছে শ্মশান কিংবা কফিনের অন্য নামÑ এ নিয়ে কারও কোনও মাথাব্যথা নেই। না শিক্ষক, না রাজনীতিক। রাজনীতি-সন্ত্রাস আর ম¯তানি সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তরুণ কবি রাজনীতিকে চিহ্নিত করতে বাধ্য হয়েছেন নির্মম বা¯তবতায় যেÑ ‘বেশ্যাকে তবু বিশ্বাস করা চলে রাজনীতিকের ধমনী-শিরায় সুবিধাবাদের পাপ। ’ রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ আর সেই পাপের পঙ্কে হাবুডুবু খেতে বাধ্য হচ্ছি আমরা। কোনও শুভ উদ্যোগ নেই। শুধুমাত্র গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসানোর ভেতরই চলছে মোক্ষলাভের আশা। তাই মসজিদ আর মন্দির ভাঙার কাজে উৎসাহের অভাব নেই।

অভাব শুধু গড়ার কাজের উৎসাহের। গণতন্ত্র আমাদেরকে সকল ক্ষমতার উৎসেই শুধু পরিণত করেনি, আমাদের করে তুলেছে একেকজন ঈশ্বর। আমরা একটি ভোটের অধিকারে একজন ঈশ্বর হয়ে ওঠেছি। আরেকজনের অধিকার? মূল্যহীন। আমাদের বোঝার এবং বোঝাবার ক্ষমতাও বিচিত্র।

একজন প্রথিতযশা কবি একবার ‘মাতাল তরণী’তে উঠে বুঝে ফেললেন যে, মেয়েরা বিজ্ঞাপনচিত্রে বুক, বাহু, নিতম্ব দুলিয়ে সমাজের গালে চপেটাঘাত করছেÑ এই পথেই চলে আসবে নারীমুক্তি! আর একজন তো সদ্য স্বাধীন দেশে সমাজতন্ত্রই কায়েম করে ফেললেন প্রায়Ñ তার প্রেমিকার প্যান্টি, ব্রা ইত্যাদি কেনার আগেও তার প্রয়োজন হয়ে পড়ল সমাজতন্ত্র শব্দটির। অবশ্য শেষ পর্যšত মহামতি গর্বাচেভ সেই মহামতি কবির চোখ থেকে নাকি সমাজতন্ত্রের রঙিন চশমাটি খুলে নিয়ে তার মহা উপকার করেছে! তবে তার রঙিন পানীয় কিংবা নীল ধোঁয়ার হ্যালুসিনিয়েশন যে এখনও বিদ্যমান তাতে কোনও সন্দেহ নেই। মহামতি গর্বাচেভ নাকি এই মহামতি কবির গা থেকে ডাকাত যেভাবে যুবতীর গা থেকে অলঙ্কার খুলে নেয়Ñ নিরাভরণ করেÑ সে রকম করে খুলে নিয়েছে সমাজতন্ত্রকে। এই কবি সম্পর্কে একজন কৃষক-পাঠক একজন অতিউৎসাহী প্রেমিক-পাঠক ভক্তকে বলেছিলÑ ‘চাচা, এই কবি তো কবিতাকে জলবিয়োগের দ্বারে এনে ছেড়েছে। ’ তো, এই কবি চেয়েছিলেন সমাজতন্ত্র।

আর তার পনেরো বছর পর আর একজন কবি, যে কিনা ঠিক ঐ কবিরই প্রায় অনুলিপি তবে বিপরীত লিঙ্গের, জাতিকে সে শেখাচ্ছে নারীমুক্তি-নারী স্বাধীনতা। এদের আদর করে কেউ কেউ অ্যালেন গীনসবার্গের শিষ্য-শিষ্যা হয়তো বলতে পারেন তবে কোনও কৃষাণী-পাঠিকা হয়তো এই কবির ভেতর একই রূপ দেখতে পারেন। এই যে অন্ধকার, এ থেকে আমাদের পরিত্রাণ কবে তা বলা দুঃসাধ্য। কেননা, আমরা এসব অন্ধকার নিয়েই মেতে আছি। ফলে সম¯ত বিকৃতি, আর অসুখে আমরা সংক্রমিক হই, ভুগি।

আর সেজন্যই নিজেদের মূর্খতা, মূঢ়তাগুলো সম্পর্কে সর্বাগ্রে নিজেদেরই সচেতন হওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজন তীক্ষè আÍোপলব্ধির। তাই উটপাখির উপাখ্যানে শরিক না হয়ে সাহসে মুখোমুখি হওয়া প্রয়োজন ‘মন্দ’ গুলোর। ভালবাসা ‘ভালো’ গুলোকে, নির্ধারিত করা প্রয়োজন কর্তব্যগুলো। এগিয়ে যাবার জন্য শুরু করা কাজ।

উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন গড়ার। আÍোপলব্ধির সেই আলোর ¯পর্শ যত তাড়াতাড়ি আমাদেরকে জাগায় ততই ভালো। । দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকা। .............১৯৯২ ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।