আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মাদকাসক্তির কারণ ও পারিবারিক দায়

চারপাশে আত্মমুগ্ধ আদিমতাবোধ, আর গ্রন্থিবদ্ধ চিন্তা; সেখান থেকে মুক্তির পথ খুঁজি... আজ বিশ্ব সভ্যতার প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে মাদকাসক্তি। অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশের মাদকাসক্ত ব্যক্তির সংখ্যা বর্তমানে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ভৌগলিক অবস্থানের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের তিনটি আফিম ও আফিমজাত মাদক উৎপাদন অঞ্চলের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে। এর মধ্যে দুটি অঞ্চল হলো এমন শক্তিশালী যেখানে কোন রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ খাটছে না। তার একটি পূর্বের 'গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল' ও অপরটি পশ্চিমের 'গোল্ডেন ক্রিসেন্ট'।

এর মাঝে পড়ে বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে মাদক চোরাচালানের চমৎকার রুট। আর সে কারণেই মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা আমাদের মারাত্মক সামাজিক বিপর্যয় হিসেবে দেখা দিয়েছে। মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা বা মাদক ব্যবসায়ী, চোরাচালানকারীর বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া যায়, তার আলোচনায় না যেয়ে আজকের এ প্রবন্ধ আমরা শুধুমাত্র কিশোর ও তরুণদের ''মাদকাসক্তির কারণ হিসেবে পরিবারের দায় কতটা'' তার উপরেই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখবো এবং সঠিক কারণটি খুঁজে বেড় করবার চেষ্টা করবো। আমরা দেখতে পাই যে, মাদক ক্ষতিকর এটা জানার পরও কিশোর ও তরুণদের মাঝে মাদকের বিস্তৃতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। মনোবিজ্ঞানীরা সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে, মাদকাসক্তির প্রধান কারণ হচ্ছে হীনমন্যতা।

আর কিশোর-তরুণদের ক্ষেত্রে এর উৎস বেশির ভাগ সময়ে পারিবারিকভাবে হয়। অর্থাৎ পারিবারিক পরিবেশ তাদের মনে হীনমন্যতার সৃষ্টি করে; আর এই হীনমন্যতাকে কাটিয়ে উঠতেই পারিবারিক পরিবেশের বাইরে যে কোন নিষিদ্ধ বিষয় ও বস্তুর প্রতি আসক্ত হয়ে উঠছে তারা। এ প্রবন্ধটি লিখার সময়ে ১৯ থেকে ২৮ বছর বয়সী ১৪ জন মাদকাসক্ত তরুণের সাক্ষাৎকার নিয়েছি, বলা প্রয়োজন যে তারা সবাই ছিল শিক্ষিত। তারা তাদের পারিবারিক পরিবেশের যে সব নেতিবাচক দিক তুলে ধরেছে তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিচের তালিকায় আমরা দেখি- ১. খাবারের (খাওয়া-দাওয়া) খোঁটা দেয়া। ২. লালন পালনের খোঁটা দেয়, তার অসহায়ত্বকে তুলে ধরে গালাগালি করে।

৩. তার পছন্দের মূল্য দেয়া হয় না। ৪. পারিবারের অবহেলা। পরিবারের সদস্য হিসেবে তার কোন গুরুত্ব না দেয়া। ৫. সামান্য কারণে গায়ে হাত তোলে। ৬. পরিবারে তার কোন ব্যক্তিত্ব নেই।

ব্যক্তিত্বের উপর আঘাত খুব সাধারণ ঘটনা। ৭. বিশ্বাস না করা। যে কোন ব্যপারে বিনা যুক্তিতে দোষী সাব্যস্ত করা। যেমন পরিবারের কোন কিছু হারিয়ে গেলে খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত তাকেই দোষী ভাবে। ৮. বন্ধু-বান্ধব, বাহিরের লোক, অতিথি এমনকি ছোট ভাই-বোনের বন্ধুদের সামনে তাকে অপমান করা হয়।

৯. লেখাপড়াসহ তার নিজের কেরিয়ার গঠনে পরিবারের মত মেনে নিতে হয়েছে। ১০. বন্ধুদের চিঠি খুলে পড়া হয়। ১১. বন্ধুরা বাড়িতে এলে তাদের সাথে বাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এমনকি কেউ যদি খোঁজ নিতে আসে তাদের সাথে ভালোভাবে কথা বলে না। ১২. কোন ব্যপারেই তার প্রাইভেসীকে মানা হয় না।

১৩. পরিবারের জন্য, অবিভাবকদের ইচ্ছায় নিজের ইচ্ছাকে জলাঞ্জলি দিতে বলা হয়; এ ব্যপারে বিভিন্ন জনের উদাহরণ দেয়া হয়। ১৪. বিয়ের ব্যপারে পরিবারের ইচ্ছার কাছে নতি স্বীকার করতে হয়েছে। ১৫. পরিবারের ইচ্ছায় বিয়েতে যৌতুক নিতে হয়েছে, কিন্তু সে নিজে এখনো স্বাবলম্বি হতে পারেনি। স্ত্রীর কাছে যেতে লজ্জা লাগে। ১৬. পারিবারিক বাঁধার কারণে পছন্দের মানুষকে বিয়ে করতে পারেনি; অথবা তার অন্য কোথাও বিয়ে হয়েছে।

১৭. অন্য ভাই বোনদের কারণে তাকে লেখাপড়ার ব্যপারে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। লেখা পড়ার কোন খরচ দেয়া বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ১৮. লেখাপড়া বন্ধ হবার কারণে বন্ধুরা তাকে ত্যাগ করেছে। ১৯. বাড়ি থেকে এই অবস্থায় উপার্জনের জন্য চাপ দেয়া হচ্ছে। ২০. বেকার অবস্থায় ঘুরছে।

তার স্বাবলম্বিতার জন্য পরিবার কিছু করবে না বলে দিয়েছে। ২১. ইত্যাদি। সুতরাং আমরা উপরের তালিকা থেকে মাদকাসক্ত তরুণদের মনস্তাত্বিক দুর্বলতা, হতাশা, অনিশ্চয়তাগুলি সহজেই খুঁজে বের করতে পারি। এসব কারণ একান্তভাবে পারিবারিক পরিবেশে তৈরী হচ্ছে; যার দায় একমাত্র পরিবারের সদস্যদেরই। এই জন্যে হীনমন্যতায় গ্রাস করছে আমাদের আগামী প্রজন্ম।

আমরা পরিবার গঠন করি সুন্দর, সুস্থ্য ও স্বাচ্ছন্দপূর্ণ জীবন যাপন করার জন্য। মানুষের মননে পরিবার নিরাপদ ও আস্থাপূর্ণ হয়ে থাকে। এই নিয়মের ব্যতিক্রম হলে সে মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। আজ তাই দেখা যায় আমাদের সমাজে পরিবার ভাঙ্গার ডাক, পরিবারের উপর বর্তমান প্রজন্ম বিতশ্রাদ্ধ। আমাদের আজকের আলোচনা থেকে অন্তত এটুকু জানা যায় যে, আমাদের সমাজে কিশোর-তরুণদের মাদকাসক্তির কারণ হিসেবে পরিবারের দায় অনেকখানি।

অতএব এ সমস্যা নিরসনে তাদেরই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে হবে। পরিবার প্রধান ও বড়দের সচেতন হতে হবে এ ব্যপারে। সুতরাং মাদকাসক্তি নিরাময়ে পরিবারের সদস্যদের জন্য বিশেষ কিছু সুপারিশ করা যেতে পারে। এগুলি হলো- ১. অবহেলা অথবা অতিমাত্রায় ভালবাসা দুটিই এদরে জন্য মঙ্গলজনক নয়। ২. পরিবারের প্রতিটি সদস্যের মতামতের গুরুত্ব দিন।

৩. তাদের সকলের পছন্দের ব্যপারে মনোযোগী হোন। ৪. তাদের ব্যক্তিত্ব গঠনে সহায়তা করুন, প্রাইভেসী রক্ষা করুন। ৫. তার সাথে সাথে তাদের বন্ধু-বান্ধবদের সাথে সম্পর্ক ভালো রাখুন, প্রয়োজনে তাদের পারিবারিক খোঁজ খবর রাখুন। ৬. পরিবারকে আকর্ষণীয়, নিরাপদ ও আস্থাপূর্ণ করে গড়ে তুলুন। ৭. তাদের সৃষ্টিশীল কাজে উৎসাহিত করুন।

৮. তার কেরিয়ার গঠনে সহায়তা করুন। ৯. ভালবাসুন এবং ভালবাসতে শেখান। মাদকাসক্তি আমাদের সমাজে এক ভয়ানক সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আমাদের এখনই উচিৎ এর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সোচ্চার হওয়া। একটি সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষ গড়ে উঠতে হলে তার পারিবারিক পরিবেশ যেমন প্রয়োজন, তেমনি পারিবারিক পরিবেশও হতে হবে আস্থাপূর্ণ ও নিরাপদ।

আমরা আশা করি এ ব্যপারে প্রতিটি পরিবারের বড়রা এবং অবিভাবকগণ সচেতন হবেন, তাহলেই আমরা মাদকাসক্তের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করবো। সমাপ্ত ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।