আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার গায়ে কাপড় নেই, তারপরেও আমি লজ্জিত নই

'জীবন' হলো এক কাপ গরম চা আর একটা জ্বলন্ত বেনসনের মতো। গরম চা একসময় জুড়িয়ে যাবে, বেনসনের তামাকও পুড়ে শেষ হয়ে যাবে। ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১০। সোমবার। সকাল এগারোটা বেজে ত্রিশ মিনিট।

নেত্রোকোণা জেলার দুর্গাপুর-বিরিশিরি হয়ে কলমাকান্দা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পৌঁছালাম অফিসের কাজে। বিরিশিরি থেকে প্রায় দেড় ঘন্টা মোটর সাইকেল জার্নি শেষে পৌঁছানোর পর শুনলাম UH&FPO স্যার ছুটিতে আছেন। অফিসে পেলাম স্ট্যাটিশটিশিয়ান মাসুদ সাহেবকে। কাজের ব্যাপারে তিনিই সার্বিক সহযোগিতা করলেন আমাকে। কাজের প্রয়োজনেই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বিভিন্ন অংশ ঘুরে দেখার সময় হঠাৎ দেখা হয়ে গেল আমার কলেজ জীবনের বন্ধু ডা: নাফিসের সাথে।

সে এখন এখানকার মেডিকেল অফিসার। আমাকে দেখেই হাসিমুখে তার রুমের ভিতরে আসতে বললো নাফিস। তারপর কুশলাদি বিনিময়ের পর জিজ্ঞেস করলো, "”কি খাবি? চা-সিগারেট তো চলবে?"” আমি কিছু বলার আগেই সে তার পিয়নকে দু’জনের জন্যে বেনসন আর চা আনতে বলে দিল। ”"তারপর বল্, আছিস কেমন? কত দিন পর দেখা তোর সাথে! বিয়ে-শাদী করেছিস?"” নাফিসের প্রশ্নের উত্তরে হেসে বললাম, ”"এইতো দোস্ত, একাই চলে যাচ্ছে। তোর খবর বল।

”" "”হেহ:! আমাদের আর খবর। এই গাঁও গেরামে পড়ে আছি বছরের পর বছর। ট্রেনিং পোষ্ট-এর জন্য ট্রাই করতেছি। কিন্তু বুঝসইতো। স্বাচিপ-এ (আওয়ামীলীগ সমর্থিত স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ) নাম লেখাইলেও ভাল করেই জানি, টাকা ছাড়া ট্রেনিং পোষ্ট পাবোনা।

তবে তোদের কথা আলাদা। তোরাতো ডেভেলপমেন্ট সেক্টরে কাজ করিস। মেলা টাকা তোদের, হিংসা হয় আমার মাঝে মাঝে। ”" কথার মাঝখানে পিয়ন এসে বেনসন আর চা দিয়ে গেল। নাফিসের দিকে সিগারেট ধরানোর ব্যাপারে জিজ্ঞাসার দৃষ্টিতে তাকালাম।

সে বললো, ” "আরে, বাইরে কি যাবি! রুমেই ধরা। ব্যাপার না। ”" চা পর্ব শেষ হতে না হতেই দেখি একের পর এক তিন-চারজন MR (Medical Representative) এসে বেশ খানিকখন নাফিসের সামনে বিনীত ভাবে তাদের ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানীর কিছু ওষুধের গুণগাণ করলো। যাবার আগে প্রত্যেকেই বেশ কিছু প্যাড, কলম আর ’গিফট আইটেম’ দিয়ে গেলো। একজনকে দেখলাম একটু আড়াল করে নাফিসের হাতে একটা খাম গুঁজে দিল।

আড়চোখে তাকিয়ে বুঝলাম, সাদা খামের ভেতরে পাঁচশো টাকার নোট আছে কয়েকটা। ”"এই MR দের নিয়ে বিপদে আছি বন্ধু। ”" নাফিস বলে চললো "”এক ব্র্যান্ডের ওষুধ একটা রোগীকে দিলে পরের রোগীকে আরেক ব্র্যান্ড দিতে হয়। বুঝসইতো, সবাইরে খুশী রাখতে হয়। তবে একটা কথা ক্লিয়ার।

যারা বেশি গিফট দিবে, তাদেরটাই আমি লিখবো। আর যারা মাসিক চুক্তিতে খাম দেয়, তাদেরটা লেখাতো মাস্ট, এই যে এখন যেমন দিয়ে গেল আর কি... হে: হে: হে:...। ”" ”"এখানে তুই প্র্যাকটিস করিস কোথায়?"” আমার প্রশ্নের উত্তরে নাফিস জানালো, কাছেই বাজারে একটা ওষুধের দোকানে সন্ধ্যার পর সে বসে। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ভিতরে তার বাসা থেকে MR দের মোটরসাইকেলেই চেম্বার করতে যায়। ”"তোদের দোয়ায় ভালই চলতেছে।

মাসে সব মিলায় লাখ খানেক বা তার উপরেই আসে। ”" কথাগুলো গর্বের ভঙ্গিমায় বলতে পেরে একটা আত্মতৃপ্তির ছোঁয়া দেখলাম নাফিসের চোখেমুখে। "”স্যার একটু আসি?"” হঠাৎ একটা নারী কন্ঠের আওয়াজে আমরা দু’জনেই দরজার দিকে তাকালাম। দেখি, মলিন ছেঁড়া শাড়ি পরিহিত এক মা তার বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে। মহিলা ভেতরে আসার পর ভালকরে তাকিয়ে দেখলাম, নিষ্ঠুর দারিদ্রতার সাথে যুঝতে থাকা এই শীর্ণদেহী নারীর শাড়ীর আঁচলের ভেতর দিয়ে তার ততোধিক শীর্ণ, পুষ্টিহীনতায় ভুগতে থাকা শিশুটি মাতৃদুগ্ধ লাভের আশায় চিৎকার করে কাঁদছে।

মায়ের মুখটা শুকনো, চোখ দুটো কোটরের ভেতরে ঢুকে গিয়েছে। ”"আসেন, আসেন। "” নাফিস তাকে ডেকে নিয়ে নিজের বাম পাশের টুলটাতে বসালো। তারপর বাচ্চার সমস্যার কথা শুনে টেবিলের উপরে রাখা নিজস্ব প্রেসক্রিপশনে রেনাটা ফার্মাসিউটিক্যালসের গিফট দেয়া কলম দিয়ে খসখস করে একটা ওষুধ লিখে দিল। ”"এই যে ওষুধ দিলাম, এইটা খাওয়ান।

আর সন্ধ্যার পর চেম্বারে আসেন। ”" অসুস্থ শিশুর মা’কে নাফিস কথাটা বুঝিয়ে বললো। মহিলা নিজের বাম হাতের মধ্যে গুঁজে রাখা একটা পুরানো পঞ্চাশ টাকার নোট টেবিলের উপরে রেখে আমতা আমতা করে বললো, ” "স্যার অনেক দূর থেইকা আইছি। সন্ধ্যারসুম তো আর আইতে পারুমনা। "” সাথে সাথে নাফিস তার হাত থেকে খানিক আগেই দেয়া প্রেসকিপশনটা নিয়ে কলম দিয়ে আরও দুইটা ওষুধ লিখে দিল।

তারপর মহিলার দেয়া পঞ্চাশ টাকাটার দিকে তাকিয়ে একটু গম্ভীর স্বরে বললো, ”"এইটা কি দিছেন?"” মহিলা অপরাধীর ভঙ্গিতে নিজের বক্ষদেশের ভেতর থেকে এবার একটা একশো টাকার নোট বের করে নাফিসকে দিল। আগের পঞ্চাশ টাকা আর এই একশো টাকা -এই দুইটা নোট সযত্নে ভাঁজ করে নাফিস নিজের পকেটে রেখে সাত দিন পর মহিলাকে আসতে বলে বিদায় করে দিল। পুরো ব্যাপারটা আমি দেখলাম। এরপর একটু বিব্রত ভঙ্গিতে বললাম, ”"এই যে হাসপাতালেই ডিউটির সময় তুই রোগীর থেকে টাকা নিস, আমি থাকলে তো নিতে পারতামনা, লজ্জাতেই মারা যেতাম”। " এই কথা শুনেতো নাফিস হাসতে হাসতে শেষ।

টেবিলে রাখা বেনসন সিগারেট বেশ কায়দা করে ধরিয়ে ধোঁয়াটা নাক দিয়ে ছাড়তে ছাড়তে বললো, "”কি যে কস তুই দোস্ত্। সিচুয়েশন বুঝতে হবে তোকে। এই যে দেখছিস রোগীগুলাকে। এরা অনেক দূরে থেকে আসে। দিনের বেলাতেই শুধু চিকিৎসা নিতে আসে, সন্ধ্যার পর আসার সুযোগ নাই তাদের।

দূরের রোগীগুলা যদি সন্ধ্যার পর না-ই আসে তাহলে সন্ধ্যার পর চেম্বারে প্র্যাকটিস করবো কিভাবে, তুই-ই বল? যেহেতু সন্ধ্যার পর দূরের এইসব রোগীদের থেকে প্র্যাকটিসের টাকাটা নিতে পারিনা, তাই এই যে এখন এরা আমাকে টাকা দিচ্ছে, এইটাতো আমার অধিকার। এইখানে লজ্জা পাবার কি আছেরে? হে: হে: হে:... নীরবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। মনে মনে বললাম, ”"হ্যাঁ, দোস্ত্ ঠিকই বলেছিস তুই, ল্যাংটার আবার লজ্জা কিসের?”" শেষের কথা: বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় আমার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, প্রায় প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এ রকম হাজারো ডা: নাফিস-এর সুন্দর চেহারা আর নামের আড়ালে হিংস্র হায়েনারা রয়েছে, যাদের প্রতিদিনের গল্প ঠিক এ রকমটাই। নাফিসের সাথে অন্যদের পার্থক্য, কেউ খুল্লামখুল্লা করছে, আর কেউ করছে গোপনে। তারা কষ্ট করে বাংলাদেশের নামকরা মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়ে সেখান থেকে এম.বি.বি.এস পাশ করেছে, এফ.সি.পি.এস পার্ট ওয়ান পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়েছে।

সামনে আরও পড়ালেখা করে আরও ডিগ্রী কমপ্লিট করবে। তারাইতো সমাজের সবচাইতে এলিট শ্রেণী, তাদের থেকে অন্য পেশার মানুষজন কি বেশি বুঝবে? কোনদিনও না। প্রশ্নই ওঠেনা। তারা সমাজকে শোষণ করবেনাতো আর কারা করবে? সোনার হরিণ বি.সি.এস পরীক্ষায় কত কষ্ট স্বীকার করে তারা স্বাস্থ্য ক্যাডারে হাজার হাজার পরীক্ষার্থীর মাঝে নিজের জায়গা করে নিয়ে এখন সরকারী গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছে। আর এই চাকুরীতে এসেও UH&FPO, Civil Surgeon এর দপ্তরের ’বখরা’ ছাড়াও DG Health-এ নিয়মিত লবিং করে, নিজের কষ্টার্জিত টাকা ঘুষ দিয়ে একটা সুবিধাজনক পোষ্টিং বা ট্রেনিং পোষ্টের জন্য দিন রাত ঘুরতে হচ্ছে।

DG Health এমনই এক বিচিত্র জায়গা যেখানে কোন ডাক্তার স্বাচিপ (স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ) বা ড্যাব (ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) - যা-ই করুকনা কেন, ঘুষের টাকা তাকে দিতে হবেই হবে। এই যে এত কষ্ট, এগুলোতো তাদের এতদিনের সময়, অর্থ, মেধা, শ্রম -এসবেরই ইনভেস্টমেন্ট বা লগ্নি। এখন এতদিনের ব্যয়কৃত সময়, অর্থ, মেধা, শ্রম -এসবের সুদসহ আসল তুলে নেবার সময় এসেছে। কোন প্রয়োজন নেই মেডিকেল এথিক্স-এ কি পড়িয়েছিল, দেখার দরকার নেই দরিদ্র, অভাবী, সুবিধাবঞ্চিত মানুষ তাকে ভিজিটের টাকা দেবার পর ওষুধ কিনতে পারবে কিনা বা টাকাটা জোগাড় করতে তাদেরকে কতটা কষ্ট পোহাতে হয়েছে। ডাক্তারী পাশ করে যখন মানুষের সেবার নামে ’'কসাই'’ হবার সার্টিফিকেট একবার পেয়েছে, এর সদ্ব্যবহার না করলে কি আর নামকরা ডাক্তার হওয়া যায়? বিশেষ দ্রষ্টব্য: ডা: নাফিস নামটি কাল্পনিক।

যার ব্যাপারে গল্পটি লিখলাম, তার সম্মানের কথা বিবেচনাপূর্বক আসল নামটি গোপন করলাম। তবে একটা কথাই বলতে চাই, নাফিসদের নিজের গায়ে কাপড় না থাকতে পারে। কিন্তু একজন বাংলাদেশী হিসেবে আমার বুকে বড় কষ্ট হয়, যখন দেখি শত চেষ্টা করেও আমার এই ডাক্তার বন্ধুর মতো আরও অনেক নাফিসদের গায়ে চাইলেও আমরা কাপড় পড়াতে পারছিনা।  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.