আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কর্ণ শোনে...চক্ষু দেখে

আমাদের কর্ণেন্দ্রিয় শোনার দায়িত্ব নিলেও সে যে কখন কী শোনে আর চোখ কখন কী দেখে, সে এক অনন্ত রহস্য। রবিঠাকুর তাঁর ছেলেবেলায় স্কুলের প্রার্থনা সঙ্গীতে শুনেছিলেন ‘মেলালিং মেলালিং’ আর দাদু বাড়িতে আমি আশৈশব শুনে এসেছি ‘হাজার টাকার ধারবাকিটা রাতটাকে যে দিন করেছে’। ওটা যে আসলে ঝাড়বাতি তা বুঝতে আমার যৌবন লেগে গেছে। ভেবেছিলাম টাকা-পয়সার ব্যাপার যখন, তখন ধারবাকি হওয়াটাই যথার্থ। ওপার বাংলার স্বনামধন্য লেখিকা নবনীতা দেবসেন একবার লিখেছিলেন তার এমনই একটি ভুল শোনার বৃতান্ত।

রবিঠাকুরের সেই বিখ্যাত গানটির একটি লাইন তিনি শুনেছিলেন ‘আকাশে উড়িছে খোকা হাতি’। শুনেছিলেন এবং মানসচক্ষে দেখেওছিলেন বেশ নধর একটি হাতিশাবক দিব্যি আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে। পরে যখন জানলেন যে, ওটা আসলে ‘আকাশে উড়িছে বক পাঁতি’ তখন নবনীতার খুব দুঃখ হয়েছিল শৈশবের বিমল কল্পনাটি ভেঙে খানখান হওয়ার জন্য। উত্তম-শর্মিলার ‘অমানুষ’ ছবির কথা মনে আছে ? হয়তো হালের কারো মনে নেই। কিন্তু আমার থাকবে।

অমানুষ ছবির সেই বিখ্যাত গান ‘কী আশায় বাঁধি খেলাঘর’ ছেলেবেলায় আমার কানে ঢুকেছিল ‘কী আশায় বাঁদর খেলা হয়’ বাক্যে অনুদিত হয়ে। শৈশবে সাইকেলের রিং দৌড়াতে দৌড়াতে সানন্দে গাইতাম,‘ কী আশায় বাঁদর খেলা হয়...। ভুল শোনা নিয়ে ভীষণ মজাদার একটা গল্প বলতেন আমার মা। পাড়াগ্রামে কীর্তনগান তখন ছিল দারুণ জনপ্রিয়। কীর্তনে মূল গায়েন একটি পদ গেয়ে শোনান আর দোহাররা সেই পদটি শুনে শুনে তার পুনরাবৃত্তি করে।

গল্পের এই কীর্তনীয়ার গাওয়া পদ দোহাররা যেমনটি শুনত, তেমনটিই গাইত। লেখা বাহুল্য যে, তারা ভুল শুনত। মূল গায়েনের মূল কথাটি এবং দোহারের ভুল শোনাটি এবার পড়তে থাকুন। মূল গায়েন– হরসূত গৌরীকুমার চড়ে ময়ূরের উপর দোহার– হরে ছুতোর গৌরে কামার চড়ে মইয়ের উপর মূল গায়েন– পার্বতী সূত লম্বোদর দোহার– পাক দিয়ে সুতো লম্বা দোর ! বলা হয়ে থাকে, নিজের কানে না শুনে বা নিজের চোখে না দেখে কিছু বিশ্বাস করা উচিত নয়। বিশ্বাস করুন নিজের কান বা নিজের চোখ সবসময় যথাযথ অনুসরণ অথবা অনুধাবন করে না।

আমাদের বাড়ির পাশেই একটি দোকান ছিল যার নাম আমি জানতাম ‌মাসার দামনি বস্ত্রালয়। অনেক পরে জেনেছি ওটি মা সারদামণি হবে। এক নজরে দেখলে এইরকমই হয়। এক নজরে দেখা সর্বদা ঠিকঠাক হয় না। এ সেই -হরে কর কমবা রুদ বিক্রয় হয়ে'র নতুন সংস্করণ।

পাঠক মাত্রেই জানেন ওটি হরেক রকম বারুদ বিক্রয় হয় আসল কথা। বর্ণসংস্থানের সামান্য একটি হেরফের হলেই চোখ কী দেখে তার একটি অভূতপূর্ব নিদর্শন নির্মাণ করেছিলেন শরৎচন্দ্র। অনেকেই এগুলি জানেন, তবু তালিকাটি সাজানোর লোভ সামলাতে পারলাম না। প্রশ্ন ও উত্তরের ঢঙে শরৎ সাজিয়েছিলেন– প্রশ্ন- সংসারটা কার বশ? উত্তর– সংসার টাকার বশ। প্রশ্ন- এটা কি গ্রাম? উত্তর- এ টাকি গ্রাম।

প্রশ্ন- রাম-রাবণের যুদ্ধের কারণ জান কি? উত্তর– রাম-রাবণের যুদ্ধের কারণ জানকী। প্রশ্ন- মাসি কি দিয়েছে? উত্তর– মা সিকি দিয়েছে। (সিকি অবশ্য এখন উঠে গেছে। সিকি মানে ২৫ পয়সা। ) প্রশ্ন- এ কজনের খোরাক? উত্তর– একজনের খোরাক।

প্রশ্ন- অরুচি হলে নিম কি রুচিকর? উত্তর– অরুচি হলে নিমকি রুচিকর। এই লেখাটি লিখতে গিয়ে রবিঠাকুরের সেই গানটি নতুন অর্থ নিয়ে এসে দাঁড়াল আমাদের সামনে। ‘কী যে শুনি তাহা কে বা জানে’ লাইনটির আগে সেই সবজান্তা মানুষটি লিখে গেছেন ‘বাণী নাহি তব কানে কানে’। সত্যিই কানে কানে প্রবাহিত হতে হতে বাণীর যে কী অবস্থা হয়, তা বলেই লেখাটিতে পূর্ণচ্ছেদ দেব। যাকে প্রাইভেট পড়াতাম সেই ছাত্রকে একদিন জিজ্ঞেস করলাম– ‘তুমি কি বলতে পারো মোনালিসা ছবিটি কার আঁকা?’ সে বলতে পারল না।

বললাম, ‘আমি তোমার কানে কানে একটা কথা বলব, যা বলব, তুমি অন্য জনকে কানে কানে সেটা বলবে’। বললাম– লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি। সে যাকে বলল, সে শুনল লিওনার্দো দ্য মিঞ্চি। সে আবার যাকে বলল, সে শুনল– লিওনার্দো দাস মিঞ্চি। এই করতে করতে কথাটা যখন আমার কাছে ফিরে এল, তখন সেটা হয়ে গেছে প্রিয়রঞ্জন দাস মুন্সি।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।