আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

উপকূলীয়দের জীবন-জীবিকায় কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতঃ

সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর খুঁজে পেতে চেষ্টা করি............ উপকূলীয়দের জীবন-জীবিকায় কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতঃ বাংলাদেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর অবস্থিত। ১৯টি জেলায় প্রায় ৩ কোটির চেয়ে বেশী লোক অধ্যুষিত ৭১০ কিলোমিটার বিস্তীর্ণ বঙ্গোপসাগরের উপকূলে বসবাস করে নানা পেশায় জড়িত থেকে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। এ লোক সংখ্যা অধিকাংশ লোকজনের জীবন-জীবিকা উপকূলীয় এবং সামুদ্রিক মাছের উপর নির্ভরশীল। প্রায় ১,৬০,০০০-এর চেয়ে বেশী জেলে সরাসরি মাছ ধরার কাজে এবং প্রায় ১,৮৫,০০০ জন চিংড়ির পোনা আহরণের সাথে জড়িত। লবণ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, মাছ আহরণ, নৌকা তৈরি, মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণ শুটকি তৈরি ও বাজারজাতকরণ ইত্যাদি কাজ এ উপকূল অঞ্চলে বিদ্যমান।

বাংলাদেশের কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত। যার পরিধি কক্সবাজার নাজিরারটেক থেকে আরম্ভ করে টেকনাফ পর্যন্ত ১২০ কিলোমিটার বালুকাময় সৈকত এবং সমুদ্র সৈকতের প্রস্থ পৃথিবীর যে কোন সৈকতের চেয়ে বড়। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের এক পার্শ্বে ঘেরা ঝাউবনের সবুজ বেষ্টনী, উচ্চ পাহাড় ও অন্যদিকে সমুদ্রের বিশাল জলরাশি চোখে পড়ে যা জলোচ্ছ্বাস বা ঝড় থেকে শহরসহ প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করে। ১৯৯১ সালে একই রকম সবুজ বেষ্টনী ঝাউবন সৃষ্ট হয়েছিল, তবে ১৯৯১ সালে জলোচ্ছ্বাসে ঝাউবন নষ্ট হয়েছিল। বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হবারপর সরকার সমর্থক লুটেরা বাহিনী ঝাউবন কেটে সাবার করে "পরিচ্ছন্নতা" অভিযান স্বার্থক করে।

সেই সংগে সৈকতের যায়গা দখল করে হাউজিং স্টেট গড়ে দেদারছে জমি বিক্রি করে চলছে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে কিন্তু প্রশাসন নিশ্চুপ! এক সময়ের সবুজ শ্যামল সমুদ্র সৈকতে এখন শুধু ধু ধু বালু চর, যা বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন আকার ধারণ করে থাকে। বর্ষাকালে সমতল বালুর চর তৈরি হয়, সেখানে অনেক সময় পর্যটকদের ফুটবল খেলতে দেখা যায়। আবার শীতকালে উচ্চ বালুচর তৈরি হয়। তবে মোটকথা জোয়ার-ভাটার প্রভাবে সকাল-বিকাল বালুকাময় সৈকতের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। অমাবস্যা ও পূর্ণিমায় জোয়ারের সময় পানির উচ্চতা স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে ৪-৫ ফুট বেশি হয়ে থাকে; যার ফলে উপকূলের চিংড়ি খামারসহ অন্যান্য অর্থনীতি কর্মকান্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে।

এ-ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট বিভাগের গভীরভাবে দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। ইদানিং লাবণী পয়েন্টে নালা সৃষ্টি হয়। যার ফলে বর্ষাকালে পর্যটকদের নানা বিপত্তি ঘটে থাকে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ২০০৯ সালে প্রায় ২৫০ জন পর্যটকদের সমুদ্র থেকে ইয়াসিন লাইফ গার্ড উদ্ধার করে। পর্যটনকদের নিরাপত্তার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপের ব্যাপারে চিন্তা করা দরকার।

এক পরিসংখ্যানে জানা যায় যে, গত ছয় মাসে ১৩ লক্ষ পর্যটক কক্সাবাজার সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে আসে। উপকূল অঞ্চলে প্রতিনিয়ত জোয়ার-ভাটার প্রভাবে পানির লবণাক্ততা হ্রাস বা বৃদ্ধি হয়ে থাকে। মৌসুমের উপর ভিত্তি করে বিশেষ করে বর্ষাকালে মাটি ও পানির লবণাক্ততার পরিমাণ কমে আসে। আবার শীতকালে উপকূলীয় অঞ্চলে মাটি ও পানির লবণাক্ততা বেড়ে যায়। সমুদ্রে মাছ ধরার সময় জেলেরা যান্ত্রিক নৌকা দ্বারা গভীর সমুদ্রে ৭-৮ দিন সময় অতিবাহিত করে এবং মাছ ধরার মৌসুম ছাড়া জেলে সম্প্রদায় মাছ ধরা সরঞ্জাম, জাল, বোট ইত্যাদি মেরামতের কাজে ব্যস্ত থাকে।

উপকূলীয় অঞ্চলে মৌসুমে প্রচুর মাছ ধরার ফলে অধিকাংশ মাছ শুঁটকি তৈরীর কাজে ব্যবহার হয় এবং জেলে সম্প্রদায়ের সকল সদস্য-সদস্যাধৃত মাছ সংরক্ষণ থেকে শুরু করে শুঁটকি কাজে ব্যস্ত থাকে। বিপদকালীন সময় উপকূল অঞ্চলের নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেয় এবং ঐ সময় জেলে সম্প্রদায় শুকনা খাবার মজুদ রাখে এবং ব্যবহার করে। এক সময় উপকূলীয় মৎস্যজীবীরা শিক্ষার আলো থেকে দূরে ছিল। বর্তমানে সরকারী পর্যায়ে আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থা শিক্ষা কার্যক্রমে সহায়তা করছে। উপকূল অঞ্চলে ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিরাজমান, ফলে জনগণকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়।

উপকূলীয় অঞ্চলের অধিকাংশ জনগণের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে; জাল ও নৌকা তাদের নিত্যনৈমিত্তিক সঙ্গী। দুইটি কারণে উপকূলীয় মৎস্যজীবীরা জাতীয় উন্নয়নের মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন। প্রথমতঃ দূরবর্তী বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকায় বসবাস করতে হয়। দ্বিতীয়তঃ বছরের প্রায় সময় মাছ ধরার জন্য তাদেরকে সাগরে থাকতে হয়। এ ধরনের ভূ-প্রাকৃতিক ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতার জন্য জাতীয় উন্নয়নের সুফল লাভের সুযোগ হতে তারা বরাবরই বঞ্চিত থাকে।

তাই গ্রামীণ সমাজে তারা দরিদ্রতম ও অসহনীয় অবস্থার শিকারে পরিণত হয়। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত বিস্তীর্ণ এলাকায় চোখ পড়ে প্রাকৃতিক বাগদা পোনা সংগ্রহ করার উৎসব। বাগদা পোনাসহ অন্যান্য পোনা ঠেলা জালে সংগ্রহ করে পানি ভর্তি পাত্রে রাখে এবং পরবর্তী সময়ে বাগদা পোনা আলাদা করে পানি ভর্তি পাত্রে বাগদা পোনা রাখে এবং বাকী পোনাগুলি পানিসহ আরেকটি পাত্রে রাখে। সৈকতে পোনা সংগ্রহকারীদের বৎসরের ফেব্রুয়ারী মাস হতে শুরু করে আগস্ট/ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ কার্যক্রম দেখা যায়। বাগদা পোনা সংগ্রহকারীদের কিছুটা হলেও সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের সচেতনা সৃষ্টি হয়েছে।

বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় যে, বিভিন্ন সমিতি এ পর্যায় ২০ হাজার চিংড়ি আহরণকারীদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের ব্যাপারে। বাংলাদেশের অর্থ-সামাজিক অবস্থায় জেলেদের এ কার্যক্রম থেকে দূরে রাখা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে প্রায় ৫৭টি বাগদা হ্যাচারী রয়েছে। যার মাধ্যমে বাগদা পোনার চাহিদা পূরণ করার কথা হয়ে থাকে এবং করা সম্ভব। তাই গভীর সমুদ্রে বাগদা ব্রুড তৈরীর সুযোগ সৃষ্টি করাসহ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে প্রাকৃতিক বাগদা আহরণ মাত্রা যাতে সীমিত আকারে থাকে সেদিকে খেয়াল রাখা প্রয়োজন।

অযান্ত্রিক নৌকা দ্বারা জেলে সম্প্রদায় সমুদ্রের উপকূলের কাছাকাছি মাছ আহরণ কাজে ব্যস্ত হয় বর্ষাকাল শেষ হওয়ার পর পর। সমুদ্র শান্ত থাকার ফলে শীতকালে অসংখ্য নৌকা মাছ ধরার কাজে নিয়োজিত থাকে। যার উপর অসংখ্য জেলেদের জীবন-জীবিকা নির্ভরশীল। যান্ত্রিক নৌকা ও আর্থিক সচ্ছলতার অভাব থাকায় গভীর সমুদ্রে তাদের যাওয়া সম্ভবপর হয় না বিধায় সমুদ্রে কম গভীরতায় ও কম দূরত্বে মাছ ধরার কাজে ব্যস্ত থাকে। উপকূলের এ অঞ্চলে বড় ট্রলার সনাতনী ক্ষুদ্র জেলেদের সাথে মাছ ধরায় প্রতিযোগিতা না করতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখা খুব প্রয়োজন।

ছোট/বড় ট্রলারগুলি ৪০ মিটার নীচে আহরণ করার সুযোগ করে দেয়া হলে একদিকে গরীব জেলে সম্প্রদায় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং অন্যদিকে সমুদ্রের উপকূলের মৎস্য ভান্ডার দ্রুত ফুরিয়ে যাবে। তাই এ ব্যাপারে নীতি-নির্ধারকদের ভূমিকা খুবই দরকার। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে অসংখ্য অযান্ত্রিক বা যান্ত্রিক নৌকা মাছ আহরণকালে বা নৌকা মেরামতের সময় তৈল জাতীয় পদার্থ পানিতে পড়ে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্র, কক্সবাজার-এর এক গবেষণায় দেখা যায় কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে তৈল বা তৈল জাতীয় পদার্থ বর্ষাকাল ছাড়া বছরে অন্যান্য সময়ে স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশী (৮০-৯০ মিলিগ্রাম প্রতি লিটারে)। দূষণের মাত্রা লাবণী পয়েন্টে বেশী।

এতে মাছের প্রাকৃতিক উৎপাদন ব্যাহত হয় সহনীয় পর্যায়ে তৈল বা তৈল জাতীয় পদার্থ যাতে পানিতে নাপড়ে সেজন্য গণসচেতনতা করে তোলা অত্যন্ত প্রয়োজন। কাছিম ডিম ছাড়তে সমুদ্রের উপকূলের বালুর চর ব্যবহার করে থাকে। আমরা সবাই সচেতন হলে কাছিমের জীব-বৈচিত্র্য রক্ষা করা সম্ভব। জেলে সম্প্রদায়ের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও সৈকতের পরিবেশ উন্নয়ন মাথায় রেখে যে কোন পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত। (তথ্য সূত্রঃ বাংলাদেশ মতস উন্নয়ন কর্পোরেশন ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন এর গণসচেতন মুলক প্রচার পত্র) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.